রচনার পটভূমি : ডি. এইচ. রেলওয়ে

আবুল হোসেন
Published : 1 Nov 2007, 05:51 AM
Updated : 1 Nov 2007, 05:51 AM

ডি. এইচ. রেলওয়ে

শিলিগুড়ি থেকে দার্জিলিঙ : কী গাড়ি!
আঁকাবাঁকায় ঘুরন্ত চাকায় গরগর গরগর
গর্জে বুনো বাঘেরা। গুড়ো গুড়ো মধ্যাহ্নের পাথর
ছড়িয়ে ছিটকিয়ে ওড়ে পাহাড়ে পাইনে পাতালে।
দুরন্ত বেগে উড়ন্ত মেঘে শার্সির কাঁচে লেগে
চিনেমাটির ঠুনঠুনে পবন খান খান।
দুমদাম উঠলাম ছুটলাম নামলাম ঘামলাম।
কী গাড়ি।

দীর্ঘায়ত দীপ্ত বর্শার মতো মধ্যদিন :
ছুটছি শিলিগুড়ি থেকে দার্জিলিঙ।
সামনে পিছে ওপরে নীচে তরঙ্গিত পর্বত,
শনশন এক প্রকাণ্ড ঝোড়ো চিল
উড়ছে নীলে অক্লান্ত পাখায় ঘুরে ঘুরে,
সহসা বিদ্যুৎ-শীর্ণা বাঁধাকপি, চা, ভুটানী তন্বী পাইন মেঘে,
বাঁকানো শিং বুনো বাইসন এই ট্রেন
শিলিগুড়ি থেকে উঠছে দার্জিলিঙ।

বারবার ছাড়বার নামবার থামবার ঘুর্ণিত চক্রে
চক্ষে বক্ষে অন্তরীক্ষে পর্বত ঘর্ঘর
পর্বত পর্বত পর্বত বর্বর বর্বর ঝরঝর পাথ্বর
ঝক্ঝক্ ঝিক্‌ঝিক্ চিক্চিক্ কাঞ্চন ঝন্ঝন্ জংঘা
বর্ষার ঝম্ঝম্ জানালায় চিত্তের পর্বতে
ঝাউ আর পাইনের হাততালি ডুবিয়ে নাচে
এ কী উজবেগী নাচ
এ কী উড়ো গাড়িরে!

রচনা ১৯৪০

এক.
১৯৪০ সালের জুন মাসে আমি দার্জিলিঙ-এ যাই বেড়াতে। কলকাতা থেকে শিলিগুড়ি গেলাম দার্জিলিঙ মেল-এ।

শিলিগুড়ি থেকে বাস-টাস তেমন ছিল না। সেকালে বাসের রাস্তাও ভালো ছিল না। ট্রেনেই যেতে হতো। ট্রেন-আশ্চর্য ট্রেন। মার্ক টোয়েন নাম দিয়েছিলেন টয় ট্রেন। খেলনা রেলগাড়ি। ট্রেন ঘুরে ঘুরে পাহাড়ে ওঠে। তার দুটো ইনজিন। একটা সামনে, আর একটা পেছনে। প্রথমে শিলিগুড়ি থেকে কার্সিয়ং-এ গেলাম। কার্সিয়ং-এ দিন পাঁচ-ছয় থাকলাম। তারপরে গেলাম দার্জিলিঙ-এ। ওখানে গিয়ে শুনলাম রবীন্দ্রনাথ এসেছেন মংপুতে। এর আগে ফেব্রুয়ারি মাসে শান্তিনিকেতনে গিয়েছিলাম রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা হয়েছিল। দু'একজন পাহাড়ীকে জিজ্ঞেস করলাম, মংপু কত দূর? ওরা বললো আঠারো মাইল। ভাবলাম তাহলে তো মংপুতে হেঁটেই যাওয়া যায়।

দার্জিলিঙ থেকে প্রতিদিন সকালে হেঁটে চলে যেতাম ঘুম-এ। দার্জিলিঙ থেকে পাঁচ মাইল। ওখানে একটা খুব বিখ্যাত বৌদ্ধ মন্দির আছে। সেখানে বুঁড়ি ছুঁয়ে দুপুরে ফিরতাম। আবার ফিরতাম। ভাবলাম দশ মাইল তো রোজই সকালে হাঁটি, সুতরাং আর আট মাইল গেলেই তো মংপুতে যেতে পারি।

তো একদিন সকালে হেঁটে ঘুম-এ গেলাম। খানিক জিরিয়ে আবার হাঁটতে শুরু করলাম। সঙ্গে ছিলেন হুমায়ুন কবিরের ছোট ভাই আকবর কবির। পরে তিনি তথ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন জিয়ার আমলে। আমি রবীন্দ্রনাথকে দেখতে যাচ্ছি শুনে তিনি বললেন, কবিকে কখনো দেখিনি, আপনার সঙ্গে আমিও যাবো।

