জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের হল চাই, তবে কারাগারের জায়গায় নয়

আতাউর রহমান
Published : 25 August 2016, 12:34 PM
Updated : 25 August 2016, 12:34 PM

তৎকালীন জগন্নাথ কলেজের একটি সাময়িকীতে পড়েছিলাম-‌'৬৮-৬৯ সালে জগন্নাথ কলেজ থেকে ভিপি এম এ রেজা আর জিএস মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিনের মিছিল ছাড়া নাকি কেন্দ্রীয় সভাসমাবেশ জমেই উঠতো না।' এরপর ধাপে ধাপে নানা আন্দোলন সংগ্রামে জড়িয়ে আছে পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির নাম। তখন আন্দোলনটা হতো একটা জাতির স্বাধীনতার লক্ষ্য।

সেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষার্থীরা এখন আন্দোলন করছে সে তুলনায় ক্ষুদ্র স্বার্থ আদায়ে। নিজেদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটার মান রক্ষায় সে আন্দোলন। প্রতিষ্ঠানটির ভবিষ্যত শিক্ষার্থীদের বাসযোগ্য পরিবেশ সৃষ্টির জন্য অগ্রজরা করে যাচ্ছে এ আন্দোলন। অবশ্য গত দেড় যুগ ধরে তা চলছে। কখনো কলেজ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরের আন্দোলন। কখনো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিনে রেজিষ্ট্রেশনের আন্দোলন। এসব আন্দোলনে সফল হওয়ার পর দখল হওয়া হল উদ্ধারের আন্দোলন, হল নির্মানের আন্দোলন। যা থেমে থেমে চলছে গত কয়েক বছরে। এসব আন্দোলন চলাকালে আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি সরকারের ক্ষমতার মেয়াদ পাওয়া গেছে। অথচ দুঃখজনক হলেও সত্যি এ দুটি দলের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ এবং ছাত্রদল কখনই সাধারণ শিক্ষার্থীদের দাবির প্রতি একাত্ম হতে পারে নি। তারা সামনে থেকে নেতৃত্ব দিতে পারে নি।

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্ত জামাতের ছাত্র সংগঠন শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধ। তবে শিক্ষার্থীদের বড় আন্দোলনগুলোতে এ সংগঠনের কর্মীরা যে নিজেদের লুকিয়ে অংশ নিয়েছে-তার প্রমান মেলে। যদিও তারা বারবারই আন্দোলনটা ভিন্নদিকে নেওয়ার চেষ্টা করেছে। হল উদ্ধার বা হল নির্মানের আন্দোলনে তারা ভিসি বিরোধী বা সরকার বিরোধী আন্দোলনে রূপ দিতে চেয়েছে বারবার। ফলে ঘাঁপটি মারা এই গ্রুপটি ভাংচুর করেছে, জ্বালাও-পোড়াও করেছে। ফলাফল-নানা আইন শৃঙ্খলা বাহিনী আন্দোলনকারীদের বিপক্ষে বল প্রয়োগ করেছে, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন আর প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনগুলো যৌক্তিক আন্দোলনের বিপক্ষে গেছে। এতে গতি হারিয়েছে দাবি আদায়ের আন্দোলনটাই।

তবে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হচ্ছে-এই আন্দােলন করতে হবে কেনো? রাষ্ট্র বিশ্ববিদ্যালয় চালাচ্ছে অথচ সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের থাকার জায়গা দেবেন না! তা তো হতে পারে না। এজন্য শিক্ষার্থীদের আন্দোলন করতে হবে? আসলে পুরান ঢাকার ঘিঞ্জি গলিতে জগন্নাথের শিক্ষার্থীরা 'মেস' নামক কারাগারে কী যে মানবেতর জীবন-যাপন করছে-তা কেউ না করলে সে কষ্ট বুঝবার কথা নয়। এজন্য তারা হয়তো ক্যাম্পাসের আশপাশে একটু খালি জায়গা পেলে সেখানে হল নির্মানের দাবিতে সোচ্চার হয়ে উঠে। যেমনটা চলমান আন্দোলনে দাবি করছে শিক্ষার্থীরা। তাদের এখনকার দাবি-নাজিমুদ্দিন রোডে কেন্দ্রীয় কারাগারের খালি জায়গায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের হল নির্মান করতে হবে। আন্দোলনকারীরা এও বলছে-সেখানে জাতীয় চার নেতার নামে চারটি হল করতে হবে। জাতীয় নেতাদের স্মৃতি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ধরে রাখবে।

