এদের একটু আনন্দ দিন, ভালোবাসুন

বেবী মওদুদ
Published : 2 Dec 2009, 05:18 PM
Updated : 2 Dec 2009, 05:18 PM

৩ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী দিবস। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও নানা অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে দিবসটি পালিত হবে। প্রতিবন্ধীদের কল্যাণ ও উন্নয়নের লক্ষ্যে অনেক কথা উচ্চারিত হবে।

উন্নত দেশে এসব প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা হলেও অনুন্নত দেশের প্রতিবন্ধীরা অসহায় ও মানবেতর জীবনযাপনে বাধ্য হয়। সাধারণত জন্মগত, অসুস্থতা ও দুর্ঘটনাজনিত কারণে মানুষ প্রতিবন্ধী হয়ে থাকে। মা-বাবার কাছে এসব প্রতিবন্ধী একরকম বোঝা হয়ে থাকে। পারিবারিক ও সামাজিকভাবে তাদের প্রতি কোনও বিশেষ উদ্যোগ দেখা যায় না।

১৯২০ সালের প্রথম দিকে যুক্তরাজ্যের ব্রিস্টলে জেমস বিগস নামে এক ব্যক্তি অন্ধদের সাদা ছড়ি আবিষ্কার করে তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন করে তোলেন। এরপর থেকেই পাশ্চাত্যের বিভিন্ন হাসপাতাল প্রতিবন্ধীদের জন্য চিকিৎসা ব্যবস্থা গড়ে তোলে। পাশাপাশি সমাজকল্যাণ সংস্থাগুলিও প্রতিবন্ধীদের অধিকার নিয়ে আন্দোলন গড়ে তোলে। জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠিত হলে তারা প্রথমে মানবাধিকার সনদ ঘোষণা করে। পরে শিশু ও নারীর অধিকার সনদে প্রতিবন্ধীদের স্বার্থে প্রস্তাব গ্রহণ করে।

৯ ডিসেম্বর ১৯৭৫ সালে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ প্রতিবন্ধীদের অধিকার রক্ষার জন্য ঘোষিত ঘোষণাপত্রে বলা হয়েছে যে, "প্রতিবন্ধী ব্যক্তি বলতে বোঝায় যে ব্যক্তি আংশিক বা পূর্ণাঙ্গভাবে ব্যক্তি বা সমাজ জীবনে প্রয়োজনীয় চাহিদা পূরণে এবং এর ফলে শারীরিক বা মানসিক অধঃস্তন অবস্থার শিকার; আর্থ-সামাজিক পরিকল্পনার সকল পর্যায়ে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের বিশেষ চাহিদাকে বিবেচনায় নিতে হবে; প্রতিবন্ধী ব্যক্তির পরিবারের সঙ্গে অথবা পালিত অভিভাবকের সঙ্গে বাস করার এবং সকল সামাজিক, সৃষ্টিশীল ও বিনোদনমূলক কার্যক্রমে অংশগ্রহণের অধিকার রয়েছে। একজন প্রতিবন্ধী ব্যক্তির জন্য পরিবারে বসবাসরত অন্যান্য সদস্যের ন্যায় অভিন্ন পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। যদি প্রতিবন্ধী ব্যক্তির জন্য কোনও বিশেষ ব্যবস্থায় যেতেই হয় সেক্ষেত্রে তার পরিবেশ এবং জীবনযাত্রার মান তার সমবয়সী স্বাভাবিক অন্য মানুষের সঙ্গে যতটা সম্ভব অভিন্ন রাখতে হবে।"

১৯৯৩ সালে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ প্রতিবন্ধীদের সমঅধিকার সংক্রান্ত ২২ দফার একটি স্ট্যান্ডার্ড রুলস অনুমোদন করে। এতে উল্লেখ করা হয়, প্রতিবন্ধীদের জন্য আইন প্রণয়ন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, প্রবেশাধিকার, তথ্য ও যোগাযোগ, সচেতনা, প্রশিক্ষণ, অর্থনৈতিক উন্নয়নসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে রাষ্ট্র যেন কার্যকর ভূমিকা নিতে পারে।

