সমকামী ব্যক্তি আমাদেরই ভাই, আমাদেরই বোন!

শাহানূর ইসলাম সৈকত
Published : 17 June 2016, 06:16 AM
Updated : 17 June 2016, 06:16 AM

গত ৫ জুন মধ্য রাতে আমেরিকার ফ্লোরিডা অঙ্গরাজ্যের অরল্যান্ডোতে সমকামী নৈশক্লাবে বন্দুক হামলার মাধ্যমে ৪৯ জন সমকামী ব্যক্তিকে হত্যা অথবা গত ২৫ মে সন্ধ্যায় বাংলাদেশের প্রথম সমকামী বাংলা ম্যাগাজিনের সম্পাদক জুলহাজ মান্নান ও তাঁর বন্ধু তন্ময়কে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে হত্যার বিষয়গুলো কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। বরং মানব সভ্যতার শুরু থকে সমকামিদের প্রতি প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক বৈষম্যের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাবে উল্লেখিত হত্যাকান্ড সংঘটিত হয়েছে।

সমাকামিতার ইতিহাসের দিকে নজর দিলে আমারা দেখতে পাই যে, যদিও মানব সভ্যতার শুরু থেকে সমকামিতার অস্তিত্ব লক্ষ্য করা যায়, তথাপি বাংলাদেশসহ বিশ্বের অধিকাংশ রাষ্ট্রের সংবিধান এখনো বিষয়টিকে স্বীকৃতি দেয়নি। অধিকন্তু সমকামিতাকে অপরাধ বলে গন্য করে আইন প্রণয়নের মাধ্যমে বিশ্বের অধিকাংশ রাষ্ট্র আইনগতভাবে সমকামি ব্যক্তিদের প্রতি বৈষম্য করে চলেছে। যদিও মৌলিক মানবাধিকার তথা নাগরিক অধিকার যথা স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশ ও সমিতি/সংগঠন করা এবং আইন প্রণয়ন ও বিচার প্রক্রিয়ায় জাতি, ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ ও যৌনপ্রবৃত্তি/আচরণ প্রভূত বিশ্বাস নির্বিশেষে সকল নাগরিক রাষ্ট্রের কাছ থেকে সমান অধিকার ও ব্যবহার পাওয়ার অধিকারী, বাস্তবে একাবিংশ শতাব্দীতে এসেও এখনো সেসব অধিকার শুধু ত্বাত্ত্বিকভাবে কাগজে কলমে রয়ে গেছে।

বিভিন্ন সময় সংগঠিত নারীর অধিকার ও শ্রমিকের অধিকার আন্দোলনের মত বিভিন্ন সফল আন্দোলনের দ্বারা তাড়িত হয়ে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চল বিশেষত ইউরোপিয়ান ও আমারিকান সমাকামী নাগরিক সমাজ নিজেদের সংগঠিত করে সমাজের আর দশজন মানুষের মত সমঅধিকার ও সামাজিক ন্যায়বিচার (যা থেকে তারা এখনো বঞ্চিত) পাওয়ার জন্য অন্দোলন শুরু করে। ফলে তাদের সমকামি অধিকার বিরোধী একটি দলের প্রতিরোধের মুখে পড়তে হয়, যা পরবর্তীতে একটি বিতর্কিত ধর্মীয় ও আইনী লড়ায়ে রূপ নেই এবং তা এখনো চলছে।

সমকামী অধিকার বিষয়ক ইতিহাসের দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে, সমকামি অধিকারের বিষয়টিকে যুক্তিসংগত ও গুরুত্বপূর্ণভাবে বিচার না করে অধিকাংশ ক্ষেত্রে সমকামীদের বিরুদ্ধে সাধারণ কুসংস্কার ও যুক্তিহীন পক্ষপাতমূলক সাধারণ বিতর্কিত যুক্তি উত্থাপন করা হয়।

