রাষ্ট্রের উচ্ছেদ প্রীতি এবং পাহাড়িদের পর্যটন ভীতি

নেংমিঞ্জা বাপন
Published : 18 June 2016, 09:04 AM
Updated : 18 June 2016, 09:04 AM

পাহাড়ে নাকি অনেক টাকা থাকে। সবাই বলে। কেউ একজন একবার বিশদ বর্ননা দিয়েও বলেছিল যে পাহাড়ে কিভাবে টাকা লুকিয়ে থাকে। শুধু পাহাড়ে বসবাসকারীরা সেই টাকা কখনও খুঁজে পায়না। আবার সমতল থেকে টাকা সন্ধানীরা ঠিকই টাকা খুঁজে পান। একটি এলাকার কথা বলতে হয়। এলাকার নামটি বলার ইচ্ছে নেই। সেখানে একসময় খাদ্যের, অর্থের, ভাল স্বাস্থের, অভাব লেগেই থাকতো। কিন্তু হঠাৎ রাষ্টের একটি সিদ্ধান্ত এলাকার ভাবমুর্তি পালটে দিল। এলাকাতে বিভিন্ন এলাকার বিনিয়োগকারোরা এসে স্থানীয়দের জমি জমা সস্তায় কিনে নিলো। যারা জমিজমা বিক্রি করল তাদের আইডিয়া ছিলনা আসলে কেন কি কারনে প্রতি শতাংশে কয়েকহাজার বেশী টাকা দিয়েও জমিগুলো কিনে নিচ্ছে তাঁরা । একটা সময়ে এসে সেই জায়গাটি স্থল বন্দর হল। সমতলের অনেকেই টাকা পয়সা বানিয়ে লাল হয়ে গেলো। কিন্তু স্থানীয় এলাকাবাসী জমি বিক্রির টাকা দিয়ে যা কদিন সুখ আহ্লাদের দিন দেখেছে এর চেয়ে বেশি কিছু আর হয়নি।

এই ছোট্ট উদাহারন হয়তো কিছুই না। কিন্তু পাহাড় প্রীতি জঙ্গল প্রীতি আমাদের দেশীয় ভাবনাকে যে ভাবে দোলাচ্ছে তাতে মনে হচ্ছে পর্যটন শিল্প দিয়ে দেশটা কদিন পর ভুরি ভুরি বৈদাশিক মুদ্রা অর্জন করার ধান্দাটা ভালভাবেই আয়ত্ব করে নেবে। ধান্দা বলছি কারন ধান্দার সংজ্ঞায় পরছে এমন সিস্টেম এই প্রীতির পেছনে সুপার গ্লু দিয়ে লাগানো আছে। পাহাড়ে বসবাসকারীদের অনেকেই বনবিভাগের জমিতে বসবাস করে আসছে। অনেক সময় নিজেদের শ বছর ধরে বসবাস করা জমিতে বছরের পর বছর কেউ কেউ আবাদ করেও টিকে আছে। ধরতে গেলে বংশপরম্পরায় বেশীরভাগ পাহাড়ীদের বেঁচে থাকার মাধ্যমটাও এই চাষাবাদ। কদিন আগে সিলেটের মৌলভীবাজার জেলার নাহারপুঞ্জি বাসীদেরকে পুঞ্জি ছেড়ে দিতে বলে একটি নোটিশ জারি করেছে জেলা প্রশাসক। জারিকৃত নোটিশে অবৈধ্য দখলের কথাটি উল্লেখ করে সময়মত পুঞ্জি ত্যাগ না করলে জোড় করে উচ্ছেদ করার হুঁশিয়ারিও দেওয়া হয়।কিছুদিন পার না হতেই আবারও ইকোপার্ক সমস্যায় জর্জরিত মধুপুরবাসীদের কপালে আরেকটি দুঃখের সংবাদ আসে। সংবাদটি হল সংরক্ষিত বনায়নের জন্য  বন বিভাগের পক্ষ থেকে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। যেখানে সেখানকার স্থানীয়রা বলছে যদি এই প্রজ্ঞাপন বাতিল না হয় তবে প্রায় ১৫ হাজার আদিবাসী তথা এলাকার জনগন উচ্ছেদের শিকার হবে। এর আগে বিশেষ অর্থনৈতিক জোন, ইত্যাদির কথা নাই বললাম। কিন্তু প্রশ্নটি হল পর্যটন শিল্পের জন্য বা বন উদ্ধারের জন্য যে সিদ্ধান্তগুলো নেওয়া হচ্ছে এর পেছনে স্বার্থ কি ?  স্বার্থের প্রকার আলোচনার আগে একটি কথা বলতে হয় আদিবাসীদের অধিকার বিষয়ক জাতিসঙ্ঘের ঘোষনা পত্র মোতাবেক ৬৪ ধারায় দশ নম্বরে বলা আছেআদিবাসীদের জোর করে তাদের এলাকা বা ভূমি থেকে উচ্ছেদ করা যাবে না। ঘোষণাপত্রের ২৬ ধারায় বলা হয়েছে- যেসব ভূমি, এলাকা ও প্রাকৃতিক সম্পদ আদিবাসীরা বংশপরম্পরায় ঐতিহ্যগতভাবে ভোগদখল বা ব্যবহার করে আসছে, তার ওপর আদিবাসীদের অধিকার রয়েছে। আবার বলা হয়েছে- রাষ্ট্র এসব ভূমি, অঞ্চল ও সম্পদের আইনগত স্বীকৃতি প্রদান করবে এবং এ ধরনের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি প্রদান করতে হবে আদিবাসীদের রীতিনীতি, ঐতিহ্য ও ভূমি মালিকানা প্রথাকে যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করে। তাহলে আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃত না দেওয়ার বিষয়টিও একটু টেনে আনতে হয়। এই ঘোষনা পত্রে ১৪৩ টি দেশ খুশী হয়ে ভোট দিলেও বাংলাদেশ ভোট করেনি। এই ভোট না করার পেছনে যে স্বার্থটি ছিল তারই ফল হিসেবে ২০০৪ সালের ৩ জানুয়ারি   সেই স্বার্থের বলি হয়েছে মধুপুরের পীরেন স্নাল সহ পঙ্গুত্ব বরণ করা অনেকেই। তাহলে সরকারী পৃষ্ঠপোষকতায় বহুদিনের করা নীলনকশার বাস্তবায়ন করা হচ্ছে বললে হয়তো খুব বেশী ভুল বলা হবেনা।

