অতিপ্রাকৃত

খন্দকার মনিরুল ইসলাম
Published : 15 April 2016, 02:53 AM
Updated : 15 April 2016, 02:53 AM

তখনও মোবাইল ফোনের ব্যবহার শুরু হয়নি। গ্রামের আত্মীয় স্বজনের সাথে চিঠি এবং টেলিগ্রাম ছিল যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম । একদিন গ্রাম থেকে একটা চিঠি এলো , আমার এক মামার বিবাহ। আমাদের বাড়ীর সবাইকে বিবাহ অনুষ্ঠানের সপ্তাহ খানেক পূর্বেই গ্রামে যেতে হবে। ব্যাস, প্রস্তুতি শুরু হয়ে গেলো এবং নির্দিষ্ট সময়ে সবাই মহা ধূমধামের সাথে অতীব উৎসাহ সহকারে বিবাহ অনুষ্ঠানে যোগ দেয়ার উদ্দেশে রওনা হয়ে গেলো। আমার তখন স্কুলে টেস্ট পরীক্ষা চলছিলো । সম্ভবত আরও একটা পরীক্ষা বাকি ছিল, তাই আমাকে পরে যেতে হয়েছিলো। যেদিন পরীক্ষা শেষ হলো, সেদিন একটা চিঠি পেলাম। আমার সবচাইতে প্রিয় বন্ধু রানার হাতে লেখা। যেহেতু রানার চিঠি, তাই আর তর সইছিলো না। অনেকদিন পর ওর লেখা চিঠি পড়ছি। প্রায় সাতদিন আগের লেখা।
"কেমন আছিস বন্ধু। অনেকদিন সাক্ষাৎ নাই। আমি কিন্তু রোজই সেই কদম গাছটার নীচে একবার করে যাই। সেই গাছটার নীচে গেলেই আমি তোকে অনুভব করি। ওই গাছটিকে ঘিরে কতো স্মৃতি আছে আমাদের। তোর ছোট মামা বিয়ে করছেন। তুই তো অবশ্যই আসবি। পরীক্ষা শেষ হলে দেরি করবিনা। যত রাতই হোক তুই সেইদিনই আসবি। আমি গ্রামের ওই চৌরাস্তার মোড়টার কাছেই থাকবো ।"
আমার পরীক্ষার খবরও যে ঠিকঠাক রাখে চিঠি পড়ার পর বুঝতে বাকি থাকলো না। তাই কালক্ষেপন করার কোন উপায় নেই। আমার নানা বাড়ি বগুড়া জেলার শেরপুর থানায়। ঢাকা থেকে যেতে অনেক দূরের পথ । বাড়িতে পৌঁছাতে ছয়-সাত ঘন্টা সময় লেগে যায়। তখনকার দিনে এত বাস সার্ভিস ছিল না। যাইহোক বাসস্ট্যান্ড-এ গিয়ে ঘন্টা খানেক অপেক্ষা করার পর একটা বাস পেলাম। সেদিন রাস্তায় প্রকট যানজট ছিলো। কেন জানিনা না, যত রকম বিপত্তি আছে সব আমার বেলাতেই ঘটে। প্রথম প্রথম ব্যাপারটা কিছুটা হতাশাজনক মনে হতো। এখন সয়ে গেছে।যানজটের ঠেলে অবশেষে যখন বাজারে পৌঁছালাম তখন প্রায় রাত দশটা। বাজারের প্রায় সবগুলো দোকানপাট বন্ধ হয়ে গেছে। সেদিন ছিল আমাবশ্যা রাত। চারিদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার।বাজার থেকে আমার নানা বাড়ী যেতে আমাকে পাঁচ কিলোমিটার রাস্তা হেটে যেতে হবে। একেতো আমাবশ্যা রাত তার ওপর গুড়িগুড়ি বৃষ্টি হচ্ছে, মাঝে মাঝে বিকট শব্দে আকাশে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছিলো। সবকিছু মিলিয়ে একটা ভয়াবহ রাত। একটু ভয়ভয় লাগছে।
একা একা এই অন্ধ কার রাতে গ্রামের গহীন রাস্তায় হাটতে হবে, ভাবতেই গা শিউরে উঠছে। হঠাৎ রানার কথা মনে হলো। কিন্তু ওর তো চৌরাস্তার মোড়ে থাকার কথা। একটু রাগ হচ্ছে ওর ওপর। কেন চৌরাস্তার মোড়ে? কেন বাজারে নয়? বিজলীর আলোয় পথ চলছি। একটি আতঙ্ক কাজ করছে মনে। এভাবেই হাটতে হাটতে চৌরাস্তার মোড়ে চলে এসেছি। এখন মনে সাহস পাচ্ছি। রানা আাশেপাশে কোথাও আছে। চিৎকার করে ডাকতে শুরু করলাম। বেশিক্ষন ডাকতে হলোনা। "ফারুক! এইযে আমি এখানে, তোর একটু পিছনে।" "সাথে সাথে পিছনে তাকালাম, অন্ধকারে ওকে আবছা আবছা লাগছিলো। কিন্তু আমি ওকে দেখতে পাচ্ছিলাম। কাছে আসতেই আমাকে জড়িয়ে ধরলো। কতক্ষণ এভাবে ছিলাম এখন ভুলে গেছি।
অভিযোগের স্বরে রানাই প্রথমে বললো- "এতো দেরী হলো কেনো তোর? কতক্ষণ দাড়িয়ে আছি। কেমন আছিস? কোন সমস্যা হয়নিতো রাস্তায়"?
