আন্তর্জাতিক নারী দিবসের শতবর্ষ পূর্তি

বেবী মওদুদ
Published : 7 March 2010, 03:45 PM
Updated : 7 March 2010, 03:45 PM

৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবসের শতবর্ষ উদযাপিত হচ্ছে এবার। দেশে দেশে নারীসমাজ অধিকার আদায় ও পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্রে তাদের ক্ষমতায়নের দাবিতে এবারও এই দিবসটি উদযাপন করবে। একশ বছর আগে ১৯১০ সালের এইদিনে জার্মানির প্রগতিশীল আন্দোলনের নেত্রী ক্লারা জেৎকিন ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে ঘোষণা করেন। তারপর থেকেই সমাজতান্ত্রিক দেশে রাষ্ট্রীয়ভাবে এবং বিভিন্ন দেশে বেসরকারিভাবে পালিত হয়ে আসছিল। আন্তর্জাতিক গণতান্ত্রিক নারী ফেডারেশন দীর্ঘদিন ধরে দাবি জানানোর পর জাতিসংঘ তার সদস্য দেশগুলোকে এই দিবস পালনের আহ্বান জানালে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে এখন বিভিন্ন দেশ দিনটি বিপুল উৎসব-উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে পালন করে থাকে। পরিবারে-সমাজে-রাষ্ট্রে নারীর সম-অধিকার ও সম-মর্যাদার দাবিটি সর্বত্র উচ্চারিত হয়ে থাকে। নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, তার মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করা রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব;কিন্তু পৃথিবীর উন্নত-অনুন্নত সবদেশেই নারীর অবস্থান ও তার জীবনযাপনের চিত্রটি বড়ই মলিন। সুযোগ-সুবিধা প্রাপ্ত ক্ষুদ্র একটি নারী সমাজ ভালো অবস্থায় থাকলেও বৃহত্তর নারীসমাজ এখনও অবহেলিত, নির্যাতিত এবং দারিদ্র্র-দু:খে জীবনযাপনে বাধ্য হয়ে আছে। পুরুষ তার শক্তি ও অর্থ আয়ের কারণে নিজেকে সুরক্ষিত, ভোগ-বিলাসী রাখতে সমর্থ হয়েছে। পরিবার সন্তান পরিত্যক্ত করে সে অন্যত্র চলে যেতে পারে। কিন্তু নারীর পক্ষে সেটা সম্ভব হয় না। নারী সন্তান ধারণ ও জন্মদান করে এবং লালন-পালন করে বলেই মানবসভ্যতা আজ উন্নত।

নারীর এই আন্দোলনের সুত্রপাত ১৮৫৭ সালে আমেরিকার একটি সূচ তৈরির কারখানায়। কারখানার নারী শ্রমিকরা প্রথম সম-মজুরির দাবিতে ও শ্রম নির্যাতনের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করলে দমন-নিপীড়ন নেমে আসে। নারীর সম-অধকার ও ভোটাধিকারের দাবিটিও সারা বিশ্বে সোচ্চারিত হয়। তাদের এই আন্দোলনের প্রতি সমর্থন ও সহানুভূতি জানিয়ে ইউরোপের নারীসমাজও ঐক্যবদ্ধ হয়। দিবসটি স্মরণীয় করে রাখার জন্য তারা ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবসের ঘোষণা দেন। তাদের দাবিতেই জাতিসংঘ প্রথমে ১৯৭৫Ñ১৯৮৫ নারী দশক পালন করে। তারপরই তারা এ দিবসের স্বীকৃতি দেয় এবং দেশে দেশে পালনের আহ্বান জানায়। এরপর থেকেই জাতিসংঘের সদস্য দেশগুলি দিবসটি জাতীয়ভাবে পালন করে আসছে এবং নারীর সম-অধিকার রক্ষায় উন্নয়নে বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করে। ১৯৭২ সালে প্রণীত বাংলাদেশের সংবিধানে সর্বক্ষেত্রে নারী-পুরুষের সম-অধিকারের স্বীকৃতি রয়েছে। এছাড়াও আন্তর্জাতিক মানবাধিকারের দলিল, নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য অপনোদন দলিল (সিডো), বেইজিং প্ল্যাটফরম ফর অ্যাকশন, নারীর অধিকার মানবাধিকার এইসব ঐতিহাসিক দলিলে সদস্য রাষ্ট্রসমূহ শর্তহীনভাবে নারীর সম-অধিকারের অঙ্গীকার করে। বাংলাদেশের নারী উন্নয়ন নীতিমালাও এর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। নারীর শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির পাশাপাশি নারীর ক্ষমতায়নেও আজ এক বিস্ময় বাংলাদেশ।

