পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি মানব মূর্তি বা হিউম্যান স্ক্যাপচার খুব সম্ভবত ফ্রান্সের প্যারিসে। আর এর বেশির ভাগই এতটা নন্দনীয়ভাবে সাজানো যে সপরিবারে উপভোগ অনেকটাই বিব্রতকর। আপনি যে সমাজের মানুষেই হন না কেন এসব মূর্তির সামনে খুব বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলে হয়তো প্রশ্নের সম্মুখীন হতে পারেন। হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখার তো প্রশ্নই উঠে না। একবার লন্ডনে একটা মূর্তির সামনে ছবি তোলার পর দেখি মূর্তির অবস্থা বেশ ভয়াবহ। আমার পেছনে থাকায় আমি খেয়াল করতে পারিনি। যাই হোক, আমার আপনার তাকিয়ে থাকতে সমস্যা হলেও কেউ না কেউ এইসব মূর্তি পরম আদরে নিজের হাত দিয়েই বানিয়েছেন। ভাবুন একবার।
অন্য সবার মতো আমি দেশে থাকার সময় ছোট খাটো শর্টস বা হাফ প্যান্ট পরে ঘুরতাম। ব্যাপারটা যতটা না প্রয়োজনীয় ছিল তার থেকে বেশি ছিল দেখানোর। আর ভাবতাম একদিন লন্ডন আমেরিকায় গেলে এইরকম শর্টস পরে ঘুরবো। ছেড়া জিন্স পড়বো। প্রথম আশাটি আমার পূরণ হলেও লন্ডন বা আমেরিকায় নিয়মিত শর্টস পরে রাস্তায় হাঁটার সৌভাগ্য হয়নি। এর কারণ হয়তো বেশির ভাগ সময়ের ঠান্ডা অথবা আমি আমার রোমশ পা দুটি এই সমাজে দেখতে চাই না তাই। আমার কাছে দ্বিতীয় কারণটি যৌক্তিক মনে হয় অনেক। কারণ আমি কাকে কি দেখাবো? যেখানে নিজেই হা হয়ে বেশির ভাগ সময় তাকিয়ে থাকি। আমার এই রোমশ পা দুটি দেখলে হয়তো এখানকার বাচ্চারা ভয় পেয়ে যেতে পারে। কয়েকবার এই অনাকাঙ্খিত রোমগুলো তুলে ফেলার চিন্তাও করেছিলাম। অগত্যা আমি লুঙ্গি বা প্যান্ট পরেই নিজের পা দুটো ঢাকি। তবে এ নিয়ে আমার আক্ষেপ নেই। মাইকেল মধুসূদন দত্তও এই রকম চেয়েছিলেন আর উনিও উনার ভুল বুঝতে পেরেছেন শেষ বয়সে। আমি তো উনার অনেক আগেই বুঝতে পারছি!
ফিরে আসা যাক মূর্তি রহস্যে। নানান দেশের নানান রকমের মূর্তি। যেমন ধরুন রোম মিলান বা প্যারিসের অনেক মানব মূর্তি পুরুষের। পুরুষের দেহের নানান অঙ্গভঙ্গী অথবা মাংস পেশী আর ভারতে গেলে দেখতে পাবেন নারী মূর্তির অবয়ব। ঠিক কি কারণে রোমান বা পারস্যে পুরুষদের দেহ মূর্তি বানানোর আদর্শ হলো জানা নেই। তবে ভারতের আগ্রহটা সবার জানা। যদি তাই হয় তবে বুঝতে একটা মূর্তি একটা সমাজের কিছু আগ্রহের ছবি তুলে ধরে। এইসব পরিচিত মূর্তিগুলো দেখলেই বুঝতে পারা যায়। ধরুন ভারতীয় একটা মূর্তি আর গ্রিক একটা মূর্তির পার্থক্য কচি কাচার ছেলে মেয়েরাও বলে দিতে পারবে। এর জন্য যে এদের মূর্তি বিষয়ক শিক্ষায় শিক্ষিত করতে হয়েছে তা কিন্তু নয়। চারপাশ থেকে দেখে ঠিক বুঝে নিতে পারে কোনটা ভারতীয় নারীর অবয়ব অথবা কোনটা গ্রিক নারীর। এখানেই মূর্তি শিল্পীর স্বার্থকতা।
তবে আমাদের সুপ্রিম কোর্টের সামনের মূর্তি গ্রিক না দেশি বোঝার উপায় নেই। আর কোন শিল্পী তার পরম মমতাময়ী হাতের ছোয়ায় এই অদ্ভুতুড়ে মূর্তির অবয়ব বানিয়েছেন আমার জানা নেই। আপনি কোনো কচি কাঁচা এক বাচ্চাকে এর সামনে নিলে নির্ঘাত প্রথমে ভয় পাবে। কারণ চোখ বাধা শাড়ি পড়া এই নারী কিভাবে গ্রিক হয় আমার জানা নেই। নগ্ন পা খোলা চুল চোখ বাধা এক নারী আমাদের দেশে ভীতিকর পরিবেশের ইঙ্গিত দেয়। আর অবাক ভাবে এই মূর্তিটির শরীরের বিভিন্ন অংশের আংশিক অনুপাত প্রচন্ড রকমের বেখাপ্পা। শিল্প একটা নৈন্দনিক ব্যাপার। যেটা পরিবেশের উপর নির্ভরশীল। বাংলা সিনেমার পোস্টার যেমন আপনার ঘরের ড্রইং রুমে আপনি বাধাই করে রাখবেন না ঠিক তেমনি একটি বিষয় এটি। হঠাৎ করে বাঙালি এক নারীর চোখ বেঁধে হাতে দাঁড়িপাল্লা ঝুলিয়ে দিলেই গ্রিক মূর্তি হয়ে গেলো? এই মূর্তি শিল্পী ঠিক কি বোঝাতে চেয়েছেন আমি জানি না। উনার অবশ্যই লুকায়িত কিছু বিষয় আছে এই মূর্তিতে। যে দেশে এই ধরনের চোখ বাধা নারীর মূর্তি বলতে নির্যাতিতা বোঝায় সেখানে এই মূর্তি কিভাবে ন্যায়পালের ভূমিকা পালন করবে?
ঠিক যে কারণে আমি আমার রোমশ পা দেখতে কুন্ঠাবোধ করি হয়তো ঠিক সেই কারণে আমাদের সর্বোচ্চ আদালত আসল গ্রিক নারীর মূর্তি রাখতে সাহস করেননি। কিন্তু পরিবেশের কথা ভাবতে গিয়ে উনারা যা করেছেন তার রুচি নিয়ে প্রশ্ন করা যেতেই পারে। পরিবেশন একটা বিশাল বড় ব্যাপার। নিতান্তই পরিবেশনের কারণে এই মূর্তি নিয়ে এতো বিতর্ক। যে কোনো জিনিস সুন্দরভাবে উপস্থাপন করলে তার পক্ষে জনমত থাকবেই। যত বাজে জিনিসই হোক না কেন।
ব্যাপারটা প্রধানমন্ত্রী বা তেতুল হুজুরের নয়, ব্যাপারটা রুচির। হয় সত্যিকারের গ্রিক নারীর মূর্তি রাখুন নইলে অপু বিশ্বাস এর মতো এমন এক নারীর মূর্তি রাখুন যাকে দেখে সবাই ন্যায় বিচার চাইবে। দেখবেন প্রধানমন্ত্রী বা তেতুল হুজুর কেউই কিছু বলবে না। কারণ ব্যাপারটা সঠিক সময়ে সঠিক পরিবেশে ঠিক জিনিসটি পরিবেশনের।