হালকা হাওয়ার ভেতর দিয়ে

২০০৩ সালের শেষের দিকে এভারেস্ট নামটিকে ঘিরে আমাদের অনেক সভা-সমিতি হয়েছিল। সবাইকে জানিয়ে দেয়া হলো, আমরা মানে বাংলাদেশীরা পাহাড়ে যাওয়া শুরু করেছি।

মুনতাসির মামুনমুনতাসির মামুন
Published : 1 Nov 2007, 05:36 AM
Updated : 1 Nov 2007, 05:36 AM

ঘটনার শুরু বেশ আগেই। তখন ঢাকা শহরে কিছু মানুষের নতুন উন্মাদনা পর্বতারোহণ। কারও তেমন অভিজ্ঞতা না থাকলেও উৎসাহিতদের নিছক কম ছিল না। ২০০৩ সালের শেষের দিকে এভারেস্ট নামটিকে ঘিরে আমাদের অনেক সভা-সমিতি হয়েছিল। সবাইকে জানিয়ে দেয়া হলো, আমরা মানে বাংলাদেশীরা পাহাড়ে যাওয়া শুরু করেছি।

নেপাল বা এ রকম জায়গাগুলোতে আমাদের পদধূলি পড়তে থাকলো, যার নাম ট্রেকিং। উপভোগের নতুন অধ্যায়। ট্রেকিং যখন খানিকটা পোক্ত হলো অভিযাত্রিক বৈভব বাড়িয়ে তোলার জন্য কিছু মানুষ যাওয়া শুরু করলেন আরও উঁচুতে। তার প্রেক্ষিতেই ভারতে পর্বতারোহণ স্কুলে আমার মতো অনেকেই গেছেন সময়ে সময়ে। পর্বতারোহণ স্কুলে পাঠ শেষ করে আমার মতো অনেকেই আটকে গেলেন হিমালয় পর্বতমালার সর্ববৃহৎ ব্যাপ্তি ভারত-হিমালয়ের সৌন্দর্যে।

কাঙ্ক্ষিত অভিযানের তৃষ্ণা আটকে ছিল অনেক দিন। সময় আর সুযোগ মিলল ২০০৭ সালে। উপমহাদেশের দেশগুলির মধ্যে বিরাজমান শান্তি উদযাপনের লক্ষ্যে বাংলাদেশের অভিযাত্রিক সংগঠন 'কেওক্রাডং বাংলাদেশ' ও পশ্চিমবঙ্গ ভারতের নদীয়া জেলার 'মাউন্টেনার্স এসোসিয়েশান অব কৃষ্ণনগর' 'শান্তির জন্য পর্বতারোহণ' ধারণা থেকে রুবাল কাং পর্বতে অভিযানে যৌথভাবে অংশ নেয়। মাসব্যাপী এই পর্বতারোহণ শুরু হয় ১৩ মে ২০০৭-এ। পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার জেলা প্রশাসন ভবনে এক অনাড়ম্বর পতাকা বিতরণী অনুষ্ঠানের মাধ্যমে। প্রথা অনুসারে দু'দেশের আরোহী দলের সদস্যদের আনুষ্ঠানিক পরিচিতি এবং দলনেতাদের হাতে পতাকা তুলে দেয়া হয়। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে অনুষ্ঠানে যোগ দেন কোলকাতার বাংলাদেশ হাই কমিশনের ডেপুটি হাই কমিশনার মোহাম্মদ ইমরান ও ফার্স্ট সেক্রেটারি। এছাড়া স্থানীয় প্রশাসনিক কর্তারাও উপস্থিত ছিলেন সেখানে।

২.
হিমাচল প্রদেশের কুল্লু হিমালয়ের পার্বতী নদী এলাকায় কাক্সিক্ষত পর্বত রুবাল কাং। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ২০৩০০ ফুট উঁচু এই পর্বত। দলনেতা বসন্ত সিংহ রায় প্রথমে অভিযান সম্পর্কে ধারণা দেন আমাদের। কার্যপ্রণালী ঠিক করা হয়। আগে ঠিক করা সময়ে হাওড়া রেল স্টেশন থেকে চন্ডিগড়গামী ট্রেনে রওনা হলাম আমরা। সবাইকে প্রথমে যেতে হলো আইএমএফ (ইন্ডিয়ান মাউন্টেনিয়ারিং ফাউন্ডেশন)-এ। রীতি অনুযায়ী আন্তর্জাতিক পর্বতারোহণ অভিযানের অংশগ্রহণকারীদের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাত করেন আইএমএফ সেক্রেটারি। নানা বিষয়ে আলাপ হলো। বাংলাদেশে পর্বতারোহণের যে সূচনা হয়েছে কিভাবে তা স্থায়ী করা যায় সে বিষয়ে তিনি বললেন। তিনি বললেন, অভিযান শেষ হবার পরে যেন আমরা তার সাথে অবশ্যই দেখা করে যাই। নিয়মানুসারেই আমাদের তার কাছে যেতে হতো। তিনি বলার সৌজন্যটুকু করলেন।

রাজধানী দিল্লীর রাজপথ তখন কেবল খানিকটা শীতল হতে শুরু করেছে। টানা জার্নিতে আমাদের শরীরের অবস্থা ত্রাহি ত্রাহি। তার উপর দিল্লীর গরম। খরচ বাঁচানোর জন্য আমরা ভরে থাকা পাবলিক বাসে করে চলে এলাম কাশমিরা গেট সংলঘœ বাস স্টেশনে। কুল্লু যাব। বাস ছাড়বে সাতটা তিরিশে। আমরা ছয়জন। একসাথে টিকেট পাওয়া গেল না। বাসে ঢোকার পর মনে হল, এত বড় দেশে বাসগুলোর সিট এত ছোট কেন! আমার দৈর্ঘ্য, প্রস্থ, উচ্চতা এ বাসে যেন খানিকটা বে-সাইজ। জার্নিটাও ছোট না। ভিতরে কলেজ পড়–য়া ক্যাম্পাররা ছিলেন। ছেলেমেয়ে একসাথে থাকার জন্যই মনে হয় তারা স্বাধীনতা প্রকাশের জন্য গলাকেই প্রধান মাধ্যম হিসেবে বেছে নিলেন। আমার পাশের সীটে জানালার পাশে পাগড়ি পরা শিখ ভদ্রলোক বাস ছাড়ার খানিক বাদেই রাতের খাবার সেরে ঘুমানোর এনতেজাম নিয়ে ব্যস্ত হলেন। ঠিক পিছনে কোন একজন – যিনি অবশ্যই ব্যবসা করেন এবং প্রচুর পান খান – এক নাগারে বলেই যাচ্ছেন অনেক কথা। কার সাথে জানি না। তার সাথের সিটে তন্ময়, বেচারা কানে গুজে দিয়েছে ইয়ার ফোন। সাগর ভাই আর রিপনের বসার জায়গা পাওয়ার কারণে মনের কোণে যে ঈর্ষাটুকু ছিল তা উবে গেল তাদের পা রাখার কায়দা দেখে। দলনেতা বসন্তদা আর এলও (লিয়াজোঁ অফিসার) দেবাশীষের অবস্থাও অনুমেয়। ইঞ্জিনের গরমে আর দুই সিটের ফাঁকে মনে হয় আটকে আছেন পুরো দলের সবচেয়ে লম্বা মানুষ বসন্তদা।

ভাবনা-চিন্তা আর বিশ্রামের চেষ্টা করতে করতে ক্লান্ত শরীর থেমে গেল এক সময়। সকাল হবো হবো করছে, হিমাচলের মেঘে ঢাকা রাস্তাগুলিতে লাটিমের মতো পাক খেয়ে উঠে আসছে আমাদের বাস। প্রকৃতির সৌন্দর্যে আটকে আছে সবাই। অনেকেই তাকিয়ে বাইরে। ঝাৎ করে বাসের গ্লাসের মধ্য দিয়ে তির্যক কিরণ এল চোখে। বুঝলাম, গুড মর্নিং এভরি ওয়ান।

প্রাতঃরাশের সময় আমরা কুল্লু পুলিশ স্টেশনের সামনে। দেখা করতে হবে। আইএমএফ যে কাগজ দিয়েছিল সেটি দিতে হবে পুলিশ সুপারকে। ভদ্রলোক তখনও অফিসে আসেননি। এই ফাঁকে খেতে গেলাম। আলু পরোটা আর সাথে কিছু একটার ঝোল হবে। আগের দিন সন্ধ্যার পর এই খাওয়া। সময়ের অভাবই এর কারণ।