পাহাড়বাসীদের পর্যটন ভীতির মাত্রা বাড়িয়ে দিচ্ছে দেশীয় আন্দোলনের  অতি আনুষ্ঠানিকতা কিন্তু অকার্যকর অবস্থা। দেশের বর্তমান পরিস্থিতির হাল বিবেচনা করতে গেলে বোঝা মুশকিল হয়ে পরেছে যে কি হচ্ছে। এই মনে হচ্ছে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হলো আবার খানিকবাদেই মনে হচ্ছে কিছুই যেনো হয়নি। জনসাধারণকে ব্যাস্ত রাখার পায়তারা হয়ে ঘটনার অবতারণা ঘটছে কদিন পরেই ইস্যু ভ্যানিশ হয়ে গিয়ে আরেক ইস্যু রিপ্লেশম্যান্ট হচ্ছে। আদিবাসীরা বা পাহাড়বাসীরা প্রতিদিন কোথাও না কোথাও ভুমি সমস্যা নিয়ে দাঁড়িয়ে মানব বন্ধন করছে না হয় বিক্ষোভ মিছিল করছে। এই ভুমি সমস্যার কারন যখন বিনোদন মেকার পর্যটন তখন উচ্ছেদ আতংকে থাকা কিছু জনসাধারণের ভাগ্যটা গিনিপিগ জাতীয় প্রাণীর চেয়েও অধম বলেই মনে হয়। দেশের বাঘা বাঘা কুমিরদের পেটে নদী ভরাট হয়ে বদদখল হয়ে যায়। খাল বিল কুম্ভকর্নের পেটে চলে যায় আর কয়েকশ বা হাজার খানেক বনাঞ্চল আমাদের দেশীয় অর্থনৈতিক অবস্থাকে এভারেস্ট চুড়ার সম পর্যায়ে এমনই স্বপ্ন দেখায় যে খেটে খাওয়া মানুষের পেটে লাথি দিতে ইচ্ছে হয় !!

আশেপাশে তাকালে মনে হয় পাহাড়ের গাছগাছড়া থেকে শুরু করে পাহাড়বাসীরা জন্মে নিজের শিকড়কে বাঁচিয়ে রাখার যুদ্ধ করার জন্যে। কেউ টাকা খুঁজতে এসে গাছের ডাল ভেঙ্গে দেয়। কেউ কেউ আন্দোলন নিয়ে রিহার্সেল করতে সহজসরল পাহাড়ীদেরকে তাগাদা দেয়। ওরা ধীরে ধীরে ব্যানার লিখতে শেখে। স্লোগান দিতে শেখে। রাজপথ আগলে দাড়াতে শেখে। একটা সময়ে এসে আবার মনে হয় পাহাড়িদেরকে কেউ যেনো শান্তিতে থাকতেই দিতে চায়না । একটির পর আরেকটি ইস্যু পাকিয়ে গোলকধাঁধা বানিয়ে খেলা করে বুদ্ধিমনরা ! এইসব গোলকধাঁধার নাম পর্যটন ! সংরক্ষিত বনাঞ্চল ! বিশেষ অর্থনৈতিক জোন ! আজ নাহারপুঞ্জি, কাল মধুপুর, পরশু আরও কোন জঙ্গলা স্থানে টাকা খুঁজে বেড়াবে অর্থপ্রেমিরা। আর পাহাড়প্রেমীরা প্রতিদিন দুঃস্বপ্ন দেখবে "একপাতা প্রজ্ঞাপন, সাথে বিশাল বড় বুলডোজার" আর এক থালা বন-আলুর ভয়ঙ্কর স্বপ্ন।