আমাদের চলচ্চিত্রের দুর্দশা নিয়ে অনেক কথা হয়েছে। পশ্চিমের ছবির তুলনায় বাংলাদেশের ছবির গুণ মান যে অত্যন্ত নিচু এতে কারোরই কোন দ্বিমত নেই। নিচু মানের পেছনে অনেক কারণ রয়েছে। প্রধান কারণ যারা এই ছবিগুলো নির্মাণ করছে তাদের শিক্ষা ঐ স্তরের নয়। শিক্ষিত লোকরা সিনেমায় এলে এই দুর্দশা হতো না। ইদানীং অবশ্য নতুন নতুন অনেকে আসছেন। যেমন গিয়াসউদ্দিন সেলিম, নির্ঝর, এরাতো অনেক ভালো সিনেমা তৈরি করেছেন। এরা সংখ্যায় বেশি হলে বাংলাদেশের সিনেমার চেহারা বদলে যাবে ধীরে ধীরে।
আমাদের বড় সমস্যা হলো এফভিসির ইকুইভমেন্ট কম, খারাপ ল্যাব, সাউন্ড একেবারেই কুৎসিত। এখান থেকে ভালো কিছু আশা করার কী কারণ থাকতে পারে? আমাদের পাশের দেশ ভারত প্রযুক্তির যে সাহায্য পায় তার কতটুকু আমরা পাই? আমার তো মনে হয় কোন কোন ক্ষেত্রে হলিউডের চেয়েও ভালো ছবি তৈরি করে ওরা। কারণ হলিউডের এখন বেশিরভাগ ছবিই কম্পিউটার গ্রাফিক্সের সাহায্য নিয়ে তৈরি করে। কোন অভিনেতার একটা ক্লোজআপ সট নিয়ে বাকিটা কম্পিউটারে করে নিতে পারে। অভিনেতার যোগ্যতা বা অন্যসব সৃজনশীলতা নিয়ে মাথা ঘামানোর দরকার নেই। অর্গাণিক ক্রিয়েটিভিটির ব্যবহার কমে গেছে। আর এটা যেহেতু কমে গেছে এবং একদিন যদি পুরোপুরি উধাও হয়ে যায় তাহলে অভিনয় দক্ষতা বলে আর কিছু থাকবে না। সেক্ষেত্রে আমরা যারা প্রযুক্তির দিক থেকে পিছিয়ে থাকা দেশ তারা অর্গাণিক ক্রিয়েটিভিটির উপর নির্ভরশীল থাকবো। এটা হলো খারাপ অবস্থার একটা ভালো দিক। তবে সত্যিকার অর্থে আমাদের চলচ্চিত্র আফ্রিকার চেয়েও পিছিয়ে পরা। আর এই পিছিয়ে পরার কারণ একটা দুটো না, অনেক। আমাদের ভালো পরিচালক নেই, ভালো সম্পাদক নেই, ভালো ক্যামেরাম্যান নেই, ভালো ল্যাব নেই, ভালো অভিনেতা নেই।
এই শূন্যতাকে পূরণ করতে পারতো টিভি-নাটকগুলো। কিন্তু কী অদ্ভূত, এটা সিনেমার চেয়েও আরও খারাপ দিকে যাচ্ছে। স্যাটেলাইট টেলিভিশনে আজকাল যা হচ্ছে, কিছুদিন পরতো মানুষ আর দেখবে না। সিনেমার চেয়েও খারাপ! কী সব অদ্ভুত অদ্ভুত নাম, যেমন জামাই মেলা। এটা কি মুর্খের পর্যায়ে পড়ে না? তারপরে আরও কী কী সব নাম, রসা ভাই, এগুলো কোন নাম হলো। তো এসব হওয়ার কারণ হলো এই মাধ্যমগুলোতে শিক্ষিত মানুষ নেই।
এগুলোর পেছনে রাজনীতিও আছে। যে দেশে রাজনীতির মান নিচু সেখানে সবক্ষেত্রে তার প্রভাব তো পরবেই।