নিয়ম মাফিক আইটিবিপি (ইন্ডিয়া টিবেত বর্ডার পুলিশ) স্থানীয় অফিসে গেলাম। পর্বতারোহণে কোন সমস্যা হলে এদের ছাড়া তল্লাটে আর কাউকে পাওয়া যাবে না। সে হিসেবে আমাদের জন্য যথেষ্টই জরুরী ছিল ব্যাপার। অ্যাডজুটেন্ট সাহেব আগের বারের আইটিবিপি'র মাউন্ট এভারেস্ট অভিযানে সফল আরোহণকারীর সাথে দেখা করিয়ে দিলেন। ভারতের পর্বতারোহণে আইটিবিপি'র বিশাল অবদান। সরকারী এই প্রতিষ্ঠানের সদস্যরা নানা সময় ভারতসহ নানা দেশের অনেক বিখ্যাত পর্বতারোহণ করেছেন।

দুপুর নাগাদ ফিরে এলাম পুলিশ স্টেশনে। পুলিশ সুপার নিজের ফোন নম্বর দিয়ে দিলেন। অভয় দিলেন যে কোন সমস্যায় তাকে যেন ফোন করি।

এবার বারসেনিতে যেতে হবে। মনিকরণ হয়ে। বারসেনি থেকেই নিতে হবে গাইড আর মালবাহক। মনিকরণ বিখ্যাত শিখ ধর্মাবলম্বীদের তীর্থ হিসেবে। এখানে বিশাল জনপদের সৃষ্টি হয়েছে। প্রচুর বিদেশী সমাগম। সামান্যই যাত্রাবিরতি এখানে। নদীতটে উপাসনালয়গুলি দারুণ। ঈশ্বরের ঐশ্বর্য সবখানে, নদীতে, আকাশে, কালচে পাহাড়ের আটকে থাকা বরফের চূড়ায়, সবখানে।

দুপুরের দিকে পৌঁছলাম বারসেনিতে। আগের টিম অপেক্ষায়। সবাই জমায়েত হলাম গাইড চমন সিং-এর আদি বাড়িতে। বাড়ি বলতে পাথরের দেয়াল আর কাঠের পাটাতনের দ্বিতল নিবাস। পুরো দলের মালামালের হিসাবে জানলাম তখন। মেপে দেখা গেল ৭৬০ কেজি। তাই পোর্টারের সংখ্যা গেল বেড়ে। আর এই পরিমাণ লোড বেসক্যাম্প পর্যন্ত নিয়ে যাওয়ার গুরুদ্বায়িত্ব চমন সিং-এর। এ অঞ্চলে তার চলাচল আগে থেকেই। অনেক দলের সাথে ছোটবেলায় তার কুক হয়ে যাওয়ার মধ্য দিয়ে শুরু।এখন সবচেয়ে অভিজ্ঞ গাইডে পরিণতি। মিষ্টভাষী সদালাপি লজিক্যাল মানুষটার সাথে কথা বলে দারুণ লাগল।

বিকালে দোতলার ঝুল বারান্দায় বসে আমাদের সবার সাথে পরিচয় হলে বসে গেলাম পরদিনের পরিকল্পনায়। আমাদের দরকার জনা ত্রিশ মালবাহকের। মেলাতে পারলেন না চমন সিং। অগত্যা সেখানে একদিনের বাড়তি থাকা। নিচতলার একটা খুপরি ঘর আর ঝুল বারান্দায় ঢালা বিছানা করা হলো। তবে বিকাল থেকে শুরু হওয়া বৃষ্টিটা সবার মাথায়। থামবে তো? সন্ধ্যার খানিক বাদে থেমে গেল। খিচুড়ি খেয়ে প্রথম রাতের থাকার আয়োজনে আমরা ব্যস্ত হয়ে গেলাম। বেশিক্ষণ হবে না, তার আগেই বারান্দায় নড়াচড়ার শব্দ পেয়ে বুঝতে বাকি থাকল না বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে। সকালে দেখা গেল বড় এক পলিথিন মুড়ে শুয়ে আছে প্রায় দশজন।

সকালটা দারুণ। আশপাশ দেখে আমার ঢেড়ায় এসে দেখলাম চমন সিং পরিপাটি হয়ে বসে আছে। বসন্তদার সাথে আমাদের এলও (লিয়াজোঁ অফিসার) দেবাশীষদা। আলোচনা থেকে বের হলো আমাদের মাল বহনের জন্য ঘোড়া নেয়া ছাড়া উপায় নেই। প্রতি ঘোড়া নিতে পারে ৬০ কেজির মতো। পরদিন সকালেই শুরু হবে হাঁটা। সে অপেক্ষায় রাতটা কাটল। অপ্রয়োজনীয় জিনিসগুলো রেখে বাক্স পেটরা বেঁধে রওনা হলাম ঘোড়ায় মালগুলো চাপানার জন্য। ভোরের আমেজ মাখা সকাল তখনও। মালগুলোকে ভাল করে মেপে নীল রঙের ড্রামগুলোতে (প্লাস্টিকের এই ড্রামগুলো আমাদের খুবই পরিচিত) বেশির ভাগ মালপত্র ভরে ফেলা হলো, আর তার ভার যাতে বেশি না হয় সেদিকে লক্ষ রাখা হলো। ড্রামের গায়ে সেঁটে দেয়া হলো 'ইন্দো-বাংলা মাউন্ট রুবাল কাং এক্সপিডিশন ২০০৭'। নেপাল বা ভারতে ট্রেকিংয়ের সময় বড় দলগুলির বাক্স-পেটরায় তাদের দেশের নাম দেখে সেই কবে থেকে ঈর্ষা আমাকে আগলে রেখেছে বলে বোঝানো যাবে না। নিজের দেশের নাম দেখার তীব্র আগ্রহ অনেক দিনের। ১৭টি ঘোড়ায় আমাদের সব কিছু উঠে গেল। অবশ্য নিজ নিজ ব্যাগপ্যাক ভরে মালামাল নিজের কাঁধে।

মূল সড়ক শেষ। এরপর পার্বতী নদীতে চলছে হাইড্রো ইলেক্ট্রিক প্রজেক্ট। ওয়াই জংশনের মতো নদীর মাথা আটকে দেয়া হচ্ছে। বেশ কয়েক বছর আগে শুরু হয়ে কাজ চলছেই। স্থানীয় গাইড বা পোর্টাররা এ প্রজেক্টের অনেক কাজেই জড়িত।

আলু পরোটা আর চা সকালের খাবার। মিনিট কুড়ি বাদে কাঠের ব্রিজ দিয়ে নদীটা পার হয়ে পাথুরে রাস্তা শুরু হয়ে গেল। প্রথম দিনের গন্তব্য খিরগঙ্গা। যেতে ৪ থেকে ৫ ঘণ্টা লাগবে। ট্রেইলটা যথেষ্টই সুন্দর, হিমালয়ের গতানুগতিক চিত্র বললে ভুল হবে না। ডান পাশটা খাড়া নেমে গেছে নিচের দিকে আর বাম পাশ উপরে, মাঝখানে বেশি হলো দু ফুটের মতো পায়ে চলা পথ। কংকরময় রাস্তাটা সাপের মতো এঁকেবেঁকে এগিয়ে গেছে। বেশ খানিকটা সময় পর হৈচৈ দেখে দাঁড়িয়ে গেলাম। আমাদের একটা ঘোড়া পড়ে গেছে খাদে। আর দার্জিলিং থেকে নিয়ে আসা শেরপা পেমা তারই খোঁজে প্রায় ২০০ ফুট নিচে। যখন ফিরে এল ঘোড়াওয়ালার দিকে তাকিয়ে আমাদের কারও বুঝতে বাকি থাকল না ঘোড়ার পরিণতি। অভিযানের প্রয়োজনীয় খাবার ডালের বস্তা হারিয়ে গেল। বাকি পেটরাগুলি পাওয়া গেল অবশ্য।

তেরজনের দল। সাথে দুজন কুক, তিনজন শেরপা, একজন গাইড আর ১৭টা ঘোড়ার সাথে তার মালিক এবং তার সাথে আরও জনা তিনেক মানুষ এই হলো আমাদের পুরো দল। বেসক্যাম্প অবধি এ অবস্থাই থাকবে। পাইন আর ফার গাছের সারিগুলো উঁচুতে উঠতে উঠতে আকাশের গায়ে কাছাকাছি প্রায়। উপর থেকে বয়ে চলা টিমটিমে ঝর্না নিচে নেমে সে কী বিশাল যজ্ঞ চালিয়ে যাচ্ছে। হিমালয়ের ফুল, লতা, গুল্ম সবই আছে নিজের ঐশ্বর্য নিয়ে।

খিরগঙ্গা
সবার হাঁটার গতি এক না হওয়ায় দলের শুরু এবং শেষটা আর দেখা গেল না। রিপনের জন্য আমাদের খানিকটা দেরি হলো, পুরো অভিযানের ভিডিও ডকুমেন্ট্রির দায়িত্ব তার। তার প্রয়োজনে যখন যাকে সে যা করতে বলে, মুখ বুজে মেনে নেয় সবাই। এতে বিরক্তি তো আছেই, সাথে হয় সময় নষ্ট। কিঞ্চিৎ মোটা আকৃতির মানুষ, সে এক পা হাঁটে তো দু মিনিট জিরায়।

