ডাক টিকিটের মালিকানা ও আমাদের স্বাধীনতা দিবস

আশরাফুল আলম
Published : 13 March 2017, 01:09 AM
Updated : 13 March 2017, 01:09 AM

বাংলাদেশের প্রথম ডাক টিকিট বা পোস্টাল স্টাম্পে ছিল চরম এক ভুল। ১৯৭১ সালের জুলাই মাসে প্রিন্ট করা এই স্টাম্পে টাকার পরিবর্তে ছিল রুপি আর জাতীয় পতাকাও ছিল ভুল! স্টাম্পটি ডিজাইন করেন বিমান মল্লিক আর প্রিন্ট হয় ইংল্যান্ড এর এক প্রিন্টিং হাউস থেকে। অনেকটা বর্তমানে পাঠ্য পুস্তকের ভুলের মতো একটা ব্যাপার। কিন্তু প্রশ্নটা হচ্ছে ৭১ এর জুলাই মাসে যখন মুক্তিযুদ্ধ প্রায় মাঝপথে ঠিক কি কারণে এই স্টাম্পটি প্রিন্ট করতে হলো? আর কেইবা প্রিন্ট করলো? তবে অনেকটা সাথে সাথেই ভুলে ভরা এই স্টাম্পটি বাতিল করে তৎকালীন বাংলাদেশ। পরে রুপির পরিবর্তে টাকা আর জাতীয় পতাকা ঠিক করে আবার প্রিন্ট করা হয় বাংলাদেশের প্রথম ডাক টিকিট ১৯৭২ এর জানুয়ারিতে। খুব সম্ভবত এটাই ছিল জাতীয় পতাকা আর জাতীয়তাবাদের প্রথম সংশোধন। খুবই সামান্য ব্যাপার মনে হলেও একবার ভাবুন। মুক্তিযুদ্ধের ঠিক মাঝপথে যখন বাংলাদেশে রক্তের বন্যা বয়ে যাচ্ছে ঠিক ওই সময় এই ডাক টিকিট এর ডিজাইন আর ইংল্যান্ড থেকে প্রিন্ট এর প্রয়োজনীয়তা কি হতে পারে?

তবে এর সাথে যদি আর একটি প্রশ্ন জুড়ে দেয়া যায় তাহলে প্রশ্নটা আপনাকে কঠিন এক বাস্তবতায় নিয়ে যাবে। কেন আমরা স্বাধীনতা দিবস আর বিজয় দিবস আলাদাভাবে পালন করি? সাধারণভাবে একটি দেশ যখন অন্য দেশের থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতা লাভ করে তখন ওই বিশেষ দিনটি স্বাধীনতা দিবস বা ইংরেজিতে ইনডিপেনডেন্স ডে হিসাবে পালন করা হয়। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ২৬শে মার্চ ইনডিপেনডেন্স ডে বা স্বাধীনতা দিবস আর ১৬ই ডিসেম্বর বিজয় দিবস। তাত্ত্বিক ভাবে এটা মেনে নেয়া যেতেই পারে। কারণ আমাদের জাতীয় দিবস আমরা যেভাবে খুশি পালন করতে পারি। কিন্তু মার্চের ২৬ তারিখ আসলে কি হয়েছিল তা আমি জানতে চাইতেই পারি আর এর সাথে কেন ২৬শে মার্চকে স্বাধীনতা দিবস হিসাবে পালন করছি তাও।

ভারত আর পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবস একই দিনে হবার কথা কারণ এই দুটি দেশ একই দিন ব্রিটিশদের কাছ থেকে অনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতা লাভ করে। পাকিস্তান স্বাধীনতার প্রথম বর্ষপূর্তি ১৫ই অগাস্ট পালন করলেও ঠিক পরের বছর ১৫ তারিখের পরিবর্তে ১৪ তারিখ পালন করে। পাকিস্তানের এই ধরনের পরিবর্তন সঙ্গত মনে হতেই পারে। ভারতের সাথে স্বাধীনতা ভাগাভাগি করলে সারাজীবন টানা হেঁচড়া কিভাবে হবে? সুতারং পাকিস্তান অনেকটা জোর করেই ১৫ই অগাস্ট এর পরিবর্তে ১৪ই আগস্টকে নিজেদের স্বাধীনতা দিবস হিসাবে দেখতে শুরু করে।

স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম স্বাধীনতা দিবস পালন করা হয় ১৯৭২ সালের ২৬ শে মার্চ। এবং বেশ ঘটা করেই পালন করা হয়। তৎকালীন বাংলাদেশ সরকার এই দিবসটিকে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে তুলে ধরে। ১৬ই ডিসেম্বর আমাদের জন্য বিজয় দিবস। কারণ এই দিনটিতে আনুষ্ঠানিকভাবে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী আমাদের মুক্তিবাহিনী আর ভারতীয় বাহিনীর কাছে যুগ্মভাবে পরাজয় স্বীকার করে। প্রত্যেকটা দেশেরই নিজস্ব ব্র্যান্ড ভ্যালু থাকে। যখন নিজেদের ব্র্যান্ড ভ্যালু অন্যের সাথে শেয়ার করতে হয় তখন স্বকীয়তা নিয়ে প্রশ্ন হতেই পারে। এটা হয়তো আমার একান্ত নিজস্ব কল্পনা প্রসূত ধারণা। কিন্তু ১৯৭১ থেকে ৭২ এর মাস গুলোতে বাংলাদেশ এর গতিবিধি যদি আপনি লক্ষ্য করেন তবে দেখবেন নিজস্ব স্বকীয়তায় সরে আসার এক প্রবণতা। প্রচন্ড জাতীয়তাবাদ কাজ করেছে তখন।

