সালভাদর দালি: গোঁফ দিয়ে কথা বলা

রাজু আলাউদ্দিন
Published : 1 Nov 2007, 05:26 AM
Updated : 1 Nov 2007, 05:26 AM

গোঁফবিষয়ে একটি নাতিদীর্ঘ নন্দনতত্ত্ব ও ফটোগ্রাফিক সাক্ষাৎকার/ ফিলিপ হলসম্যান

ভূমিকা ও অনুবাদ: সুমন রহমান


সালভাদর দালি। চিত্রশিল্পী এবং সেলিব্রিটি। কেউ বলেন, আগে সেলিব্রিটি এবং পরে চিত্রশিল্পী! মজার বিষয় হল, দ্বিতীয় মতাবলম্বী যারা তাদের পুরোভাগে দালি স্বয়ং। তিনি একদিন কথাচ্ছলে বলছিলেন, 'সামারে অনেক আমেরিকান ট্যুরিস্ট আমায় দেখতে আসে। তারা কি আমার ছবি দেখতে আসে? মোটেও না! তাদের সবার আগ্রহ আমার গোঁফের ব্যাপারে। মহৎ চিত্রকলার দরকার নাই পাবলিকের, দরকার খালি একটা জম্পেশ গোঁফ।'

আকর্ষণীয় গোঁফ ছিল বটে দালির। কখনো কখনো, কারো কারো কাছে, কোনো কাজের চেয়ে ঐ কাজের কাজীর দাড়িগোঁফ বেশি প্রিয় হয়ে ওঠে। জনশ্রুতি আছে, মৃত্যুর পর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সৎকার হয়েছিল চুলদাড়ি ছাড়াই। ভক্তের জন্য এরচে দামি অটোগ্রাফ আর কী হতে পারে? বা ধরা যাক নস্ট্রাদামাস, আর্কিমিডিস, বা কপার্নিকাসের কথা, আমরা সবাই তাদের নানাবরণ দাড়ির খবর রাখি, কিন্তু তাদের ঠিক ঠিক হাড়ির খবর রাখে কয়জনা? বিংশ শতকে হিটলার, স্ট্যালিন ও চ্যাপলিনের মৃত্যুতে পৃথিবীর গোঁফসাম্রাজ্যে যে শূন্যতা দেখা দিতে শুরু করছিল, দালির গোঁফ যেন সেই
শূন্যতার ওপর সুররিয়াল প্রলেপ হয়ে এল।

সেই গোঁফজোড়াকেই কথা বলিয়েছেন ফটোগ্রাফার ফিলিপ হলসম্যান। নানান গোঁফাভিব্যক্তি দিয়ে দালি উত্তর দিয়েছেন তার বিভিন্ন প্রশ্নের। এসব নিয়ে ১৯৫৪ সালে বেরিয়েছিল 'Dali's Mustache' নামে একটা বই। সে বইয়ের ভূমিকা লিখতে গিয়ে সালভাদর দালি তার গোঁফ নিয়ে যে প্রশস্তিটুকু লিখেছিলেন সেটি সহ সাক্ষাৎকারের কিছু অংশ তুলে ধরা হল।

'এবং নিজকে দিয়ে বানাও, তাড়াহুড়ায় বা শান্তচিত্তে, আহ্! এর বিকল্প নাই'
– আন্দ্রে জিঁদ

পূর্বকথা/ সালভাদর দালি
আমার বয়স যখন তিন তখন বাবুর্চি হতে চেয়েছিলাম। ছ'বছর বয়সে হতে চাইলাম নেপোলিয়ন। তখন থেকেই আমার উচ্চাকাঙ্ক্ষা ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। ২৯ বছর বয়সে যখন প্রথম আমেরিকার মাটিতে পা দিলাম, সেই দিনই টাইম
ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদে ওরা আমার ছবি ছাপায়। সেই ছবিতে দেখা যায়, পৃথিবীর সবচে ছোট একটা গোঁফ পরে আছি আমি। তখন থেকে দুনিয়া কেবল চুপসে যেতে থাকে আমার চারপাশে আর আমার গোঁফ, আমার কল্পনাশক্তির মত, ক্রমেই ফুলে-ফেঁপে উঠতে থাকে।

ধূমপান করি না, তাই ভাবলাম একটা গোঁফ গজাতে দেয়া যাক, গোঁফ থাকা নিশ্চয়ই স্বাস্থ্যের জন্য ভাল! যাক, ধূমপান না করলেও আমি সবসময় একটা মুক্তোখচিত সিগারেট কেস সাথে রাখি, যার ভেতর সিগারেটের বদলে রাখা আছে নানান ধরনের গোঁফ। ঠিক এডলফ মেনজো স্টাইল। যথোচিত বিনয়সহ সেসব গোঁফ আমি আমার বন্ধুদের সাধাসাধি করি: 'গোঁফ লাগবে? গোঁফ? গোঁফ?'