পাহাড়ে দিন বলতে সূর্য ওঠার পর থেকে দুপুর, ভাগ্য খুব ভাল থাকলে বেলা ২টা। তারপর আবহাওয়া কেমন হবে তা কেউ বলতে পারবে না। সে কারণে সময়ের ব্যাপারটাই মাথায় ছিল। ১১টার পর থেকে আকাশে মেঘের ঘনঘটা। নদীর ডান পার ধরে এগিয়ে যাচ্ছি বনের ভিতর দিয়ে। বেশ শীতল। খুব দ্রুত পা চালাতে পারছি না রিপন পিছিয়ে পড়বে বলে। প্রমত্তা নদীর চলার আওয়াজ, গাছের বাতাসের তোড়ে পাতায় পাতায় ঘষা খাওয়ার খসখসে আওয়াজ, মাঝে মাঝে পাখির অস্তিত্বের প্রমাণ দিয়ে কিচিরমিচির। এসবের মধ্যে আমাদের ট্রেক। পানি ফুরিয়ে গেলেও চিন্তা নেই। খানিক বাদেই ঝর্না। একপা-দুপা করে যখন খিরগঙ্গার কাছাকাছি, বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। চারপাশ কালো অন্ধকার হয়ে গেছে হঠাৎই। তড়িৎ ভাব দেখা গেল সবার মাঝে। শেষটা ভালই চড়াই। তাই খুব দ্রুত যাওয়া সম্ভব হলো না। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির কারণে ছাতা বের করতে হলো। খানিক বাদে চড়াইটা পার হতেই আমাদের তাঁবুগুলি দেখতে পেলাম। শেরপারা আগেই চলে এসেছে। রান্নার জোগাড়ে ব্যস্ত কুকরা। আমরা চারজন (আমি, রিপন, সাগর ভাই, তন্ময়) এক তাঁবুতে। আমাদের পাশেই রান্নার ভাঙাচোরা ঘর। বয়ে যাওয়া একটা পানির নালাতে পাইপ বসিয়ে পানির ব্যবস্থা করা হয়েছে। অবিরাম বৃষ্টি চলে যাচ্ছে। দুপুরের খাওয়া ভাত আর সবজি।

খিরগঙ্গা বিখ্যাত উষ্ণ প্রস্রবণের জন্য। দেশি-বিদেশি পর্যটকের ভিড়ে একাকার এলাকা। এলাকা বললে ভুল হবে। ৭০০ থেকে ১০০০ মিটার হবে পুরো সমতল ভূমিটা। তাতেই গড়ে ওঠা নেপালি কায়দার একচালা হোটেল কাম খাওয়ার ব্যবস্থা। শুধুই বিদেশীদের দেখতে পাওয়া যায়। এখানে তারা আসে হিমাচলের চরস আর গাঁজা সেবনের জন্য। পার্বতী নদীর এই ভূখণ্ড এ দুই জিনিসের জন্য বিখ্যাত। বিকালে ক্যাম্প এরিয়া থেকে খানিকটা উপরে উঠে এগিয়ে গেলাম উষ্ণ প্রস্রবণের দিকে। সকাল পাঁচটা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত এখানে গোসল করা যায়। মেয়েদের জন্য দেয়াল দিয়ে আলাদা করা আছে। আমরা একে একে পানিতে নেমে গেলাম। পরন্ত বিকালে হালকা বাতাসে অনাবৃত অংশগুলোতে শীতের চিনচিনে পরশ লাগলেও পানিতে নামার পর বেশ আরাম। ঢাকার রাজপথে শীতের সময় যে ঠেলা কিংবা টং কিংবা আঁস্তাকুড়ের মতো দেখতে দোকানগুলিতে ভাপা পিঠা বিক্রি হয় এবং দূর থেকে দেখলে ভাপা পিঠার উপর যে ভাপ দেখা যায়, খানিকটা দূর থেকে আমাদের গা থেকেও সেরকম ভাপ উঠতে দেখা গেল। গত কদিনের ক্লান্তিকর জার্নি আর প্রথম দিনের ট্রেক, সব মিলিয়ে শরীরের জন্য দারুণ উপকার হলো। হঠাৎ করে উচ্চতাজনিত কারণে খানিকটা মাথাব্যথার লক্ষণ দেখা দিলেও এইবার একেবারেই ফিট। কোনও সমস্যা নাই!

এখানে সন্ধ্যা নামার সময় শিশির পড়ে না, দমকা হাওয়া দেয়। শরীরের প্রতিটি আনাচে-কানাচে শীতের চিরুনি আঁচড় কাটার জন্য আকুপাকু করে। তবে রক্ষা হলো বর্মের মতো কয়েক পরত শীতের কাপড়। খাওয়ার পর যে যার মতো তাঁবুতে স্লিপিং ব্যাগে। প্রথমে কিছুটা সময় একটু কষ্ট হয়। তবে স্লিপিং ব্যাগ গরম হলে বেশ আরাম। বেশ সকাল সকাল উঠতে হবে। দেরি না করে ঘুমানোর চেষ্টায় মত্ত সবাই। আমিও।

টুন্ডাভুজ
আজকের গন্তব্য টুন্ডাভুজে। খুব ভোরে উঠে গেলাম সবাই, ঘুম ভাঙল কুক জগিন্দরের ডাকে। ঘোড়াগুলিকে একসাথে করার জন্য ছুটোছুটি দেখলাম ঘোড়াওয়ালার। প্রথমটায় শিস দেয়, বেয়ারা ঘোড়াগুলি ছাড়া সবাই চলে আসে। যারা আসে না তাদের পিছনে ছোটা ছাড়া উপায় নেই। শুরু করতে করতে ৯টা বেজে গেল। সাতটা তাঁবু গুটানো, মালামালগুলোকে আবার নিয়মমাফিক ঘোড়ার পিঠে বাঁধা, যার যার ব্যাগটা প্যাক করে রেডি হতে হতে সময় লেগে গেল।

এবারের ট্রেকটা বেশ ছোট। ঘণ্টা দুয়েক লাগার কথা। তাই সবার মাঝেই একটু অলসতা দেখা গেল। এ ফাঁকে যে যার মতো হাঁটার সঙ্গী হয়ে গেছে। আমার সাথে ব্রহ্মদা। চল্লিশ ছোঁয়া ভদ্রলোক ফটো ওঠানোর কারণেই এ গতিতে চলছেন আমার সাথে। বসন্তদা চলে গেছে প্রায় সবার আগে। কোন জায়গায় তাঁবু ফেলতে হবে তা তিনি ঠিক করবেন। ব্রহ্মদার কাছ থেকে জানতে পারলাম, ভুজ নামে একধরনের গাছ আছে এ অঞ্চলে তার বাকলগুলি বেশ পাতলা। এক সময় এই পাতা লেখার কাগজ হিসেবে ব্যবহৃত হতো। খানিক বাদে পায়ের নিচে কাগজের মতো পড়ে থাকা বস্তুটা হাতে তুলে নিয়ে চিনিয়ে দিলেন আর এর খানিক বাদেই দেখিয়ে দিলেন গাছগুলি। খুব একটা অপরিচিত লাগল না, গতানুগতিক গাছের মতোই। পথে ফুলের বেশ ছড়াছড়ি। আমাদের কেউই নাম জানে না। জানা নেই গোত্র-পরিচয়। পথ খুবই সুন্দর। ওঠানামা থাকলেও পরিবেশের কারণে অসহনীয় হয়ে উঠছে না। যে নদীটাকে আমরা বামে রেখে এগিয়ে আসছিলাম, তা এখনও বয়ে যাচ্ছ। এখানে নদীর বেড় বড়। গর্জনের তাপ দেখে বোঝা যায় কতদূর তার ক্ষমতা। নদীর একটা পাশের নালা জমে বরফ হয়ে গেছে। সেই দিন প্রথম বহরের উপরে থাকবার অভিজ্ঞতা হলো। ৫০ থেকে ৭০ ফুট হবে বেশি হলে।

বারটার দিকে উঠে গেলাম। বড় একটা নালার উপর কাঠের সাঁকো দিয়ে পার হয়ে তাঁবুতে চলে এলাম। তাঁবু এলাকার সামান্য কিছু দূরে এ ভূখণ্ডের শেষ। প্রায় ৪০০-৫০০ ফুট নিচ দিয়ে বয়ে চলা নদীটাকে অচেনা লাগছে। রোদের তাপে শরীরটা ঝলসে নেয়ার জন্য রোদে বসে মুড়ি খাওয়া হলো। আর দুপুরে ভাত-সবজি।

