ডাক্তারি পানি পড়া

আশরাফুল আলম
Published : 4 March 2017, 05:41 AM
Updated : 4 March 2017, 05:41 AM

রয়েল লন্ডন হসপিটালে আমার স্ত্রী যখন তীব্র প্রসব বেদনায় চিৎকার করছিলো আমি তখন পাশে দাঁড়িয়ে ছবি তুলছিলাম। সাথে আরো দুইজন মিডওয়াইফ বা ধাত্রি ছিল । ওরাও হাসি ঠাট্টা করছিলো। একজন নারীর প্রসব বেদনা কতটা প্রখর তা নিজে না দেখলে বুঝতাম না। এই যন্ত্রনা সহ্য করার মতো না। আমার স্ত্রী বারবার চিৎকার করে বলছিলো ইনজেকশন বা পেইন কিলার দিতে। কিন্তু আমাদের দুজনের কথা সেখানে ছিল অচল । স্বাভাবিক এই যন্ত্রনা ভোগের পর একজন মা তার সন্তান এর জন্ম দেয় । এটাই প্রাকিতিক নিয়ম । এই সময় সব স্ত্রী তাদের স্বামীদের অকথ্য ভাষায় গালি গালাজ করে এটাও খুবই স্বাভাবিক একটা ব্যাপার । এই অতি স্বাভাবিক নিয়মটা আমাদের দেশের ক্ষেত্রে খুবই অস্বাভাবিক । কয়েক ঘন্টার প্রসব বেদনা যেতে না যেতেই সি-সেকশন বা সিজার করে সন্তান বের করে আনা হয় । দেশের কতজন চিকিৎসকে এই সিজার বা অপারেশন কতটা অস্বাভাবিক তা কি রোগীর কাছে ব্যাখ্যা করেন? মনে হয় না খুব বেশি বরং এই পদ্ধবতিতে প্রসবকে রীতিমতো সহজলভ্য সামগ্রী করে দিয়েছেন আমাদের চিকিৎসাবিদরা ।

আমার মেয়ের বয়স যখন ৪ মাস তখন আমরা দেশে চলে আসি। এরপর দেশের ডাক্তারের কাছেই সব রকম চিকিৎসা পরামর্শ নেয়া হতো । খুবই আশ্চর্জজনক ভাবে আমার মেয়ের নাড়ি শুকাচ্ছিলো না । স্বাভাবিক ভাবে যেটা শুকিয়ে ঝরে পরে যাবার কথা তা না শুকিয়ে বেশ বড় আকার ধারণ করে । এবং আমরাও বেশ স্বাভাবিক ভাবে শহরের সবচেয়ে বড় শিশু বিশেষজ্ঞ ও মেডিকেল কলেজ এর বিভাগীয় প্রধান এর কাছে মেয়েকে নিয়ে গেলাম। দীর্ঘ কয়েক সপ্তাহ ধরে অপেক্ষার পর এই ডাক্তার  অতি দ্রুত নাড়ি কেটে ফেলার তাগিদ দিলেন। বললেন, নাড়ি কাটা ঠিক হয় নাই তাই এমন হচ্ছে । একটা অপারেশন এর মাধ্যমে নাড়ির বাড়তি অংশ কেটে ফেলে দিতে হবে । আমি ঠিক বুঝতে পারছিলাম না উনি কী বলছিলেন । কারণ আমার মেয়ের নাড়ি আমি নিজেই কেটেছি । আর বাড়তি বা অল্প এই সব এমনিতেই তো শুকিয়ে যাবার কথা । যাই হোক, মা-মেয়ে-দাদি-নানী সবার মাঝে কান্নার রোল । মাত্র ছয় মাসের একটা বাচ্চাকে অপারেশন। ভাবাই যায় না ।

