বিবেকের কাঠগড়া

মো: আব্দুল আলীম খান
Published : 14 Nov 2016, 01:09 AM
Updated : 14 Nov 2016, 01:09 AM

রুমে একটু কাজ করছিলাম। এমন সময় আমাদের মেসের এক বর্ডারের বড়ভাই,যে মাঝে মাঝেই বিভিন্ন চাকরির পরীক্ষা দিতে ঢাকায় আসেন, এবারো যথারীতি একই কাজে এসেছেন, আমার রুমে সালাম দিয়ে ঢুকলেন। আমি আমার রুমে একাই থাকি, নিজের কাজে ব্যস্ত থাকি বিধায় কেউ তেমন ঢোকেনা। তো ঢুকেই তিনি দরজাটা লক করতেছিলেন। বললাম, লক করার কি দরকার? কিছু বলবেন? বললেন, জ্বি ভাই, একটা পরামর্শ করতে হবে আপনার সাথে। বললাম, তাতে দরজা আটকানোর কি আছে? বললেন, বিষয়টা খুব গোপনীয় আর সেনসেটিভ।

আমি কাজ বন্ধ রেখে বললাম, বলেন আপনার গোপনীয় আর সেনসেটিভ বিষয়টা। এরপর, তিনি বললেন: ভাই, পরীক্ষা তো অনেক দিলাম, কিন্তু কোনো গতি তো হয়না। মানুষ নানা কথা বলে। অনেকেই ভালো ভালো চাকরিতে ঢুকে গেছে। এই জন্য আরো কথা শুনতে হয়। আর ভালো লাগেনা!

বললাম, ভাই অনেকের যখন হইছে, আপনারও হবে, একটু টাইম লাগবে, এইতো। ধৈর্য্য ধরেন। বললেন, ভাই ধৈর্য্য তো অনেক ধরলাম। মানুষের কথা আর ভালো লাগেনা! টাকা দিয়ে চাকরি নিছে, আবার বড় বড় কথা বলে। আর ভালো লাগেনা!

বললাম, দেখেন, তারা কি স্বীকার করে যে তারা টাকা দিয়ে চাকরি কিনছে? বললেন, না, তা করে না। কিন্তু আমরা তো জানি। আর খারাপ লাগে যখন শুনিয়ে শুনিয়ে বলে যে, কি রে, এত ভালো ছাত্র ছিলি, ভালো রেজাল্ট তো করলি। কিছু একটা কর। তখন বেশি খারাপ লাগে!

বললাম, ভাই, ভালো লাগানোর ওষুধ তো আমার কাছে নাই। তবে ভালো কিছু কথা শুনাতে পারি, আর ঐ টুকুই আমার সম্বল। বললেন, এই জন্যই তো আপনার কাছে এসেছি। বললাম, বলেন তাহলে, কি পরামর্শ? বললেন, ভাই, কেউ যাতে না জানে। মান সম্মানের ব্যাপার! বললাম, দরজা তো আটকাইছেন। ওপারে কথা যাবেনা। কিন্তু দরজারও নাকি কান থাকে! তবে আমার দরজার মনে হয় নাই। আপনি বলে ফেলেন।

বললেন, ভাই একটা ব্যাংকের পরীক্ষা দিতে এসেছি।  বললাম, ভালো কথা। সিট কোথায়? সাথে যেতে হবে? বুঝলেন যে দুষ্টুমি করতেছি। হেসে ফেললেন। বললেন, না না। ঢাকা শহরের অলি গলি মুখস্থ হয়ে গেছে। সাথে যেতে হবেনা। তবে বিষয়টা যে কি করে বলি!