আমিও আমার প্রিয় বিশ্ববিদ্যালয়টির জন্য হল চাই। সে দাবিটা জোরালোভাবেই করছি। তবে তা কারাগারের জায়গায় নয়। ব্যক্তিগতভাবে মনে করি- কারাগারের খালি জায়গায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের হল নির্মানের দাবিটি যৌক্তিক নয়। কারণ সরকার দীর্ঘদিনের পরিকল্পনায় কারাগারটি সেখান থেকে স্থানান্তর করছে। নিশ্চয় ওই জায়গা নিয়ে সরকারের একটা পূর্ব পরিকল্পনা রয়েছে।

সুতরাং আমরা হল নির্মান চাই-সেই জায়গাটাো সরকারই আমাদের দেবে-সেটাও চাই। আর এই চাওয়াটা দ্রুতই হউক। কারণ আন্দোলনটা যে অনেকদিন হলো। গত ৭-৮ বছর আগে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকার সময় এ আন্দোলনটায় আমিও সামিল হয়েছিলাম। ২০০৫-২০০৬ সালে আমি তখন দৈনিক সংবাদে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করি। তখন সম্ভবত আমিই প্রথম জগন্নাথের যে ১২ টি হল (ছাত্রাবাস) রয়েছে এবং তা দখলে-সেই খবরটা হলের ঠিকানা, কার দখলে এবং জমির পরিমানসহ লিখেছিলাম। সেই নিউজের তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে ধাওয়া খেয়েছিলাম। নির্যাতনের শিকার হয়েছিলাম দখলদারদের। ওই সময়ের নব গঠিত বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ হল থাকার কথা অস্বীকার করেছিল। তবে এসব হল উদ্ধারের দাবিতে কঠোর আন্দোলন হয়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বাধ্য হয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির পুরনো সম্পত্তির হিসেব পেতে একটি সিএ ফার্ম নিয়োগ দেয়। এতে পাঁচটি ছাত্রাবাসের মালিকানার দলিলপত্র পাওয়া যায়। ২০১০ সালের জানুয়ারীতে তা নিয়ে সংবাদে নিউজও করেছিলাম। তবে হল নির্মানের যৌক্তিক দাবির আন্দোলনটা আজো থামেনি।

ব্যক্তিগত পুরনো নথি ঘেটে দেখেছি- দৈনিক সমকালে যোগ দিয়েও সেই হল উদ্ধার, হল নির্মান নিয়ে নিউজ লিখতে হয়েছে। ২০১৪ সালে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে সমকালের তৎকালীন প্রতিনিধি রাজবংশী রায়কে নিয়ে লিখেছিলাম-‌'জবির বেদখল ১০ হল : আন্দোলন হয়, হল উদ্ধার হয়না।' সেই প্রতিবেদন প্রকাশের দুই বছর পরও চলছে আন্দোলন। চলমান আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের বলছি-আরেকটা প্রতিবেদন লিখতে চাই-‌' ১৯ সালের মধ্যে জবিতে দুই হল নির্মান।' স্বপ্নের এই শিরোনামটা বাস্তবায়ন হলে বড় বেশিই খুশি হবো। তবে বরাবরই বিশ্বাস করি সহিংস আন্দোলনে জানমালের ক্ষতি হয়, দাবি আদায় হয় না। তাই শ্রমিকদের মতো রাস্তা দখল করে, ভাংচুর করে, জন ভোগান্তি সৃষ্টি করে পুরনো কায়দার আন্দোলন নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের কাছে চাই নতুন অথচ শাণিত আন্দোলন।