একুশে, কালে কালে

হাসনাত আবদুল হাইহাসনাত আবদুল হাই
Published : 2 March 2010, 11:53 AM
Updated : 2 March 2010, 11:53 AM

একুশে বলতে এক সময় কেবল একুশে ফেব্রুয়ারিকেই বুঝিয়েছে যদিও সেই দিনটির তাৎপর্য ছিল সুদূর প্রসারিত। উনিশ শো বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারিতে পাকিস্তানী ঔপনিবেশিক শাসকবৃন্দ সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও পূর্ব পাকিস্তানের বাংলা ভাষাভাষীদের মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার জন্য রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গ্রহণের অস্বীকৃতি জানিয়ে জনতার দাবি বন্ধের উদ্দেশ্যে যে হত্যাযজ্ঞ ও নিপীড়ন চালিয়েছিল এবং যার ফলশ্রুতিতে শহীদ হয়েছিলেন বরকত, সালাম এবং আহত হয়েছিলেন প্রতিবাদ মিছিলে অংশগ্রহণকারী আরো অনেকে তাদের  প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর জন্যই উদযাপিত হয়েছিল প্রথম পর্বের একুশে ফেব্রুয়ারি। বায়ান্নর পর যে পর্যন্ত বাংলা ভাষা অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পায় নি সেই সময় একুশের উদযাপন কেবল শ্রদ্ধা জ্ঞাপনে এবং দিনটিকে স্মরণ করার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। স্বৈরচারি অগণতান্ত্রিক শাসকদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষার আন্দোলন অব্যাহত রাখাও ছিল সেই সময়ের একুশে উদযাপনের উদ্দেশ্য। যখন রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলা স্বীকৃতি পেল তখন শহীদদের স্মরণ করা এবং শ্রদ্ধা জানানোর পাশাপাশি স্থান পেল পূর্ব বাংলার বাঙালিদের অন্যান্য নায্য অধিকার আদায়ের বিষয়। তখন একুশে উদযাপনে কেবল ভাষার শহীদদের স্মরণ শ্রদ্ধা জ্ঞাপন গুরুত্ব পায় নি, ভাষার মর্যাদা রক্ষার প্রশ্নও শীর্ষে ছিল না। বায়ান্নর রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন রূপান্তরিত হয়েছিল পূর্ব বাংলার মানুষের জন্য স্বায়ত্ব-শাসনের দাবিতে। এইভাবে একুশের চেতনার উত্তরণ ঘটেছিল বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে যেখানে রাজনীতি এবং অর্থনীতির সব মৌলিক প্রশ্ন প্রাধান্য পেয়েছিল। এরই ধারাবাহিকতায় উনিশশো একাত্তরে এসেছিল মুক্তিযুদ্ধের আহ্বান এবং শুরু হয়েছিল স্বাধীনতা অর্জনের দুর্বার অভিযান। রাষ্ট্রভাষা থেকে স্বায়ত্বশাসন এবং তারপর স্বাধীনতা লাভ, একুশের চেতনা এই ভাবে ধীরে কিন্তু নিশ্চিত ভাবে অগ্রসর হয়েছে এবং উদ্বুদ্ধ করেছে পূর্ব বাংলার মানুষকে।

