দেখে এলাম গণবিশ্ববিদ্যালয়

বাসন্ত বিষুব
Published : 18 June 2016, 06:25 PM
Updated : 18 June 2016, 06:25 PM

ছুটির দিনে ভ্রমণ আর ছবি তুলা বিগত কয়েক বছর ধরে কড়া অভ্যাসে পরিণত হয়েছে আমার। আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে চেষ্টা করি শুক্র কিংবা শনিবারে কাছাকাছি কোন জায়গায় একটু ঘুরে আসতে। কিন্তু এই কড়া অভ্যাসে ছেদ পড়লে মনটা খারাপ হয়ে যায়, এর রেশও থাকে অনেকদিন। ফলে রাতে স্বপ্ন দেখি, ক্যামেরায় জং ধরেছে আর আমি ঘষে ঘষে সেই জং পরিস্কার করছি! কয়েক রাত আগে এমনই একটা স্বপ্ন দেখে পণ করেছিলাম এই শুক্রবারে কোথাও না কোথাও যাবই। ভ্রমণের জন্য ঐতিহাসিক স্থানগুলোই আমার কাছে অগ্রাধিকার পায়, তবে সব সময়ের জন্য নয়। কখনো কখনো ডোবা-নালা, খাল-বিল হলেও চলে। কারণ নিখাদ প্রকৃতি আমাকে টানে, বিশেষ করে পাহাড়। তবে হাস্যকর হলেও সত্য খুব কাছ থেকে পাহাড় দেখার সৌভাগ্য আমার একবারই হয়েছিল। সেটা কক্সবাজারের হিমছড়িতে, মাস দুয়েক আগে।


কিন্তু সব সময় তো আর অত দূরে যাওয়ার সুযোগ হয় না কিংবা মনও চায় না। তাই ভ্রমণের জায়গা নির্বাচন করতে যথেষ্ট হিমশিম খেতে হয় আমাকে। দূরত্ব, আবহাওয়া, পকেটÑ সব কিছু বিবেচনা করতে গিয়েই এই অবস্থা। কিন্তু পণ যেহেতু করেছি, যেতে তো হবেই। কোথায় যাওয়া যায় ভাবছিলাম। চলমান কড়া রোদের কথাও মাথায় রাখতে হচ্ছিল। ইদানিং রোদ একদমই সহ্য করতে পারি না। যাই হোক, অনেক ভেবে-চিন্তে স্থির করলাম সাভারের দিকে যাব। কিন্তু এ ক্ষেত্রেও একটা একটা সমস্যা উঁকি দিল। কারণ, ওদিকে বহুবার গিয়েছি। জীবনের বিশাল একটা সময় তো ওখানেই কেটেছে। তবে সাভার যাবার সিদ্ধান্তটাই শেষ পর্যন্ত পাকাপোক্ত করে নিলাম যখন এক ছোট ভাই গণ বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিল। ওর নাম সবুজ, টাঙ্গাইলের ছেলে। পড়ালেখা নামক ক্রিয়াটা ও ওখানেই সম্পাদন করেছিল। তো, জাহাঙ্গীরনগরে আমি বহুবার গিয়েছি, কিন্তু ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে আজ অবধি যাওয়াই হয়নি। দুটোর দূরত্বও খুব বেশি না। কিন্তু যাওয়া হল না কেন? সম্ভবত ধারণার অভাব ছিল। গণ বিশ্ববিদ্যালয় প্রচার বিমুখ বলেই হয়ত ওটার কথা কখনও মাথায় আসেনি। তাছাড়া গণ স্বাস্থ্য কেন্দ্র কিংবা গণ বিশ্ববিদ্যালয় দর্শনীয় কিছু হতে পারে সেটাও কখনও মনে হয়নি। এবার ওই ধারণা পুরোপুরি ভুল প্রমাণিত হয়েছে।

রওনা দিলাম বেশ সকালে। পৌঁছতে লাগল ঘন্টা খানেক। প্রবেশ করলাম গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরনো ক্যাম্পাস অর্থাৎ গণ স্বাস্থ্য কেন্দ্রের ফটক দিয়ে। ঢুকতেই চোখে পড়ল নারী নিরাপত্তারক্ষীদের। ওই ক্ষণে অবাক হয়নি, কিন্তু যখন শুনলাম গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র আর গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের সব নিরাপত্তারক্ষীই নারী, তখন অবাক না হয়ে পারলাম না। এত বড় প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তার দায়িত্ব শুধুমাত্র নারীদের হাতেÑ সত্যিই চমকপ্রদ। এই চমকের সাথে আরো কিছু ভাল লাগা যোগ হল যখন শুনলাম ওনাদের অধিকাংশই এক সময় পেশাদার যৌনকর্মী ছিলেন। ড. জাফরুল্লাহ চৌধুরী তাদের কর্মসংস্থান করে নতুন জীবন দিয়েছেন। সত্যিই অসাধারণ কাজ করেছেন তিনি। ছবি তুলতে চাইলে প্রথমে তারা আপত্তি করলেন। পরোক্ষণেই রাজি হওয়ায় একজনের ছবি তুলেছি। ওনারা হয়তো বুঝতে পেরেছিলেন, সুযোগ দিলে নারীরাও যে গুরু দায়িত্ব পালন করতে পারেন সে কথা মানুষের জানার প্রয়োজন আছে।

যাই হোক, হাঁটতে শুরু করলাম। চমৎকার প্রাকৃতিক পরিবেশ। অনেকটাই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের মত। একটা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এত বড় এলাকা নিয়ে গড়ে উঠতে পারে সেটা কল্পনাতীত ছিল। স্বাস্থ্য কেন্দ্রের পেছনে ইট বিছানো ঢালু পথ বেয়ে নামতেই দুই পাশে চোখে পড়ল তিনটি বড় বড় পুকুর। একটি মজে গেছে, বাকি দুটোয় মাছ চাষ হয়। জনা পাঁচেক লোক মাছের খাবার দেওয়ার আয়োজন করছিল। পাশেই আরো একটা জলাশয় আছে। বিলের মত দেখতে তবে লেক বললেও ভুল হবে না। হলে হলই। দারুণ জায়গা ওটা। ঘাটে নৌকা বাঁধা। একবার মনে হল, বলে কয়ে নৌকায় উঠা গেলে মন্দ হত না। কিন্তু লোকগুলো তো মাছের সেবায় ব্যস্ত, তাই আর বলা হয়নি।


ইটের রাস্তার দুপাশে বেশ কয়েকটা বাঁকানো ছাদের ঘর চোখে পড়ল। পাকা ঘর। সম্ভবত কর্মচারীদের জন্য বানানো। এখন কেউ ওগুলোতে থাকে কিনা সেটা নিশ্চিত হতে পারিনি। একই পথ ধরে আরেকটু এগুলে পুকুরের পাশে বিভিন্ন শ্রেণির কর্মচারীদের জন্য লম্বা একটা বাড়ি চোখে পড়বে। লাল বাড়িটা অসাধারণ। নকশা শৈলী দেখে মনে হল বৃটিশ ধাচের। লোকজন এখনও থাকে ওটাতে, তবে কিছুটা অযত্নে পেছন দিকটায় আগাছা গজিয়েছে প্রচুর।

অসংখ্য কাঠাল গাছ দুপাশে রেখে আরো এগিয়ে গেলাম। গ্রামের 'স্কুলঘর' এর মত একটা টিনশেড বাড়ি। ভাবলাম, এটাও কর্মচারীদের জন্য। কিন্তু পাশের জন জানালো, গণ স্বাস্থ্য ট্রাস্টের প্রাথমিক বিদ্যালয় এটি। নাম বলল 'গণ বিদ্যাপীঠ', যদিও সাইনবোর্ডে লেখা আছে 'গণপাঠশালা।' একই কথা। ৭৭ সালে প্রতিষ্ঠিত, পরে সরকারি হয়েছে। এই বিদ্যাপীঠের আঙিনার একটি গাছ থেকে বহু বছর পর টিয়া পাখির ডাক শুনেছি সেদিন। শৈশবে সাভার থাকতে এমন ডাক নিয়মিতই শুনতাম।

গণ পাঠশালার ঠিক পেছনেই 'গণস্বাস্থ্য পিএইচএ' ভবন। শুনেছি, বড় বড় অনেকগুলো অডিটরিয়াম আছে এই ভবনে। বিভিন্ন অনুষ্ঠান ও নাটক মঞ্চস্থ করার জন্য এই ভবন নির্মিত হয়েছে। তবে অনুষ্ঠান চলছিল বলে ভিতরে যাওয়া সমীচিন মনে করিনি। কিন্তু ভিতরে না গেলে কী হবে? চোখ জুড়িয়ে গেছে সামনের সুসজ্জিত বাগান আর বাঁধানো পথটা দেখে। পথটা ফরাসি ধাচের। সত্যি বলতে, মনে হচ্ছিল কোন এক ফরাসি পথ ধরে হাঁটছি আমি।

ওই লম্বা 'ফরাসি' পথ ধরে হেঁটে আরেকটা ফটক দিয়ে বের হয়ে গেলাম পুরনো ক্যাম্পাস থেকে। এখানেও ছিল নারী নিরাপত্তারক্ষী। গণ বিশ্ববিদ্যালয় ধামসোনা ইউনিয়নের নলাম গ্রামে ভিতরে পড়েছে। গেট দিয়ে বের হয়ে নলাম যাবার যে রাস্তায় উঠলাম ওটার নাম মাজার রোড। মাজারটা 'ঘোড়া পীর'-এর মাজার নামে পরিচিত। হযরত বদর শাহ কাশ্মীরি নামক পীর সাহেব ঘোড়ায় চড়ে চলাফেরা করতেন বলে এই নাম। একজন বলল, এখনো এখানে রাতের বেলায় সাদা ঘোড়া দেখা যায়। আমি বললাম, মাজারের কেউ গোপনে ঘোড়া এনে রেখে দেয় না তো! সে জবাব দিল, হতেও পারে। সত্য স্বীকার করায় ধন্যবাদসরূপ তার দিকে তাকিয়ে হাসলাম।


মাজার থেকে বের হয়ে দুপাশে তালগাছ-সজ্জিত কাঁচা রাস্তা ধরে দুই-তিন মিনিট হাঁটলেই গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন ক্যাম্পাস। নির্মানাধীন গেটের কাছে একটা অস্থায়ী ঘরে একজন নারী নিরাপত্তা রক্ষী বসে ছিলেন। তিনি জানালেন, এখানে ছুটির দিনে প্রবেশ নিষেধ। কিন্তু না বলে কয়ে এসেই যখন গেছি তখন কী আর করার। তিনি সংক্ষিপ্ত-ভ্রমণ অনুমোদন করলেন। কিন্তু কে শুনে কার কথা, ঘুরে ঘুরে যা যা দেখা দরকার তার সবই দেখেছি। বেশ লম্বা সময় কাটিয়েছি ওখানে। দৌড়াদৌড়ি করে তো আর বেড়ানো যায় না! এই ক্যাম্পাসে সুদৃশ্য তিন তলা প্রশাসনিক ভবন এবং ইংরেজি 'ই' অক্ষরের মত ছয় তলা একাডেমিক ভবন যে কারোরি ভাল লাগবে। আমারও লেগেছে। যতটুকু সম্ভব স্পষ্ট ফটোশট নেয়ার চেষ্টা করেছি। তবে দাঁড়াবার জায়গা না থাকায় বেশ বেগ পেতে হয়েছে। একাডেমিক ভবনের দোতলায় গণস্বাস্থ্য মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক লায়লা পারভীন বানু'র অফিস। তিনি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা।

এই একাডেমিক ভবনের সামনে ছোট একটা এনিমেল হাউজ। গবেষণার জন্য ইঁদুরসহ বিভিন্ন প্রাণি সংরক্ষণ করা হয় এখানে। শুনলাম, এরকম এনিমেল হাউজ নাকি আর কোন বিশ্ববিদ্যালয়েই নেই। এই এনিমেল হাউজ দেখে জর্জ অরওয়েলের এনিমেল ফার্ম-এর কথা কিছু সময়ের জন্য মাথায় ঘুরপাক খেল।

ঘুরতে ঘুরতে একটা ইন্টারেস্টিং তথ্যও জানলাম। নতুন ক্যাম্পাসের একাডেমিক ভবনের পাশেই নলাম গ্রামের মসজিদ। ড. জাফরুল্লাহ চৌধুরী নাকি এই মসজিদটি সরিয়ে দেয়ার উদ্যোগ নিয়েছেন। নতুন মসজিদ নির্মাণ করে দেওয়ার শর্তে গ্রামবাসীরও নাকি আপত্তি নেই এই উদ্যোগে। কিন্তু এই উদ্যোগ কতটুকু সফল হবে তা নিয়ে আমার সন্দেহ আছে। এদেশে অনেকেই তো এখন বারুদ খুঁজে বেরায়।

গণ বিশ্ববিদ্যালয় অনাবাসিক। কয়েকটি বাস দেখলাম তবে শিক্ষকদের জন্য। ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য কোন পরিবহন সুবিধা নেই। থাকলে ভাল হতো, থাকা উচিতও।

সব মিলিয়ে খুব ভাল লেগেছে এই গণ বিশ্ববিদ্যালয় ভ্রমণ। অনেক বছর পর এই ভ্রমণের সুবাদে টিয়াপাখির ডাক শুনেছি, লজ্জাবতী ফুল দেখেছি। আমার মত যারা এর আগে এখানে কখনো যাননি তারাও ইচ্ছা করলে যেতে পারেন। ঠকার সম্ভাবনা একদমই নেই। ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ে গেলে ভাল। পাবলিক বাসে গেলেও খুব বেশি সময় লাগবে না। রাস্তা ফাঁকা থাকলে ঢাকা থেকে মাত্র এক ঘন্টা। নবীনাগড় নেমে ২৫ টাকা ভাড়া দিয়ে রিকসায় করেও যাওয়া যায়। একটু ঝুঁকিপূর্ণ হলেও রিকসা ভ্রমণ ভালই লাগবে। আর সময় ও পূর্বানুমতি থাকলে মাজার রোডের 'গণ ফার্মা'টাও দেখে আসা যেতে পারে। বাংলাদেশে যে দুটি কারখানায় প্যাথেড্রিন তৈরি হয় এটা তার একটি।


ঘুরতে ঘুরতে ক্ষুধার্ত হয়ে পড়েছেন! কোন সমস্যা নেই। নবীনাগড়ের জয় রেস্তোরাঁ তো আছেই। আর বোনাস হিসেবে এর ঠিক পেছনেই আছে মৃৎ শিল্পের সুপরিচিত বাজার। খাওয়ার পর পকেট ঠিক থাকলে কেনাকাটাও হতে পারে।