একশ বছর আগে পৃথিবীর অনেক দেশেই নারীর শিক্ষা স্বাস্থ্য-সেবা ও আর্থিক স্বনির্ভরতা অর্জন সম্ভব ছিল না। দেহ-ব্যবসাই নারীর পেশা হিসেবে বিবেচিত হতো এবং পুরুষই ছিল তার ব্যবস্থাপক ও পৃষ্ঠপোষক। নারীর ধর্ম ছিল সংসারের কাজ কর্ম করা ও সন্তান ধারণ জন্মদান। নারীও যে শিক্ষার্জন করতে পারে, অর্থোপার্জন করে স্বাধীনভাবে জীবনযাপন করতে পারে, সৃজনশীল সাধনার চর্চা করতে পারে এটা পুরুষের চিন্তাভাবনার বাইরে ছিল। ধর্মের অপব্যাখ্যা, সামাজিক কুসংস্কার ও রক্ষণশীল তত্ত্ব দ্বারা নারীকে তারা নিয়ন্ত্রণ করতো। তারা অপব্যাখ্যা দিয়ে প্রচার করতো নারী শিক্ষার্জন করলে সন্তান জন্ম দিতে পারবে না। কিন্তু নারী দেখিয়ে দিয়েছে তারা মেধা-দক্ষতা ও শ্রমশক্তিতে পুরুষের চেয়ে কোন অংশে কম নয়। সে তার নারীত্বকে ধারণ করেই পরিবারে-সমাজে-রাষ্ট্রে যথেষ্ট অবদান রাখতে পারে। ঘরে-বাইরে সব কাজ সুষ্ঠু ভাবে করতে পারে। চিকিৎসক, বিচারক, সৈনিক, প্রশাসক, শিক্ষকতা, শিল্প-কলা ও সাহিত্য চর্চা, ফসলের মাঠে, কারখানায়, ব্যাংকে-ব্যবসায় সর্বত্র নারী আজ কর্মরত। এমনকি রাষ্ট্রপতি-প্রধানমšী¿-মন্ত্রী-সংসদ সদস্য হিসেবেও রাষ্ট্রপরিচালনার দায়িত্ব পালন করে চলেছে যোগ্যতার সাক্ষর রেখে। নারীর এই যে সকলক্ষেত্র অংশগ্রহণ, এটা আমাদের আনন্দিত করে সন্দেহ নেই, কিন্তু মনে রাখতে হবে এই অবস্থানে আসতে হয়েছে অনেক সংগ্রাম করে, অনেক সাধনা ও সাহসিকতার মধ্য দিয়ে।

তারপরও আমরা দেখি নারী পরিবারে নির্যাতিত হয় স্বামীর দ্বারা। সম্পত্তিতে তাদের বঞ্চিত করে পিতা-স্বামী ও ভাইরা। সমাজে নিরাপদে চলাফেরা করার অধিকার খর্ব ও লুণ্ঠন করা হয়। ধর্ষণ-অপহরণ-হত্যা-পাচার বিক্রয় করা হয়। নারীকে পুরুষতন্ত্র সবসময় ভোগের সামগ্রী ও পণ্য হিসেবে বিবেচনা করে যা সভ্যতার অভিশাপ ছাড়া কিছু নয়। যুদ্ধ-দাঙ্গা-হাঙ্গামা, সন্ত্রাসী কর্মকা-ের শিকার হয় নারী। দারিদ্র নারী জীবনের আরেকটি অভিশাপ। দারিদ্র্রের কারণে সে ঘরের বাইরে আসতে বাধ্য হয়েছে সত্য, মাটিকাটা, নির্মাণ কাজ, পোষাক তৈরি, ফসলের মাঠেও সে কাজ করে চলেছে খাওয়া পরার অভাব ঘোচাতে। কিন্তু সেখানেও রয়েছে বঞ্চনা-বৈষ্যম্যসহ নানাপ্রকার দুর্ভোগ। কোনোভাবে জীবনযাপন করার একটা আশ্রয় মেলে কিন্তু তার কোন স্থায়ীত্ব নেই, ভবিষ্যতও নেই।