বিকালে গেলাম হাইট গেইন করতে। সাগর ভাই সবার আগে। তার সাথে আমাদের দলেও (!) কুল্লু থেকে আসা কুকুরটা। সামান্য ঢাল ধীরে ধীরে উঠে আসছি। এটাকে ঠিক হাইট গেইন বলা যায় না। আমরা বেশি দূর চলে এলেও বেশি উপরে উঠতে পারিনি। তাই সামান্য সময়ের জন্য বসে কালো হয়ে আসা আকাশ থেকে বৃষ্টি ঝরার আগেই দৌড়।

ঠাকুরকুয়া ৩৫৩৫ মিটার
আজকের পথ গত দুদিনের পথের চেয়ে খানিকটা বড় এবং সময়ও লাগল বেশ। মানসিকভাবে নিজেকে তৈরি রাখা। সকালের খাবারটাও একটু ভারি হলো। আগের দিনের রাস্তার মতোই পরিবেশ। নদী পার হবার পর থেকে চড়াই শুরু হলো। প্রথম চড়াইটা বেশ বড়। ওঠার গতি মন্থর সবার। শেষ মাথার কাছাকাছি এসে দেখতে পেলাম আমাদের ঘোড়ার বহর হেলেদুলে এগিয়ে আসছে ব্রিজের দিকে। চারদিক সবুজ রঙের ছড়াছড়ি, ঈষৎ ধূসর বঙ্গের নদী, মেটে ট্রেইলের উপর বহরটা দেখতে সারি বাঁধা পিঁপড়ার দলের মতোই মনে হবে সবার। পিছন থেকে এগিয়ে যাওয়ার গুতো খেয়ে তন্দ্রা ভাঙল। সময় কম। রওনা হয়েছিলাম আটটার দিকে। এখানে দুপুর গড়াবার আগেই সন্ধ্যা নামে এবং শুরু হয় ঝড়-বৃষ্টি। তাই যে যার ম্যাক্সিমাম স্পিডে এগিয়ে যাচ্ছে।

চড়াইটা ধরে উঠে এলে দারুণ একটা সমতলভূমি। যার পুরোটাই ঘাসে ঢাকা। গাছের উচ্চতা কমে যেতে শুরু করেছে। আমরা প্রায় তিন হাজার মিটার বা ১২ হাজার ফুট উচ্চতা অতিক্রম করে ফেলেছি কিংবা ফেলতে যাচ্ছি। জুনিপারের ঘন ঝোপ আর পাথরের পাতার মতো শক্ত ঘাস। গাছগুলোকে যখন ছাড়িয়ে এলাম তার খানিক বাদেই আবহাওয়ার পরিবর্তনটা প্রকাশ পেল। বুঝতে পারলাম আমরা ট্রি লাইন অতিক্রম করেছি। পায়ের তলায় মাটি শক্ত শক্ত হতে হতে এগিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে প্রথমে মোরেইন এলাকায় প্রবেশ করলাম। ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মোরেইনের মধ্য দিয়ে কখনও একা আবার কখনও দলের সাথে এগিয়ে যেতে থাকলাম। এই জায়গাটা আমার কাছে নেপালে এভারেস্ট বেস ক্যাম্প যাওয়ার পর লেবুচের পরের এমনই এক সমতল বিশাল ভূখণ্ডের কথা মনে করিয়ে দেয়। দুপুরের কড়া রোদ। এ পথে খুব বেশি একটা চড়াই ছিল না। তবে রোদের ঝাঁজটা বেশি। সাড়ে দশটার দিকে আমরা পৌঁছে গেলাম। ক্যাম্প স্পট খানিকটা নিচের দিকে। উপর থেকে পার্বতী নদীপাড়ের সবুজ ঘাসে মোড়া অদ্ভুত সুন্দর একটা মালভূমি। মাঝে মাঝে ছোপ ছোপ হয়ে ফুটে আছে ফুল। কতকগুলি হলুদ, কতকগুলি বেগুনি। মাদার ইন ম্যানভিলে পড়া রডোডেনড্রনের বাহার দেখলাম। কতই না শোনা এই ফুলের নাম। আবেশে জড়িয়ে রেখেছে সারা পথ। সম্বল চকলেট বার। পানি তো পথেই আছে, সময় মতো বোতল ভরে নিলেই হলো। তবে তাতে জুনিপারের গন্ধ আর নুড়ির মেশাল।

এই জায়গাটাতে হাইড্রো ইলেক্ট্রিক পাওয়ার প্রোজেক্ট হওয়ার কথা ছিল যা কিনা এখন বারসেনিতে হয়েছে। আর তাই এখনও বেশ কিছু স্থাপনা দেখতে পাওয়া যায়। যার মধ্যে মেটাল আর ফাইবারের লাইট ওয়েট মেটেরিয়ালের ঘরগুলি এখনও অটুট আছে। পর দিনের ট্রেকটা বেশ বড় তাই আজ আর তাঁবুটা খাটিয়ে এরকম দুই ঘর পরিষ্কার করে থাকার ব্যবস্থা করা হলো। ধূসর হয়ে যাওয়া বোর্ডগুলিতে নানা ধরনের লেখালেখি-আঁকিবুকি। ঘরের দরজা জানালার অবস্থা বেশ করুণ। দুপুরের খাওয়া হলো ডিম আর ভাত। এর মাঝেই বৃষ্টি। পড়িমরি করে যে যার রুমে। জোর বৃষ্টি খোলা জানালা পেয়ে আমাদের সঙ্গী হওয়ায় মত্ত। পলিথিন শিট আর ছাতা দিয়ে কোনও মতে আটকে রাখা হলো। পাশের ঘরে দেবাশীষদার গলা শোনা গেল, 'সাধের লাউ বানাইলো মোরে বৈরাগি'। সবাই মিলে হেরে গলায় গেয়ে গেলাম গান।

বেসক্যাম্প কার্ডে সবার সিগনেচার দেয়া বাকি ছিল তাই গানের সাথে সমান তালে চলল। দেখতে দেখতে খামে ভরা কার্ডগুলির স্তুপ জমে গেল সবার মাঝে। বৃষ্টি থামার কোন লক্ষণই দেখা গেল না। ঝুমঝুম বৃষ্টির শব্দে এই গহীন হিমালয়ের মাঝে অদ্ভুত এক নৈসর্গিক পরিবেশ তৈরি হয়েছে। রাতের বেলা খাবার নেবার সময়ও বৃষ্টি বন্ধ হলো না। অবশ্য ঘুমটা ভাল হবে তাতে কোন সন্দেহই রইল না।

টিম মিটিং আগেই ঠিক করা হয়েছে, যতটা সকালে পারা যায় রওনা হতে হবে। সে কারণেই প্রাতঃরাশে মুড়ি আর চা ছাড়া কিছুই মিলল না। ঠাকুরকুয়া থেকে বেসক্যাম্প একদিনের পথ। লম্বা এই পথের মাঝে আর কোথাও নাকি ক্যাম্প করার জায়গা নেই। এবং এর পরের পথটা আমাদের কারোই চেনা নয়, তাই দুপুরের খাবারের পর গাইড চমন সিং, শেরপা ঠেন্ডিব আর পেমাকে নিয়ে বেরিয়ে গেল, পথ আগের দিনেই কিছুটা পরিচিত হয়ে নিতে।

এবার শুরুতেই হাড় ভাঙা খাটুনির জন্য প্রস্তুত হয়ে গেল সবাই। চড়াই উঠছে তো উঠছেই। গুল্মলতার ঝোপ আর লম্বা আকারের ধূসর ঘাসগুলোর মধ্যে দিয়ে হালকা হয়ে যাওয়া পথ ধরে এগিয়ে যাওয়া। বেশিক্ষণ লাগল না, শরীরটা বেয়ারা হয়ে উঠল। একটু একটু করে বুঝতে পারা যায় আমরা বেশ উচ্চতায় চলে এসেছি। হাঁটার গতির কারণেই ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে গেছে পুরো দলটা। মোরেইন আর বোল্ডারের পথে কেউ যদি বেশি দূরে থাকে তো তাকে অনুসরণ করা যথেষ্টই কঠিন। এ কারণেই একসময় খেয়াল করলাম আমি সম্পূর্ণ একা। কোন পথ ধরে এগোব এটাই বের করতে পারলাম না। অনুমান করে এগিয়ে যেতে থাকলাম। একটা রীজ পার হয়ে ঘন্টাখানেক যাওয়ার পরও কোন হদিস খুঁজে পেলাম না। তবে ভাগ্য ভাল যে কেবল একদিকেই যাওয়া সম্ভব। অগত্যা কী করা। ভাগ্যের উপর ভরসা করে চলতে থাকা। বুদ্ধ আর রাহাদাকে দেখে খানিকটা আশ্বস্ত হলাম। যদিও বেশ দূরে তারা। তাতে কী আছে। একসময় তাদের ধরে ফেললাম। কথা হলো রাস্তা নিয়ে আমার মতো তারাও আস্থা হারিয়ে ফেলার উপক্রম। তিনজনে মিলে এবার এগিয়ে যেতে থাকলাম।

