ডে-কেয়ারের বৃদ্ধ রূপ

মো: আব্দুল আলীম খান
Published : 5 Nov 2016, 06:36 PM
Updated : 5 Nov 2016, 06:36 PM

সেদিন রাতে এয়ারপোর্ট হতে আমার এক আত্বীয়কে নিয়ে বাসায় ফিরতেছিলাম | রাত তখন প্রায় ১২টা হবে | আমার বাসা এয়ারপোর্ট হতে অদূরে হওয়াতে আমাকে মাঝে মাঝেই এই ধরণের মধুর যন্ত্রণা সহ্য করতে হয় | বিদেশ যাবার আগে কিংবা বিদেশ হতে ফেরার পথে নিকট আত্বীয়দের অনেকেই অন্তত একরাত থাকেন | মন্দ না | আমার ভাবি ফোন করে বললেন যে,তার বড় ভাই সিঙ্গাপুর হতে ফিরবেন |তাই ভাবির ছোট ভাই আগেই আমার এখানে চলে আসবে |এরপর দুজন মিলে তার বড় ভাইকে আনতে যেতে হবে |

ছোট ভাই আসলেন |আনতে গেলাম |মশার উপদ্রব উপেক্ষা করেই অপেক্ষা |অবশেষে আসলেন |বাসা কাছে বলে তিনজন একটা সি.এন.জি-তে চড়ে বসলাম সামানপত্র গুলো নিয়ে |অনেক হাসাহাসি হচ্ছিল বিভিন্ন বিষয় নিয়ে |কথার একফাঁকে আমি বলে বসলাম যে,বড় ভাই আপনার ছোট ছেলেটা নাকি সেই বুদ্ধিমান হইছে !!বুদ্ধিদীপ্ত কথা বলে আর দারুণ দারুণ উত্তর দেয় সব প্রশ্নের |তিনি দিলেন এক মজার উত্তর ! বললেন,আমিতো ওকে চিনিই না আর ও আমাকে চিনে না |

একটা হাসির রোল পড়ে গেল | হ্যা, চিনবে কী করে? ওই বড় ভাইয়ের দুই ছেলে | গতবার যখন গেছেন তখন ছোট ছেলেটা খুবই ছোট ছিল | উনার কাছে আসতো না | বলতো, উনি কে? তাহলে না চিনাটা দোষের কি? কথা সামনে আগাতে থাকলো |আমি বললাম,আবার যাবেন নাকি? বলল, বলা যাচ্ছেনা | তুমি বাসা বদলাইওনা | আমার জন্য তোমার বাসাটা খুব উপকারী |
আমি বললাম,আপনি টেনসন করবেন না |আমি ঢাকা থাকলে যে বাসাতেই থাকি না কেন,আমি আপনাকে দিয়ে এবং নিয়ে আসব | আবার হাসির রোল | কথা চলতে থাকলো |

কথার মাঝে আবার বলে উঠলাম,আচ্ছা ভাইয়া,বিদেশ আর না গেলে হয়না ? বললেন, হয় | তবে দেশে কি করবো? বললাম, আপনার বাপ দাদার এত এত সম্পত্তি | আপনাদের বাড়িতে কত লোক কাজ করে | আর আপনি দেশের বাইরে থাকেন বউ সন্তান ফেলে! দেশেই থাকেন | দেশেই কিছু একটা করেন |আপনাদের তো টাকা পয়সার অভাব নাই | হঠাত তিনি বলে উঠলেন,না না,আমি তো বউ-এর অনুমতি নিয়েই গেছি |আমাকে অনুমতি দিছিল | আমি তর্কে জড়াতে চাইলাম না |কিন্তু না বলে পারলাম |বললাম,অনুমতি দিছিলো না নিছিলেন ? বলল,মানে কি ?
বললাম,আপনি জিজ্ঞাসা করছেন,তাই না করতে পারে নাই |কাছে বসিয়ে পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়ে বলতেন যে আমি যেতে চাই,তুমি কি বলো ?তুমি বললে যাব,আর না বললে যাবনা |দেশেই কিছু করবো |তুমি যা বলো আমি তাই করবো | তোমাকে ছেড়ে যেতে মন চাইছে না |দেখতেন বলত যে,যাবার দরকার নাই |দেশেই থাকেন |আমার অত টাকা পয়সা লাগবেনা |আপনি যাবেন না |

শুনে হাসলো আর মাথা নাড়লো |যেন সবই মেনে নিলো |আর আমি মনে মনে ভাবতেছিলাম,বেচারী !অনুমতি কি আর এমনি দিছে !সংসার যাতে না ভাংগে সেই জন্যই হয়তো |নইলে বছরের পর বছর কেউ স্বামীকে বিদেশ থাকার অনুমতি দেয় ? বিড়বিড় করে কি যেন বললেন !এরপর আত্মপক্ষ সমর্থন করে বললেন,সবই বুঝি |কিন্তু কি করার আছে রে ভাই ?