আমি যে কথার ফাঁকে ফাঁকে খুব মজা করি তা সে ভালো করেই জানে। বললাম, বলতে অসুবিধা হলে বোবাদের মতো ইশারায় বলেন। আমি বুঝে নিচ্ছি। আর নয়তো লিখে দেন। আর তাতেও অসুবিধা হলে, আপনি বলেন, আমি লিখি। সে কি হাসি! বললেন, ভাই, দুষ্টুমি না, সিরিয়াসলি বলছি।  বললাম, সিরিয়াস হইছেন, কিন্তু বলেন নাই। এবার বলে ফেলেন কি এত মারাত্মক গোপনীয় কথা।  বললেন, ভাই আমি কখনো এমন অফার গ্রহণ করি নাই। এটা ঠিকও না।

বললাম, ভাই, আপনি কি গ্রহণ করেন নাই জানিনা। কিন্তু সেটা ঠিক যে না, সেটা আপনিই বলতেছেন। তাহলে আর পরামর্শের দরকার কি? নাকি আমার কাছে ঠিক করাতে আইছেন? আর বলতে তো হবে ব্যাপারটা কি? বললেন, ব্যাংকের প্রিলিমিনারির প্রশ্নটা দিবে, এক লক্ষ টাকা চাচ্ছে। লিখিতের জন্য আলাদা। তবে, লিখিততে আমি টিকবো নিজেই। এরপর ভাইভা পর্যন্ত গেলে তারাই দেখবে। বললাম, তো আমি কি করতে পারি? টাকা ইমার্জেন্সি ধার লাগবে? কিন্তু আমি তো গরিব মানুষ!

আবার হাসি! বললেন, কি যে বলেন ভাই! টাকা রেডি আছে। বললাম, তাহলে আমি কি গুণে দেবো? নাকি, আমাকে সাক্ষী রাখতে চান? বলেন, ভাই, খালি দুষ্টুমি করেন! আমি জানতে চাচ্ছিলাম, কাজটা ঠিক হবে কিনা? বললাম, ভাই, আপনি নিজেই বললেন একটু আগে যে, কাজটা ঠিক না। তো, সেটা তো ফায়সালা হয়েই আছে।

চা খাবেন, দাঁড়ান আমি চা বানিয়ে আনতেছি। মেজাজ খুব চড়ে গেছিলো। এসব নষ্ট কথা শুনতে শুনতে কান ঝালা ফালা! তাই, নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য একটা ব্রেক দিলাম আর কি। চা বানিয়ে নিয়ে আসলাম। দেখি মাথা নিচু করে বসে আছেন। মনে হয় লজ্জায়! হায়রে মানুষ, লজ্জাও পায়, আবার অন্যায় করতে মনও চায়! কোথায় পালাবে এমন দোটানায় নিজেকে রেখে?

চায়ের কাপটা হাতে দিয়ে বললাম, ভাই চা খান, চাঙ্গা হন। ধন্যবাদ দিতে দিতে বললেন, ভাই আমি জানি কাজটা ঠিক না। কিন্তু কি করবো  লেন? পরিস্থিতির স্বীকার। আবার দুষ্টুমি জুড়ে দিলাম! বললাম, ভাই ইদানিং একটা তথ্য পাচ্ছি সবার কাছ থেকে, আর সেটা থেকে একটা তত্ত্ব দাঁড় করাইছি যে, পরিস্থিতি একজন ভালো শিকারী এবং তার একটা অত্যন্ত কার্যকরী বন্দুক আছে! বিষয়টা বুঝতে পেরে অনেকক্ষণ চুপ থাকলেন। এরপর বললেন, ভাই সময় খুব কম। তাড়াতাড়ি জানাতে হবে। বলেন কি করি? বললাম, ভাই পরিস্থিতির বন্দুক আমার দিকেও তাক করা কতকাল ধরে তাতো জানেনই। তো, আমি কি পরামর্শ দিবো? আমরা মুসলমানের সন্তান, ব্যাঙ্ক জব নিয়ে এমনিতেই ঝামেলা আছে। বললেন, হ্যাঁ, হারাম। পুরাই মুফতি সাহেব। নিজেই মাসয়ালা দিয়ে ফায়সালা দিয়ে দিলেন। বললাম, এরপর কি আর কোনো পরামর্শের দরকার আছে? ঠিকই তো বলছেন।  বললেন, কিন্তু ভাই, এখন তো সবাই করতেছে।