বেসক্যাম্প হবে রুতিরুনি গ্লেসিয়ারের কাছে। সেটাকে মাথায় রেখে যাচ্ছি কিন্তু গ্লেসিয়ারের দেখা তো আর পাই না। বেলা বেড়ে গেছে এর মাঝে, পেটের মধ্যে গুরর গুরর শব্দ আসছে, রোদে মাথায় ক্যাপ রাখা দায়। এর মাঝে বেশ খানিকটা দূর থেকে প্রায় সমতল কিন্তু বোল্ডারে ভরা জায়গাটাকে আলাদা করা যায় এমনিতেই। বেশ বড় (খুব কম করে হলেও তিন তলার সমান হবে) বোল্ডারের কারণেই মনে হয় এলাকাটায় কোন বিশেষত্ব আছে। বাম পাশ খাড়া পাথরের দেয়ালে আটকানো আর ডান পাশে গর্জন করে এগিয়ে যাচ্ছে নদী। এগিয়ে এলাম এ পথটুকুও। কারণ সামনে বসন্তদাকে অপেক্ষা করতে দেখলাম। বুঝিয়ে দিলেন কিভাবে কোন দিকে বাকি পথটুকু যেতে হবে। ক্লান্ত শরীরের বিশ্রাম দেয়ার জন্য বসে গেলাম দিবাকরিনালার পাশে। আবহাওয়া খারাপের দিকে। বৃষ্টি আসার প্রবল সম্ভাবনা। পরিকল্পনা মাফিক আমাদের এর মাঝে বেসক্যাম্প পৌঁছে যাবার কথা। তাই কষ্টটা মনে হয় বেশিই হচ্ছে এখন। মিনিট পনের হবে, উঁচু রীজ থেকে তন্ময়কে দেখলাম হাত নেড়ে ইশারা করছে ঐদিকে যাওয়ার জন্য। প্রথমটা ঘাবড়ে গেলাম সবাই, খারাপ কিছু হলো নাকি এই ভেবে। পরে গাইড চমন সিং-এর ইশারার পাঠোদ্ধার করলেন বসন্তদা। ফিরে গেলেন ফেলে আসা পথে। রীজের উপরের কী হলো তাদের মাঝে শোনা গেলেও এতদূর থেকে বুঝতে একটুও কষ্ট হলো না, আমরা বেশ এগিয়ে গিয়েছি। সবাইকে আবার পিছনের দিকে যেতে হবে। আমরা যেখানে অপেক্ষা করছিলাম তার থেকে আরও মিনিট কুড়ি বাদে অপেক্ষায় সবাই। বিশ্বদা এগিয়ে গেলেন তাদের ডাকতে। আমি এগুতে থাকলাম বসন্তদার দিকে। উপরে অনেকক্ষণ বাদে সাগর ভাইকে দেখে ভাল লাগল।

রুতিরুনি গ্লেসিয়ার : বেসক্যাম্প
তন্ময় আর সাগর ভাইয়ের সাথে সেই বড় বোল্ডারটার কাছে ফিরে এলাম। ঘোড়া থেকে মাল নামানো শুরু করে দিয়েছে। বুঝলাম এটাই আমাদের বেসক্যাম্প। চলেন চলেন সবাই। এবার খেয়াল হলো, গত দিনগুলোতে আমাদের সাথে কখনও সামনে কখনও পিছনে থাকা আমাদের দেয়া 'হাচ' নামের কুকুরটা শুয়ে আছে ঘাসের উপর। সারা শরীর প্রশ্বাস আর নিঃশ্বাসের সাথে কখনও উঠছে কখনও নামছে। সুনশান নীরব হিমালয়ের কোলে নতুন এক বসতির গোড়াপত্তনে আমরা ব্যস্ত। খুঁজলে কিছু মেষপালকের দেখা পাওয়া ছাড়া নিকটতম ৩০ কিলোমিটারের মধ্যে কারও দেখা পাওয়া একেবারে অসম্ভব।

নদীতে পানি আনতে গেল রামলাল, কিচেন টেন্ট বা শেড যাই বলা হোক করা হলো সেই বড় বোল্ডারটার গায়ে। এবার খেয়াল করলাম এর গায়ে কোন একসময় নীল রংয়ের কালিতে তিন চার লাইন কিছু একটা লেখা হয়েছিল। মানে এখানেই আরেকবার কিংবা অনেকবার গড়ে উঠেছিল বসতি। চমন সিংয়ের মতে এর পরে গিয়ে একেবারে ক্যাম্প-১ না গেলে ভাল জায়গা মেলা ভার। সবুজ ঘাসের জমিন, পাশেই নদী, বেশ সুন্দর একটা কিচেনের ব্যবস্থা, যোগাযোগ, সবকিছু মিলিয়ে এখন এটাই সত্য যে এরচেয়ে ভাল জায়গা আমরা পেতাম না সামনের দিকে। তার উপর ঘোড়াগুলিও এগুতে পারবে না। এত মালপত্র আমাদের পক্ষে নিয়ে যাওয়া একেবারেই সম্ভব না।

এলপি গ্যাস আর বার্নারের কল্যাণে তাঁবু ফেলে ব্যাগগুলো ঢুকাতে ঢুকাতেই খাবারের বাঁশি পেলাম। দুুপুর গড়িয়ে বিকাল, ক্ষুধাতো লাগবেই। গতানুগতিক খাওয়া। তবে সমস্য হলো বাঙালির ছেলে বলে হাত না দিয়ে চামচ দিয়ে খাওয়া হচ্ছে বলে তেমন একটা জমে উঠছে না। হাত দিয়ে খেতে কোনও মানা নেই। তবে এই ঠাণ্ডায়, কনকনে ঠাণ্ডা পানিতে প্রতি বেলা হাত ধোয়ার সাহস শেরপা আর কুকদের থাকলেও আমার মতো অনেকেরই ছিল না। মালগুলোকে যথাসম্ভব একসাথে করে পলিথিনে ঢেকে রাখার আগেই গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি। যে যার তাঁবুতে। স্লিপিং ব্যাগের ভিতরে, ক্লান্ত শরীরটাকে খানিকটা উষ্ণতা দেয়ায় ব্যস্ত। বৃষ্টির শব্দের দারুণ পরিবেশ। এক নাগাড়ে পড়েই যাচ্ছে, কখনও বা খুব বেশি কখনও বা কম, তবে থামছে না। রিপনের তন্দ্রাহত চোখ, সাগর ভাইয়ের ব্যাগ গোছানোর তাগাদা, তন্ময়ের এমপি-থ্রি প্লেয়ার দিয়ে গান শোনার চেষ্টা সবকিছুই কেমন জানি একটু আলাদা। প্রকৃতি মানুষকে কেমন করে পালটে দেয়! ঢাকা শহরে কখনই আমরা এই সময় এমনভাবে শুয়ে-বসে থাকতে পারতাম না। এই শীতে একটু বাড়তি উষ্ণতার জন্য যারপরনাই কাছাকাছি থাকার চেষ্টা করা, সবই যেন পরিস্থিতির চাহিদা আর নিত্যনৈমিকতায় বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখানো।

বুদ্ধ-ধ-ধ-ধ তাঁবু ঝাড়…এই সৌরভ তোদের তাঁবুর কী অবস্থা…ইমরান…ও ইমরান…বসন্তদার ডাকে ভাবনায় ইতি দিলাম। সম্বিৎ ফিরে পাবার পর বুঝতে পারলাম তাঁবু আগের চেয়ে আর কিছুটা কাছে চলে এসেছে, ঠাণ্ডার প্রকোপটাও বেড়েছে। বৃষ্টি এরই মাঝে তুষার হয়ে গেছে তা খেয়াল করিনি। সাগর ভাই ও তন্ময় বাইরে গেল আশপাশটা পরিষ্কার করতে, আমি রিপন তাঁবু ঝাড়ার কাজে। ঢুপঢুপ শব্দ আসতে থাকলো আশপাশ থেকে। প্রায় ফুটখানেক বরফ। রিপন তন্ময়ের জন্য প্রথম প্রথম তুষারপাত। বিস্মিত মুখ দেখতেও ভাল লাগল। তাঁবুর চারপাশ পরিষ্কার করে ছাতা নিয়ে এ ওর তাঁবুতে কুশল বিনিময়, খাওয়ার কী অবস্থা, বিকালের চা হবে কিনা ইত্যাদি ইত্যাদি। এ সময় পুরোপুরি থেমে গেল ঝড়। বের হলাম সবাই। রাতের খাওয়ারও সময় হয়ে গেছে। যে যার মতো দাঁড়িয়ে পড়েছে। প্রথম দিন, তাই খাওয়ার বেশ ভাল আয়োজন। খাসির মাংস আর ভাত। গোগ্রাসে খেল সবাই। একে গরম খাবার তার উপর মাংস। নাকে-মুখে ঝোলের ঝাঁজ বুঝতে শুরু করে দিয়েছি এর মাঝে। পানি ঝরছে নাক দিয়ে। এক নিঃশ্বাসে শেষ করে যত দ্রুত সম্ভব ঢুকে গেলাম যে যার মতো।

