তবে কি বাঙালির পরিচিতি হবে বর্বর জাতি?

সোহাগ অতনু
Published : 3 June 2017, 06:56 PM
Updated : 3 June 2017, 06:56 PM

যুবলীগের নেতার মৃত্যুর ঘটনায় রাঙামাটির লংগদু উপজেলায় পাহাড়িদের বাড়িঘরে মিছিল নিয়ে হামলা চালানো হয়েছে, কয়েকশ' বাড়িঘর পুড়ে গেছে এতে। আগের দিন রাতেই পাহাড়িরা সম্ভাব্য গোলযোগের শঙ্কায় সরে পড়ায় কোনো হতাহতের ঘটনা ঘটেনি।

১৯৮৯ সালে এই তিনটিলা এলাকায় তৎকালীন লংগদু উপজেলা চেয়ারম্যান আব্দুর রশীদকে গুলি করে হত্যার ঘটনার পর সেখানে পাহাড়িদের বাড়িঘরে আগুন দেওয়া হয়। এতে বহু পাহাড়ি উদ্বাস্তু হয়। মধুপূর্ণিমার আগের রাতে রামুর বৌদ্ধপল্লী এবং বৌদ্ধ মন্দিরে উখিয়া, টেকনাফ ও পটিয়াতে হামলা হয়েছিল ২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর রাতে। ন'টা থেকে সেখানে রাতভর হাজার হাজার লোকসমাগম, বিক্ষোভ, তারপর বৌদ্ধ বিহার-মন্দির-ঘরবাড়ি আগুনে পুড়িয়ে ছাই করার ধ্বংসযজ্ঞ চলে।

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর উপজেলায় মন্দির ও হিন্দুদের বাড়িঘরে হামলা-ভাঙচুরের ঘটনাসহ এমন অসংখ্য ঘটনার উল্লেখ করা যায়। যা অন্তর্জালে খোঁজ করলেই পাওয়া যাবে। সম্প্রতি ভাস্কর্য নিয়ে হেফাজতের সঙ্গে শ্রদ্ধেয়া সুলতানা কামালের একটি তর্ককে কেন্দ্র করে, সাধারণরে যে প্রতিক্রিয়া সামাজিক মাধ্যমে দেখছি  তা ভয় জাগানিয়া।  সেখানে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামাত বা হেফাজত বলে কোন পার্থক্য চোখে পড়েনি। সব দলের মানুষ একই সুরে কথা বলছে। তাই কারা মুক্তি যুদ্ধের পক্ষের শক্তি বা আওয়ামী লীগের তৃণমূল পর্যায়ের নেতা কর্মীরা মুক্তি যুদ্ধের চেতনা কাকে বলে তা কতটা বোঝে?

কিন্তু এই বাংলাদেশ তো এমন ছিল না! বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাস তো একথা বলে না! যদি একটু পিছন ফিরে তাকাই, ৭৫০ খ্রিস্টাব্দ থেকে দীর্ঘ সাড়ে চার শো বছর ধরে বৌদ্ধ পালবংশের শাসন ছিল বাঙলায়। তখন নানা ধর্ম-বর্ণের মানুষের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ছিল। ১২০৪ খ্রিস্টাব্দে  বাংলায় মুসলিম শাসক রাজত্ব শুরু করে। মুসলিমদের এই উপমহাদেশে আগমন কীভাবে আর কীভাবে ক্ষমতা দখল করেছে সে ইতিহাস সবার জানা। তবে ৭৫০ থেকে ১৭৫৭ পর্যন্ত সাড়ে পাঁচশো বছর মুসলিমরা বাঙলা শাসন করলেও এমন বর্বর হয়ে ওঠেনি তারা কখনো। তখনও বাঙালি মোটের ওপরে বাঙালি ছিল। তখনো সকল ধর্মের মানুষের শান্তি পূর্ণ সহাবস্থান ছিল।

ব্রিটিশ যাবার সময় থেকে বাড়তে থাকে সাম্প্রদায়িক সংঘাত। যা মোটেও ধর্মীয় কারণে নয়। নিতান্তই রাজনৈতিক কারণে। পুঁজিবাদী অর্থনীতি টিকিয়ে রাখতে সুপরিকল্পিত ভাবেই একদল মানুষ এই কাজগুলো করে আসছে। নির্দিষ্ট কোন ধর্ম বা রাজনৈতিক দলের দিকে আঙুল তোলা ঠিক হবে না। কারণ সাধারণ জনতা সব সময়ই হুজুগে মাতাল থাকে। একটা কোন প্রোপাগান্ডা ছড়িয়ে দিতে পারলেই হলো। তাই পুঁজিবাদী গোষ্ঠি যখন যেমন করে খেললে সুবিধা হবে তেমন করেই খেলছে অন্তরালে থেকে। আর নষ্ট রাজনীতিকেরা পুঁজিবাদের পাহারাদার হিসেবে তাদের উদ্দেশ্য সাধনে কাজ করেছে আয়েশি জীবনের লালসায়। আর তার জন্য ব্যবহার করে আসছে নিরীহ, অশিক্ষিত, আবেগ প্রবণ সাধারণ মানুষকে এবং তাদের অন্ধ বিশ্বাসকে।

দেশ বিভাগের পর থেকে এ পর্যন্ত কোন সংঘর্ষই ধর্মের জন্য হয়নি কেবল ধর্মকে ব্যবহার করে ধর্মের নাম ভাঙিয়ে করা হয়েছে। সেটাও রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য। প্রায় অর্ধশতক ধরে একটা গোষ্ঠি ধর্মকে ভাঙিয়ে রাজনীতি করে আসছে। এ দেশে টাকা আর ক্ষমতার বিরাট জাল বিস্তার করে ফেলেছে তারা। ধর্মীয় সম্প্রীতির দেশকে রূপান্তরিত করেছে একটি সাম্প্রদায়িক দেশে। যখন তাদের সেই ভীত নড়ে উঠেছে তখনই তারা মরিয়া হয়ে উঠেছে। আর সাধারণ আবেগ প্রবণ বাঙালিকে উষ্কে দিচ্ছে নানা ভাবে। নষ্ট রাজনীতিকেরা তাদের লালসা মেটাতে ওদের দালালি করছে তলে তলে। আওয়ামী লীগ, বিএনপি দূরের কথা বামপন্থিদের মধ্যেও এমন নেতার সংখ্যা নেহায়েত কম না। তা হলে লড়াই করার লোক কোথায়? তবে কি জনাব আবুল বারাকাতের কথা সত্যি হবে? আগামি ৩০ বছর বা তারও আগে অন্য ধর্মের মানুষ নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে এদেশ থেকে?