ক্ষমতাসীনদের সামনে কঠিন সময়

হাসান মামুনহাসান মামুন
Published : 23 March 2011, 08:05 AM
Updated : 8 July 2013, 10:03 AM

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী আজমত উল্লা খান যদি অল্পকিছু ভোটে জিতে যেতেন গাজীপুর সিটি করপোরেশনের প্রথম নির্বাচনটিতে, তাহলেও আমরা বলতাম তিনি খুব ভালো করেননি। তার একটা কারণ, প্রার্থী হিসেবে তিনি তো মন্দ ছিলেন না। সুপরিচিত ব্যক্তি- টঙ্গী পৌরসভার টানা ১৭ বছরের চেয়ারম্যান তিনি। এতদিন ধরে ক্ষমতা চর্চা করলে এ দেশে যে মাত্রায় দুর্নাম কামাই করার কথা, তিনি তাও করেননি।

এর চেয়ে বড় কথা, মেয়র নির্বাচনে তিনি দাঁড়িয়েছিলেন আহসানউল্লাহ মাস্টারের এলাকায়; টঙ্গী ও গাজীপুরে- যেটিকে বলা হয় 'গোপালগঞ্জের পর আওয়ামী লীগের দুর্গ'। নির্বাচনী বিপর্যয়ের সময়ও যে বুঝ থেকেই হোক- গাজীপুরের মানুষ দাঁড়িয়ে গেছে আওয়ামী লীগের পক্ষে। তাছাড়া গাজীপুর আয়তনের দিক থেকে দেশের সবচেয়ে বড় সিটি করপোরেশন তো হল বর্তমান শাসনামলেই। সেখানেই কিনা আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী আজমত উল্লা হারলেন এক লাখেরও বেশি ভোটে!

মনে পড়ে, বিএনপিসহ ১৮ দল সমর্থিত মেয়র প্রার্থী এম এ মান্নান প্রত্যয়ের সঙ্গে বলেছিলেন, তিনি এক থেকে দেড় লাখ ভোটের ব্যবধানে জিতবেন। অতটা নাও হতে পারত। কিন্তু হল অতটাই। নির্বাচনী প্রচারণার শেষদিকে মিডিয়া সূত্রে খবর মিলছিল, হাওয়া আজমত উল্লার দিকে ঘুরছে। চার সিটি নির্বাচনে সরকারি দল সমর্থিত মেয়র প্রার্থীরা একযোগে হেরে যাওয়ার পর তিনি নাকি জিতে যেতেও পারেন। আর হারলেও হারবেন অল্প ভোটে ইত্যাদি।

গাজীপুর নির্বাচন কভার করা এক স্নেহভাজন রিপোর্টার জানিয়েছিলেন, ধর্ম প্রতিমন্ত্রী থাকাকালে হজযাত্রীদের বাড়িভাড়া নিয়ে কেলেংকারি বিষয়ে তার বিরুদ্ধে লিফলেটিং হওয়ার পর মান্নান সাহেব নাকি বেকায়দায়। করখেলাপের অভিযোগে এনবিআর কর্তৃক তার ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ হওয়ার খবরও নাকি তার বিরুদ্ধে গেছে। এই লেখক দ্বিতীয় পয়েন্টটি সম্পর্কে ভিন্নমত পোষণ করে তাকে বলেছিলেন, এতে সরকার সমর্থিত প্রার্র্থীর জন্য হিতে বিপরীত হবে। ভোট গ্রহণের দু'একদিন আগে প্রশাসনকে দিয়ে এভাবে আর্থিক স্বচ্ছতা অনুসন্ধানের চেষ্টা ভোটাররা ভালোভাবে নেয় না। ওই প্রার্থীর প্রতি তারা বরং হয়ে পড়ে সহানুভূতিশীল।

অনেক বছর আগে হজ ব্যবস্থাপনায় সংঘটিত দুর্নীতির অভিযোগও মনে হয় না ভোটারদের প্রভাবিত করেছে। গাজীপুরের এক স্থানীয় বাসিন্দা ও সাংবাদিকের কাছ থেকে জানা গেল, মান্নান সাহেবের বিরুদ্ধে ওই লিফলেটিং হওয়ার পরদিনই আজমত সাহেবের বিরুদ্ধে (দীর্ঘ ১৭ বছর দায়িত্বে থাকাকালে) কোন পত্রিকায় কী রিপোর্ট হয়েছে, তার কাটিং পেস্ট করে চালানো হয়েছে পাল্টা প্রচার।

এ সবই নেতিবাচক রাজনীতি। নির্বাচনে এগুলো আমরা করে চলেছি অকুণ্ঠভাবে এবং ধরে নিয়েছি, শতাব্দীর পর শতাব্দী এগুলো করে যেতে হবে!