কোন ব্যক্তি যদি একই লিঙ্গের কোন ব্যক্তির প্রতি শারীরিক বাঁ মানসিক ভাবে যৌন আকর্ষন অনুভব করে সাধারণভাবে আমরা তাঁকে সমকামি ব্যক্তি বলে সংজ্ঞায়িত করে থাকি। তাছাড়া, আমরা সচরাচর সমকামি ব্যক্তির পরিবর্তে "গে" বলতে বেশী স্বাচ্ছন্দ বোধ করি, যদিও নারী সমকামিদের আমরা "লেসবিয়ান" হিসেবেই সম্বোধন করে থাকি। সমকামিতার এই মৌলিকতা আমাদের দেখিয়ে দেই যে সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে যৌনপ্রবৃত্তিগত/আচরণগত এই সংখ্যালঘু সম্প্রদায় অবস্থান করছে। যদিও আমাদের ভুল ধারনা রয়েছে যে, শুধুমাত্র পশ্চিমা সংস্কৃতি ও ইহুদি-খ্রীষ্টান্দের মধ্যে সমকামিতা প্রচলিত, কিন্তু বাস্তব হলো বিশ্বের সকল শ্রেণী, পেশা, জাতি, ধর্ম, বর্ণ, অবস্থান, বয়স, নারী,পুরুষ নির্বিশেষে সর্বত্র সমকামিতা বিদ্যমান রয়েছে।

একটু দৃষ্টি দিলেই আমরা দেখি যে, বিশ্বের প্রতিটি দেশেই পরিবার থেকে সমাজ, সমাজ থেকে রাষ্ট্র সর্বত্র সমকামি ব্যক্তির প্রতি বৈষম্য করা হয়। সমকামি ব্যক্তি শুধুমাত্র যে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের নিকট থেকে বৈষম্যের শিকার হচ্ছে তা নয়, অধিকন্তু শুধুমাত্র সমকামী হওয়ায় তারা তাদের পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের নিকট থেকে শারীরিক, মানসিক, অর্থনৈতিক নির্যাতন ও হয়রানীর শিকার হচ্ছে। অন্যান্য দেশের মত বাংলাদেশেও সমকামিতাকে প্রকৃতির বিরুদ্ধে কার্যক্রম বলে অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। দণ্ডবিধির ৩৭৭ ধারায় সমকামিতাকে অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করে সমকামিতা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। অন্যথায়, উক্ত ধারায় কৃত অপরাধের জন্য যাবৎজ্জীবন অথবা অনধিক দশ বছরের সশ্রম কারাদণ্ডের বিধান করে সমকামী ব্যক্তির মৌলিক মানবাধিকারকে অস্বীকার করা হয়েছে।

এককভাবে শুধুমাত্র সমকামি যৌনপ্রবৃত্তিগত/আচরণগত সংখ্যালঘু হওয়ায় সমাকামি ব্যক্তি তার সহপাঠী, সহকর্মি এমনকি পরিবারের সদস্য দ্বারা প্রায়শ অপমান ও অবহেলা করা, চরথাপ্পর ও লাথি মারাসহ বিভিন্নভাবে শারীরিক, মানসিক, যৌন ও আর্থিক নির্যাতন ও হয়রানীর শিকার হয়ে থাকে। এই বৈষম্য, নির্যাতন ও হয়রানী সমাজে বিদ্যমান সমকামিতা সম্পর্কিত কুসংস্কার ও চিরাচরিত মনোভাবেরই প্রতিফলন। সমকামি ব্যক্তিরা শিশু নিপীড়ক ও যৌন বিকারগ্রস্ত অথবা সমকামিতা সম্পূর্ণরূপে অনৈতিক, কারণ তারা সমাজের প্রচলিত প্রথা বা রীতি-নীতি অনুসরন করে না বা সমকামিতা মানুষের যৌনাঙ্গের প্রচলিত কার্য বিরোধী বিধায় প্রকৃতি বিরোধী যৌনাচার করে- সমকামিতা সম্পর্কিত সমাজে প্রচলিত উল্লেখিত বিভিন্ন কুসংস্কার ও চিরাচরিত মনোভাবের ফলে সবার মাঝে তাদের প্রতি একধরণের ভীতি ও অবহেলা দেখা যায়।