প্রতিবন্ধীদের অধিকার হিসেবে যে দশটি বিষয় বিবেচনা করা হয়ে থাকে সেগুলো হচ্ছে:
১. পারিবারিক জীবন ২. আশ্রয় ৩. খাদ্য ৪. শিক্ষা সম্পৃক্ততা ৫. শিক্ষা এবং প্রশিক্ষণ ৬. অবসর জীবন ৭. সরকারি সেবা ৮. সংগঠন ৯. আর্থিক সুযোগ সুবিধা ১০. রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা।

বাংলাদেশে মোট জনসংখ্যার দশভাগ প্রতিবন্ধী। তার মধ্যে তিনভাগ বুদ্ধি প্রতিবন্ধী রয়েছে বলে গবেষকরা বলে থাকেন। অধিকাংশই জন্ম থেকে এই অবস্থার শিকার। শারীরিক প্রতিবন্ধীদের চিকিৎসার জন্য ঢাকায় একটি পঙ্গু হাসপাতাল আছে। এছাড়া বিভিন্ন হাসপাতাল ও ক্লিনিকে অন্ধ, বধির, বোবা এবং বুদ্ধি প্রতিবন্ধীদের সাধারণ রোগীদের সঙ্গে চিকিৎসা দেওয়া হয়। এসব চিকিৎসার মধ্যে অপারেশন, ফিজিওথেরাপি ছাড়াও নিউরো সার্জারির চিকিৎসা দীর্ঘদিন ধরে চলে। সাধারণ রোগী বেশি হওয়ায় প্রতিবন্ধীদের প্রতি জরুরিভাবে যত্ন নেওয়াও চিকিৎসকদের পক্ষে সম্ভব হয় না।

এজন্য প্রতিবন্ধীদের অভিভাবক ও সংগঠনগুলো দীর্ঘদিন ধরে সরকারিভাবে একটি প্রতিবন্ধী হাসপাতোল প্রতিষ্ঠার দাবি করে আসছে, যেখানে তাদের চিকিৎসা, পরামর্শ ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা থাকবে।

সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে সরকারের নানা উদ্যোগ ও উন্নয়ন পরিকল্পনা রয়েছে। সরকারের একটি নীতিমালাও আছে। অসচ্ছল প্রতিবন্ধীদের জন্য মাসিক ভাতার ব্যবস্থাও আছে। শারীরিক প্রতিবন্ধীদের জন্য শিক্ষা, প্রশিক্ষণ ও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা থাকলেও তা উন্নতমানের নয়। বুদ্ধি প্রতিবন্ধীদের জন্য স্পেশাল শিক্ষার স্কুল আছে এবং পুনর্বাসন ও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা আছে। প্রতিবন্ধী সংগঠনগুলোরও নিজস্ব প্রকল্প রয়েছে। বিশেষ অলিম্পিকে অংশ নিয়ে প্রতিবন্ধীরা স্বর্ণপদক নিয়ে আসায় তাদের উন্নয়নের জন্য সরকার ক্রীড়া শিক্ষায় বাজেটে বিশেষভাবে অর্থ বরাদ্দ রেখেছে। কিন্ত সবই বিচ্ছিন্নভাবে। সমন্বয়হীনতার কারণে অনেক প্রতিবন্ধীর আভিভাবকরা কোথায় যাবে, কার কাছে যাবে সেটা বুঝে উঠতে পারে না।

প্রতিবন্ধী ফোরামের মহাসচিব জওয়াহেরুল ইসলাম সেদিন বললেন, "প্রতিবন্ধীদের পারিবারিক ও সামাজিকভাবে বিশেষ সম্মান ও মর্যাদা দিতে হবে। রাষ্ট্রীয়ভাবে তাদের শিক্ষা, চিকিৎসা, চিত্তবিনোদন, যাতায়াত ব্যবস্থা উন্মুক্ত রাখতে হবে। তাদের মেধা ও প্রতিভা বিকাশে সহযোগিতা করতে হবে।"

ঢাকার ফিরোজা বারি পঙ্গু শিশু হাসপাতালে ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা নিতে আসা শিশুদের মায়েদের সঙ্গে কথা বললে তারা আমাকে জানান, এরা একটু আনন্দে থাকতে চায়। এরা গান শুনতে ভালোবাসে। এদের কাছে বসুন, ভালোবাসুন। এরাও আপনাকে ভালোবাসবে।