যাহোক, নির্বাচনী ফল তো পাওয়া গেল। রাজধানীর অদূরে সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠিত একটি স্থানীয় সরকার নির্বাচনে বিরোধী দল সমর্থিত মেয়র প্রার্থী জিতলেন বিপুল ভোটে। এটাকে বলা হচ্ছে আওয়ামী লীগের বড় একটা দূর্গে বিএনপিসহ বিরোধীদের হুড়মুড় করে ঢুকে পড়া।

জাহাঙ্গীর আলম নামে আওয়ামী লীগের এক বিদ্রোহী প্রার্থী ছিলেন সেখানে। সাবেক ছাত্রনেতা এ ব্যক্তি গাজীপুর উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান পদ ছেড়ে দাঁড়ান মেয়র নির্বাচনে। তাকে অবশ্য দাঁড়িয়ে থাকতে দেওয়া হয়নি। প্রার্থিতা প্রত্যাহারের সময় পেরিয়ে যাওয়ার পর তাকে যেভাবে খোদ প্রধানমন্ত্রীর সামনে এনে হাজির করে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াতে বাধ্য করা হয়, তাতে স্থানীয় সরকার আন্দোলনকারী তো বটেই- রাজনীতিসচেতন ও রুচিবান মানুষ মাত্রই কষ্ট পেয়েছেন।

নারায়ণগঞ্জ সিটি নির্বাচনেও আমরা দেখেছিলাম, বিএনপির এক সুপরিচিত প্রার্থী 'কেন্দ্রের নির্দেশে' প্রায় কাঁদতে কাঁদতে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিয়েছিলেন। সেখানে বিপুলভাবে জয়ী হন আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী সেলিনা হায়াৎ আইভি। ইতিবাচক ভাবমূর্তির আইভিকে মাঝে দেখা গিয়েছিল গাজীপুরে গিয়ে আজমত উল্লার পক্ষে প্রচারণায় শামিল হতে। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারাও গেছেন সেখানে; যেমন গেছেন বিএনপির।

সরকারপ্রধানের হস্তক্ষেপে এক তরুণ প্রার্থীকে বসিয়ে দেওয়াসহ যত কাণ্ড হয়েছে গাজীপুরে, তাতে কারও মনে হবে না যে, এটি একটি স্থানীয় সরকার নির্বাচন। আমরা অনেকে দুঃখ পেয়েছিলাম এর আগে চার সিটির নির্বাচনে স্থানীয় ইস্যুর ওপর জাতীয় ইস্যু প্রাধান্য পাওয়ায়। এবার দেখলাম, গাজীপুরে এটা আরও বেশি করে ঘটল।

মহাজোটের শরিক জাপা চেয়ারম্যান এ নির্বাচনে সমর্থন দেওয়া না দেওয়া নিয়ে শেষদিন পর্যন্ত যা যা করলেন, তাতেও নতুন করে লজ্জিত হতে হল রাজনীতিসচেতন মানুষকে। শেষ পর্যন্ত 'মহাজোটে আছি' বলে আজমত উল্লার প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করলেও ততদিনে তার যা ক্ষতি হওয়ার, তা কিন্তু হয়ে গেছে।

স্থানীয় জাপা বিভক্ত ও বিভ্রান্ত হয়ে যা পেরেছে করেছে গাজীপুর সিটি নির্বাচনে। তাদের অনেকে ক্ষুব্ধ হলেও কিছু তো করার নেই। এরশাদ সাহেবের স্বেচ্ছাচার মেনেই তাদের এ দলটি করতে হবে। আওয়ামী লীগ-বিএনপিও চেষ্টা করে যাবে জাপা তথা এরশাদকে সঙ্গে রাখতে। গাজীপুরে নাকি দলটির বাঁধা ভোট আছে। ওখানে গার্মেন্টশিল্পের একটা কেন্দ্রীভবন ঘটেছে। বিপুল সংখ্যক শ্রমিক ভোটার রয়েছে সেখানে। তাদের অধিকাংশই আবার উত্তরবঙ্গের আর এদের মধ্যে নাকি রয়েছে এরশাদের 'অপ্রতিরোধ্য প্রভাব'।