"আমি ভালো আছি রানা। একটু সমস্যা হয়েছিলো। কিন্তু এখন সব সমস্যা, সব ক্লান্তি, সব সবকিছু দূর হয়ে গেছে। এখন তুই আর আমি একসাথে। এখন পুরো পৃথিবী শুধু তোর আর আমার।"
"ফারুক, অনেক ধকল গেছে তোর ওপর, চল তাড়াতাড়ি তোকে পৌঁছে দেই।"
"না রানা, এখন আর কোন ক্লান্তি নেই। আজ সারারাত তুই আর আমি পুরো গ্রাম ঘুরে বেড়াবো ।"
এভাবে দুজন কথা বলতে বলতে বাড়ি ফেরার কথা ভুলেই গিয়েছিলাম । শেষরাতের দিকে রানা আমাকে বলল, " ফারুক , চল , বাড়ি ফিরতে হবে। "
এরপর রানা আমাকে বাড়ি পৌছিয়ে দিয়ে চলে গেলো। সকালে ঘুম ভাঙ্গতেই কাউকে কিছু না বলেই রানাদের বাড়ি চলে গেলাম। রানাদের বাড়ীতে একটা থমথমে ভাব। সাধারণত এরকম থাকেনা ওদের বাড়ীতে। অনেক খোঁজাখুঁজির করেও রানাকে পেলাম না।আমার ডাকাডাকি শুনে ওর বাবা এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে কান্না শুরু করে দিলো । কান্না ভরা চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন ," রানাকে খুঁজছ বাবা ? ওকে আর কোথায়ও খুঁজে পাবেনা । তিন দিন আগে মোটর সাইকেল দুর্ঘটনায় আমার ছেলেটা মারা গেছে বাবা।"
" কি বলেন চাচা , অসম্ভব । কিছুতেই হতে পারেনা এটা। গত রাতে আমি আর রানা একসাথে হেঁটেছি , কথা বলেছি । ও আমাকে বাড়ীতে পৌছিয়ে দিয়েছে । ও মারা যেতে পারেনা । আপনার ভুল হচ্ছে।"- কথাগুলো বলার পর চারিদিকে তাকিয়ে দেখি অনেক লোক জড়ো হয়ে গেছে । সবাই আমার দিকে অন্য রকম এক দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে । কেউ কেউ বলছে বন্ধুর শোকে আমি পাগল হয়ে গেছি ।আমি আর থাকতে পারলাম না। চলে গেলাম সেই কদম গাছ তলায়। হঠাৎ করে সবকিছু যেন এলোমেলো হয়ে গেলো।কি হচ্ছে এসব , বুঝতে পারছিনা । এমন সময় পিঠে কারও হাতের স্পর্শ টের পেলাম। পিছনে তাকিয়ে দেখি রানা। " রানা, এসব কি বলছে সবাই?" রানাকে দেখতেই জিজ্ঞাস করলাম।
" ফারুক, তুই যা শুনেছিস সবই সত্যি ।আমি মরে গেছি। কিন্তু আমি শুধু তোর কাছেই আসবো । এই কদম গাছের নীচে এসে আমাকে ডাকলেই আমি তোর কাছে আসবো। মন খারাপ করিসনা । বাড়ীতে যা।" – বলেই রানা মিলিয়ে গেলো।
এখনো আমি যখনই গ্রামে যাই , রানার সাথে দেখা হয় সেই কদমগাছ তলায় । কেউ বিশ্বাস করে না আমার এই কথা। আমিও কাউকে বিশ্বাস করানোর আর প্রয়োজনবোধ করিনা। যেভাবেই হোক না কেন , রানার সাথেতো দেখা হচ্ছে ।