প্রারম্ভঃ
আমি বলবো না আমি হিন্দু, আমি বলবো আমি মানুষ, আমি বাঙালি, আমি বাংলাদেশি। এই দেশের মানচিত্র গড়তে ত্রিশ লক্ষ মানুষ রক্ত দিয়েছে। সেই রক্তে কি আলাদা করে কোথাও লেখা ছিল হিন্দুর রক্ত, মুসলমানের রক্ত, বৌদ্ধর রক্ত, খ্রিস্টানের রক্ত, আদিবাসীর রক্ত। কোথাও লেখা ছিল না, দৈব লেখা থাকলেও তা দেখা সম্ভব না। তবুও কেন এই দেশের সব শ্রেণি, পেশার মানুষের ধর্মীয় বিশ্বাসে স্বাধীনভাবে মত প্রকাশ করার, স্বাধীনভাবে চলাফেরা করার অধিকার নেই? কেন এই দেশের তথাকথিত রাজনৈতিক দলের লোকজন, নেতাকর্মী, ধর্মীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ সমাজের লোকজন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর আঘাত হানে? এই প্রশ্নের উত্তর কারো জানা নেই।
কেন একজনের ধর্মীয় বিশ্বাসে আপনি আঘাত করবেন? কেন একজনের পবিত্র উপাসনালয়ে আপনি আঘাত করবেন? কেন আপনি নিজের বিশ্বাস আরেকজনের উপর চাপিয়ে দিবেন? কে আহমদিয়া সম্প্রদায়ের? কে শিয়া? কে সুন্নী? কে হিন্দু? কে বৌদ্ধ? কে খ্রিস্টান? কে আদিবাসী তা আপনার কি দরকার? কে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কি লিখল? কে কার বাপ মা তুলে গালাগাল করল? কে কার ধর্মের জাতগুষ্টি উদ্ধার করল তাতে আপনার কি? আপনি কে? কি আপনার পরিচয়? আপনি কি আদৌ নিজের ধর্ম পরিপূর্ণভাবে বিশ্বাস করেন? নাকি ধর্মে বেশভূষা নিয়ে রাস্তায় ঘুরে বেড়ান? আপনার ধর্মের পবিত্রগ্রন্থে কি লেখা আছে তা কি কখনো পড়ে দেখেছেন? নাকি শোনা কথায় গোটা জীবন, যৌবন পাড় করে দিয়েছেন? কে কি অজুহাত দিল তা মনে প্রাণে বিশ্বাস করে নিজের পবিত্র ধর্মকে ধর্মগ্রন্থকে অপমান করেছেন।
পৃথিবীতে এমন কোনো ধর্ম নেই, এমন কোনো ধর্মগ্রন্থ নেই, যেখানে লেখা আছে অন্যের ধর্মীয় বিশ্বাসে আঘাত করার কথা, অন্যের বিশ্বাসকে ভেঙ্গে চুরমার করে দেয়ার কথা, অন্য ধর্মের উপাসনালয়ে হামলা করার কথা। তবে কেন এই পৌশাচিকতা? কেন এই বর্বরতা? কেন?