উনিশ শো একাত্তরের ষোল ডিসেম্বর স্বাধীনতা অর্জনের পর একুশের তাৎপর্য ও ভূমিকা বদলে যায়, যা ছিল অনিবার্য। রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার স্বীকৃতি প্রশ্ন আগেই নিশ্চিত হয়েছিল। স্বাধীনতার পর বড় হয়ে দেখা দিল জাতীয় জীবনের সর্বস্তরে এর ব্যবহারের বিষয়টি। সরকারের পক্ষ থেকে এক্ষেত্রে কোনো প্রশ্ন তোলা হয় নি, কিন্তু এই দাবি বাস্তবায়নে পরিকল্পনার অভাব দেখা গিয়েছিল। উপযুক্ত পরিভাষার অভাবে এবং শৈথিল্য প্রকাশের জন্য সরকারি কাজে বাংলা ভাষা ব্যবহার স¤পূর্ণভাবে বাস্তবায়িত হয়নি। রাজনীতিবিদদের জন্য বিব্রতকর হলো এই সত্যটি যে, আশির দশকে সামরিক শাসনের সময় অবশেষে সুস্পষ্ট নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল সকল সরকারি দপ্তরে বাংলা ব্যবহার করতে হবে। তারপর থেকে সরকারি কাজে বাংলার ব্যবহার আর ঐচ্ছিক হয়ে থাকলো না। এখন সচিবালয় থেকে উপজেলা পর্যায়ে সব সরকারি দপ্তরেই বাংলায় সব কিছু লেখা হয়। কেবল উচ্চ বিচারালয়ের ক্ষেত্রে বিষয়টি এখনো ঐচ্ছিক রয়ে গিয়েছে। ব্যবসা-বাণিজ্য, ব্যাঙ্ক, ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির কাজে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে যোগাযোগ রক্ষার জন্য ইংরেজিই ব্যবহৃত হচ্ছে বেশি। এতে হয়তো আপত্তির কারণ নেই, যেমন ব্যতিক্রমী মনে করতে হবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ইংরেজি ভাষার ব্যবহার। সর্বস্তরে বাংলা ভাষা ব্যবহারের মধ্যে উচ্চ শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে এর ব্যবহার বেশ গুরুত্বপূর্ণ। এমন ভাবে শিক্ষিত হলেই পরবর্তীতে উচ্চ শিক্ষিত যারা তাদের পক্ষে কর্মজীবনে বাংলা ব্যবহার সহজ ও স্বতঃস্ফূর্ত হতে পারে। দুঃখের বিষয় ক্লাস রুমে বাংলা শিক্ষা দেওয়া হলেও কলেজ, বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষাক্রমে অনেক বিষয়েই বাংলায় লেখা বইয়ের অভাব প্রকট। এই কাজটি বাংলা একাডেমীর করার কথা। তারা এক্ষেত্রে শোচনীয়ভাবে পিছিয়ে আছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এবং বাংলা একাডেমীর এ ক্ষেত্রে যৌথ উদ্যোগ গ্রহণ করে সুপরিকল্পিতভাবে পরিভাষা তৈরি এবং তার ভিত্তিতে টেক্সট বই লেখার কর্মসূচি হাতে নেওয়া জরুরি হয়ে পড়েছে। এখানে তৎপরতার অভাব বেশ হতাশাজনক।

প্রাথমিক শিক্ষার পর্যায়ে  বাংলা ভাষায় লেখা বইয়ের অভাব নেই; মাধ্যমিক শিক্ষার ক্ষেত্রেও তাই। তবে প্রাথমিক শিক্ষা পর্যায়ে জাতিগত ভাবে সংখ্যালঘিষ্ঠ গোষ্ঠীর এবং আদিবাসীদের নিজ মাতৃভাষায় শিক্ষা লাভ প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের প্রক্রিয়া বলতে গেলে শুরুই হয় নি। একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি পাবার পর এর প্রয়োজন জরুরি হয়ে পড়েছে। আগেই বলা হয়েছে, একুশের চেতনা কেবল বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষা এবং সর্বস্তরে এর ব্যবহারে সীমাবদ্ধ নয়। এই চেতনার তাৎপর্য সুস্থ গণতন্ত্রের চর্চা থেকে শুরু করে সকল মৌলিক অধিকার উপভোগ পর্যন্ত বিস্তৃত। মৌলিক অধিকারে কেবল বাক স্বাধীনতা বা চলাফেরার স্বাধীনতা নেই, এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত জীবনযাপনের জন্য প্রয়োজনীয় সকল বস্তুগত সুযোগ সুবিধা লাভে ন্যায় সম্মত অংশ গ্রহণ এবং প্রাপ্তি। ন্যায় সম্মতভাবে মৌলিক চাহিদাগুলি প্রাপ্তির সুযোগ সরকারকেই নিশ্চিত করে দিতে হবে। প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে (বেসরকারি খাত নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে)। স্বাধীনতা লাভের পর একুশের উদযাপনে একুশের চেতনায় উল্লেখ করা হলেও এই সব আর্থ সামজিক এবং রাজনৈতিক চাহিদা ও তা পূরণের কথা বলা হয় না। বর্তমানে একুশের উদযাপনে এটাই অসম্পূর্ণতা এবং ত্রুটি।