মেয়ের জন্মের মাত্র ছয় মাসের মধ্যে আমি কন্যা দায়গ্রস্থ পিতায় পরিণত হলাম। কী করবো বুঝতে না পারলেও একটা চরম কুসংস্কার করে বসলাম। মেয়ের নাড়ির উপর একটা ধাতব পয়সা দিয়ে সব সময় চেপে রাখতাম। মাস খানেকের মধ্যে আমার মেয়ে সুস্থ হয়ে উঠল। এখন ওর বয়স ছয় বছর । আমার কুসংস্কার করার পেছনে অতীব পার্থিব যে কারণ তা হচ্ছে আমি মনে প্রাণে স্বাভাবিক আচরণ বিশ্বাস করি । যদি রয়েল লন্ডন হসপিটালে বেশির ভাগ ডেলিভারি খুব স্বাভাবিক নিয়মে হতে পারে ধাত্রীর হাতে, তবে মাঝে মধ্যে মা-খালার টোটকা ডাক্তারি মেনে নেয়া যেতেই পারে ।

এই ধরণের নানান ঘটনায় আমি আর আমার স্ত্রী সিদ্ধান্ত নেই আমরা খুব সহজে ডাক্তারের দেয়া ওষুধ হড়হড় করে খেয়ে ফেলবো না । আমরা যে জিনিসটি করি এখনো তা হলো একই সাথে কয়েকটা ডাক্তারের কাছে পরামর্শের জন্য যাই যে কোন ব্যাপারে । এরপর সব ডাক্তারের পরামর্শ গুলো টালি করে গুগল করে নিজেরাই সিদ্ধান্ত নেই। এক্ষেত্রে আমাদের সবসময় যে খুব বেশি রোগ  লেগেছিল তা কিন্তু না, বলতে পারেন আমরা প্রায় সুস্থ জীবন যাপন করছি ।

একজন ডাক্তার তার চেম্বারে সর্বোচ্চ রোগী দেখেন ২০ মিনিট আর এই ২০ মিনিটে রোগীর ২০ বছরের সমস্যা ডায়াগনসিস প্রায় অসম্ভব। প্রতিটা মানুষ আলাদা। আলাদা তাদের শারীরিক গঠন। আপনার শরীরে যে ওষুধ কাজ করবে আমার নাও করতে পারে । প্রচন্ড নেশা করে এমন একজন মানুষকে এনেস্থেসিয়া দিতে আমার আপনার চেয়ে একটু বেশি মাত্রার ইনজেকশন লাগতে পারে । নাহলে হয়তো অপারেশন এর মাঝখানে উনি উঠে বসে যেতে পারেন । কিন্তু ইমার্জেন্সিতে কতজন ডাক্তার রোগীর এই রকম ইতিহাস জানার চেষ্টা করেন আমার জানা নেই । আর অপারেশন থিয়েটারে কত জন রোগী মাঝপথে উঠে বসে তাও একমাত্র ডাক্তাররাই বলতে পারেন ।

আমাদের দেশের রোগীদের মেডিকেল হিস্টোরি বলে কিছু নেই । যখন যে ডাক্তারের কাছে যাবেন উনি আবার প্রথম থেকে সব শুরু করবেন । একত্রে আপনার বয়স যত বেশি হবে আপনার জন্য তত সমস্যা হবে নিজের হিস্টোরি বলতে । আর ঠিক কতজন ডাক্তার রোগীর মেডিকেল হিস্টোরি জানতে চান তাও ভাববার ব্যাপার । দেশ ডিজিটালি এতো এগিয়ে যাচ্ছে কিন্তু আমাদের সবার জন্য সামান্য একটা মেডিকেল হিস্টোরি বানানোর ক্ষমতা কারো নেই । অথচ এটা খুবই সামান্য একটা ব্যাপার । চাইলে আমি আপনি নিজে নিজেদের মেডিকেল হিস্টোরি সবসময় আপডেট করে রাখতে পারি । আপনার হাতের ছোট মোবাইল এর একটা আপসেই এইসব জমা রাখা যায়। ডাক্তার দেখতে না চাইলেও দেখান। কারণ অসুখ আপনার আর আপনার ডাক্তারের পক্ষে ২০ মিনিটে আপনাকে বোঝা আসলেই কঠিন ব্যাপার।