আমরা বুঝতে চাই না যে, সমকামিতা এমন একটি সহজাত যৌন প্রবৃত্তি/আচরণত বৈশিষ্ট্য যা একজন শিশু জন্মের সাথে পেয়ে থাকে। বিষমকামী ব্যক্তির যেমন বিষমকামী হওয়া বা না হওয়ায় ক্ষেত্রে নিজের কোন পছন্দ/অপছন্দ বা করণীয় কিছু থাকে না, তেমনি সমকামী ব্যক্তিও সমকামি হওয়া বা না হওয়ায় ক্ষেত্রে নিজের কোন পছন্দ/অপছন্দ বা করণীয় কিছু থাকে না। তাছাড়া, একজন ব্যক্তির নৃতাত্ত্বিক ও জাতিগত পরিচয় কি হবে বা তাঁর বাহ্যিক চেহারা কেমন হবে বা তিনি কোন সমাজে জন্মগ্রহণ করবে তাতে যেমন তাঁর কোন নিয়ন্ত্রণ থাকে না, তেমনি তাঁর যৌন প্রবৃত্তি/আচরণ কেমন হবে তাতেও তাঁর কোন নিয়ন্ত্রণ থাকে না। সবই নির্ধারণ হয় প্রাকৃতিকভাবে তাঁর জন্মের সাথে সাথে বা জন্মের পূর্বে গর্ভাবস্থায়। অধিকন্তু, ইম্পেরিয়াল রিসার্চ অন অ্যাডাল্ট সেক্সুয়াল অরিয়েন্টেশন এন্ড মোলেশট্রেশন শীর্ষক একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে, বিষমকামী ব্যক্তি সমকামী ব্যক্তির চেয়ে বেশী শিশু নিপীড়নকারী।

যদিও পাশ্চাত্ত্বের সমাজে বর্তমানে সমকামিতা অনেকাংশে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে, তবুও অতীতে দাসরা যেমন স্বাধীনতাহীনতাসহ বিভিন্নভাবে তাদের মালিকের কাছ থেকে বৈষম্যের শিকার হত, তেমনি বর্তমান সময়ে বাংলাদেশে সমকামি ব্যক্তি সমাজে গ্রহণযোগ্যতার অভাবে এখনো তথাকথিত অদৃশ্য সংখ্যালঘু হিসেবে বেঁচে আছে। যদিও সরকার হিজরাদের আইনগতভাবে তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে, কিন্তু সমাজের প্রচলিত চিরাচরিত মনোভাব ও ধর্মীয় বিষয়াদি বিবেচনায় নিয়ে এখনো সমকামি ব্যক্তির অধিকার প্রতিষ্ঠায় দণ্ডবিধির ৩৭৭ ধারা বাতিলসহ অন্য কোন উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। বরং দণ্ডবিধির ৩৭৭ ধারা ব্যবহার করে সরকার আইনের চোখে সবাই সমান এবং সমানভাবে সুরক্ষা পাওয়া সংক্রান্ত সমকামি ব্যক্তির সাংবিধানিক অধিকার প্রতিনিয়ন লঙ্ঘন করে চলেছে।

সমাজের আনুমানিক দশ শতাংশ সমকামী ব্যক্তিকে মুল জনস্রোতে সংপৃক্ত না করে উন্নত রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখা হবে বোকামি। তাই, সমকামি ব্যক্তির সুরক্ষা ও অধিকারের বিষয়টি পাশ কাটিয়ে না গিয়ে সরকারকে তা গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করতে হবে। যুগের সাথে তাল মিলিয়ে সমাজের সকল স্তরের মানুষের মাঝে সমকামিতা সম্পর্কে সঠিক তথ্য উপস্থাপন করে সমাজে তাদের গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধির ব্যবস্থা করতে হবে এবং তাদের প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য, নির্যাতন ও অবহেলা বন্ধ করতে হবে। একই সাথে দণ্ডবিধির ৩৭৭ ধারা বাতিল করে সমকামি ব্যক্তি সুরক্ষা প্রদান আইন প্রণয়ন করে তাদের সাংবিধানিক অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। তবেই একুশ শতকের উন্নত সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন পুর্ণ হবে।