প্রথম পা বাড়াবে কে ?

আলী যাকের
Published : 13 Jan 2010, 03:21 PM
Updated : 13 Jan 2010, 03:21 PM

আমাদের অভাগা বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম প্রধান দুর্নীতিগ্রস্থ দেশ হিসেবে চিহ্নিত। এটি খুব একটা সুখের বিষয় নয়। যেখানেই যাই, বিশ্বের সর্বত্র, বড় সংকোচের সঙ্গে বাংলাদেশী হিসেবে নিজের পরিচয়টি দিতে হয়। অথচ এমন তো আমাদের হওয়ার কথা ছিলো না। কেবল আমাদের নিজস্বতার জন্যে, আমাদের মানুষের ভাষা, সংস্কৃতি এবং সংস্কৃতি সম্পৃক্ত রাজনীতির জন্যে নিঃস্বার্থ ভাবে আমরা একটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম। অজস্র জীবনের বিনিময়ে এই বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিলো। এই দেশে তো সবারই উচিৎ দেশের কথা ভেবে সোজা, সহজ পথে পথ চলা? অথচ আমরা সোজা পথ ছেড়ে বাঁকা পথ নিলাম। আমরা এমন একটি অসাধু এবং অসৎ পথে পদচারণা শুরু করলাম যে আমাদের নিয়ে বিস্তর আলোচনা হতে লাগলো স্বদেশে এবং বিদেশে। এই আলোচনায় অংশগ্রহণ করতে লাগলেন খ্যাত, অখ্যাত নানা ধরনের মানুষ। বিষয়টি এতই ব্যাপকালোচিত যে এ নিয়ে নতুন কিছু বলবার আর নেই। আমিও এই পুরনো কাসুন্দি আর ঘাটতে চাই না। তবে এ কথা অনস্বীকার্য যে দুর্নীতি আমাদের জীবনের সঙ্গে ওতোপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছে। এই দুর্নীতি বিষয়ে নতুন কোনো কিছু ভাবা যায় কিনা বা নতুন ভাবে কিছু ভাবা যায় কিনা সেটা নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করা যেতে পারে। আমাদের একটা প্রবৃত্তি আছে এই রকম যে, যে কোনো একটি বিষয়কে অবলম্বন করে আমরা সামগ্রিক ধারণা করে বসি। আমরা কোনো বিষয়কেই এককভাবে দেখার চেষ্টা করি না। অথবা কোনো একটি বিষয়ের গভীরে প্রবেশ না করে অতি সরলীকরণ করায় প্রবৃত্ত হই। আমরা পত্র-পত্রিকার পাতায় একজন ট্রাফিক কনস্টেবলের ঘুষ গ্রহণের দৃশ্য দেখে গোটা পুলিশ প্রশাসনকে দুর্নীতিগ্রস্থ বলে আখ্যা দেই। একটি অফিসের একজন কর্মচারী যদি কারও কাছে ঘুষ চায় তবে ভেবে বসি ঐ অফিসের সবাই দুর্নীতিগ্রস্থ। আমার বলতে দ্বিধা নেই যে এ ধরনের দুর্নীতি নিঃসন্দেহে অত্যন্ত গর্হিত অপরাধ এবং যে কোনো সমাজে এই সব অপরাধকে প্রশ্রয় দেওয়া একান্তই অনুচিত। তবে আমাদের দেখা, না দেখার ফাঁক দিয়ে অনেক কিছুই আমাদের সমাজে ঘটে যায় যা সম্বন্ধে আমরা সজাগ থাকি না। দুর্নীতির যে দু'টি ছোট উদাহরণ আমি এখানে দিলাম তার চেয়ে অনেক বড় দুর্নীতি উদ্ভূত