এমনটি মনে করা হলেও এতদিন পর এটা কতখানি সত্য কে জানে। এদিকে যুক্তরাষ্ট্রে জিএসপি স্থগিতের ফলে বাংলাদেশের গার্মেন্টশিল্প সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার তেমন কারণ নেই। তবু গাজীপুরের শ্রমিকদের নাকি বোঝানো হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের একটি সংবাদপত্রে বিরোধী নেত্রীর দেশবিরোধী নিবন্ধ প্রকাশের কারণেই জিএসপি 'বাতিল' হয়েছে আর এতে বিরাট ক্ষতি হতে চলেছে তাদের।

এগুলোর আদৌ কোনো প্রভাব কী পড়েছে শ্রমিক ভোটারদের ওপর? নাকি তাদের অনেকে ওই কারণে উল্টো ভেবেছেন- বেগম জিয়া তো তাহলে বিরাট প্রভাবশালী! সব নির্বাচনেই এমন নানা কিছু করা হয় ভোট টানতে। পরে আর এ বিষয়ে কোনো স্টাডি করা হয় না। মুখে মুখে কিছু কথা প্রচারিত হয় যে, এতে কাজ হয়েছে কিংবা ওতে।

এরশাদ সাহেবের দোদুল্যমানতায় গাজীপুরে উত্তরবঙ্গের ভোটাররা কতটা কী প্রভাবিত হয়েছেন, সে বিষয়ে কিন্তু একটা স্টাডি হওয়া দরকার। কারণ এ নিয়ে রাজনীতির উভয় পক্ষেই আমরা চরম নীতিহীনতার চর্চা দেখলাম। একটি স্থানীয় সরকার নির্বাচনে তার সমর্থন পেতে এরশাদের সঙ্গে বৈঠক করলেন খোদ প্রধানমন্ত্রী।

বিদ্রোহী প্রার্থীকে বসিয়ে দেওয়ার পর এ ইস্যুতেও গাজীপুরের ভোটাররা সরকারের ওপর বিরক্ত হয়েছে। (ব্যালট পেপারে নাম থেকে যাওয়ায়) আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী ভোট পেয়েছেন খুব অল্প। তবে তিনি মনে হয় অনেক ভোট নষ্ট করেছেন অফিসিয়াল প্রার্থীর। একবার একে, আরেকবার তাকে 'দোয়া' বিতরণকারী এরশাদও কম ভোট নষ্ট করেননি আজমত উল্লার।

ভোটের ব্যবধান অবশ্য বলে দেয়, এসব না ঘটলেও কমপক্ষে ৫০ হাজার ভোটে হারতেন আওয়ামী লীগ সমর্থিত মেয়র প্রার্থী। যেমন আমরা লক্ষ্য করি, সেখানে অর্ধেকের বেশি কাউন্সিলর পদে হেরে গেছেন সরকার সমর্থিতরা। একই দিনে আরও তিনটি পৌরসভায় নির্বাচনের আয়োজন করে ইসি। এর দুটিতে ক্ষমতাসীন দলের অফিসিয়াল প্রার্থী হেরেছেন মেয়র পদে; অন্য একটিতে জিতেছেন বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী।

একের পর এক এসব ঘটনা ক্ষমতাসীনদের বুকের পানি শুকিয়ে দেওয়ার কথা। অনেকে অবশ্য আশায় ছিলেন, আদি সমর্থকদের নিয়ে আপন ভুবন গাজীপুরে ঘুরে দাঁড়াবে আওয়ামী লীগ। তা আর হল না। আজমত উল্লা সাহেব এখানে স্পষ্টতই হারলেন জাতীয় রাজনীতি ও ইস্যু শুরু থেকে প্রাধান্য বিস্তার করায়।

গাজীপুরের বড় একটা অংশ এরই মধ্যে হয়ে উঠেছে শিল্প এলাকা। জমির দাম বেড়েছে এখানে লাফিয়ে। শ্রমিকের বসবাস বেড়েছে। এখানকার উদ্যোক্তাদের রয়েছে বিশেষভাবে গ্যাস প্রাপ্তির সমস্যা। রাস্তাঘাটসহ যাতায়াত সমস্যাও কম নয়। অথচ গাজীপুর সিটি করপোরেশনের প্রথম নির্বাচনে এগুলো কোনো ইস্যু হতে দেখলাম না আমরা।