তবে হ্যাঁ, আপনি যেই হোন না কেন, আপনি জানেন যে, এইসব ধর্মীয় উপাসনালয়ে আঘাত করলে, বর্বরতা চালালে আপনার বিচার হবে না। আপনি স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিক হয়ে মাথা উঁচু করে, বুক ফুলিয়ে চলতে ফিরতে পারবেন তাই আপনি এই কাজ করছেন তো। বেশ ভালো। সমস্যা নেই আপনার ঘরে এই শত্রু বড় আকার ধারণ করে আপনাকেই আঘাত করবে।
গত ৩০ অক্টোবর ২০১৬ তে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর, দত্তপাড়া, ঘোষপাড়া, গাংকুলপাড়া, মহাকালপাড়া, কাশিপাড়া, নমশুদ্রপাড়া, মালিপাড়া ও শীলপাড়ায় সহ বিভিন্ন জায়গায় শতাধিক হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষজনের বাড়িঘর লুটপাট করা হয়েছে। কমপক্ষে পনেরোটিরও বেশি মন্দির ভাঙ্গা হয়েছে। হিন্দু সম্প্রদায়ের নারীদের শ্লীলতাহানী করা হয়েছে। হিন্দু পুরুষদের মারধোর করা হয়েছে। এইসমস্ত কিছু করার পরও যা থাকে তা হল উসকানী। তা তো অনেক আগেই দেয়া শেষ। সর্বশান্ত হয়ে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোকজন হয়তো একটু সান্তনাই আশা করেছিল, সেই সান্তনার নামে গালিগালাজি করে বসলেন বর্তমান সরকার প্রধানের মহামান্য নেতা, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী ছায়েদুল হক।
সূত্রপাতঃ
মূলত উসকানী দিয়েই শুরু, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিভিন্ন মতের, বিভিন্ন ভাবনার লোকজন সামাজিক মাধ্যমে নিজস্ব মতামত দেন। তাতে কিছুসংখ্যক মানুষ থাকেন যাদের সুনির্দিষ্ট কোনো পরিচয় নেই তথা তারা ভুয়া আইডি দিয়ে ভিন্ন যেকোনো নাম দিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিজস্ব মতামত দেন। এই হামলার নেপথ্যেও রসরাজ নামের একজনের কথা শোনা যাচ্ছে। নামেই বোঝা যাচ্ছে রসরাজ নামধারী একজন হিন্দু। রামু হামলার পিছনেও উত্তম কুমার বড়ুয়া নামধারী বৌদ্ধ ধর্মের একজনের কথা আমরা জেনেছিলাম। এদের অস্তিত্ব নিয়ে আমি যথেস্ট সন্দিহান। এছাড়া যশোরের সাঁথিয়া বা মালোপাড়ায় সংখ্যালঘু ধর্মাবলম্বীদের উপাসনালয়ে হামলা, ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেয়ার পিছনে কারো নাম শোনা যায়নি। এই হামলাগুলোকে বর্তমান সরকারের মহামন্য মন্ত্রীদ্বয় বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে পাড় করে দিয়েছিলেন।
বিডিএসআইআরটি নামের সরকারি একটি প্রতিষ্ঠান আছে যাদের বিভিন্ন ধরনের কাজের মধ্যে অন্যতম কাজ হল বিভিন্ন আইটি বিষয়ক অপরাধীকে খুঁজে বের করা। বেশ কিছুদিন আগে বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একজন ব্যক্তি বাজে কথা লিখেছিল। তাকে খুঁজে বের করার জন্যে বিডিএসআইআরটি এত দ্রুত কাজ করেছে যে, তাদের প্রতিষ্ঠানের সর্বোচ্চ গতিপ্রাপ্ত কাজ ছিল এটি।
বিশ্বাস বা মূল্যবোধঃ
শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে একটি নির্দিষ্ট ধর্ম তার রীতিনীতি, আদাব-কেতা, আচার-সংস্কৃতি নিজ গুণে মানুষের মধ্যে প্রবাহিত করে সমৃদ্ধ হয়েছে। যুগের পর যুগ ধরে ধর্মীয় বিশ্বাস বা মূল্যবোধ নিয়ে মানুষ বড় হয়েছে। এই বিশ্বাস বা মূল্যবোধ বা রীতিনীতি, আদাব-কেতা কোনো একজন বিভ্রান্তকারীর জন্যে পরিবর্তন হয়ে যাবে না বা কেউ চাইলেই তা পরিবর্তনও সম্ভব নয়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কে কি লিখল তাতে করে কারো ধর্মীয় বিশ্বাসে আঘাত করা হয় না, বরং যৌক্তিক তর্ক হতে পারে, মতবিরোধ হতে পারে, যুক্তি খন্ডন চলতে পারে। এইসব বাদ দিয়ে সরাসরি অন্যধর্মের বিশ্বাসী মানুষজনের উপর আঘাত হানাটা অবিশ্বাসীর পরিচয়, কাপুরুষের পরিচয়।
বাংলাদেশের জন্মলগ্ন থেকে একশ্রেণির মানুষজন তথা গোষ্ঠী গোটা আন্দোলনকে ধর্মীয় দিকে মোড় নিতে চেয়েছিল। এরা অন্য কেউই নয় বাংলা ভাষাভাষী বিশ্বাসঘাতক, যারা মায়ের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে, নিজের মাতৃভূমির সাথে মীরজাফরের ন্যায় আচরণ করতে দ্বিধাবোধ করে না। সময়ের বিবর্তনে এরা কখনো জামায়াতে ইসলামী, কখনোবা অন্য নাম ধরে তাদের কার্যকলাপ চালায়। বর্তমান সরকারের শাসন ব্যবস্থায় এই গোষ্ঠীর কোনো ভূমিকাই নেই। তারা সবদিক থেকে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছে। কিন্তু তৃণমূলে থাকা লোকজন কিন্তু তাদের নোংরা আদর্শ থেকে সরে যায়নি। তারা নিজেদের নাম পাল্টে অন্য নাম ধরে বর্তমান সরকারের পক্ষ নিয়ে বিভিন্ন কার্যকলাপ চালিয়ে যাচ্ছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় হামলাকারী সংগঠনটি এইরকম হবে বলে আশা করা যায়। এতে করে উন্নয়নের ডামাঢোল ফেটে যাওয়ার মতো পরিস্থিতিও তৈরি হতে পারে। আমার ধারণা সরকার এই বিষয়ে কড়া নজর দিবেন।
যবনিকাঃ
১লা জুলাই ২০১৬ তে গুলশানে জঙ্গি হামলা কিন্তু একদিনের নয়। ছোট ছোট ভুল, অপরাধ, প্রতিহিংসা থেকেই কিন্তু গুলশানে জঙ্গি হামলার জন্ম। পাদ্রী হত্যা, পুরোহিত হত্যা, বৌদ্ধভিক্ষু হত্যা, মসজিদের ইমাম হত্যা, ধর্মীয় উপাসনালয়ে হামলা, অন্য ধর্মের মানুষজনের বাড়িতে হামলা, শ্লীলতাহানি, অগ্নিসংযোগ, কক্সবাজারের রামুতে হামলা, যশোরের সাঁথিয়ায় হামলা, মালোপাড়ায় হামলা, হেফাজতের মতিঝিল অ্যাটাক, চকবাজারে আহমদিয়া সম্প্রদায়ের উপর হামলা, শিয়া সম্প্রদায়ের মিছিলে হামলা, শোলাকিয়ায় ঈদগাহ'তে হামলা, দিনাজপুরে কীর্তন মন্ডপে হামলা এইসবকিছু একটু একটু করে জড়ো হতে হতে ১লা জুলাই ২০১৬ তে গুলশানে জঙ্গি হামলা। সমস্ত হত্যা, হামলা, ধ্বংসযজ্ঞ, অগ্নিসংযোগ, উপাসনালয়ে আঘাতের বিচার হলে এই পরিস্থিতি হয়তো আমাদের দেখতে হত না। বর্তমান সরকারের সমস্ত উন্নয়নকে মুখ থুবড়ে ফেলার জন্যে একটি ঘটনাই যথেস্ট। আমরা কেউই আবার সেই পুনরাবৃত্তি দেখতে চাইনা।
এই দেশের হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান তথা অন্য ধর্মাবলম্বী সবাই এই দেশের নাগরিক, তাদের নিরাপত্তা দেয়ার দায়িত্ব সরকারের। সরকার এই দায়িত্ব অবশ্যই পালন করবে। পালন করতে বাধ্য। কারণ সরকার, গণমানুষের সরকার। তার সাথে গোটা জাতির উচিত এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্যে একে অন্যের পাশাপাশি দাঁড়ানো, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবার প্রতি সবার সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়া।