ঘটনা আমাদের সমাজে অহরহ ঘটছে যাতে সারা দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এইসব দুর্নীতিবাজদের টিকিটিও আমরা ছুঁতে পারি না। অথচ এদের সকলের সম্বন্ধেই অল্প-বিস্তর ধারণা আমাদের সবার আছে। আমাদের দুর্নীতি বিরোধী যে সব প্রতিষ্ঠান আছে, আমি দেখেছি যে তারা সবাই অতি সাধারণ ছোট-খাট দুর্নীতি নিয়ে বড় বেশি ব্যতিব্যস্ত থাকে। সামনে দিয়ে পিঁপড়ার পদচারণা নিয়ে মহাব্যস্ত থেকে আমাদের পেছন দিক দিয়ে যে হাতি গলে বেড়িয়ে গেল সে সম্বন্ধে আমরা সচেতন থাকি না বা সচেতন থাকলেও বলতে ভয় পাই কেননা বড় মাপের দুর্নীতিবাজরা তো পরম শক্তিধর, তাদের বিরুদ্ধে কেউ সাহস করে বলে তেমন সাহস এখন পর্যন্ত কারও নেই। বরং দেখা যায় দুর্নীতির বিরুদ্ধে যারা সবসময় বলেন তারাই চরম ক্ষমতাবান এই দুর্নীতিবাজদের সাথে বেশ ঘনিষ্ঠ। এই বিষয়টি ভাবলে আমার প্রায়ই মনে হয় যে আমাদের সকল দুর্নীতি বিরোধী অভিযান বোধহয় এখনও সঠিক পথের দিশা খুঁজে পায়নি। অবশ্য এটাও অনস্বীকার্য যে ছোট-খাট ঘুষের বড়-সর অংশ, আমি শুনেছি যে, সর্বোচ্চ পর্যায় পর্যন্ত পৌঁছে যায়। যা হোক, আমার মনে হয় সময় এসেছে কোদাল কে কোদাল বলার। তাই অতি সাধারণ দুর্নীতি যারা করেন তাদের কর্মকাণ্ডকে বাস্তবের প্রেক্ষাপটে একটু যাচাই করা দরকার।

এই যে পুলিশ কনস্টেবল কিংবা অফিস কর্মচারীর কথা আমি এই কলামের শুরুতে উল্লেখ করেছিলাম তারা সাধারণত গ্রাম থেকে ভাগ্যান্বেষণে রাজধানী শহরে আসে। গ্রামেই তারা শুনে আসে যে রাজধানীতে গেলে তাদের কপাল খুলে যাবে। অনেক সময় তো এমনও বলা হয়ে থাকে যে ঢাকা শহরের রাস্তায় টাকা হাওয়ায় ভেসে বেড়ায়। তবে তারা যাই শুনে আসুক না কেন শহরে আসবার পর বেশিরবাগ ক্ষেত্রে মোহগ্রস্থ এই মানুষগুলোর স্বপ্ন উড়ে যায়। এদের মধ্যে কিছু আছে যারা গ্রামে অবস্থিত তাদের বড় ভাইদের রাজনৈতিক ছত্র-ছায়ায় লালিত হয়েছে। অতএব জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার আনুকূল্যে তারা হয়তো একটি চাকরি কোনোমতে জোটাতে পারে। এদের মধ্যে কেউ হতে পারে পুলিশ কনস্টেবল, আবার কেউ কোনো অফিসের করণিক। এরা সবাই এসে শহরে ঘিঞ্জি কোনো বস্তিতে, অন্ধকার একটি ঘরে ঠাঁই করে নেয়। তারপর ঐ অ-বাসযোগ্য প্রকোষ্ঠটিতে তাদের পরিবার-পরিজন নিয়ে এসে ওঠে। কারও কারও অবশ্য পরিবার গ্রামেই থেকে যায় যেখানে প্রতিনিয়ত শহর থেকে টাকা পাঠাতে হয় জীবন যাপনের জন্যে। যে প্রক্রিয়ায় তারা চাকরি পায় সেই প্রক্রিয়াটি যেহেতু খুব স্বচ্ছ নয় এবং যেহেতু তা আমাদের আলোচিত মানুষটিকে জানান দেয় বাঁকা পথে অর্জনের সম্ভাবনাগুলো, সেহেতু তারা সহজেই দুর্নীতির প্রতি আকৃষ্ট হয়। আমি একবার অবাক হয়েছিলাম শুনে যে কোনো একটি বিচারিক আদালতের কনিষ্ট করণিক ঘুষ নেন বেনসন এন্ড হেজেস সিগারেট টানার জন্যে। খাদ্য নয়, বস্ত্র নয়, বাসস্থান নয়, বেনসন এন্ড হেজেস। সত্যি কথা বলতে কী আমার মাঝে মধ্যে মনে হয় কী এক অসংলগ্ন সমাজে আমাদের অধিবাস। যে ঘরটিতে সাধারণত এরা বসবাস করে সে ঘরটির ভাড়া ন্যূনপক্ষে এক থেকে দুই হাজার টাকা। আমার ভাবতে অবাক লাগে কীভাবে একটি ব্যক্তি যার মাসিক আয় পাঁচ, ছয় এমনকি সাত-আট হাজার, এই ভাড়ায় পরিবার পরিজন নিয়ে ঢাকা শহরে বসবাস করতে পারে? এরা খায় কী?

কাজেই ছোট-খাটো দুর্নীতি এখন আমাদের জীবন যাত্রার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে গিয়েছে। যাদের কথা বললাম তাদের চেয়ে একটু ওপরের দিকে যদি আমরা তাকাই তাহলে দেখবো যে তাদের বিষয়টা আরো বেশি অস্বাভাবিক। ত্রিশ হাজার টাকা যে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার আয় আমি অনেক সময় দেখেছি তিনি তার বাসার জন্যে ভাড়া দেন ত্রিশ হাজার। আমার এক বন্ধু সেই দিন কথা প্রসঙ্গে বললেন যে ছোট-খাটো দুর্নীতি আমাদের সমাজের জন্য অত খারাপ নয়। এই দুর্নীতির দ্বারা অর্জিত অর্থ দেশের ভেতরেই ঘোরাফেরা করে। যেমন, যিনি দিচ্ছেন তার থেকে এটি আসে যিনি গ্রহণ করছেন তার কাছে এবং তারপর চলে যায় বাজারে। কিন্তু যারা বড় ধরনের দুর্নীতি করছেন, আমি গত সপ্তাহের কলামে লিখেছিলাম, তাদের অর্থ শেষ পর্যন্ত বিদেশে চলে যায়। অতএব, যে সম্পদের উৎপত্তি আমাদের এই দেশে, তা শেষ পর্যন্ত রক্ষিত হয় ভিন দেশে। এই ভাবেই ধনী আরও ধনী হয়ে ওঠে এবং দরিদ্র হয়ে পড়ে আরো দরিদ্র। এই দারিদ্র যখন একটি মানুষকে একেবারে কোণঠাসা করে ফেলে তখন সেই মানুষটি প্রাণে বেঁচে থাকার জন্যে শেষ চেষ্টা হিসাবে যে কোনো প্রকারে অর্থ উপার্জনে উদ্যোগী হয়। ধনী দরিদ্রের এই যে দৃশ্যত প্রভেদ এইটিই আমাদের সমাজে দুর্নীতির প্রধান নিয়ামক বলে ধরে নেয়া যায়। এখানে আমি পাঠককে তার কল্পনাশক্তি প্রয়োগ করে একটি দৃশ্য অবলোকন করতে অনুরোধ জানাবো। ধরা যাক একজন ব্যক্তি গ্রাম থেকে এসে ঢাকার কোনো একটি বস্তির ক্ষুদ্র প্রকোষ্ঠে স্থান পেয়েছে। এইখানে সে তার স্ত্রী এবং দু'টি সন্তান নিয়ে বসবাস করে। সারাদিন প্রচণ্ড পরিশ্রমের পর সে যখন অন্ধকার রাতে ঘরে ফেরে তখন হয়তো সেখানে লোড শেডিং চলছে। প্রচণ্ড গরমে ঘামতে ঘামতে তার সন্তানদ্বয় কাঁদছে। তার স্ত্রীর মুখে অভিযোগ চাল নেই, ডাল নেই, জলকষ্ট ইত্যাকার নানাবিধ সমস্যা। এই রকম একটি পরিস্থিতিতে আলোচ্য ব্যক্তি তার ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ে। একটু আলো বাতাসের আশায় সে আনমনে হাঁটতে থাকে। ধরা যাক, সে হাঁটতে হাঁটতে একটি বিশাল বিপনী বিতানের সামনে হাজির হয়। এখানে আলোর অভাব নেই। এখানে প্রতিবার দরজা খুললেই বিপনী বিতানের ভেতর থেকে তাপানুকূল হাওয়া বেরিয়ে আসছে। এটা প্রাচুর্যের আবাসভূমি। সে দেখতে পায় একের পর এক অতি মূল্যবান গাড়ি এই মলের সামনে এসে থামছে এবং উগড়ে দিচ্ছে ঝলমলে সাজে আবৃত কিছু মানুষকে যারা বাজার করার উদগ্র বাসনা নিয়ে শপিং মলের ভেতরে ঢুকে যাচ্ছে। এই দৃশ্য অবশ্যই প্রলুব্ধ করতে পারে বস্তিবাসী মানুষটিকে অসামাজিক কোনো কাজে ব্রতী হতে। এছাড়াও একটি ব্যাপার ঘটে একজন সাধারণ চাকুরিজীবির ভাগ্যে এবং সেটি হ'ল যার আনুকূল্যে সে চাকরিটি পায় শহরে তার দুর্দশাগ্রস্থ সময় তার কোনো সহায়তা আর পাওয়া যায় না। চাকরি পেতে তাকে সাহায্য করেছে যে গড ফাদার সে নিজের উত্তোরত্তর সমৃদ্ধি নিয়ে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ে। আরেকটি বিষয় আমাদের জানা দরকার যে এই ধরনের গড ফাদারদের রাজনীতির সঙ্গে কিংবা আমলাতন্ত্রের সাথে সম্পৃক্ততা অত্যন্ত গভীর। ফলে সে থাকে ধরাছোঁয়ার বাইরে। তবে কি আমাদের দেশের সাধারণ চাকরিজীবি অথবা বেকারের জন্যে গুহার পেছনে সর্বদাই থাকবে নিঃচ্ছিদ্র অন্ধকার? এর জবাব কোথায় তা আমি জানি না। এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্যে প্রথম পদক্ষেপ কে গ্রহণ করবে? আপনি আমি অথবা তারা? শেষ পর্যন্ত কে একটি উদাহরণ স্বরূপ এমন পদক্ষেপ গ্রহণ করবে যাতে করে আমাদের এই দেশ অসুস্থ, অস্বাভাবিক অবস্থা থেকে বেরিয়ে সুন্দর, স্বাভাবিক পথে পদচারণা শুরু করতে পারে? আমাদের মত অবস্থাপন্ন ব্যক্তিরা কখনও কি এটা একবার ভেবে দেখতে পারি না যে আমাদের প্রাচুর্যের এই অশ্লীল প্রদর্শনী কীভাবে আমাদের হতদরিদ্রদেরকে অসামাজিক ব্যবহারে উৎসাহী করতে পারে?

আমি বলবো আমরা সবাই, যারা এই দরিদ্র বাংলাদেশে অপেক্ষাকৃত ভালো অবস্থায় আছি, এ ব্যাপারে তাদেরকেই এগিয়ে আসতে হবে এবং দেশের স্বার্থে, জাতির স্বার্থে, আমাদের সন্তানদের স্বার্থে উদযোগী হতে হবে যাতে করে এই অসম্ভবের দেশ সম্ভাবনাময় দেশে পরিণত হয় ।