হাঁটছি তো হাঁটছি, কিন্তু মংপু আর আসে না। কিছু দূর যাই, খানিক থামি। রাস্তায় মাঝে মাঝে ভুটানিদের ছোট ছোট দোকানে চা বিস্কুট খেয়ে আবার হাঁটা শুরু করি। যখন মংপুতে পৌঁছলাম তখন বিকাল সাড়ে চারটা।

মংপুতে সিনক্রোনা প্ল্যানটেশনের ম্যানেজার ছিলেন মৈত্রেয়ী দেবীর স্বামী। রবীন্দ্রনাথ মাঝে মাঝে ওখানে যেতেন। গিয়ে শুনি রবীন্দ্রনাথ ওখান থেকে চলে গেছেন। তাঁকে কালিম্পং-এ নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ওঁর শরীরটা ভালো যাচ্ছিল না। ওরা ভেবেছিলেন কালিম্পং-এ থাকলে সহজে কলকাতায় যেতে পারবেন। কালিম্পং-এ ময়মনসিংহের গৌরীপুরের মহারাজার বাড়িতে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন অতিথি হয়ে। তো, মংপুতে মৈত্রেয়ী দেবীকে পেলাম না, রবীন্দ্রনাথকে পেলাম না, কিন্তু দেখা হয়ে গেল আমার কলেজের প্রিন্সিপাল ভূপতি মোহন সেনের সঙ্গে। বি. এম. সেন আমাকে বললেন, তোমরা এখানে কী করছো? উনি মংপুতে ওর এক আত্মীয়ের বাসায় এসেছিলেন ছুটি কাটাতে। আমাদের সেখানে নিয়ে গেলেন। চা-টা খাওয়ালেন। বললেন, তোমরা আজ এখানে থেকে যাও। আমরা বললাম, না আমরা সন্ধ্যায়ই চলে যাবো। উনি একটা জিপ দিয়ে আমাদের পৌঁছে দিলেন আট মাইল দূরে রিলবং-এ। ওখানে তিস্তা নদী বয়ে যাচ্ছে। তার পাড়ে রাস্তার পাশে পাখির বাসার মতো একটা ডাকবাংলো। রাত্রিটা ওখানে থাকলাম।

পরদিন সকালে আমরা আবার হাঁটতে আরম্ভ করলাম কালিম্পং-এ যাবার জন্য। ওই রাস্তায় অনেক গাড়ি-টাড়ি চলে। আমরা হেঁটে যাচ্ছি দেখে অনেকে বললেন, আসুন আমাদের সঙ্গে, আপনাদের পৌঁছে দিচ্ছি। কিন্তু আমরা বললাম, না আমরা হেঁটেই যাবো। আকবর কবিরের শখ ছিল হিচ হাইকিং-এর। উনি কিছুতেই গাড়িতে যাবেন না। হেঁটেই যেতে হবে।

আমরা সকাল আটটায় বেরিয়েছিলাম। কালিম্পং-এ গৌরীপুর ভবনে যখন পৌঁছালাম-তখন দুপুর সাড়ে বারোটা বাজে। রবীন্দ্রনাথের সেক্রেটারি তখন ছিলেন খুব সম্ভব সুধাকান্ত রায়চৌধুরী। উনি আমাকে চিনতেন। উনি বললেন, গুরুদেব খাওয়া-দাওয়া করে বিশ্রাম করছেন। এই সময় তো দেখা করা সম্ভব না, আপনারা কাল আসুন।

আমরা বারান্দায় কথাবার্তা বলছিলাম। রবীন্দ্রনাথ পাশের ঘরেই বিশ্রাম করছিলেন। আমাদের কথাবার্তার আওয়াজ পেয়ে তিনি সেক্রেটারিকে ডাকলেন-সুধাকান্ত, কে?

সুধাকান্ত বাবু ঘরের ঘরের ভিতরে গিয়ে আমাদের কথা বললেন। রবীন্দ্রনাথ বললেন, ওদের নিয়ে এসো। সুধাকান্ত আমাদের বললেন, চলুন ভিতরে যাই। তো, আমরা তিনজনে ভিতরে গেলাম। গিয়ে দেখি রবীন্দ্রনাথ একটা খাটে শুয়ে আছেন। সমস্ত শরীর একটা কালো চাদরে ঢাকা। আমি পা ছুঁয়ে প্রণাম করলাম। প্রণাম করে দাঁড়িয়ে আছি। একটু পরে রবীন্দ্রনাথ যেন আপন মনে কথা বলছেন এমনি ভাবে বললেন, 'শুনেছো আজ প্যারিসের পতন হয়েছে। শিক্ষা সংস্কৃতি সভ্যতার শ্রেষ্ঠ কেন্দ্র বর্বরদের হাতে পড়ে গেল। এখন আর বেঁচে থেকে কী লাভ।' এইটুকু বলে রবীন্দ্রনাথ চোখ বন্ধ করলেন। আমরা তিনজন দাঁড়িয়ে আছি, মিনিট দুই চলে যাওয়ার পরে সুধাকান্ত বাবু ইশারা করলেন, চলুন, আমরা বাইরে যাই। আমরা নিঃশব্দে বেরিয়ে এলাম।

