জীবন নামের রেলগাড়িটা

মো: আব্দুল আলীম খান
Published : 10 Dec 2016, 00:16 AM
Updated : 10 Dec 2016, 00:16 AM

এয়ারপোর্ট রেল স্টেশন হতে রাত বারোটা পনেরো মিনিটে ট্রেন, যাবো চট্ট্রগ্রাম। আমরা তিনজন ছিলাম। আমি, রিয়াদ ভাই আর মহল্লার এক মুরুব্বি (আমিনুল ইসলাম ভাই)। আমরা সাড়ে এগারোটার দিকেই পৌঁছে গেলাম। বারোটার পর ঘোষণা হলো যে, চট্ট্রগ্রামগামী ট্রেনটা লেট হবে। অবশেষে একটার পর আসলো, পথে কিছু ছোটোখাটো ঝামেলা ছাড়া তেমন কোনো অসুবিধা হলোনা। সকাল আটটার দিক নামলাম গন্তব্যে। ট্রেনে এক সিট দূরে বসা একটা ছেলে রাতভর ছারপোকা মারতেছিলো আর সরকার ও রেলওয়ে বিভাগের গুণকীর্তন করতেছিলো। পাশের লোকজন হাসতেছিলো গভীর রাতেও।

তিনদিন পর আবার ট্রেনেই ফিরলাম ঢাকাতে। ফেরার পথে বেশ ঝামেলা পোহাতে হইছিলো। বেলা তিনটায় ট্রেন। বেশ আগেই রওনা দিছিলাম বাঁশখালী থানা থেকে। পথে বেবিটেক্সি নষ্ট হলো, এরপর টেম্পুতে উঠলাম। সেটাও নষ্ট হলো। এরপর অন্য টেম্পু, তারপর বাসে করে আসলাম চট্টগ্রাম স্টেশনে। জোহরের জামাত তো মিস বটেই, প্রায় আড়াইটা। জোহরের কছর নামাজ স্টেশনের মসজিদে পড়ে ট্রেনে উঠার আগে ভাবলাম কিছু শুকনা খাবার নিয়ে নেয়া যাক। কিন্তু সময় বেশি নাই। আর আমিনুল ইসলাম ভাইকে রেখে আমি আর রিয়াদ ভাই ফিরতেছিলাম ঢাকাতে। দু'জন না গিয়ে আমি দু'জনের সামানা (লাগেজ) নিয়ে মসজিদে থাকলাম আর রিয়াদ ভাই গেলেন খাবার আনতে। বললাম, বেশি সময় নাই, খুব দ্রুত ফিরেন কিন্তু। ভাই আমার খাবারের সন্ধানে সময় ভুলে গেছিলেন! বেলা দুইটা পঞ্চান্ন মিনিট, ভাইয়ের দেখা নাই। ট্রেন বাঁশি বাজাচ্ছে, কিন্তু আমার দিলের সাপ তো আর নাচে না! দুই মিনিট বাকি তিনটা বাজতে, ভাইয়ের দেখা নাই! একমিনিট বাকি, ভাইয়ের ছায়াও নাই! ট্রেন গড়াচ্ছে, আর আমার মেজাজ সীমা ছাড়াচ্ছে ধৈর্য্যের! টিকেট রিয়াদ ভাইয়ের কাছে, তার মোবাইল আমার কাছে! আমি ট্রেনে উঠলে লাভ নাই, টিকেট নাই, আর তাকে ফেলে একা কেনই বা ফিরবো। কিন্তু ঢাকাতে যে ফিরতেই হবে!

ট্রেন গড়াচ্ছে,আর রিয়াদ ভাই হেঁটে আসছেন দেখা যাচ্ছে! ইশারা করলাম দৌঁড়াতে। তিনি দৌঁড়াতে শুরু করলেন, আর ট্রেন মশাই তার গতি বাড়িয়ে দিলো! ভাবতেছিলাম, ভাই রে, আবার সেই বাঁশখালীই ফিরতে হবে? খাবার আনতে কেন যে পাঠালাম তাই ভেবেই নিজের উপর রাগ লাগতেছিলো। এখন ট্রেন মিস করে যে বাঁশটা খেতে হবে তার চেয়ে ট্রেনের পঁচা আর চড়া দামের খাবারই ভালো হতো। হায়রে বাঁশখালী, নিজে তো নামে, আর আমাদের বাঁশ খাওয়ালি! ট্রেন দৌড়ায়, আমি দৌড়াই, রিয়াদ ভাই দৌঁড়ান! রেস কম্পিটিশন, যন্ত্র আর মানবের! জিতে গেলাম! হ্যাঁ, সত্যি বলছি! শেষ বগি দিয়ে কোনো মতে উঠলাম, টেনে তুললাম ভাইকেও। পুরাই সিনেমার শুটিং ছিল যেন! হয়তো বা তাই। জীবন সিনেমার, যেখানে এক টেক দুইবার নেয়া হয়না, যে সিনেমার কোন হলে মুক্তি দেয়া হয়না। একবারই মুক্তি মেলে। যাহোক, ট্রেনে উঠে অনেকক্ষণ রিয়াদ ভাইয়ের সাথে কথা বলি নাই। আমার রাগের ব্যাপারটা তার জানা, তাই বুদ্ধিমানের মতো কিছুক্ষণ চুপ থাকলেন নিজেও। এরপর আস্তে আস্তে অনুতপ্তের সুরে বলতে লাগলেন, কাছে কোনো খাবারের দোকানই ছিলনা। বললাম, ফিরে আসতেন। বললো, যাক পেয়েছিতো, এভাবেই রিজিকে লিখা ছিল। বলার কিছুই থাকলো না। তবে দু'জনেই একযোগে হেসে উঠলাম একটা কথা বলে যে, তিনটার ট্রেন তিনটার আগেই ছাড়ে যে!