ঠাণ্ডার চেয়ে বেশি ভয়াবহ হলো হাড় কাঁপানো বাতাস। দমকা হাওয়াতে কিছুটা সময় যে কাটাবো তারও জো নেই। শেষ গন্তব্য, তাঁবুতে, স্লিপিং ব্যাগে।

বেসক্যাম্প দ্বিতীয় দিন
আজ ক্যাম্প-১ এ লোড ফেরি করতে হবে। তবে সকালে সবাই কিছুটা আলসেমি দেখাল ঘুম ভাঙতে। রামলালের চায়ের ডাকে কয়জন তাঁবুর দরজাটা একটু ফাঁক করে মগ বের করেছে আমি অনুমান করতে পারি। আটটার দিকে বের হলাম। ভাত আর বাটার, এই হলো আমাদের প্রাতঃরাশ। তাই খাবার নেয়ায় খুব একটা রাশ দেখা গেল না। খেয়ে দিনের পরিকল্পনা জানিয়ে দিলেন বসন্তদা। গতকাল শেরপা ঠেন্ডু আর গাইড চমন সিং সামনের দিকের রাস্তা দেখে এসেছে। পরের ক্যাম্প ঘণ্টা চারের পথ। তবে পুরোটাই বিশ্রি রকমের বোল্ডারে ভরা।

মালামাল ভাগ করে দেয়া হলো সবার ব্যাগে। দশটার দিকে সবাই একসাথে বের হলাম। সবার আগে লেজ দুলিয়ে দুলিয়ে আমাদের সাথে হাচ। হাঁটা না বলে ছোটা বলাটাই ভাল। সে দৌড়ে আমরা অনেকেই এগিয়ে গেলাম। যারা পিছিয়ে পড়ল তারা বেশ পিছনে। দারুণ ভয়ে ছিলাম অনুজপ্রতীম তন্মমকে নিয়ে। তার শক্তির কোন কমতি নেই কুড়ি ছোঁয়া বিখ্যাত রাশিয়ান পর্বতারোহী আনাতো বুখারেভের মতো দেখতে প্রায় ছয় ফুটি মানুষটার এই পথে প্রথম পা ফেলা। এ পথে পায়ের পেশীশক্তির চেয়ে অভিজ্ঞতার প্রয়োজন অনেক বেশি। তাই চোখের আড়াল হতে দিলাম না কখনও। শক্তি আর অসাধারণ বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়ে এগোতে থাকল। কখনও আমার সাথে, কখনও এগিয়ে।

প্রথম ঘণ্টার কিছুটা সময় চলে গেল উঠতেই। উঠেই যাচ্ছি। তবে হাঁটার কষ্টটা কিছুটা কম অনুভূত হচ্ছে কারণ কষ্টের অনুভূতির চেয়ে বেশি হচ্ছে মাথার কাজ। কোথায় পা ফেলবো, কোথায় ফেললে কী হবে, এই চিন্তাতেই সময় শেষ। পথ বলতে বিশেষ কিছু নেই। যে দিকটাকে সুবিধার মনে করছে সেদিক দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। দূরের কোন একটা বোল্ডারের ফাঁকে হঠাৎ করেই দেখা গেল সবাইকে বসে থাকতে, মনে হলো এটাই ক্যাম্প-১। হাহ! মরীচিকা। জল পানের জন্য বিশ্রাম, পৌঁছানো মাত্র আবার ছোটা। এর অবশ্য প্রয়োজনও আছে। পাহাড়ে বেলা বারটার পর থেকে আবহাওয়া এমন ভাবে বদলে যায় যে এর কোন লক্ষণ বোঝা যায় না। আর যেহেতু আজ শুধু মালপত্র রেখেই চলে আসা তাই যেভাবেই হোক তড়িঘড়ির ব্যাপারটা থেকেই যায়।

এবার অবশ্য শিওর হলাম এটাই ক্যাম্প। বসন্তদা আর শেরপারা নিজেদের প্যাক থেকে মালগুলি বের করে এক সাথে জমা করতে শুরু করেছে। তবে জায়গাটাকে ভয়াবহ ধরনের অপছন্দ হলো আমার মতো তন্ময়েরও। একে তো ফাঁকা জায়গা তার উপর রীজের একেবারে শেষের উঁচু জায়গাতে। খানিক পাশে নদী বয়ে যাচ্ছে। পাহাড়ের দেয়ালে ঘেরা চারপাশ। তাই বাতাস যেন আমাদের পেয়ে মহা খুশি। এই গহীন পাথরের জঙ্গলে অন্তত কাউকে পাওয়া গেল, এই তার ভাব। উত্তর-দক্ষিণ মুখী বাতাসের তোড়ে কীভাবে রাত কাটাতে হবে, তাঁবু ফেলার আগেই তা ভাবতে বসলাম। বেশি সময় না নিয়ে ফেরার তাড়া সবার মাঝে, কখন আবার আবহাওয়া খারাপ হয়ে যায়। তবে সাগর ভাইরা এখনও পৌঁছেনি। রওনা হলাম, পথে যেখানে দেখা হলো তাদের সাথে মালগুলো বড় পাথরের আড়ালে রেখে সবাই একসাথে হলাম।

বেসক্যাম্পে দুপুরের খাওয়া ছিল বিখ্যাত পোস্ত আলু আর ভাত। হায়! এই খাবার, এই অমানুষিক কষ্টের পর? তাবুতে ফিরে আমাদের আলোচনার বিষয়ই হতো খাবার। ঢাকায় ফিরে কখন কী খাব। বেইস ক্যাম্প পাঠালাম সবাই। তবে আমরা শুধু নিজেদের বাড়ির ঠিকানায় ছাড়লাম। গাইড চমন সিং ফিরে যাবে। আবার সময় মতো ঘোড়া নিয়ে কবে আসবে তাও বলে দেয়া হয়েছে।

ক্যাম্প-১ (৪৪৮৫)
দুদলে ভাগ হয়ে গেছি আমরা। পাঁচ-পাঁচ করে। টিম এ আর টিম বি। প্রথম দলে আমি, সাগর ভাই, তন্ময়, বসন্তদা আর বিশ্বদা। টিম বি আমাদের ব্যাকআপ টিম হিসেবে কাজ করবে। তাই আজ আমাদের সাথে তারা আসলেও লোড রেখে আবার ফিরে যাবে বেসক্যাম্পে। আমরা থেকে যাব। বেশ পরিষ্কার আবহাওয়ার মধ্যে ক্যাম্প-১ এর তাঁবুগুলি দেখতে পেলাম কিছুটা আগে থেকেই। শেরপারা আমাদের আগেই রওনা হয়েছিল আমাদের এই বাড়তি সুবিধাটুকু দেয়ার জন্য। কেননা যদি তুষারপাত শুরু হয়ে যেত তবে তার মধ্যে তাঁবু খাটানোটা বেশ কঠিনই হয়ে যেত।

মালপত্র গুছিয়ে রাখার পর আর কোনও কাজ নেই। রান্নার কাজে সাহায্য করার নামে কিচেন শেডের বাড়তি গরমটুকু পাওয়ার জন্য খুব বেশি হলে মাটি থেকে চার ফুট উঁচু শেডের নিচে গাদাগাদি করে বসে থাকা। খাওয়ার পর তাঁবুতে। তুষারপাত শুরু হয়ে গেছে। চাইলেও আর বাইরে থাকার জো নাই। দেখতে দেখতে কালচে হলুদ রঙের পাথরগুলির উপর শুভ্র বরফের কুচি পুরো পরিবেশটা পাল্টে দিল নিমিষেই। দুপুর গড়িয়ে বিকাল। থামতেই যেন চায় না। স্লিপিং ব্যাগে গুটিশুটি মেরে বসে থাকা আর ডাইরির পাতা ভরানোই যেন জগতের একমাত্র কাজ। সাগর ভাই তার বিখ্যাত লাল রঙের ট্রাউজারটা মেরামতে ব্যস্ত। তবে সুঁইতে সুতা পরাতে ঘাম ঝরে যাওয়ার অবস্থা।