আমি আর কি বলবো ?সান্তনা দিতে গিয়ে বললাম,আপনি বিদেশ না গেলে একটা অতি মূল্যবান জিনিস পেতেন | বললেন,কি ? বললাম,আপনার ছেলে আপনাকে চিনতো আর আপনিও আপনার ছেলেকে চিনতেন |আর এতে যে মহব্বত তৈরী হতো তার দাম কেউ দিয়ে পারবেনা | আবারও স্বীকার করলেন এবং আত্মপক্ষ সমর্থন করে বললেন,তা ঠিক | কিন্তু টাকা পয়সা জোগার না করলে পরে তো আর দেখবে না ! একেবারেই অযথার্থ উত্তর ছিল |

যাহোক,আমি বিরোধিতা না করে একটা সুযোগ তৈরী করলাম |বললাম,বড় ভাই বৃদ্ধাশ্রমের ধারণা কতটুকু আছে? বললেন, কেন? বললাম, ওখানে কারা থাকেন? বললেন, বৃদ্ধ বাপ-মা |
বললাম, তাদের সন্তান-সন্ততি আছে না? বললেন, বেশির ভাগেরই তো আছে মনে হয়| বললাম, মনে হয়না, আছে এবং তাদের অধিকাংশই প্রতিষ্ঠিত | আর এই প্রতিষ্ঠার পিছনে অবদান কার জানেন? বললেন, বাপ মার | বললাম, একদম ঠিক। কিন্তু আজ সেই বাপ মা ওখানে কেন? টাকা তো ঠিকই কামাই করে দিছিল? বললেন, তাদের তো টাইম নাই | বললাম, কেন? বললেন, কাজের চাপ | বললাম, কার জন্য এত কাজ, এত সময় খরচ এত আয়? বললেন, সন্তানদের জন্য | বললাম, তার সন্তানরা কি তার সাথে এমন আচরণ করবেনা? বললেন, করতে পারে | বললাম, করতে পারেনা, অবশ্যই করবে | জানতে চাইলেন, কেন? বললাম, দুইটা কারণ | প্রথমটা হলো, সে তার বাবা মার সাথে এমনটা করছে, তাই এটা তার প্রাপ্য | আর দুই নম্বর কারণ হলো,সে তার সন্তানদেরও সময় দিচ্ছেনা | ভালো করে খোঁজ নিয়ে দেখেন, আজ যে বাপ মা বৃদ্ধাশ্রমে আছেন, তারাও তাদের সন্তানদের সময় দেন নাই | শুধু বেশি বেশি টাকা আয় করেছেন আর সন্তানদের রেখেছেন ডে-কেয়ার এ | যখন বাবা মায়ের আদর দরকার ছিল, বিশেষ করে মায়ের, যা বাবা মায়ের সাথে আত্মিক সম্পর্ক গড়ে তোলার সময়, তখন তারা সময় দেন নাই | রেখেছেন ডে-কেয়ার সেন্টারে | তো আজ যখন বৃদ্ধ বাবা মায়ের সন্তানদের দরকার, তখন তারাও ব্যস্ত নিজ নিজ কাজে | সময় নাই | রেখেছেন অল কেয়ার সেন্টারে | আর তৈরী করেছেন, ফাদার ডে, মাদার ডে! যাতে বছরে একদিন অন্তত দেখা করা যায়  তাদের সুখী করতে | বললেন, তাই তো! এমন তো ভেবে দেখিনি! বললাম, ভাই,সব কিছুরই একটা হিসাব আছে | হিসাব মিলবেই| কিন্তু আমরা ভুল সূত্রে হিসাব করি আর অন্যের দোষ দেই! দোষ ওই বাপ মায়েরও ছিল| এখন সন্তানের| আবার এই সন্তানই বৃদ্ধ হয়ে তার সন্তানদের দোষারোপ করবে | কি অদ্ভুদ আর উদ্ভট আমাদের জীবন ধারা! তাই না, বড় ভাই?

কিছুক্ষণ চুপ থাকলেন | আমিও সুযোগ নিলাম | বুঝলাম কিছু ক্রিয়া বিক্রিয়া হচ্ছে মনের মাঝে |বললাম, যাবেন নাকি আবার বিদেশ ? বললেন, বলা যাচ্ছেনা | ভেবে দেখি | আমরাও ভাবতে থাকি|

কি হবার কথা ছিল,আর কি হচ্ছে? কেন হচ্ছে? আর কার জন্যই বা হচ্ছে? সব দোষ কি অন্যের? নিজদের কিছুই কি করার না ? বাবা মা যে ডে-কেয়ার এ রেখে সন্তানদের সুরক্ষা হবে ভেবে অমুল্য আদর সোহাগ বঞ্চিত করেছিলেন, আজ বৃদ্ধাশ্রমেও বাবা মায়ের সুরক্ষা হবে ভেবেই সন্তানরা তাদের সেখানে রেখেছেন | ডে-কেয়ার আজ বড় হয়ে বৃদ্ধাশ্রম হয়েছে! আগে বুঝেন নাই বাবা মা, আর এখন বুঝতেছেনা সন্তানেরা| কী হিসাব মিললো?