ষড়যন্ত্র সফল করার সহজ উপায়

শফিক রেহমান
Published : 23 Nov 2009, 06:49 PM
Updated : 23 Nov 2009, 06:49 PM

স্থান : অ্যারাইভাল এরিয়া, জিয়া ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট, ঢাকা।

কাল : সকাল এগারোটা, ৬ জানুয়ারি ২০১০।

পাত্র : লন্ডন থেকে আগত একজন স্মার্ট, ইয়াং বাঙালি যাত্রী। পরনে নেভি ব্লু সুট, ডিপ ব্লু শার্ট, ব্রাইট রেড টাই। এয়ারপোর্টে নিযুক্ত মধ্যবয়সী ইমিগ্রেশন অফিসার, পরনে ইউনিফর্ম ও ব্যাজ। এবং একজন ড্রাইভার।

ইমিগ্রেশন অফিসার : আপনার পাসপোর্ট ঠিক আছে। ল্যান্ডিং ফর্ম, সোয়াইন ফ্লু ফর্ম এবং ব্যাগেজ ডিক্লারেশন ফর্মও ঠিক আছে। কিন্তু আপনার কন্সপিরেসি ডিক্লারেশন ফর্ম কই? ওই ফর্মটা কি আপনি ফিল আপ করেননি? প্লেন ল্যান্ড করার আগে ওই ফর্ম কি আপনাকে দেয়া হয়নি?

যাত্রী : হ্যা। দেয়া হয়েছিল।

অফিসার : তাহলে ফর্মটা ফিল আপ করেননি কেন?

যাত্রী : আমি ভেবেছিলাম এমিরেটস এয়ারলাইন একটা জোক করছে। তাই।

অফিসার (ভ্রূ কুচকে) : জোক?

যাত্রী : দেখুন, কোনো কন্সপিরেসি বা ষড়যন্ত্র করার সময় আমার নেই। আমি একজন বিজনেসম্যান। সারা বছর জুড়ে বিজনেস টৃপ দিই। বিভিন্ন দেশে যাই। কোথাও কন্সপিরেসি ফর্মের নাম শুনিনি। ফিল আপ তো দূরের কথা। তাই ওই ফর্মটা হাতে পেয়ে ভেবেছিলাম ওটা একটা জোক। আমি ওটাকে সিরিয়াসলি নিই নি।

অফিসার : কন্সপিরেসি একটা সিরিয়াস ম্যাটার। ভেরি সিরিয়াস ম্যাটার। ভেরি ভেরি সিরিয়াস ম্যাটার। বিশেষত বাংলাদেশে। আপনি কি সেটা জানেন না?

যাত্রী : কিছু কন্সপিরেসি সিরিয়াস ম্যাটার হতে পারে। কিন্তু সব ষড়যন্ত্রই কি সিরিয়াস হতে পারে? যেমন ধরুন, আমি যদি আমার ব্যাংকের চোখে ধুলা দিতে চাই? আমার পার্টনারকে পথে বসাতে চাই?

অফিসার : না, না। আমি বিজনেসের কথা বলছি না। আমি বলছি রাষ্ট্রবিরোধী কন্সপিরেসির কথা। সরকার বিরোধী চক্রান্তের কথা। এই ধরনের কন্সপিরেসি খুবই সিরিয়াস ম্যাটার হতে পারে। ১৯৬৯-এ আগরতলা ষড়যন্ত্র, ১৯৭৫-এর রাজনৈতিক হত্যাকান্ডের কন্সপিরেসি, ১৯৭৭-এ এই ঢাকা এয়ারপোর্টেই বাংলাদেশ এয়ার ফোর্সের কন্সপিরেসি, ১৯৮১-তে চিটাগংয়ে সার্কিট হাউজে হত্যাকান্ডের ষড়যন্ত্র, ১৯৮২-তে জেনারেল এরশাদের ক্ষমতা দখলের চক্রান্ত, এসব নিশ্চয়ই আপনি জানেন। তারপর যশোরে উদীচির সভায় বোমা, রমনার বটমূলে বোমা, কোটালিপাড়ায় হামলার প্ল্যান, চিটাগংয়ে বহির্নোঙ্গরে অস্ত্র খালাস, ঢাকায় শেখ হাসিনার জনসভায় গ্রেনেড হামলা, সারা দেশ জুড়ে চারশ স্থানে একই দিনে প্রায় একই সময়ে এক যোগে বোমা বিস্ফোরণ এবং গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে ঢাকায় পিলখানায় বিডিআর বিদ্রোহ – এসবই তো গভীর ষড়যন্ত্রের ফল। এসব কি আপনি জানেন না?

যাত্রী : জানি। এসব তো ইতিহাস। নতুন কোনো ষড়যন্ত্রের আভাস কি আপনারা পেয়েছেন যেজন্য সব আগত যাত্রীদের একটা ফর্ম ফিল আপ করতে বলছেন?