এফভিসির পরিকল্পনাটা ছিলো বঙ্গবন্ধুর। তারপরে এই যে যমুনা সেতু এটা ছিলো বঙ্গবন্ধুর পরিকল্পনা। এগুলো পরে বাস্তবে রূপ নিয়েছে। কিন্তু সব কিছু কি একজনই করবে? এরপরে যত সরকার এসেছে এফভিসির আর কোন উন্নতি হয় নি। আমাদের দুর্ভাগ্য হলো ১৪ই ডিসেম্বর বুদ্ধিজীবী হত্যা। আমাদেরকে পঙ্গু করে দিয়েছে। এর পরে বঙ্গবন্ধু হত্যা। আমাদের যে কর্ণধার তাঁকে আমরা হত্যা করেছি। তারপরে জেলখানায় চার নেতাকে হত্যা করেছি। আমরা বেঁচে থাকবো কী নিয়ে, কে পথ দেখাবে ? নেই তো কেউ। আমাদের দুইজন প্রেসিডেন্টকে গুলি করে হত্যা করেছি। আবার দেখা গেল যারা এক সময় মুক্তিযুদ্ধ করেছে এবং এখনও বেঁচে আছে তাদের কেউ কেউ নিজের দেশকেই লুট করছে। খালেদ মোশারফ একটা সুন্দর কথা বলেছিলেন, স্বাধীন দেশ জীবিত মুক্তিযোদ্ধাদের পছন্দ করে না। সেই অর্থে আমরা খুবই অসহায়। আমাদের এখন কিছুই করার নেই। সেদিন আমাকে এক মুক্তিযোদ্ধা বলছিলো যে বাংলাদেশ এরকম হবে জানলে আমি মুক্তিযুদ্ধই করতাম না।
তারপরেও আমরা কিন্তু অনেক ভালো আছি। গত এক হাজার বছরের ইতিহাসে আমরা এই প্রথম স্বাধীন হয়েছি। আমরা তো চিরকাল পরাধীন ছিলাম। বহুদিন সংগ্রাম করার পর আমরা স্বাধীন হলাম। এটা ঠিক যে মাত্র চল্লিশ বছর একটা জাতির জন্য কিছুই না। আমাদের দেশে দুর্বৃত্তের অভাব নেই, তারপরেও জাতি হিসেবে আমরা এখনও অনেক সংযত। এখনও আমরা কথা বলি বিবেচনা দিয়ে, যুক্তি দিয়ে। আগে এটা ছিলো না। এখন প্রশ্ন উঠতে পারে এত দুর্নীতি আর ঘুষ কীভাবে বিস্তার লাভ করলো। এর পেছনে মূলত দারিদ্র। আমাদের ধর্মে যাকাতের বিধান আছে। তুমি যদি তোমার আয়ের আড়াই পারসেন্ট যাকাত দাও তাহলে পৃথিবীর কোন মানুষ না খেয়ে মারা যাবে না। কিন্তু আমরা এটা কি করি? আমাদের কতিপয় দুর্নীতিবাজ আর ঘুষখোররা আমাদের আয়ের বহু পারসেন্ট যাকাত ওরা নিয়ে নিচ্ছে। ওরা যাকাতের নিয়মটা এইভাবে বাস্তবায়ন করছে। ফলে দারিদ্র বাড়ছে। আমাদের ধর্মে আর একটা কথা আছে চল্লিশ দিনের বেশি খাবার মজুদ রাখা যাব না। এটা যদি অনুসরণ করা হয় তাহলে কেউ গরীব থাকবে না, না খেয়েও মরবে না। কিন্তু আমরা সেটা পালন করি না। অথচ ধর্মের অন্যসব নিয়মকানুন ঠিকই পালন করি, যেমন নামজ রোজা হজ। ফলে অদ্ভুদ একটা স্ববিরোধী মানসিকতার মধ্য দিয়ে আমরা যাচ্ছি।
হুমায়ূন ফরীদি : টিভি-নাটক ও চলচ্চিত্রের অভিনেতা।