মজার ব্যাপার হল, তাদের কেউই সেসব ছুঁতে সাহস করত না। গোঁফের মধ্যে একটা পুতপবিত্র ব্যাপার যে আছে, আমি এভাবে সেটা টের পেলাম।

বাইবেলে মনুষ্য কেশরাশির বেড়ে ওঠার ব্যাপারে বেশ গুরুত্ব দেয়া আছে। দেলাইলা চুলের ক্ষমতায় বিশ্বাস করত, দালিও সেটা করে। সপ্তদশ শতকের ন্যাচারাল ম্যাজিকের উদ্ভাবক লা পোর্ত ভাবতেন, গোঁফ কিংবা ভুরু হচ্ছে এন্টেনা। কীটপতঙ্গ যেমন তাদের সুঁচালো এন্টেনা দিয়ে অনেক খবরাখবর পায়, তেমনি এইসব মনুষ্য-এন্টেনা মারফত সৃজনশীল প্রেরণাগুলো মানুষের মন পর্যন্ত পৌঁছায়। প্লেটোর বিস্ময়কর ভুরুজোড়া, কিংবা তার চেয়েও নিবিড় ঘন এবং প্রায় চোখ-ঢেকে-ফেলা লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি-র ভুরুজোড়া হচ্ছে মুখস্থ কেশরাশির সবচেয়ে উজ্জ্বল নজির।

কিন্তু মুখস্থ কেশরাশির সবচেয়ে দুর্দান্ত ডিসপ্লে দেখার জন্য দুনিয়াকে বিশ শতক পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছে। দালির গোঁফ দেখার আগ পর্যন্ত সেটা সম্ভবই ছিল না। এখানে গোঁফের নানারকম উদ্ভাবনী ব্যবহারের কিছু দৃষ্টান্ত থাকল। অবশ্য প্রতিদিনই আমি গোঁফের নতুন নতুন ব্যবহার খুঁজে পাই। এই যেমন আজ সকালে, শেভ করার আগে আগে, হঠাৎ মনে হল আমার গোঁফকে বেশ আলট্রা-পারসনাল ব্রাশ হিসাবেও কাজে লাগানো যায়! গোঁফের সূঁচালো আগা দিয়ে আমি একটা মাছি পুরা ডিটেলে এঁকে ফেলতে পারি।

আর এই মাছি আঁকতে আঁকতে গোঁফ সম্পর্কে নানান দার্শনিক ভাবনাও মনে আসছে আমার। এই সেই গোঁফ যেখানে আমার সময়ের সকল মাছি আর কৌতূহল আঠার মত লেগে থাকার জন্য ছুটে আসছে। কোনোদিন কেউ হয়ত এই গোঁফজোড়ার মতই অদ্ভূত আরেকটা সত্য আবিষ্কার করবে – ও হ্যাঁ, সালভাদর দালি, ওই গোঁফঅলা, সম্ভবত
ছবিটবিও আঁকত!

আচ্ছা, তোমায় কিছু প্রশ্ন করতে পারি?


পার। তবে আমার গোপনীয়তা নাশের চেষ্টা করো না।

তুমি গোঁফ রাখ কেন?


লোকচক্ষু থেকে নিজেকে আড়ালে রাখার জন্য।

বরাবরের মতই, মাথার অনেক ওপর দিয়ে গেল। কি বোঝাতে চাইছো?


আমার গোঁফ, অতন্দ্র প্রহরীর মত, আমার আত্মাকে লোকজনের নাগালের বাইরে রাখে।

কিন্তু এরকম গোঁফ নিয়ে সমস্যা হয় না? বিশেষত যখন তুমি ভ্রমণ কর?


না। তেমন না। একটু গিঁট দিয়ে রাখতে হয় আর কি।

ছবি আঁক কেন?


কারণ, আমি শিল্পকলা ভালবাসি।

ছবিতে তুমি এমন দুর্দান্ত ডিটেল কর কিভাবে?


কারণ আমার সবচেয়ে চমৎকার যন্ত্রটা প্রকৃতিদত্ত।

তোমার কি কোনো সুনির্দিষ্ট স্টাইল এসে গেছে?


না। আমি পুরাপুরি মোবাইল।

অসুন্দর কী?


বিশৃঙ্খলা।

সুন্দর কী?


ঐকতান।

সুররিয়ালিজম কী?


সুররিয়ালিজম হচ্ছি আমি।

তুমি কি তোমার নিজের ব্যাপারে খুবই নিশ্চিত?


হুম, সামান্য কিছু অন্তর্দ্বন্দ্ব ছাড়া।

কানে কানে বলি, তুমি কি একজন বহির্মুখি প্রদর্শনবাদী নও?


ননসেন্স! আমি আসলে অস্বাভাবিক রকমের অন্তর্মুখী।

দালি, তোমার সাফল্যের গোপন রহস্য কী?


সঠিক সময়ে সঠিক মক্ষিকাটির জন্য সঠিক মধুর জোগান দিতে পারা।

তোমার মত একজন সফল শিল্পী কি জনস্তুতির থোড়াই তোয়াক্কা করে?


আমি সবসময় প্রশংসা পাবার আশায় ছিপ ফেলে রাখি।

তোমার প্রিয় পারফিউম কোনটা?


দ্য এসেন্স অব দালি।

তোমার গোঁফকে তো বেশ দৃঢ় মনে হয়। জনমতের দমকা হাওয়ায় সে কী করে?


বেঁকে বসে।

দালি, তুমি মোনালিসা-র মধ্যে কী খুঁজে পাও?


অতুলনীয় সৌন্দর্য।

বন্ধুদের কাছে লেখাটি ইমেইল করতে নিচের tell a friend বাটন ক্লিক করুন: