পাখি, কিরণমালা এবং ওরা সাতাশ জন

Published : 29 July 2011, 04:13 AM
Updated : 12 July 2015, 12:06 PM

মাত্র সাতাশ জনের মৃত্যু হয়েছে! এমন বেশি কিছু তো হয়নি! প্রতিবারই এমন হয়। নতুন আর কী? যাকাতের কাপড় নিতে গিয়ে ময়মনসিংহে মাত্র এই কজন হতদরিদ্র নারী ও শিশুরই না হয় জীবন গেছে। তাই বলে আমাদের ঈদের আনন্দে কি কমতি হতে পারে?

ঢাকার শপিং মলগুলোতে এখন উৎসবের আমেজ আর উপচেপড়া ভিড়। ফুটপাতে কেনাবেচার পাশাপাশি নামিদামি শপিং মলের সামনে মানুষের ভিড়ে তিল ধারণের স্থান নেই। লাখ টাকা দিয়ে ভিনদেশি সিরিয়াল-মার্কা পোশাক কেনার মানুষের অভাব নেই এদেশে। গত বছর ছিল 'পাখি' নামধারী পোশাক আর এবার শুনছি 'কিরণমালা'র কথা। গতবার 'পাখি' পোশাক কিনতে গিয়ে অনেক অঘটনও ঘটেছে। উচ্চমূল্যের পোশাক কিনতে না পেরে আত্মহত্যাও করেছে দুচারজন। এ বছর আবার 'কিরণমালা' হাতে না পেয়ে কতজনের ঈদ নষ্ট হয় কে জানে।

সেই উদ্ভট পোশাকগুলো পরলে যদি সার্কাসের ক্লাউন বা যাত্রার ঐতিহাসিক নাটকের শাহাজাদীর মতো লাগে তাতেও আপত্তি নেই কারও। তবুও হাজার হাজার টাকা ব্যয় করে কিনতে হবে সেইসব 'যাত্রাপালা'মার্কা কুরুচিপূর্ণ পোশাক। অন্যদিকে প্রত্যন্ত অঞ্চলের হতদরিদ্র মানুষ হয়তো ঈদের দিন একটু ভালো খাবারের আশায় ভিড় জমাবে ধনী মানুষ কিংবা মসজিদের সামনে আর একটা লুঙ্গি কিংবা শাড়ি সংগ্রহের জন্য রোজার মাসে যাকাত নিতে গিয়ে পায়ের নিচে চাপা পড়ে প্রাণ হারাবে। কী নিদারুণ বৈষম্য!

আবার সেই আমরাই নাকি 'দরিদ্র' থেকে 'নিম্ন-মধ্যম' আয়ের সারিতে প্রবেশ করেছি। অংকের হিসাবে তা করেছি, কিন্তু ধনী-গরিবের বৈষম্য কি কমেছে? কমেছে হতদরিদ্র মানুষের জীবন-যন্ত্রণা? তাই যদি হবে, তাহলে এখনও কেন সামান্য একটি কাপড় সংগ্রহের জন্য জীবন দিতে হচ্ছে মানুষকে? যে নারী ও শিশুরা প্রাণ হারালেন, তাদের কথা ঈদের দিনে কি আমাদের একবারও মনে পড়বে?

প্রশ্নটির উত্তর দিতে পারবেন বিজ্ঞজনেরা। আমার মতো 'বোকা' মানুষের মাথায় শুধু এ ধরনের অবান্তর প্রশ্ন আসে। আরেকটি 'বোকা প্রশ্ন' না করে পারি না। তা হল, প্রতি বছরই যেখানে যাকাত প্রদানের সময় এমন মর্মান্তিক দুর্ঘটনা ঘটে, তখন একটু কি সতর্ক হতে পারে না বা আগাম ব্যবস্থা নিতে পারে না যাকাত প্রদানকারীরা? নিদেনপক্ষে যদি পুলিশেও খবর দিয়ে রাখে তাও হয়। আর এলাকায় কয়েক দিন ধরে যেখানে মাইকিং হচ্ছে সেখানে প্রশাসনও আগাম সর্তকতামূলক ব্যবস্থা নিতে পারত? বোঝা গেছে, দরিদ্র মানুষগুলো মরবে কী বাঁচবে তা নিয়ে মাথাই ঘামায়নি কেউ।

আর কয়েকশ মানুষকে একটি করে শাড়ি বা লুঙ্গি দিয়ে কী এমন উপকার হয় সে কথাও বুঝতে পারি না। বরং যাকাতের অর্থ দিয়ে যদি কজন দরিদ্র মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে দেওয়া যায় সেটি কি বেশি ভালো উদ্যোগ নয়? তাতে কি পূণ্য কিছু কম হবে না বেশি?