ফিরে এসে ওই সময়ে আমি লিখলাম 'চোখের দেখা'। এই গদ্য রচনাটি কোন কাগজে লিখেছিলাম এখন আর আমার মনে নেই। বহু বছর পরে, সেদিন আবার এই ঘটনাটা লিখলাম, জনকণ্ঠে। কলকাতায় ফিরে আসার কয়েক মাস পরে 'ডি. এইচ. রেলওয়ে' কবিতাটি লিখি। ডি. এইচ. রেলওয়ে মানে দার্জিলিঙ হিমালয়ান রেলওয়ে। কবিতাটি প্রথম ছাপা হয় বুদ্ধদেব বসুর কবিতা পত্রিকায়, ১৯৪১ সালে। ছাপার পরে দুএকটা শব্দ হয়তো বদলানো হয়েছে। তবে খুব সামান্য।

তিন/সাড়ে তিন যুগ পরে আবদুল মান্নান সৈয়দ এই কবিতাটি নিয়ে সংবাদ-এ একটা দীর্ঘ প্রবন্ধ ["আবুল হোসেন-এর 'ডি. এইচ. রেলওয়ে"] লেখেন। রশীদ করীমও ষাটের দশকে এই কবিতাটি নিয়ে লিখেছিলেন দৈনিক পাকিস্তানে। পরে সেটা স্থান পেয়েছে তার প্রবন্ধের বই-তে।

দুই.
কবিতায় আমি কী করতে চাই সেটা প্রথম দিকেই ধরতে পেরেছিলাম। নতুন একটা কিছু করতে না পারলে কোথাও জায়গা হবে না। ছেলেবেলায় যখন স্কুলে পড়তাম তখন যা লিখতাম তা রবীন্দ্রনাথের অনুসরণেই হতো। রবীন্দ্রনাথ বেঁচে থাকতে কেউ তো রবীন্দ্রনাথকে এড়িয়ে যেতে পারেন নি। অমিয় চক্রবর্তী, সুধীন দত্ত, বুদ্ধদেব বসু সবাই রবীন্দ্রনাথকে অনুসরণ করে লিখতেন। শুধু দু'জন ছিলেন ব্যতিক্রম। তিনজনই বলতে পারি। বিষ্ণু দে, সমর সেন এবং জীবনানন্দ দাশ। অমিয় চক্রবর্তী তো বহুদিন পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথের অনুসরণে লিখতেন। আধুনিক কবিতা লিখতে শুরু করলেন ১৯৩৮ সাল থেকে। তখন আমার লেখাও কবিতায় বেরুচ্ছে।

দীপ্তি ত্রিপাঠি, যিনি আধুনিক কবিতা সম্পর্কে প্রথম বই লেখেন, তিনি তিরিশের পঞ্চ পাণ্ডবের কথা বলেছেন। আমি এর সঙ্গে দুটো নাম যোগ করতে চাই। সমর সেন এবং প্রেমেন্দ্র মিত্র। পঞ্চ পাণ্ডবরা সবাই ছিলেন ইংরেজির অধ্যাপক। ওঁরা আমার আট দশ বছর আগে থেকেই আধুনিক কবিতা লিখছেন। আমার জন্ম ১৯২২ সালে আর ওঁদের ১৮৯৯ থেকে ১৯১৮ সালের মধ্যে। সমর সেন আমার পাঁচ ছয় বছরের বড়। আমি যে বছর প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হলাম সে বছরই তিনি পাশ করে চলে গেলেন।

আমি 'দিকনির্ণয়' বলে একটা কবিতা লিখেছিলাম। ওখানেই আছে আমি কোন পথে যাবো। আমি মনে করি বাংলায় সমর সেনই খাঁটি গদ্য কবিতার প্রথম রচয়িতা। যদিও তার অনেক আগেই রবীন্দ্রনাথ গদ্য কবিতা লিখেছেন। কিন্তু সে কবিতার জাত ভিন্ন। রবীন্দ্রনাথের ধারণা সব বিষয়ে গদ্য কবিতা লেখা যায় না, গদ্য কবিতার বিষয় ভিন্ন।