অফিসার : সরকার সতর্কতামূলক অগ্রিম ব্যবস্থা নিয়েছে। আমরা সেটা পালন করছি। বর্তমান সরকারের ক্ষমতায় থাকার প্রথম বছর পূর্তি হচ্ছে আজ। দ্বিতীয় ডিজিটাল বছর নামে আজকের দিনটি দেশ জুড়ে পালিত হচ্ছে। এই দিনটিকে পন্ড করার জন্য সরকার বিরোধীরা নাশকতামূলক কাজ করতে পারে। চারদিকে তাকিয়ে দেখুন কতো একস্ট্রা সিকিউরিটি ফোর্স মোতায়েন করা হয়েছে। সারা দেশে এখন একটা স্টেট অফ এলার্টনেস চলছে।

যাত্রী (চারিদিকে তাকিয়ে) : হ্যা। দেখছি। আনসার, পুলিশ, র‌্যাব-এর সব লোকজন! ওদের অনেকের হাতে অস্ত্র। প্যাসেঞ্জারের চাইতে সিকিউরিটির লোকের সংখ্যাই বেশি মনে হচ্ছে।

অফিসার : সরকার আর আমরা সবাই খুব টেনশনে আছি। কখন যে কোথায় কি ঘটে যায়!
যাত্রী : এভাবে তো আপনারা চক্রান্তকারীদের দমাতে পারবেন না। যারা চক্রান্ত করবে তারা তো প্ল্যান করেই করবে যাতে কেউ জানতে না পারে। তারা কি কেউ জানিয়ে চক্রান্ত করবে?

অফিসার : সেজন্যই তো চক্রান্তকারীদের একটা সুযোগ সরকার দিয়েছে ডিক্লেয়ার করার জন্য। সেজন্যই তো কন্সপিরেসি ডিক্লারেশন ফর্ম চালু করা হয়েছে। এই নিন একটা ফর্ম। চটপট ফিল আপ করে দিন।
যাত্রী (ফর্মটা হাতে নিয়ে ফর্মের দিকে দ্রুত চোখ বুলিয়ে) ; এখানে প্রশ্ন করা হয়েছে, আমার সঙ্গে কটা হাত বোমা, কটা গ্রেনেড, কটা মলোটভ ককটেল, কটা রিভলভার, ইত্যাদি আছে। এসব প্রশ্নের উত্তরে কেউ কি "হ্যা" লিখবে?

অফিসার : লিখতেও পারে। যারা নার্ভাস টাইপের চক্রান্তকারী তারা সব লিখে দিয়ে এখানেই সারেন্ডার করতে পারে।

যাত্রী : আর যারা দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ টাইপের চক্রান্তকারী, তারা?

অফিসার : তারা "না" লিখে বেরিয়ে যাবার চেষ্টা করবে। কিন্তু তারা ধরা পড়বে রেড চ্যানেলে অথবা গ্রীন চ্যানেলে। সকল যাত্রীকে উভয় চ্যানেলেই বডি সার্চ, লাগেজ সার্চ করা হচ্ছে।

যাত্রী : কিন্তু কন্সপিরেসি তো চিন্তা প্রসূত বিষয়। চিন্তার মধ্যেও তো চক্রান্ত থাকতে পারে। সেটা আপনারা চেক করবেন কি করে?

অফিসার (মৃদু হেসে) : সেটা চেক করার যন্ত্রও সরকার এয়ারপোর্টে বসিয়েছে। এক ধরনের লেটেস্ট সিটিস্ক্যানিং মেশিনে প্রতিটি যাত্রীর ব্রেইন স্ক্যান করা হচ্ছে। মেইড ইন ইসরেল। ইমপোর্টেড ভায়া ইনডিয়া। সব চক্রান্তই এই মেশিনে ধরা পড়ে যাবে।

যাত্রী : মনে হয় না। আই অ্যাম নট সো শিওর। চক্রান্ত বন্ধ করতে হলে অন্য কিছু করতে হবে।
অফিসার : কি করতে হবে?

যাত্রী : দেশে সন্দেহ এবং সাংঘর্ষিক রাজনীতি অনুসরণ না করে, সম্প্রীতি এবং সহঅবস্থানের রাজনীতি চালু করতে হবে। রিমান্ড, টর্চার ও মামলার রাজত্ব কায়েম না করে, কর্মসংস্থান, ন্যায্যমূল্য ও আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতিমূলক শাসন চালু করতে হবে। জনসাধারণের মনে বিরক্তি, ক্ষোভ ও ক্রোধ পুঞ্জিভূত হতে থাকলে, চক্রান্ত হতেই থাকবে। দয়া করে এই সহজ সত্যটা বোঝার চেষ্টা করুন। বিডিআরের ঘটনা কিন্তু সেই লেসনটাই সবাইকে দিয়েছিল। (ফর্মটা ফিরিয়ে দিয়ে) এই নিন আপনার ফর্ম। এটা আমি ফিল আপ করবো না।

অফিসার (কঠিন মুখে) : আপনার সমস্যা হবে।

যাত্রী : হতে পারে। আই ডোন্ট কেয়ার। দেখুন, যে কোনো দেশের প্রেসিডেন্ট, প্রাইম মিনিস্টারের প্রাণের ঝুকি সবসময়ই থাকে। ক্ষমতার আনন্দ ভোগের পাশাপাশি বিপদের সম্ভাবনা থাকে জেনেই পলিটিশিয়ানরা রাজনীতিতে আসেন। কিন্তু তার জন্য সাধারণ মানুষকে এত ভোগান্তির মধ্যে পড়তে হবে কেন? আমি ফর্ম ফিল আপ করবো না।