এখানেও ইস্যু নাকি হয়েছে শাপলা চত্বরে পুলিশের মধ্যরাতের অভিযান। হেফাজতে ইসলামের লোকজন বিশেষত গ্রামের দিকে ঘরে ঘরে গিয়ে বুঝিয়েছে, কেন 'ইসলামরক্ষায়' আজমত উল্লাকে ভোট দেওয়া যাবে না। পুলিশের সঙ্গে সংঘাতে রাস্তায় সেদিন যারা মারা যান, তাদের কয়েকজন নাকি আবার গাজীপুরের মানুষ।

এ অবস্থায় আজমত সাহেবকেও হেফাজত নামধারী কয়েকজনকে সঙ্গে রেখে প্রচারণা চালাতে হয়। হেরে যাওয়া নির্বাচনে এ ধরনের কৌশল আওয়ামী লীগকে নিতে দেখা গেছে অতীতেও। এর সুফল-কুফল নিয়ে কোনো পর্যালোচনা দলটি করেছে বলে শোনা যায় না। তবে মনে হয়, ক্ষমতায় থাকাকালে বহুল প্রচারিত কিছু নেতিবাচক ঘটনা ও তাদের আচরণগত কারণে দলটি যখন ভাবমূর্তির সংকটে পড়ে, তখনই বেশি কার্যকর হয়ে ওঠে তার বিরুদ্ধে অপপ্রচার।

অর্থনীতি পরিচালনাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বর্তমান সরকারের সাফল্যের পাল্লা কম ভারি বলা যাবে না। তারপরও কিছু অপঘটনা ও আচরণে এবং সেগুলো 'ম্যানেজ' করতে ও নিজেদের সংশোধনে ব্যর্থতায় মেয়াদের শেষ সময়ে তারা বেশি করে পড়ে গেছেন সংকটে।

এখানে তার তালিকা দেব না। প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় এগুলোর কথা নতুন করে বলা হবে এখন। সরকারকে বলা হবে- এখনও সময় আছে, সংশোধিত হোন। মেয়াদের একেবারে শেষ সময়ে সংশোধিত হওয়াটা কিন্তু কঠিন। নতুন নতুন ভুলে জড়িয়ে পড়ার শংকাই বরং বেশি।

একটি জরুরি কাজ করতে তো সরকার এরই মধ্যে অনেক দেরি করে ফেলেছে। সেটি হল, জাতীয় নির্বাচন ব্যবস্থাপনা নিয়ে সৃষ্ট নতুন সংকট নিরসনে সংলাপের আয়োজন। ক্রমে শক্তিশালী হয়ে উঠছে যে বিরোধী দল, তাকে গুরুত্বের সঙ্গে না নিয়ে হেঁয়ালিপূর্ণ আচরণও সরকারের প্রতি মানুষকে বীতশ্রদ্ধ করে তুলছে।

ধর্মীয় ও নৃতাত্ত্বিক সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীও নাকি সরকারের ওপর আর আস্থা রাখতে পারছে না। সিলেট সিটি নির্বাচনে তাদের সমর্থিত প্রার্থীকে ভোট দেওয়ায় ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের রীতিমতো লিখিতভাবে ধন্যবাদ জানিয়েছেন বিরোধী নেত্রী। গাজীপুরের সংখ্যালঘুপ্রধান এলাকাগুলোয় কী ফল হয়েছে, সেটিও এখন দেখার বিষয়।

বিগত জাতীয় নির্বাচনে সংখ্যাগুরু আর লঘু নির্বিশেষে দৃশ্যত সবার আস্থাই বিপুলভাবে অর্জন করেছিল আওয়ামী লীগ। গাজীপুরে কঠিনভাবে বোঝা গেল, সে আস্থায় চিড় নয়- ফাটল ধরেছে। এটি বোঝা গিয়েছিল বরিশাল আর রাজশাহী সিটি নির্বাচনেও, যেখানে তাদের সমর্থিত মেয়র প্রার্থীরা দাঁড়াতেই পারেননি নিজেদের সুকর্মগুলো নিয়েও।

সরকারবিরোধী প্রার্থীদের কার্যত এখন কিছুই করতে হচ্ছে না। শুধু কষ্ট করে দাঁড়াতে হচ্ছে নির্বাচনে। তাদের ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে নেতিবাচক ভোট। এর মর্মবস্তু তারা কতটা বুঝতে পারছেন, সে প্রশ্ন অবশ্য রয়েছে। বুঝতে পারলেই ভালো। তাতে জনগণ প্রদত্ত ক্ষমতা চর্চায় কিছুটা হলেও পরিবর্তন আসার সম্ভাবনা। আর আমরা তো পরিবর্তনই চাইছি- কেন্দ্র থেকে স্থানীয় সরকারে।

হাসান মামুন : সাংবাদিক