বুঝলাম, যত কথাই বলি না কেন, সে একটা চূড়ান্ত কথা শুনতে চাচ্ছেন। সিদ্ধান্ত তো সে নিজেই নিবেন তা ভালো করেই জানা। তবুও সব সময় দুষ্টুমি করা ঠিক না। একটা আশা করে এসেছেন। তাই, আমি নিজেও একটু সিরিয়াস হলাম। বললাম, ভাই হালাল হারামে পরে আসতেছি। আগে দেশ উদ্ধার করে নেই। টাকা দিবেন কেন? বললেন, না হলে তো প্রশ্ন পাবোনা। বললাম, আলবৎ পাবেন, টাকা ছাড়াই পাবেন। ভীষণ খুশি। বললেন, ভাই বলেন, সিস্টেমটা কি? বললাম, পরীক্ষার রুমে সময়মতো চলেন যাবেন। ঠিক সময় মতো আপনার হাতে প্রশ্ন দিতে তারা বাধ্য! এইবার বেচারা মনই খারাপ করে বসলেন। আমি সান্ত্বনা দিতে গিয়ে বললাম, আচ্ছা ভাই, চাকরি দেয়ার আগে সরকারি কিংবা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো পরীক্ষা নেয় কেন? বললেন, যোগ্য প্রার্থীকে নেয়ার জন্য। পরীক্ষা তো কত কত লোক দেয়! বললাম, তাইতো! এভাবে তো ভেবে দেখি নি! তাহলে যোগ্যরাই চাকরি পাবে, সেখানে টাকা দিবেন কেন? বললেন, ভাই সেই দিন কি আর আছে? বললাম, কেন নাই? কে বদলালো? বললেন, মানুষেই। ভাই, টাকা দিয়ে অযোগ্যরা ঢুকে যাচ্ছে, তাই কিছুই করার নেই। টাকা দিয়ে হলেও এখন ঢুকতে হবে।

বোঝেন, নিতে এসেছে পরামর্শ। ফায়সালা সে নিজেই দিচ্ছেন, আবার আমার কাছে জানতে চাচ্ছেন! ঠেলা সামলান এবার! বললাম, ভাই, কেউ যদি টাকা না দিতো, তাহলে চাকরিটা কার হতো? বললেন, যার যোগাযোগ ভালো। বললাম, ধরেন যোগাযোগও নাই, তখন? বললেন, যে অধিক যোগ্য। বললাম, সেটাই তো চাই। তাহলে টাকা না দেন। যে যোগ্য তারই হবে। বললেন, সেইদিন আর নাই। বললাম, আচ্ছা, তাহলে যারা টাকা দিচ্ছে, তারা কি অন্যের হক মারতেছে না? বললেন, তা হবে কেন? বললাম, টাকা না দিলে আপনার হবেনা। টাকা দিলে হবে। তাহলে আপনি টাকা না দিলে যার হবে, আপনি টাকা দিলে তো তার হবেনা। কারণ, এক পোস্টে তো আর ডাবল নিবেনা। বললেন, তা ঠিক। বললাম, তাহলে কি ঐ ব্যক্তির হককে মারা হলোনা? অনেকক্ষণ চুপ থাকলেন। কথাটা যে তার মনে ধরেছে তা বুঝলাম। তো সুযোগ মতো বলেই ফেললাম, ভাই, আপনি এক লক্ষ টাকা নিয়ে একজনের হক মারা চেষ্টা করতেছেন, আর একজন হয়তো দুই লক্ষ টাকা নিয়ে আপনার হক মারা জন্য অপেক্ষা করতেছে। বাহ্! বিক্রিয়া ঘটে গেলো! বললেন, ভাই, তাইতো! কথা ঠিক। না করে দেই। ফোনটা হাতে নিয়ে বের হয়ে গেলেন।