এই মানবেতর জীবনযাপন থেকে নারীকে মুক্তি দেবার একমাত্র উপায় শিক্ষা, তারপর ফসলের প্রান্তর ও গৃহপালিত পশু উৎপাদনের কাজে মেয়েদের নিয়োজিত করতে পারি, তাহলে অনেকখানি এগিয়ে যাওয়া সম্ভব। বিশেষ করে কৃষিজাত শিল্প গড়ে তোলার কাজেও আমরা মেয়েদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা নিতে পারি। পোষাক তৈরি কারখানাতে মেয়েরা দক্ষতা ও যোগ্যতার স্বাক্ষর রেখেছে এবং বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জনের দেশ সক্ষম হয়েছে।

পারিবারিক নির্যাতন থেকে রক্ষা ও সামাজিক নিরাপত্ত্যা নিশ্চিত রাখতে হলে অবশ্যই সরকারি আইনের যথাযর্থ প্রয়োগ ছাড়াও মেয়েদের দ্বারাই কমিউনিটি নিরাপত্তা রক্ষাবাহিনী গড়ে তুলতে হবে। ধর্মীয় গোঁড়ামি ও অপব্যাখ্যা, যৌন নিপীড়ন, যৌতুক, ধর্ষণ, সম্পত্তি থেকে বঞ্চনা, বহুু বিবাহ, তালাক, ফতোয়া ইত্যাদির অভিশাপ থেকে নারীকে রক্ষা করতে হলে সামাজিক আন্দোলনও গড়ে তোলা দরকার।

আমাদের দেশের নারীর সমস্যাগুলির সঙ্গে এশিয়ার অন্যান্য দরিদ্র দেশের নারীর সমস্যার খুব বেশি পার্থক্য নেই। পুরুষের কঠোরতা ও দমনপীড়নের চিত্র সর্বত্র প্রায় একইরকম। তাপরও তারা শিক্ষা-দীক্ষা ও কর্মসংস্থানে অনেকখানি এগিয়ে গেছে বলে মর্যাদা এবং সম্মানও পেয়ে থাকে। উন্নত দেশগুলোতেও নারীর ওপর যৌন নিপীড়ণ এবং বৈষম্য বঞ্চনার শেষ নেই। কল্যাণধর্মী দেশগুলোতেও নারী খুব ভালো অবস্থায় নেই। সেখানে মৌলিক অধিকার নিশ্চিত হয়েছে সত্য, মেয়েরা সমাজে ও রাষ্ট্রে শ্রম বিনিয়োগেও যথেষ্ট দায়িত্বশীল। কিন্তু যৌন নিপীড়ন সেখানেও নারীর ভাগ্যকে কলুষিত করে রাখে। যৌন স্বাধীনতার শ্লোগান তুলে কেউ কেউ নারীর পক্ষে সাফাই গেয়ে থাকেন, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে নারী কি সেই স্বাধীনতা ভোগ করতে সক্ষম হয়েছে। পুরুষের হাতেই সে বন্দি এবং পণ্য হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।

এবার আন্তর্জাতিক নারী দিবসে জাতিসংঘ ঘোষিত বিষয় হচ্ছে "সম-অধিকার, সমান সুযোগ, সকলের জন্য অগ্রগতি।" আমরা প্রত্যাশা রাখতে পারি নারীর ভাগ্যোন্নয়নে পুরুষ তার সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেবে। নারীর পাশে দাঁড়াতে হবে পিতা, স্বামী, ভাই, সন্তান ও বন্ধুর অবস্থান থেকে। নারীর বিড়ম্বনা ও অসহায়ত্ব দূর করতে পারলে পরিবারে ও সমাজে তার অবস্থান দৃঢ় হবে, সম্মানজনক হবে। একুশ শতকে এসে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি আমাদের জীবনযাপন সহজ সাধ্য করেছে তাহলে শান্তিময় ও মানবিক সম্পন্নও করে তোলা সম্ভব। যুদ্ধ-সন্ত্রাস দাঙ্গাহাঙ্গামা বন্ধ করতে হবে, মানুষের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলা, সমাজ-সংসার ভেঙে-পুড়িয়ে ধ্বংস করে দেওয়াও কোনো বিবেকসম্পন্ন ব্যক্তিত্বের হতে পারে না। বিশ্বকে শান্তিময় মঙ্গলময় করে তোলার দায়িত্ব নারী-পুরুষ উভয়ের। আমরা সেই প্রচেষ্টা নিতে পারি আগামী প্রজন্মের ভবিষ্যতকে আনন্দময় করার লক্ষ্য সামনে রেখে।