অফিসার : কন্সপিরেসি ডিক্লারেশন ফর্ম ফিল আপ করার শেষ সুযোগ আপনাকে দিচ্ছি।

যাত্রী : আইরিশ নাট্যকার অস্কার ওয়াইন্ড যখন নিউ ইয়র্কে গিয়েছিলেন, তখন তাকে এক কাস্টমস অফিসার প্রশ্ন করেছিলেন, হ্যাভ ইউ এনিথিং টু ডিক্লেয়ার? অস্কার ওয়াইন্ড উত্তরে বলেছিলেন, আই হ্যাভ নাথিং টু ডিক্লেয়ার একসেপটিং মাই জিনিয়াস (I have nothing to declare execpting my genius)। অস্কার ওয়াইন্ডের মতো জিনিয়াস আমার নেই। তাই আমি বলবো না, আমার জিনিয়াস ছাড়া আর কিছুই ডিক্লেয়ার করার নেই। তবে হ্যা, একটা জিনিস আমি ডিক্লেয়ার করতে চাই।

অফিসার : সেটা কি?

যাত্রী : (জ্যাকেটের পকেট থেকে একটা কালো চকচকে মোবাইল ফোন বের করে) : এটা। এটা অ্যাপলের লেটেস্ট আইফোন।

অফিসার (খুব কৌতূহলী হয়ে) : বাঃ। চমৎকার দেখতে তো! খুব বড় স্কৃন তো!

যাত্রী : এই মোবাইলে ফোন করা, ফটো তোলা, ভিডিও করা, ইমেইল করা, ইন্টারনেটে যাওয়া, সবকিছু সম্ভব। ইন্টারনেটে একটা পর্নো দেখবেন?

অফিসার (চারদিকে তাকিয়ে)। হ্যা। দেখবো। খুব তাড়াতাড়ি দেখান। কেউ যেন সন্দেহ না করে।

যাত্রী : নিশ্চয়ই।

এ কথা বলার পর যাত্রী কয়েকটা নাম্বার টিপে আই ফোনটা মুখের কাছে নিয়ে এসে বললেন, হ্যালো।  তুমি এখন একশনে যেতে পারো। রেডি, স্টেডি, গো।

সঙ্গে সঙ্গে বাইরে এক প্রচণ্ড বিস্ফোরণের শব্দ হলো।

এয়ারপোর্ট ভবনটা কেপে উঠলো।

কয়েকটা কাচের দেয়াল ভেঙে পড়লো।

অফিসার দৌড়ে পালালেন।

এয়ারপোর্ট ভবনের মধ্যে টহলরত আনসার, পুলিশ, র‌্যাব সবাই আতঙ্কিত হয়ে রাইফেল ফেলে ছোটাছুটি শুরু করলো। কেউ কেউ ফ্লোরে শুয়ে পড়লো।

অন্যান্য যাত্রী এবং সিভিল এভিয়েশন স্টাফরা আতংকে দিগবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে পালাতে থাকলো।

সবাই নিরাপদ জায়গা খুজছিল।

কয়েকটা সিকিউরিটি এলার্ম বেল বিদঘুটে শব্দে বাজা শুরু করলো।

যাত্রী তার আইফোনটা পকেটে পুরে গটগট করে হেটে এয়ারপোর্ট ভবনের বাইরে এসে দাড়ালেন।

বাইরে সবাই আরো বেশি সন্ত্রস্ত হয়ে ছোটাছুটি করছিল।

কয়েকটা ভীত কাক ইলেকটৃক তারের ওপর জড়ো হয়ে কর্কশ স্বরে কা-কা করছিল।

একটা পাজেরো এসে যাত্রীর সামনে থামলো।

ড্রাইভার (পাজেরোর দরজা খুলে দিয়ে) : গুড মর্নিং স্যার।

যাত্রী : (গাড়িতে উঠে দরজা বন্ধ করে দিয়ে) সব কিছুই প্ল্যান মোতাবেক হলো দেখছি একসেলেন্ট। এ গুড জব হ্যাজ বিন ডান।

ড্রাইভার : হ্যা। সব কিছুই প্ল্যান মোতাবেক হয়েছে। (রিমোট কনট্রোলটা দেখিয়ে) তবে গ্যাস সিলিন্ডারটা বড় সাইজের কিনতে হয়েছিল। বেশি শব্দের জন্য। দামটা একটু বেশি পড়ে গিয়েছে।

যাত্রী : নেভার মাইন্ড। আমার আইফোনটা নিয়ে আমি বেরিয়ে আসতে পেরেছি। (পকেট থেকে আবার আইফোনটা বের করে পরম যত্নের সঙ্গে হাত বুলিয়ে) এখানেই সব সিক্রেট নাম্বারগুলো আছে!

২২ নভেম্বর ২০০৯