কথাটা আমি এখানেই শেষ করতে পারতাম। কিন্তু, তাহলে তো আমার লিখার শিরোনাম পাল্টাতে হতো! পরের ঘটনার জন্যই এই শিরোনাম।
কিছুদিন পর শুনলাম সেই ভাই, সতেরো লক্ষ টাকা দিয়ে একটা এম.পি.ও ভুক্ত কলেজে ঢুকছেন আর সেই কলেজ কয়দিন আগে সরকারি হয়ে গেলো! কি তৃপ্তির আনন্দ তার চোখে মুখে। কোথায় উড়ে গেছে সেই হক মারার উপলব্ধি! বলে হয়তো ঐ দিন থামানো গেছিলো, কিন্তু আবার যখন সুযোগ এসেছে, তখন আর বিবেক কাজ করে নাই। হয়তো মনকে বুঝ দিয়েছে শিক্ষকতা তো হারাম না, কিন্তু হক মারা যে হারাম তা আর কাজ করে নাই বিবেকে।

একটা অতিরিক্ত কথা বলেই শেষ করছি। বি.সি.এস ভাইভার আগে বাড়ি হতে দুলা ভাইকে দিয়ে বলালো যে, এডমিট কার্ড দিতে। মন্ত্রী মশাইয়ের সাথে যোগাযোগ করবে। বললাম, তা কখনোই হতে পারেনা। না হলে না হবে, নসিবে না থাকলে কি আর হবে? বললেন, বেশি বুঝিস না। বললাম, তাহলে করেন যোগাযোগ, আমি ভাইভা দিতে যাবোনা। হবে তো? না, নসিবে ছিল না, ভাইভাতে ফেল করালো। কেন জানিনা। এরপর হতে তো আমি মহা অপরাধী। কারণ, তাদের কথাই ঠিক হলো যে!

আমি তাদের আজও বুঝাতে পারিনা যে, আমি পরীক্ষা খুব ভালো দিছিলাম, আর এই যোগাযোগ নীতিই আমাকে ফেল করাইছে। কেউ যোগাযোগ না করলে তো সৎদেরই বেছে নিতো। হয়তো এখন অনেকেরই হাত পা বাঁধা, অনেকেই লোভের কাছে পরাজিত! কিন্তু, তারাও তো মহাজ্ঞানী! ঐ যে, বিবেকের কাছে তারা বাধ্য না। নিজেকে কখনোই বিবেকের কাঠগড়ায় দাঁড় করান না!

আজ হয়তো আমি অনেকের কাছেই অবহেলিত, হয়তো অনেকের কাছেই বোকা, অনেকেই অনেক কথা বলে, যাকে দিল হতে চাই তার কাছে প্রত্যাক্ষিত স্ট্যান্ডার্ড কেউ না বলে! কিন্তু, আমার বিবেক আমাকে দংশায়না। আমি কারো কিংবা দেশের কোনো ক্ষতি করি নাই, এটা আমাকে আত্মতৃপ্তি দেয়। হয়তো অনেকেই আমার সাথে একমত হবেননা, এমনকি অনেকে তীব্র বিরোধিতাও করবেন। কিন্তু আমি ঢালাও ভাবে বলছি না যে, সব ক্ষেত্রেই পুরাপুরি এমন হচ্ছে। কিন্তু হচ্ছে যে, এটা অস্বীকার করলে সেটা মিথ্যা বলাই হবে।

আসুন না, নিজেকে নিজেরই বিবেকের কাঠগড়ায় দাঁড় করাই। একদিন তো মহাপরাক্রমশালীর সামনে দাঁড়াতেই হবে, সেদিন যেন আটকে না যাই। অন্তত এতটুকু বলার মুখ যেন থাকে যে, হে আমার রব, আমি জামানার অত্যাচারে জর্জরিত ছিলাম। তবুও অন্যের হককে মারি নাই, তোমার হক আদায়ে যা গাফেলতি হইছে, তুমি তা মাফ করে দিয়ে আমাকে চূড়ান্ত সফলতা দিয়ে দাও। সেদিন সব দুঃখ মুছে যাবে, ইনশা আল্লাহ।