দি গ্যাদারিং : জীবনের বহু মাত্রা

রাজু আলাউদ্দিন
Published : 25 Oct 2007, 05:23 PM
Updated : 25 Oct 2007, 05:23 PM


এগারো মাসের বড় ভাই লিয়াম হিগারটিকে কবরস্থ করার সময় ভেরোনিকা এক শারীরিক ও মনস্তাত্ত্বিক অভিযাত্রার সম্মুখীন হয়। শহরতলীর ঘিঞ্জি ঘরে ফিরে খাঁটি মফস্বলীয় স্বামীর বিছানার চেয়ে নিজের গাড়িতে বসে সে স্মরণ করতে চেষ্টা করে নানীর বাড়িতে লিয়ামকে নিয়ে ঘটে যাওয়া একটা ঘটনা। কিন্তু নিশ্চিত হতে পারে না, আসলেই তেমন ঘটেছিল কিনা। বড় ভাই লিয়াম অন্যান্য বালকদের মতোই পাখি ভালবাসতো, মৃত প্রাণীর হাড়গোর পছন্দ করতো। মৃত মানুষের কংকাল বা মাথার খুলি পথে কোথাও পাশ কাটাতে হলে ভেরোনিকা অবাক হয়ে ভাবতো, এর মাঝে কি এমন আছে যা লিয়ামকে মুগ্ধ করতো!

ভেরোনিকা তার কন্যাদের এসব থেকে বাঁচিয়ে রাখতো। কেন করতো সে জানে না। কিন্তু একবার সমুদ্রসৈকতে ক্যাটালফিশের কাঁটা পেয়ে পকেটে চালান করে দিয়েছিল। হাত উন্মুখ হয়ে ছিল রহস্যময় শ্বেত হাড়টিকে স্পর্শ করতে। ভেরোনিকার মনে হয় মৃত্যুকে গালমন্দ করে কোন লাভ নেই, সান্ত্বনা খুঁজতে হয় কেবল। ভেরোনিকা তার মৃত ভ্রাতাকে দেখাতে চায় যে, তার দুটি মেয়ে, রেবেকা ও এমিলি, কেমন ছোটাছুটি করছে পাথুরে সৈকতের বালুময় প্রান্তরে, পরিধেয় কোটের উপরিভাগ দুলিয়ে। কিন্তু পরক্ষণেই সে মুছে ফেলে স্মৃতি এবং জেগে ওঠে সাগরের সুললিত গর্জনে। ভেরোনিকার কিছু যায়-আসে না, কোনটা সত্য, আর তা লেখেই বা কিভাবে। সে কেবল জানে রাতের চিন্তা, স্বীকারোক্তি – অকস্মাৎ জন্মে যায় যা। রাত শেষ হয়ে সকালের সূর্য ওঠে পূবাকাশে, পরিবারের সবাই উপর তলায় ঘুমে অচেতন। নিচতলার ঘরে লিখে চলে ভেরোনিকা। সুন্দর সুন্দর শব্দে তাদের স্বচ্ছ করে তুলে ধরে সেই শ্বেত হাড়ের মতো।

ভেরোনিকার মা মোটেও চোখে পড়ার মত ছিলেন না। তিনি নিজেকেই দেখতে পান না। পুরানো ছবিতে মেয়েদের সারিতে নিজেকে আলাদাও করতে পারেন না।

অন্য সন্তানদের মধ্যে ভেরোনিকা একমাত্র ব্যতিক্রম, যাকে দেখতে তার নানির মতো লাগে। বিভ্রান্তিকর। লিয়াম সম্বন্ধে যেদিন ভেরোনিকা জানতে পারে, সেদিন সে ঘরে প্রবেশ করতেই মা দরজা আগলে দাঁড়িয়েছিল বরাবরের মত। দরজা খুলে দাঁড়িয়েছে বটে, আবার যথারীতি প্রবেশ পথ বন্ধ করেও রেখেছে। ভেরোনিকার নামটা মনে রাখা ছাড়া সে ঠিকই মনে করতে পারে এও তার এক সন্তান।

ভেরোনিকার মা অস্থিরমতি। কোন কিছু খুঁজে না পেলে ভেরোনিকাদের দিকে সন্ধিগ্ধ দৃষ্টিতে তাকাতেন। পার্সটা গেল কোথায়! স্বগতোক্তির মতো হলেও এমন প্রশ্ন ছুড়ে দিতেন ভেরোনিকা ও তার ভাইবোনদের কাছে। তিনি কখনও চাবি খুঁজে পান না, কখনও চশমা। বাচ্চাদের জিজ্ঞেস করেন, কেউ কি দেখেছো পার্সটা? হলরুম, বসার ঘর ও রান্নাঘর তন্ন তন্ন করে খুঁজতে শুরু করেন। ভেরোনিকারা মায়ের দিকে তাকায় না, সম্মিলিত একটা অপরাধবোধ হতে থাকে। ধূসর ও পেটমোটা পার্সটা হয়তো তাদের আশপাশেই আছে, কিন্তু তারা দেখছে না। বা হয়তো খুঁজে পেল। সবসময় একজন না একজন খুঁজে পাবেই, যে কেবল তাকাতো না, দেখতোও। শান্তশিষ্ট। মা তাকে আদর করে দেবে, বলবে, সোনামনি আমার! অনেক অনেক ধন্যবাদ।