এ বছর যারা যাকাতের শাড়ি-লুঙ্গি সংগ্রহের জন্য জীবনবাজি রাখছেন, আগামী বছরও কিন্তু তাদের অবস্থার হেরফের হবার সম্ভাবনা নেই। তারা প্রতি বছরই এ রকম দরিদ্র থেকে যাচ্ছেন, প্রতি বারই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যাকাতের কাপড় সংগ্রহ করছেন। একটা কাপড়ে যে তাদের বছর কাটছে তাও কিন্তু নয়।

ধরে নিলাম একজন ধনী এক হাজার কিংবা পাঁচশ দরিদ্রকে কাপড় দিচ্ছেন। সমপরিমাণ অর্থে যদি দশ কিংবা পাঁচজনের স্থায়ীভাবে কর্মসংস্থান সম্ভব হয় তাহলে পূণ্য কিছু কম হয় না। ঐ দশজনকে যদি মুরগির খামার করা, সেলাই মেশিন কেনা বা একটি মুদির দোকান প্রতিষ্ঠার মতো কোনো আয়মূলক কাজের ব্যবস্থা করে দেওয়া হয় তাহলে তার স্থায়ী উপকার হয়। মানুষটি তাতে স্বাবলম্বী হতে পারেন। পরের বছর তার আর যাকাত গ্রহণের প্রয়োজন হবে না। বরং হয়তো কয়েক বছর পরে তিনি নিজেই অন্য দরিদ্রকে সাহায্য করার মতো সক্ষমতা অর্জন করতে পারবেন। এভাবে সমাজ থেকে কিছুটা হলেও তো দারিদ্র্য দূর হয়।

শুধু শিল্পপতিদের প্রদত্ত যাকাতের কথা বলছি না। যারা উচ্চ মধ্যবিত্ত এবং প্রতি বছর পনের-বিশটি কাপড় যাকাত দেন, তাদের কথাও বলছি। যারা পাঁচ থেকে দশ হাজার টাকা যাকাত দেন তারা যদি তাদের মতো কয়েক পরিবারের টাকা একসঙ্গে করে পাড়ার গরিব পরিবারটিকে স্বাবলম্বী হওয়ার মতো কিছু করে দেন তাহলে টাকাটা সঠিকভাবে ব্যয় হয়।

ঈদ পালন করতে অনেক ধনী সন্তানই শহর থেকে গ্রামে যান। তারা তাদের যাকাতের টাকা একত্র করে গ্রামের কজন দরিদ্রকে স্বাবলম্বী হওয়ার মতো কোনো কিছু করে দিতে পারেন। শহরেও অনেক পরিবারে ধনী আত্মীয়ের পাশাপাশি দরিদ্র আত্মীয় আছেন। ধনী আত্মীয়রা যাকাতের টাকা একত্র করে দরিদ্র আত্মীয়দের প্রতিষ্ঠিত করার জন্য কোনো আয়মূলক কাজের ব্যবস্থা করে দিতে পারেন।

অবশ্য এভাবে যাকাত দিলে শত শত মানুষকে নিম্নমানের শাড়ি-লুঙ্গি বিতরণ করে বাহবা পাওয়া সম্ভব হয় না। হাজারও মানুষের সামনে নিজেকে ধনী বলে প্রদর্শন করে আত্মশ্লাঘাও বোধ করা যায় না। দান নাকি এমনভাবে করা প্রয়োজন যাতে ডান হাত যখন দান করবে, বাম হাত তা জানতে পারবে না। তাহলে মাইকে কাপড় বিতরণের ঘোষণা দিয়ে, মানুষকে পায়ের নিচে পিষ্ট হবার পথ সৃষ্টি করে এ কেমন দান আর হতদরিদ্রদের নিয়ে প্রতি বছর ধনীদের এ কেমন তামাশা?

পাশাপাশি বলব, লাখ টাকা ব্যয় করে ভারতীয় ও পাকিস্তানি পোশাক ক্রয়কারীদের মানসিক দৈন্যতার প্রতি ঘৃণা ও করুণা প্রদর্শন ছাড়া কিছু করার নেই। আমরা সবাই যদি বিদেশি পোশাকের পরিবর্তে দেশীয় পোশাক পরে তাহলে দেশীয় শিল্পের পৃষ্ঠপোষকতা করা হত, খরচও কম হত এবং দেখতেও রুচিশীল লাগত। উচ্চমূল্যের ওই উদ্ভট পোশাকগুলোর পরিবর্তে কজন দরিদ্র রোগীর চিকিৎসা সম্ভব হত, কজন দরিদ্র শিক্ষার্থীর ব্যয় বহন করা যেত আর কজন দরিদ্র শিশুর ঈদের পোশাক কিনে দেওয়া যেত সে হিসাব কে কষবে?

যে 'বেকুব'রা পয়সা খরচ করে নিজের কদর্য রুচির পরিচয় দেয় তারা কি কখনও বুঝবে যে, চড়া দামের পোশাক পরলেই যে তাদের সবাইকে ঐশ্বরিয়ার মতো সুন্দর দেখাবে তা নয়। বরং কেনাকাটায় কিছুটা সংযমের পরিচয় দিলে মানসিকভাবে সুন্দর হওয়ার পথটা সহজ হয়ে যাবে।

শান্তা মারিয়া: সাংবাদিক।