ছিটমহলের কষ্টগাথা থেকে আলোয় উদ্ভাসিত জীবন

আতাউর রহমান
Published : 31 July 2015, 04:44 PM
Updated : 31 July 2015, 04:44 PM

২০১৪ সালের ৭ ডিসেম্বর থেকে চারদিন ধরে লালমনিরহাট এবং পঞ্চগড়ে বেশ কয়েকটি ভারতীয় ছিটমহল ঘুরে দেখেছিলাম। কথা হয়েছে ছিটমহলের শিশু, নারী থেকে শুরু করে নানা বয়স ও পেশার মানুষদের সাথে। মনে হয়েছে, মিথ্যায় ভাসছে তাদের জীবন। বাংলাদেশে আলো-বাতাসে বড় হয়ে মানচিত্রের একটু সীমানার জন্য তারা পরিচয় দিতে পারছিলেন না এদেশের নাগরিক হিসেবে। সে আধাঁর কেটে গেল আজ ১ আগষ্ট, ২০১৫ সাল থেকে।

সেই সময়কার কষ্টগাথা….। লালমনিরহাটের পাটগ্রামের আশারপাড়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ে শিশু আলমিনা। বাবা রফিকুল ইসলাম পাটগ্রাম উপজেলার বাঁশাকাটা বড়খানকী ছিটমহলের বাসিন্দা। আলমিনার জন্মও ভারতের ওই ছিটমহলে। তবে শিশুটিকে বাংলাদেশের স্কুলে ভর্তি করা হয়েছে মিথ্যা পরিচয় দিয়ে। একই স্কুলের পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্রী চম্পার বেলায়ও ঘটেছে একই ঘটনা। ছিটমহলের এ শিশুরা জন্মের পর থেকেই মিথ্যা তথ্যের উপর বড় হতে বাধ্য হয়েছিল এতোদিন। নাগরিক অধিকার না থাকায় চিকিৎসা থেকে শুরু করে বড় হয়ে চাকরি, ব্যবসা বা বিয়েতেও দিতে হয়েছিল তাদের মিথ্যে পরিচয়। তবে ৩১ জুলাই, ২০১৫ এর পর থেকে ছিটমহলের বাসিন্দাদরে আর মিথ্যা পরিচয় দিতে হবে না। ছিট নয়, তারা এখন বাংলাদেশের নাগরিক। সোনার বাংলার লালসবুজের পতাকাটাও তাদের।

গত বছরের ডিসেম্বরে সিটমহল ঘোরার সময় পঞ্চগড়ের গারাতি ছিটমহলের বাসিন্দা বাহার আলী বলছিলেন, তার ছেলে ওমর আলী এবং মেয়ে বাসিরন আক্তার স্থানীয় পুকরিডাঙ্গা স্কুলের ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ে। পরিচয় গোপন করে ছেলে-মেয়েকে স্কুলে দিতে হয়েছে। অন্যরা স্কুল থেকে উপবৃত্তি পেলেও ছিটমহলের বাসিন্দা জানার পর তার মেয়ে আর উপবৃত্তি পাচ্ছে না। ভাগ্য ভালো শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত করেনি স্কুল কর্তৃপক্ষ। এখন মানিচত্র বদলেছে, পতাকা পেয়েছে। এখন থেকে বাসিরনও পাবে উপবৃত্তি।

ওই সময়টায় লালমনিরহাট, পঞ্চগড় ও কুড়িগ্রামে থাকা ভারতের ছিটমহলের বাসিন্দাদের সঙ্গে আলাপ হয়েছে বিস্তর। তারা বলছিলেন, সময়ের পরিবর্তনে তাদের কপালে শিক্ষা, চিকিৎসার মতো কিছু সেবা জুটলেও তা পরিচয় গোপন করেই পেতে হচ্ছে। একজন গর্ভবতী নারীকে হাসপাতালে চিকিৎসা দিতে নেওয়া হলেও পরিচয় গোপন রাখতে হয় তাদের। তাদের পুরো জীবনটাই ভাসে মিথ্যার উপর ভিত্তি করে। আমি অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে ছিলাম তাদের দিকে। দেখতাম তাদের চেহেরা, গায়ের রঙ, চুলের রঙ সবকিছুই ঠিক ছিল। শুধু মানচিত্রের এক টুকরো সীমানার কারণে তাদের পুরো জীবনটাই মিথ্যায় ভাসছিল তখন। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সফল কুটনৈতিক প্রচেষ্টায় এবার সত্য জীবন পেল সেই মানুষেরা।