ভেরোনিকা মা'কে পাশ কাটিয়ে প্রবেশ করে সেই পরিচিত ঘরে। প্রয়োজনের তুলনায় একেবারেই ক্ষুদ্র পরিসর। দেয়ালগুলো চেপে এসেছে। যদিও সে এ বাড়ির আগন্তুক নয়। একসময়ে এই ঘরেই তার স্বপ্নের বিস্তার হয়েছিল। রান্নাঘর থেকে পেছনের উঠোনে বের হবার দরজা এতই ক্ষুদ্র যে কোটসমেত বের হতে কসরৎ করতে হয়। রান্নাঘরে সেই পুরাতন গন্ধ। মাথার খুলিতে ধাক্কা দেয়, জঘন্য। হলুদ রঙ চারিধারে। কাপবোর্ড ভরা পুরাতন চাদরে। পিতার ব্যবহৃত চেয়ারখানিও জরাজীর্ণ। ভেরোনিকা রান্নাঘরে গিয়ে কেতলিতে পানি ভরতে গেলে কোটের হাতা ভিজে যায় খোলা ট্যাপের পানিতে। কেতলি পরিপূর্ণ হলে সে কোটটি খুলে হাতাটা চিপে পানি বের করে, তারপরে বাতাসে কিছুক্ষণ নাড়াতে থাকে।

ভেরোনিকার মা অবাক চোখে তাকিয়ে দেখে এই দৃশ্য, তার মনে পড়ে অন্য কিছু। তাক থেকে তুলে নেয় তার পথ্যি। একটার পরে একটা অন্যমনস্কভাবে জিভে রাখতে থাকে। তারপরে পানি ছাড়াই গিলে ফেলে। ভেরোনিকা তার ভেজা হাতা শুকাতে ব্যস্ত। সবুজ রঙের শেষ ট্যাবলেট মুখে দিয়ে ভেরোনিকার দিকে ফ্যাকশে দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। ভেরোনিকা তাকে লিয়ামের কথা বলতে এসেছে। লিয়ামকে খুঁজে পাওয়া গেছে। কিন্তু ভেরোনিকার মনে পড়ে এই রান্নাঘরে বসে তার শেষ কান্নার দৃশ্যের কথা। তখন সতের, কান্নাকাটির জন্য বেশ অমানানসই বয়স। কিন্তু এই পরিবারে সেটা অবাক কিছু নয়। সবাইকেই কেমন যেন এক বয়সের মনে হতো। হলুদ পাইন কাঠের টেবিলে ঝকঝকে ও পুরু বার্নিশ; ভেরোনিকা ভিজে যাওয়া বাহু দিয়ে ঘষে। কিছু ধর্মীয় নিয়মনীতির কথা বলতেই, 'ভেরোনিকা!' বলে মা চিৎকার করে ওঠে। কেতলিটাকে চেপে ধরে, কয়েক ফোঁটা ফুটন্ত জল ছিটকে পড়ে চারিধারে।

লিয়াম তার মাকে বেশি পছন্দ করতো না। দরজার পাশের দেয়ালে একটা দাগের চিহ্ন আছে। লিয়াম একবার একটা চাকু ছুড়ে মেরেছিল মায়ের দিকে যা সবাইকে হাসিয়েছিল সেদিন। দেয়ালে আরো অসংখ্য গর্ত, কাটা দাগের মধ্যে সেই বিখ্যাত দাগটি এখনও আছে। মা নুয়ে পড়ায় দেয়ালে গর্তটা হতে পেরেছিল। মা কি আর বলতে পারতো লিয়ামকে! ভাইয়েরা তাকে ধরে নিয়ে পেছনের উঠোনে লাথালাথি করেছিল বটে, সবই ছিল হাসির। ভেরোনিকাও হাসছিল। মা কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে তার কাজে মনযোগ দিয়েছিল। চা গরম করতে করতে মা ভেরোনিকার দিকে তাকিয়ে থাকে। ভেরোনিকার কোমর থেকে হাটু পর্যন্ত দুলে ওঠে। অসহনীয় উষ্ণতা শরীর বেয়ে নামে। ডাইরিয়া আর যৌনতার মাঝামাঝি ধরনের। প্রেমিকের জন্য শেষ কেঁদেছিল ভেরোনিকা এই রান্নাঘরে দাঁড়িয়েই। সাধারণত পারিবারিক অশ্রুপাত এই রান্নাঘরে তেমন অর্থবহ ছিল না, অন্যান্য আওয়াজের মতোই স্বাভাবিক ছিল কান্নার আওয়াজও।
ঢাকা, অক্টোবর ২০০৭
kowshik.ahmed@gmail.com