বই পড়বেন বই? কাগজের বই, ই-বই…

বিপুল আশরাফ
Published : 1 May 2012, 10:54 AM
Updated : 1 May 2012, 10:54 AM

প্রতিবার বাংলাদেশ থেকে আসার আগ মুহূর্তে মার সাথে একটা বিষয়ে অবধারিতভাবে দ্বিমত হবেই। সারা বছর ধরে বানিয়ে রাখা নানা ধরনের আচার দিয়ে তিনি আমার লাগেজ ভর্তি করার চেষ্টা করেন আর আমার প্রাণান্তকর চেষ্টা থাকে সেই আচার কমিয়ে কীভাবে তার পরিবর্তে আরও একটু বেশি বই লাগেজে ঢোকান যায়।তাঁর কথা, সঙ্গে একটু আচার থাকলে বিদেশে খাওয়াটা হয়ত একটু ভাল হয়, একটু বেশি-ই স্বাদ পাওয়া যায়। আচার দিয়ে না হয় জিহ্বার স্বাদ মেটানোর চেষ্টা করলাম কিন্তু বই না থাকলে যে মনের স্বাদ মিটবে না এটা তাকে কীভাবে বোঝাই?প্রবাসের এই একঘেয়ে জীবনে সারা দিন ক্লান্তিকর পরিশ্রমের পর রাতে ঘুমুতে যাবার আগে যদি একটুখানি বই পড়তে না পারি তাহলে ক্লান্তিটা মনে হয় আরও বেশি জেঁকে ধরে, বিষণ্ণ মন আরও বেশি বিষণ্ণ হয়ে যায়।

বই নিয়ে আমার ছোটবেলার মজার কিছু ঘটনা আছে। বাসা থেকে বই কেনার জন্য কোন টাকা পেতাম না। যখন একটু বড় হলাম, নীলক্ষেতে একা একা যাওয়া শিখলাম (আমাদের বাসা বুয়েট কোয়ার্টারে থাকার কারনে নীলক্ষেত খুব কাছেই ছিল) তখন প্রায়ই সেখানে গিয়ে বই নেড়েচেড়ে দেখতাম। কিনতে পারতাম না কিন্তু বই দেখতে তো সমস্যা নেই। যাই হোক একদিন নীলক্ষেতে ফুটপাতের উপর বই দেখছি, হঠাত খেয়াল করলাম দোকানি নেই, আমার হাতে তখন শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের 'চুরি' নামের একটা বই। মাথায় কী খেয়াল চাপল জানি না, 'চুরি' নামের বইটা চুরি করে দ্রুত সেখান থেকে পালিয়ে এলাম। পরে আমার খুব কাছের এক বন্ধুকে এই ঘটনার কথা বললাম। সে আমার দ্বারা বেশ ভালভাবেই অনুপ্রাণিত হল বলে মনে হল। একদিন গল্পগুচ্ছ কিনতে আমি আর আমার সেই বন্ধু নীলক্ষেত গেলাম। গল্পগুচ্ছ কেনার পর সেটা ওর হাতেই ছিল।এক দোকানিকে অন্যমনস্ক দেখে আমার সেই বন্ধুবর একটি বই লুকিয়ে নিয়ে যেই পা বাড়াতে যাবে অমনি দোকানি তাকে দাঁড়াতে বলল। একেবারে হাতেনাতে ধরা। আমি তখন দূরে দাঁড়িয়ে। ভাবখানা এমন যেন কাউকেই চিনি না। বেচারা যে বইখানা নিতে চেয়েছিল দোকানি সেটা তো রাখলই সাথে গল্পগুচ্ছটাও রেখে দিল। তবে আমি নিশ্চিত রবীন্দ্রনাথের গল্পগুচ্ছই সেদিন আমাদের গনপিটুনীর হাত থেকে বাঁচিয়েছিল। পরে অবশ্য ও আমাকে আরেকটা গল্পগুচ্ছ কিনে দিয়েছিল। কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার আমার সেই বন্ধুর সাথে কিছুদিন আগেও এ নিয়ে ফোনে কথা হল। হাসির দমকে অবশ্য কথা বেশিদূর আগাতে পারলাম না। ছোটবেলার আমার আরেকজন খুব কাছের বন্ধু রানা। তিন গোয়েন্দার নতুন বই বের হলেই ও কিনে ফেলত। সবসময় অপেক্ষায় থাকতাম কখন ওর পড়া শেষ হবে আর কখন পাব। কিন্তু দেখা যেত বেশ কয়েকজন লাইন ধরে আছে বইটা নেওয়ার জন্য। আবার বই নিলেও খুব দ্রুত ফেরত দিতে হবে কারন অন্য আরও অনেকেই পড়ার জন্য অপেক্ষা করছে। আমার এই বন্ধুটির কাছে আমি অসম্ভব কৃতজ্ঞ। কারণ ছোটবেলায় যা বই পড়েছি তাঁর প্রায় সব ওর কাছ থেকে নেওয়া। আজ যখনই ছোটবেলার বই পড়ার কথা মনে হয়, কিশোর বয়সের আমার সবচেয়ে কাছের এই বন্ধুটির কথা খুব মনে পড়ে।