তৎকালীন মুজিব সরকার স্পষ্টত যে স্পর্ধা দেখিয়েছে তা অসাধারণ। একদিকে পাকিস্তানের কাছ থেকে স্বাধীনতা আর অন্য দিকে ভারতের আগ্রাসন থেকে নিজেদের রক্ষা। একবার ভাবুন বিমান মল্লিক নামের ভদ্রলোক কার নির্দেশে ডাক টিকিটে রুপি আর ভুল পতাকা ডিজাইন করে? আর কেই বা ইংল্যান্ড থেকে প্রিন্ট করার অনুমতি দেন? যদি মুজিব নগর থেকে এই নির্দেশ যেত তবে ডাক টিকিটে ভুল থাকার কথা ছিল না। আর স্বাধীন বাংলাদেশের নাম আর পতাকা দিয়ে করা এই ডাক টিকিট প্রিন্ট হয় ৭১ এর জুলাই মাসে। সুতারং বুঝতেই পারছেন একাত্তরের ওই দিনগুলিতে অনেক কিছুই অনেক আগে থেকেই ঠিক করা ছিল। যেহেতু বাংলাদেশের পতাকা আর বাংলাদেশ নামের বানান আগে থেকেই ঠিক করা ছিল এবং তৎকালীন মুজিব নগর সরকার এই বিষয় গুলোতে এক বিন্দুও ছাড় দেন নাই সেহেতু বলা যেতেই পারে বাংলাদেশ স্বাধীনতা আকস্মিক কোনো ব্যাপার না। সুচিন্তিত আর অত্যন্ত জাতীয়তাবাদ মাথায় নিয়ে তখনকার সরকার এই জিনিসগুলো সামলে নিয়েছে। তা না হলে হয়তো আজকে আমরাও টাকার পরিবর্তে রুপি বলতাম আর পতাকার সবুজ রং টা অনেকটা ফিকে থাকতো।

যদিও আমাদের দালিলিক স্বাধীনতা দিবস ১৬ ই ডিসেম্বর, আমরা এর অনেক আগে থেকেই নিজদের স্বাধীনতা স্বীকার করে নিয়েছিলাম। সুপরিকল্পিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বা সামান্য ডাকটিকিটের ভুলের ফলে তাৎক্ষণিক ওই ডাকটিকিট বাতিল এই সব কিছুই বলে দেয় আমরা অনেক আগে থেকেই জানতাম বাংলাদেশ স্বাধীন এক রাষ্ট্র। নাহলে এতটা কনফিডেন্স কিভাবে পায় তখনকার মুজিব নগর?

আমার প্রশ্নটা ছিল কেন বাংলাদেশ বছরের দুইটা দিনে প্রায় একই স্বাধীনতা দিবস পালন করে? আমি আমার উত্তর খুঁজে পেয়েছি? এই প্রজন্ম বা ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যখন একই প্রশ্ন করবে তখন হয়তো এই উত্তর টুকুই যথার্থ হবে? এর জন্য ইতিহাসের বই পড়ার প্রয়োজন নেই। সামান্য গুগল আর উকিপিডিয়ার পাতা উল্টালেই সব পরিষ্কার হয়ে যাবে। ৭১ থেকে ২০১৭, এতো বছর পর এসেও ঠিক একই জাতীয়তাবাদের জন্য লড়তে হচ্ছে বর্তমান সরকারকে। তখন লড়েছিলেন বঙ্গবন্ধু আর এখন তার কন্যা। এই দৃশ্যগুলো এতো সহজ সরল নয়। সাধারণভাবে আমার আপনার চোখে ধরা নাও পড়তে পারে। তবে যুদ্ধ এখনো চলছে নিঃসন্দেহে। নাহলে হয়তো নেপাল বা ভুটানের মতো আমাদের দেশের ডাকটিকিট রুপিতে কেনা যেত। এই অদ্ভুত লড়াই প্রতিনিত চলছে। আমাদের সবচেয়ে বড় শক্তি আমরা নিজেরা। যতদিন আমরা সবাই ঠিক একইভাবে ভাবতে পারবো ততদিন কেও আমাদের কোনো কিছু বদলে দিতে পারবে না। আমাদের নিজেদের ওনারশিপ থাকবে প্রতিটা কাজে। এক হবার সুবিধা এটাই।

সবাইকে অগ্রিম স্বাধীনতা দিবসের শুভেচ্ছা।