সত্যি, তিনদিন আগে মেজাজ খারাপ হচ্ছিলো অপেক্ষা করতে করতে, আর আজ ঠিক উল্টোটা! জীবন এমনই। চলছে গাড়ি, বাড়ছে গল্প। কলা খেতে খেতে বলতেছিলাম, বেটা কলা, তোরে আনতে গিয়ে বাঁশ আর কলা একসাথে খাচ্ছিলাম প্রায়! তোরে আর বেশি দূর নিমুনা! অনেক হাসাহাসি করতেছিলাম। মাঝখানে গিয়ে আসর নামাজ পড়ে আসলাম ট্রেনের মসজিদে। মাগরিবের আগেই আঁধার হয়ে আসতেছিল। ভীষণ অন্ধকার! মাগরিবও পড়ে আসলাম। শুরু হলো ঝড়, ভীষণ ঝড়! ভয় লাগতেছিলো বেশ। আস্তে আস্তে চলছিল ট্রেন। এরপর থেমেই গেলো! গাছ ভেঙে পড়ছে লাইনে, কেটে সড়াতে হবে, এরপর আবার যাত্রা শুরু। কি মুশকিল! ধৈর্য্যের খেলা যে আজ হারাতে বসেছে সেটা বুঝলাম। কিন্তু অধৈর্য্য হয়ে লাভ কি? নানা ঝামেলা পোহায়ে রাত দশটার জায়গায় দুইটায় আসলাম বাসায়, তবু তো বাসা স্টেশন হতে বেশি দূরে নয় বলেই। সেই ক্লান্তি কাটতে লেগেছিলো বেশ কয়েক দিন!

শুধু শুধু এই সংক্ষিপ্ত সফরের গল্প কেন শুনালাম? হ্যাঁ, তা এই জন্য যে, এই সংক্ষিপ্ত সফর আর ট্রেনের সাথে জীবনের একটা বড় মিল খুঁজে পাই যে! পুরাটা জীবনই একটা সফর! তবে তা কতদিনের তা জানা নেই কারো! হতে পারে পরের নিঃশ্বাসটাই শেষ, কিংবা আরো বেশ কিছুদিন চলবে এই জীবন গাড়ি! হ্যাঁ, ট্রেনের মতই আমাদের জীবনও একটা গাড়ি। চলছে অজানা গন্তব্যে। চলার পথে কখনো নানা রকম মনমাতানো দৃশ্য আনন্দে করে আত্মহারা! আবার কখনো ওঠে কালবৈশাখী ঝড়! তছনছ করে দেয় সাজানো অনেক কিছুই। প্রতিবন্ধক সড়িয়ে আবার চলতে হয় নতুন করে।

ট্রেন থামে, শিডিউল বিপর্যয় হলে আবার নতুন সময়ে চলে নতুন করে, ইঞ্জিন বিকল হলে তা পাল্টিয়ে নতুন ইঞ্জিন লাগিয়ে চলে। কিন্তু জীবনের ক্ষেত্রে সেটা সম্ভব নয়। জন্মের দিনই শুরু করছে চলা, শেষ স্টেশন কবর, তবে রাস্তা বড় আঁকাবাঁকা! থামার বা ইঞ্জিন বদলানোর কোনো সুযোগ নেই! তবুও দুটোই তো চলছে, দুটোই গন্তব্যের দিকে ধাবমান। একটার গন্তব্য জানা, অন্যটার অজানা। একটা গন্তব্যে থেমে আবার চলে নতুন ঠিকানায়, অন্যটা একবার থামে আর চলে না, করে চিরপ্রস্থান।  তবুও চলার পথে দুটোই ধাবমান। একটা যন্ত্র, আরেকটা মানব, এই যা পার্থক্য। জীবন তো একটা চলমান রেলগাড়িই, কি বলেন?