উচ্চতার সাথে মানিয়ে নেয়ার জন্যই এখানে থাকা। ধীরে ধীরে উচ্চতা অতিক্রম করা পর্বতারোহণে বাধ্যতামূলক। মাত্র তিনটা টেন্ট। তাই প্রথমবারের মতো বেশ ফাঁকা ফাঁকা লাগল। এতদিন সবাই এক সাথেই ছিলাম। এখানেই প্রথম। রাত নামার পর একটু করে বের হলাম সবাই। চাদের ঈষৎ নীলাভ আলোতে পরিবেশটা কেমন ভুতুরে মনে হলো। দিনের চেনা আলোতে দেখা আর এখনকার পরিবেশ যেন খুব অচেনা। হাড় কামড়ানো ঠাণ্ডা! বেশিক্ষণ বাইরে টিকতে পারলাম না কেউ। খাবার নিয়ে তাঁবুতে ঢুকে গেলাম। গরম জলের বোতলটাকে ভাল করে মুছে স্লিপিং ব্যাগের উষ্ণতা বাড়ানোর জন্য ঢুকিয়ে দিলাম। প্রতিদিনের নিয়ম এটা। যতটা পারা যায় কিছুক্ষণ তো এর উষ্ণতা উপভোগ করা যাবে। এতে অবশ্য আরেকটা উপকার হয়, সকালে সাধারণ তাপমাত্রার এক বোতল পানি পাওয়া যায়। কেননা তাঁবুর ভিতরে রাখলেও সেই পানি সকাল বেলা পানের উপযোগী থাকে না।

ক্যাম্প-২ (৫০৩০)
সকাল সকালই রওনা হলাম সবাই। গতরাতে তন্ময় ছিল আমাদের সাথে। আজ সবাই মিলে রওনা হলাম। কিছুটা চেনা বলেই মনে হয়। পথটাকেও ছোট মনে হলো কালকের চেয়ে। তিন তাঁবুতে আটজন। আজ শেরপারাই রান্নার কাজ করবে। দুপুরে পৌঁছানোর পর দেবাশীষদারা ফিরে গেল ক্যাম্প-১ এ। এখানে কাজের মধ্যে ছিল শরীরটাকে গরম রাখা। ভয়াবহ ঠাণ্ডা এখানে। যেসব জায়গায় আমরা ক্যাম্প করেছি তার মধ্যে এখানেই শীতের প্রকোপ সবচেয়ে বেশি। রীজের দুপাশেই ঢালু হয়ে নেমে গেছে অনেকখানি। আমাদের তাঁবু ফেলার জায়গাটা বেশি হলে ২০ ফুটের মতো চওড়া হবে। সাদা বরফ ছাড়া সমতল বলে কোন কিছু নেই। এবড়ো-খেবড়ো ভাবে মাঝে মাঝে কিছু বোল্ডার দেখা যায়।

দুপুরের খাবার শুধু ভাত আর বাটার! তবে চায়ের ব্যবস্থা করা গেল। তাঁবুতে বসে পরের দিনের কাজগুলি বুঝে নিয়ে চলে এলাম নিজের তাবুতে। স্লিপিং ব্যাগে ঢুকে আড্ডা আর বাদাম খাওয়া ছাড়া তেমন কোন কাজ করার ছিল না। কোনও বেলা খাবারের সমস্যা হলে কিংবা না খেতে ইচ্ছা করলে আমরা বেশ মজা করেই চিনা কিংবা কাজু বাদামের পোটলা নিয়ে বসতাম। কখনও খালি, কখনও বা সরিষার তেল আর মুড়ির সাথে! মাঝে মাঝে দরজাটাকে একটু ফাঁক করে দেখে নেয়া হতো বাইরের কী অবস্থা। বিকালের শেষ আলোতে বেরিয়ে এলাম বসন্তদার ডাকে, ইমরান, ও ই ই ম রা ন ন, দেখো ভারি সুন্দর একটা ওয়েদার। বের হতে ইচ্ছা না করলেও এই উচ্চতার সাথে মানিয়ে নেয়ার জন্য অবশ্যই বের হতে হবে। যত বেশি তাঁবুর বাইরে থাকা যায় ততই ভাল। এসব এলাকার মজা হলো সূর্য ডুবে যাওয়ার পরও আকাশ যদি পরিষ্কার থাকে তো রাতের অনেকটা সময়ই ঝকঝকে থাকে। দেখতে দেখতে সাদা বরফগুলি একসময় নীলচে হয়ে গেল। দূরের চূড়াগুলি আঁধারে হারিয়ে গেল কিছুক্ষণের জন্য। চাদের আলোয় শৃঙ্গগুলোকে মনে হয় বাতিঘর।

রাতের খাওয়া হলো ডিমের ঝুড়ি আর ভাত। বেশ। বেশ না আসলে, অসাধারণ। এই উচ্চতায় উচ্চতাজনিত কারণে খাওয়ার কোন রুচিই থাকে না। গতানুগতিক খাওয়া তখন হয়ে যায় অসহ্য। তাই গরম ভাতের সাথে ডিমের ঝুড়ি আর সাথে ঘি-এর মতো করে সরিষার তেল ছিটিয়ে খাওয়া।

ক্যাম্প-৩ লোড ফেরি (৫৩৭৮)
ক্যাম্প-৩ দিকে রওনা হতে হবে আজ। কেমন জানি দুরুদুরু বুক। প্রায় কাছেই চলে এসেছি রুবাল কাং শিখরের। মাত্র কটা দিন বাকি আর। দল বেঁধে লোড ফেরির জন্য বের হলাম। লোড ফেরি আর নতুন কোন বিষয় না আমাদের জন্য। তবে রক্ষা হলো উঠতি পথে এটাই শেষ। প্রথম দিকের বেশির ভাগ পথই প্রায় সমতল। মাঝে মাঝে ছোট বড় কিছু হাম্প থাকলেও তেমন কঠিন কিছু ছিল না। পূর্বে রুবাল কাংকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। উত্তরে পাশাপাশি হোয়াইট (সাদা) পিক আর ব্ল্যাক পিক। ব্ল্যাক পিকটা দেখতে একেবারে মাউন্ট এভারেস্টের নর্থ ফেসের মতো। ভীষণ রকম লম্বা এই প্রায় সমতল পথ। একঘেয়েমি পেয়ে বসার আগেই শরীর নিংরে নেয়ার মতো চড়াই পেয়ে গেলাম সামনেই। কত হবে, ৫০ মিটার, ১০০ মিটার? নিচ থেকে বলাটা বেশ শক্ত। কেননা ৩০ থেকে ৪০ ডিগ্রি কোণে এগিয়ে যাওয়া ঢালটার শেষ কোথায় তা দেখা যাচ্ছিল না। আলতো তুষারে উরু অবদি বসে যাচ্ছে। তাই সামনের জনের ফেলে যাওয়া পায়ের ছাপেই এগিয়ে যাওয়াটা সুবিধার। মাঝে মাঝে অবশ্য সমস্যাও হয়। বারবার পা ফেলার কারণে আলতো হয়ে যাওয়া বরফ শরীরের ভর ধরে রাখতে না পেরে নিচের দিকে ধসে যায়। তখন কোমর অবদি বরফের মধ্য থেকে অন্যের সাহায্য ছাড়া বেরিয়ে আসাটা ¯পষ্টতই অসম্ভব।

চড়াই ধরে এগিয়ে যাওয়ার সময় সামান্য উত্তরে বাঁক নিয়ে দেখলাম, পথ একটা বড় বোল্ডারে বাঁক নিয়ে আবার দক্ষিণ দিকে বাঁক নিয়েছে। বাম পাশটা খাড়া উঁচু আর আলতো পাথরে ভরা। বুঝে গেলাম ল্যান্ড স্লাইড প্রন এলাকা এটা। শরীরের শক্তি বলে কোনও কিছুু অবশিষ্ট নেই। তবে থেমে যাওয়ারও কোনও উপায় নেই। পর্বতারোহণের মজাই এখানে; প্রথম পা ফেলার পর আর পিছিয়ে আসতে চায় না কেউই। বেশ চড়াইটা পার হয়ে এগিয়ে যেতেই চিরচেনা তাঁবুগুলোকে দেখে দারুণ লাগল। তবে বেশিক্ষণ না থেকেই আবার রওনা হলাম ক্যাম্প-২ এর দিকে।

প্রায় বিকাল, সূর্যের তেজ কমে গেছে বেশ খানিক আগে। কুক রামলালকে দেখলাম তাঁবুটাকে ফাক করে উননের উপর কিছু একটাকে নড়াচড়া দিতে। পেটে ক্ষুধা, শরীরে সারা দিনের ঘামে ভেজা কাপড়, অস্বস্তিকর এক পরিবেশ। শরীর বিশ্রাম চায়, তাই খাওয়া শেষ করেই ঘুমিয়ে গেলাম। কাল হলো আসল পরীক্ষা।

সামিট ক্যাম্প
সকালে রওনা হওয়ার পর তেমন একটা বেগ পেতে হয়নি আজ, কেননা গতকাল রাতে নতুন বরফ পড়াতে পথ বেশ শক্ত। মচমচ শব্দ করে এগিয়ে গেলাম। তাঁবুটাকে আরেকবার ঠিক করে নিলাম। কাপড় পালটে খাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। কুকরা সবাই নিচে, শেরপারা থাকলেও রোপ ফিক্সিং করার জন্য তারা সবাই ব্যস্ত। এই হাড় কাঁপানো ঠাণ্ডায় খাওয়ার রুচি না থাকলেও খেতে হবেই, আজ রাতেই আমাদের সামিট পুশ, কতদিনের স্বপ্ন আমাদের, কত কষ্ট, সব কিছুর ইতি আর ঘন্টা কয়েক পর।