ছোটবেলায় বইয়ের প্রতি এই তীব্র আকর্ষণ আমার জীবনে একটা দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলল। দশ বছর বয়সে মাকে এবং ইন্টারমিডিয়েট পড়াকালীন অবস্থায় বাবাকে হারানোর পর আমি একপ্রকার অভিভাবকহীন হয়ে গেলাম। আমার দ্বিতীয় মা (যার কথা লেখার শুরুতে বলা হয়েছে এবং যিনি এ পর্যন্ত আমাদের আগলে রেখেছেন পরম মমতায়) অতি সাধারন এবং সরল হওয়ার কারণে তাঁকে ফাঁকি দেওয়া কোন ব্যাপার ছিল না। সত্যিকার অর্থে আমি তখন জীবনকে বুঝতে শিখলাম, অবাক হয়ে খেয়াল করলাম, কোন অন্যায় কাজ করতে গেলে কোথায় যেন একটা প্রচ্ছন্ন বাধা পাচ্ছি। জীবনের সম্পূর্ণ 'স্বাধীনতা'কে উপভোগ করার সুযোগ পেয়েও স্রোতে গা ভাসিয়ে দিতে পারছিনা। বুঝতে পারলাম, এত দিন পড়ে আসা বই, সেগুলোর ভেতর যে চরিত্রগুলো থাকত তাদের আদর্শ আমাকে যা খুশি তাই করতে দিচ্ছে না। বইগুলো যেন আমার বিবেক আর মূল্যবোধকে সুনিপুণভাবে নিয়ন্ত্রণ করে চলেছে।

আমাদের ছেলেমেয়েরা কি জানে কতটা অপরিসীম শক্তির অধিকারী তারা? উচ্ছল, প্রাণবন্ত আর অসম্ভব সৃষ্টিশীল এই ছেলেমেয়েগুলো চাইলে কত কিছু করতে পারে? অথচ আজ প্রায়ই দেখি মানুষ কেমন করে যেন অমানুষ হয়ে যায়। যে মানুষগুলো প্রতিনিয়ত জীবন বাঁচানোর জন্য লড়ছে, কিছু অন্যায় করছে তাদের কথা না হয় বাদ দিলাম, কিন্তু যারা শিক্ষিত, সভ্য তাদের অনেকেই কেন অন্যায়ের স্রোতে এভাবে গা ভাসিয়ে দিচ্ছে? সমাজটাকে টেনে তোলার, অসহায় মানুষগুলোর অবস্থান পরিবর্তনে তো তাদেরই এগিয়ে আসার কথা ছিল। আমার সবসময় মনে হয়, আমাদের মূল্যবোধে বড় রকমের ঘাটতি আছে। আর এ ঘাটতির একটা বড় অংশই পূরণ করা যাবে যদি আমাদের তরুণ ছেলেমেয়েরা তাদের প্রত্যেককে মূল্যবোধসম্পন্ন ভাল মানুষে পরিণত করে, যারা শুধু নিজেকে নিয়েই ভাববে না, দেশকে নিয়ে দেশের মানুষকে নিয়ে ভাববে। এজন্য বইয়ের চেয়ে বড় অভিভাবক আর কে হতে পারে?বই পড়ার আগে একজন মানুষ যেরকম থাকে একটা ভাল বই পড়ার পর সে আর সেই মানুষটি থাকে না।ভাল কিছু বই খুব সহজেই ভাল কিছু মানুষ তৈরি করতে পারে।

বইয়ের উচ্চমূল্যের কারণে অনেকের পক্ষেই বই কেনা সম্ভব হয় না বিশেষ করে ছাত্রছাত্রীরা যারা বই সবচেয়ে বেশি আগ্রহ নিয়ে পড়ে তাদের পক্ষে বই কিনে পড়াটা প্রায়ই বেশ দুষ্কর হয়ে পড়ে। অথচ এই ছেলেমেয়েগুলো যদি ছোটবেলা থেকে নিয়মিত বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে পারত তাহলে হয়ত তাদের জীবনধারাটাই পরিবর্তন হয়ে যেত। জীবনটাকে এরা অন্যভাবে দেখতে শিখত। আর তাই অবাধে বই পড়ার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য আমরা গঠন করেছি 'স্বপ্নচারী' নামের একটি সংগঠনের। যে কেউ এখান থেকে বই নিয়ে পড়তে পারবেন বিনা দ্বিধায়, বিনামূল্যে। 'স্বপ্নচারী'র সংগ্রহে নেই এমন কোন বই যদি কেউ পড়তে চান তাহলে আমাদের ওয়েবসাইটে জানান, আমরা চেষ্টা করব বইগুলো সংগ্রহ করতে কারণ স্বপ্নচারীতে প্রতি মাসেই নতুন কিছু বই যুক্ত হবে ইনশাআল্লাহ। তবে স্বপ্নচারীর প্রায় সব সদস্যই যেহেতু বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী, তাই আমাদের সাধ্যও সীমিত। একারণে কেউ যদি তার পঠিত কোন বই অন্য সবাইকে পড়ার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য স্বপ্নচারীতে দিতে চান কিংবা আপনার পুরনো কোন বই আমাদের কাছে বিক্রি করতে চান, আমরা সাগ্রহে তা গ্রহণ করব।দেশের বাইরে যাদের অবস্থান তারাও যেন বই পড়তে পারেন সেজন্য রয়েছে আমাদের ই-বইয়ের ব্যবস্থা। প্রতিদিন আমাদের ওয়েবসাইটে একটি করে বইয়ের ডাউনলোড লিঙ্ক দেওয়া হবে।তবে আমরা সবসময় চাই, যাদের পক্ষে বই নেওয়া সম্ভব তারা যেন সরাসরি বই নিয়ে পড়েন। আমাদের কষ্ট এবং উদ্দেশ্য সার্থক হবে যদি আপনারা এবং আপনার পরিচিতজনেরা আমাদের সাথে থাকেন এবং বই নিয়ে পড়েন।