আমার বৃদ্ধ পিতাকে নিয়ে আমরা নগরীর প্রখ্যাত এক ক্লিনিকে যাই। উনি যে কদিন ওখানে ছিলেন প্রায় প্রতিদিন রাতেই রোগীর স্বজনদের সাথে ক্লিনিক কর্তৃপক্ষের হাতাহাতি হতো । দুচার দিন পর আমি অনেকটা যুদ্ধ করে উনাকে আইসিইউ থেকে বাসায় নিয়ে আসি। এর জন্য আমাকে পরিবারের পক্ষ থেকে রীতিমতো দোষারোপ করা হচ্ছিলো। কেউ বলছিলো টাকা বাঁচাবার জন্য কেউ বলছিলো সময় বাঁচাবার জন্য আমি এ কাজ করেছি। কিন্তু আমি আমার বাবাকে বাঁচাবার জন্য সেদিন ওই ক্লিনিক থেকে বাসায় নিয়ে এসেছিলাম । বাবার রুমটাকে ক্লিনিকের মতো করে সব কিছু দিয়ে সাজিয়ে দিয়েছিলাম । অক্সিজেন, ক্লিনিক বেডসহ প্রায় সব কিছু । আর ডাক্তার ছিলাম আমি আর আমার বড় ভাই। দুজনে মিলে পালা করে বাবার পাশে বসে সেবা করতাম । দীর্ঘ প্রায় এক বছর শয্যাশায়ী থাকার পর বাবা আমার কোলে মারা যান।

এটা কি খুব বেশি অস্বাভাবিক মনে হচ্ছে আপনার কাছে? অথচ একবার ভাবুন এমনটাই কিন্তু হবার কথা ছিল। একজন ডাক্তার বা চিকিৎসক সর্বোচ্চ কী করতে পারেন আপনার জন্য? তাহলে এতটা আশা কেন করেন একজন চিকিৎসকের কাছ থেকে? আমার আপনার চাহিদাই উনাদের আজকে এই রকম ব্যবসায়িক প্রেসক্রিপশন লিখতে বাধ্য করছে ।

আমাদের মাঝে অনেকে আছেন যারা পীর বা হুজুরের ফু দেয়া পানি খান । একবার ভাবুন আপনি একগ্লাস পানি নিয়ে গেলেন ডাক্তারের চেম্বারে আর ডাক্তার সাহেবকে বললেন ফুঁ দিয়ে দিতে। উনি কী করবেন? ভাবতেই যেন কেমন লাগছে । কিন্তু আমি বাজি ধরে বলতে পারি এই মুহূর্তে যদি আপনি এক গ্লাস পানি নিয়ে কোন ডাক্তারের চেম্বারে যান উনি নির্ঘাত একটা লম্বা ফুঁ দিয়ে দিবেন । হয়তো আপনি এই ফুঁ -তে উপকার পেতেও পারেন। সরকার ওষুধ ব্যবসায়ী আর চিকৎসদের এই রকম অদ্ভূত আচরণকে কি কুসংস্কার বলা যায় না? সরকার ভাবছে বড় হরফে ওষুধের নাম লিখলে রোগীর সুবিধা কিন্তু আমি বা আপনি ওষুধের নাম দিয়ে কি করবো? পাড়ার মোড়ের ওষুধের দোকানদার পড়তে পারলেই তো হলো। এই অবস্থা চলতে থাকলে খুব শীগ্রই হয়তো ওষুধ প্রস্তুতকারকরা ওষুধের নাম আই ফোন স্যামসাং এই ধরণের রাখবেন। কারণ চিকিৎসকের পক্ষে জেনেরিক নাম ছাড়া ওষুধের প্রকৃত নাম মনে রাখা প্রায় অসম্ভব।

যে চিকিৎসকদের উপর সাধারণ মানুষের এমনিতেই বিশ্বাস কম সেখানে সরকারের নতুন এই নিয়ম আমাদের মতো সাধারণ মানুষের কী কাজে আসবে আমার জানা নেই । তাই বলছি আসুন সবাই মিলে চিকিৎসকদের কাছে পানি ফুঁ নিতে যাই । অন্তত যতদিন না তারা সঠিক ভাবে ওষুধের নাম মুখস্ত করতে না পারেন । কারণ এই মুহূর্তে একজন রোগী হিসেবে আপনি মারাত্মক ঝুঁকির মাঝে বসবাস করছেন।