ওটমিল, দুধ, চকলেট আর বাদাম এই ছিল খাবার। শেষে বসন্তদা এলেন আমাদের তাঁবুতে। অনেক কথা হলো, কীভাবে কখন রওনা হবো, কারা কারা যাবো, কীভাবে যাবো। সন্ধ্যা ঘনিয়ে প্রায় রাতের শুরু, যদিও তখন ঘড়িতে বেশি সময় না। প্রথম দলে আমি, সাগর, তন্ময়, বসন্ত দা, বিশ্ব আর দুজন শেরপা – ঠেন্ডু আর পেমা। রাত ৩টায় উঠতে হবে এই বলে চলে গেলেন নিজের তাঁবুতে।

ঘুমাতে পেরেছি কিনা জানি না, ধড়পড় করে যা যা নেয়ার কথা, গায়ে জড়ানোর কথা, করে নিলাম। খাবার এল গরম দুধে কর্নফ্লেক্স। কোন অনুভূতি পেলাম না কোথাও, না শরীরে না মনে। কেমন যন্ত্রের মতো মনে হচ্ছে। খুটে খুটে দেখা নিয়ে রওনা হলাম এক সারিতে। চারদিক অন্ধকার। তবে বরফের উপর নিজের ছায়া দেখে বেশ অস্বস্তি হচ্ছিল। প্রায় সমতল পথে এগিয়ে যাওয়া। গতকাল এ পথে শেরপারা এসেছিল বেশ বোঝা গেল। খানিক পর সমতল মিশে গেল প্রায় ৩৫ ডিগ্রির সাথে। উঠা শুরু করে দিলাম। ধীরে খুব ধীরে, প্রথমটায় ধাতস্থ হতে সময় লাগছিল। তবে খানিক বাদে বেশ ফিট। পূর্বাকাশে আলোর আভাস।

ক্রাম্পন লাগাতে বললেন বসন্তদা। তবে গতরাতে হয়ে যাওয়া এভেলাঞ্চে বেশ কিছুটা জায়গার বরফ ধসে যাওয়ায় পথ খানিকটা বদলাতে হলো। সামিট ক্যাম্প দেখা তিনটি বড় বড় রক ফেসের পাশ দিয়েই আমাদের পথ। এ পর্যায়ে প্রথমটায় আমরা। রোপে টান পড়ল, পিছনে তাকিয়ে দেখলাম, কিছু হয়নি। আবার উঠা শুরু করলাম, আবার টান পড়ল। ফিরে তাকিয়ে দেখলাম তন্ময় আর সাগর বেশ নিচে একসাথে কথা বলছে। চিৎকার করে জানতে পারলাম, সাগর স্নো গগল্স নিয়ে আসেনি। রক্ষা হলো আমাদের কাছে বাড়তি ছিল বলে।

সময় বাড়ছে, বাড়ছে আলো.. পূর্ব আকাশে সূর্যের আভা, নিচে ক্যাম্পটাকে দেখা যাচ্ছে অনেক ছোট, পিঁপড়ার মতো নড়াচড়া করছে কে? আমাদের শেরপা? উপর থেকেও ¯পষ্ট দেখা যাচ্ছে কারমাজিকে। পথে আমরা আটকে পরে আছি, পেমা এগিয়ে যাচ্ছে রোপ ফিক্স করতে। পথটা বেশ খাড়া, ঠিকমতো দাঁড়িয়ে থাকতেও সমস্যা হচ্ছ্।ে দুপা আগে পিছে করে ভারসাম্য রক্ষা করেই কথা চালিয়ে যাওয়া। এরপর আর পথ কতটুকু। আমাদের প্রয়োজনীয় রোপ আছে কিনা। আরও কতটা সময় লাগবে। এটা সেটা আরও কত প্রশ্ন। অর্বাচীনের মতো আরও কত কথা আমার পেটে ঘুরপাক খাচ্ছিল। সময়ই বলে দিলো এখানে নিরাপত্তার কথা জিজ্ঞেস করাটা খুবই বেমানান। পর্বতারোহণ হলো সেই খেলার যেখানে পর্বতারোহী নিজেই নিজের বিচারক। তার গৌরব বা পরাজয়ের অংশীদার সে নিজেই। আর নিরাপত্তার প্রশ্নটা আরও ভয়ঙ্কর, তাই বলা হয়ে থাকে পর্বতারোহণের সময় তুমি কখনই মারা যাবে না কেননা তুমি যে মৃত সেই চিন্তা মাথায় রেখেই তুমি পর্বতারোহণে এসেছ। উল্টাপাল্টা চিন্তা করতে করতে আমরা এগিয়ে যেতে থাকলাম। কর্নেসের উপর দিয়ে স্টেপ কেটে এগিয়ে যাওয়া ছাড়া আর কোনও রাস্তা নেই। কর্নেস হলো ঝুলে থাকা বরফের দেয়াল। আমাদের বাড়িঘরের জানালায় যে কর্নেস থাকে ব্যাপারটা আসলে সে-রকমই।

যতটা দ্রুত উঠতে পারব বলে আশা করা গেছে কিন্তু রোপ লাগানোর জন্যই সময়টা বেশি লাগছিল। সাত জন একসাথে। একটা রোপে এগিয়ে যাওয়া। সামিট দেখা যাচ্ছে সামনে। কিন্তু মাঝখানে একটা বড় রীজ। বেশ সরু এবং তারপর বটল নেকের রক ব্যান্ড- সেখান থেকে আরও ৫০ ফুটের মতো, সামিট। রক ব্যান্ডের সামনে যাওয়ার পর আরোহণের কোন রাস্তাই পাওয়া যাচ্ছিল না। প্রায় ঘন্টা খানেকের প্রানায়ন্তকর পরিশ্রমের পর ঐ পথটুকু পেরুলাম আমরা। সামিটে আগেই পৌছে গেছে শেরপা ঠেন্ডিব। আমরা একে একে উঠে এলাম। বাধনহারা কান্নায় আত্মহারা আমরা, সবাই। কে বাংলাদেশী, কে ভারতীয়, কে তিব্বতী – ভীম শীতে চোখের জলের লোনা স্বাদ সবাই পেলাম তাতে কোন সন্দেহ নাই। দেশের পতাকা হাতে নেয়ার সময় গর্বে হারিয়ে গেল ভয়। এত উঁচুতে আমরা – এত উঁচুতে যে উচ্চতায় কেউ জাতীয় পতাকাকে নিয়ে আসেনি। গর্ব হবেই! আর এ গর্বের কথা ভাবতে কিংবা বলতে আরও গর্ববোধ হয়। দলগত ছবি উঠানোর পর আর বেশিক্ষণ থাকার সময় পেলাম না। হঠাৎ করেই চারদিকে তুষারের সাদা আবরণ। ঘড়ির দিকে তাকালাম, বেলা আনেক, গত কয়েক সপ্তাহের নিয়মানুযায়ী বেলা ১২টার পর থেকেই হাওয়া হতে থাকে দমকা। তুষারপাতের সময় এখন। পড়িমরি করে নামা শুরু। নামার পথটাও আর শেষই হতে চায় না।

বেলা তখন তিনটা। বিকালের সোনালী আবেশে টেন্টগুলোকে দারুণ লাগছে দূর থেকে, তার থেকেও ভাল লাগছে, ওহ! অবশেষে ফিরে এলাম যদিও না আরও অনেক পথ বাকি। আজই ফিরতে হবে ক্যাম্প-২ এ। ভারি কাপড় ছেড়ে সামান্য কিছু মুখে দিলাম। টিম বি চলে এসেছে। আজ তারা আরোহণের চেষ্টা চালাবে। আমরা তিনজন আর বিশ্বদেব রওনা হলাম প্রায় সাড়ে চারটার দিকে। ক্যাম্প ১ থেকে রেখে যাওয়া মালগুলো একসাথে করে নিচে নেমে আসার সময় বিশ্রি রকম ঝড়ের মধ্যে পড়লাম। বেশখানিকটা দেরি হলেও যখন বেসক্যাম্পে পৌঁছলাম, আনন্দে অভিভূত রিপন- অশোকদাকে জড়িয়ে কান্না চেপে রাখতে পারলাম না। অবশেষে ফিরে এলাম বেসক্যম্পে। দেশে ফেরার তাগাদ অনুভব করলাম। ভরপেট খেয়ে শুয়ে পড়লাম, তলিয়ে গেলাম ঘুমে, স্বপ্নে বাংলাদেশ।

muntasir@gmail.com