এখন একুশের উদযাপন দুটি বিষয় গুরুত্ব পাচ্ছে। প্রথমটিতে রয়েছে ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন, যা একুশের মধ্যরাত থেকে শুরু হয় এবং পরবর্তী চব্বিশ ঘণ্টা হয়ে থাকে। উদযাপনের এই অংশ চিরকাল এমনই থাকবে, এখানে পরিবর্তনের প্রশ্ন ওঠে না। দ্বিতীয় যে বিষয় এখন প্রাধান্য পাচ্ছে তা হলো বইমেলা। ফেব্রুয়ারির প্রথম তারিখ থেকে বাংলা একাডেমীর পক্ষ থেকে সারা মাসই বই মেলা করে ভাষার প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের কথা বলা হলেও প্রকৃত পক্ষে এটি হয়ে দাঁড়িয়েছে একুশের বাণিজ্যিকীকরণ। বইমেলা হোক, আরো বড় আকারে হোক, এ নিয়ে বিতর্ক নেই। তবে একুশের উদযাপনে বাংলা একাডেমীর উদ্যোগে বই মেলা হতে হবে কেন? হলেও সেই মেলায় সব ধরনের বই থাকবে কেন ? একুশে উদযাপনে বাংলা একাডেমীর বিশেষ ভূমিকা রয়েছে যা বাণিজ্যিক বই মেলা দিয়ে পালন করা যায় না। প্রতিটি একুশের উদযাপনে বাংলা একাডেমীকে দেখাতে হবে বাংলা ভাষার উন্নতিতে এবং উচ্চ শিক্ষার মাধ্যমসহ সর্বস্তরে এর ব্যবহারের জন্য কী কর্মসূচি নেওয়া হয়েছিল এবং তার কতটুকু বাস্তবায়ন হয়েছে। এই সম্পর্কে গবেষণা ভিত্তিক তথ্য পরিবেশের জন্য আলোচনা অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করতে হবে। এখনো পহেলা ফেব্রুয়ারি থেকে বাংলা একাডেমীতে আলোচনা সভা হয় তবে সেই সব আলোচনার বিষয়ের মধ্যে ভাষার উন্নতি এবং উচ্চশিক্ষার মাধ্যম সহ সর্বস্তরে বাংলা ব্যবহারে অগ্রগতির বিষয় অন্তর্ভুক্ত থাকে না। থাকলেও নিতান্তই দায়সারা ভাবে। এর পরিবর্তন হওয়া প্রয়োজন। বাংলা একাডেমীকে তার মূল দায়িত্বের কথা মনে রেখে একুশের উদযাপনে কার্যকরী কর্মসূচি তৈরি করতে হবে। বাংলা একাডেমীর প্রাঙ্গণে যে মেলা হবে সেখানে স্থান পাবে ভাষা ও ভাষা ব্যবহারের নানা বিষয় কেন্দ্রিক বই, গবেষণাপত্র, অভিধান, পরিভাষার বই এবং বিদেশী ভাষা থেকে বাংলায় প্রয়োজনীয় বইয়ের অনুবাদ। একইভাবে বাংলায় লেখা গুরুত্বপূর্ণ বইগুলি ইংরেজীতে অনুদিত হতে হবে যেন বহির্বিশ্বে বাংলা ভাষার পরিচিতি বৃদ্ধি পায়। বড় আকারের যে বই মেলা; তার ব্যবস্থা অবশ্যই থাকবে ফেব্রুয়ারিতে, তবে সেখানে উদ্যোক্তা হবে পুস্তক প্রকাশক সমিতি এবং পৃষ্ঠপোষক হিসেবে থাকবে গ্রন্থকেন্দ্র। এই মেলা বাংলা একাডেমীর প্রাঙ্গণ থেকে বেরিয়ে এসে একাডেমীকে তার বর্তমানের বাড়তি দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিবে। এই ব্যবস্থা একুশের উদযাপনকে কেবল সময়োপযোগী করে তুলবে না, দায়িত্বের যৌক্তিক বিভাজনের জন্য এর ফলাফল হবে উত্তম।