এই মানুষদের আক্ষেপ ছিল, বছরের পর বছর ধরে তারা বাংলাদেশের ধুলোবালিতে লুটুপুটি খেয়েছেন, বাংলার আলো-বাতাসে বড় হলেও শুধু মানচিত্র অনুযায়ী ভারতের বিচ্ছিন্ন ভূমিতে বসবাসের কারনে তাদের মানবেতর জীবনযাপন করতে হয়। তারা ভারতের ভূমিতে বসবাস করলেও সেখানকার নাগরিক নন। বাংলাদেশের আলো-বাতাসে বড় হলেও বাংলাদেশের নাগরিক হতে পারছিলেন না এতোদিন।

৭৮ নং গারাতি ছিটমহলের বাসিন্দা ৫৫ বছর বয়সী রফিকুল ইসলাম বলছিলেন, জীবনের শেষ পর্যায়ে গিয়েও নাগরিক সুবিধা কি তা তারা বুঝতে পারেন নি। তাদের ছিটে ২৪ শ' বাসিন্দা হলেও রাস্তাঘাট নেই, বিদ্যুৎ নেই। শিক্ষা ব্যবস্থা নেই। সামান্যতম নিরাপত্তাও নেই তাদের। ৩১ জুলাইয়ের পর থেকে তাদের সে আধাঁর কেটে গেল।

একই ছিটমহলের বাসিন্দা জহির উদ্দিনের ভাষ্য ছিল, নিজের ছিটমহলের ঠিকানা গোপন করে ছোট ছেলে নুরুল ইসলামকে এইচএসসি পর্যন্ত পড়িয়েছেন কলেজে। এরপর আবারও মিথ্যে পরিচয় দিয়ে ঢাকায় একটি ওষুধ কোম্পানিতে চাকরি নেয় সে। ছিটমহলের পরিচয় জেনে বছরখানেক আগে সেই চাকরিটা চলে গেছে। এখন শিক্ষিত ছেলে ছিটমহলেই কৃষি কাজ করে। জহির উদ্দিনের বড় ছেলে নুরনবী। সেও মিথ্যে পরিচয়ে মেট্রিক পাশ করার পর শ্রমিক হিসেবে বিদেশ যেতে পাসপোর্ট করতে গিয়েছিলেন। তবে পুলিশের তদন্তে আর পাসপোর্ট জুটেনি তার। এখন থেকে নুরুল ইসলাম বুক ফুলিয়ে পরিচয় দিয়ে চাকুরি পাবে এদেশে, নুরনবী বাংলাদেশী পাসপোর্ট নিয়েই বিদেশ যাবে। তার ঘামের টাকায় আরও বড় হবে প্রিয় বাংলাদেশের রেমিটেন্স।

একই ছিটমহলের বাসিন্দা ওসমান আলী বলছিলেন, তার অসহায়ত্বের কথা। তিনি জানান, বাংলাদেশের স্থানীয় একটি ছেলের সঙ্গে তার মেয়ে পারভিনের বিয়ে হয়। বিয়েটা পারিবারিক সিদ্ধান্তে হলেও কাবিন রেজিষ্ট্রেশন সম্ভব হয়নি। কারন তিনি ছিটমহলের বাসিন্দা। তিনি উৎকণ্ঠা নিয়ে বলছিলেন, এখন ছেলেটা যদি ভবিষ্যতে মেয়েটাকে ফেলে চলে যায় তাহলে তিনি কোনো আইনের আশ্রয় নিতে পারবেন না।
উল্টোভাবে বিয়ে হয়েছে লালমনিরহাটের শ্রীরামপুরের বাসিন্দা জাহানারার। বাবা জসিম উদ্দিন বাংলাদেশি হলেও মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন বাঁশকাটা ছিটমহলের বাসিন্দা আজগর আলীর কাছে। সে বিয়েতেও কোনো কাবিন রেজিষ্ট্রি হয়নি বলে জানিয়েছিলেন জাহানারা। তার উদ্বেগভরা ভাষ্য ছিল, স্বামী ছেড়ে চলে গেলেও তার আর কিছুই করার থাকবে না। নিজে বাংলাদেশী হলে তার ছেলে মেয়েরা বড় হচ্ছে ছিটমহলবাসীর পরিচয়ে। আনন্দের খবর এখন থেকে বাবা ওসমান আলীর উৎকণ্ঠাটা আর রইল না। জাহানারা গর্ব ভরেই পরিচয় দেবেন তার স্বামীর বাড়ি বাংলাদেশে। ছেলেমেয়েরাও বড় হবে বাংলাদেশি পরিচয়ে। এখন থেকে তারা দেশের আইনের দৃষ্টিতে সমান। এদেশ তাদের, এদেশের লালসবুজ পতাকা তাদের।