আধুনিকরা রবীন্দ্রনাথের কথায় সায় দিলেন না। তারা বললেন, সব বিষয়ই গদ্য কবিতার বিষয়। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে সুধীন দত্তের খুব ভালো সম্পর্ক ছিল। রবীন্দ্রনাথ সুধীন দত্তকে বললেন, লেখো তো মোরগ নিয়ে একটা কবিতা। সুধীন দত্ত চ্যালেন্জট্ াগ্রহণ করলেন এবং লিখে পাঠালেন 'কুক্কুট' বলে একটা কবিতা। পড়ে রবীন্দ্রনাথ একদম চুপ করে গেলেন।

আমার সঙ্গেও রবীন্দ্রনাথের গদ্য কবিতা নিয়ে একটা বাহাস হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ আমার এক প্রবন্ধের ('গদ্য কবিতা ও রবীন্দ্রনাথ'; দু সংখ্যায় মোহাম্মদীতে বেরিয়েছিল, ১৯৩৯ সালে) জবাব দিয়ে প্রবাসীতে লিখলেন 'গদ্য কাব্য'। সেখানে তিনি বললেন, প্রাত্যহিক যেসব বিষয় সেটাই গদ্য কবিতার বিষয়। আরো অনেক কথা বলেছিলেন, তার মধ্যে এটাই ছিল প্রধান কথা। এটা আমি কোনোদিন মানি নি। আজও মানি না। কিন্তু তখন তো কলেজে পড়ি। রবীন্দ্রনাথ প্রতিবাদ করার পর আমি চুপ করে গেলাম।

আমি তখন ঠিক করলাম, কবিতার বিশেষ ভাষা আমি বর্জন করব। আমি কবিতা লিখব প্রতিদিন যে ভাষায় আমরা বৈঠকখানায় বসে গল্পগুজব করি, বাজারসদাই করি সে ভাষায়। সুতরাং আমি কবিতায় গদ্য আনবার চেষ্টা করলাম। সেই সঙ্গে আমার মনে হল ছন্দ, মিল, সুর কবিতার আঙ্গিকের এই বৈশিষ্ট্যও এই ভাষায় আনতে হবে। সুতরাং সমর সেনের নিছক গদ্য থেকে আমি কিছুটা সরে গেলাম। গদ্য কবিতায় মিল আনবার চেষ্টা করলাম। সমিল গদ্য কবিতা লিখতে শুরু করলাম। বাংলা সাহিত্যে এর আগে এটা কেউ করেনি। পরে কিছু লোকে করেছে। তার মধ্যে বাংলাদেশে সাইয়িদ আতীকুল্লাহ একজন।

১৯৪০ সালে প্রকাশিত আমার প্রথম বই নববসন্ত-এ তার একটা কবিতা আছে 'বাংলার মেয়ে' (রচনা ১৯৩৯)। সমিল গদ্যের শুরু এই কবিতায়। এটাকে আমার একটা বড় কাজ মনে করি। ডি. এইচ, রেলওয়েকে আমি ওইভাবে সমিল গদ্য বলি না। 'বাংলার মেয়ে' যে ছন্দে লেখা একে সেই দলে ফেলা যাবে না। কিন্তু এটা কোনো প্রথাগত ছন্দের কবিতাও না। বিভিন্ন ছন্দ মিলিয়ে একটা অর্কেস্ট্রা তৈরি করা হয়েছে এখানে। এর মধ্যে স্বরবৃত্ত, মাত্রাবৃত্ত; ছয়মাত্রা, পাঁচমাত্রা, চারমাত্রা, তিনমাত্রা সবই পাওয়া যাবে। এটা তো বললাম ছন্দের ব্যাপার। অন্য জিনিসও আছে। অন্ত্যর্মিল আছেই। আর এই যে পরাবাস্তব নিয়ে লাফালাফি, আমি কিন্তু তিরিশ পয়ত্রিশ বছর আগেই পথ দেখিয়েছিলাম।

পুরো 'ডি. এইচ. রেলওয়ে' কবিতাটিই শিলিগুড়ি থেকে দার্জিলিং পর্যন্ত এক ট্রেন ভ্রমণের কাহিনী। ট্রেনটা যখন পাহাড়ের ভেতর দিয়ে যায় তখন গুম গুম আওয়াজ হয়। আমি গাড়িতে বসে আছি। গাড়ি উঠছে-নামছে। আমার ঝাঁকুনি লাগছে। আর সেই ঝাকুনিতে পাথর পাত্থর হয়ে যাচ্ছে। পাহাড়ের গা বেয়ে ঝর্নার পানি পড়ছে। ভাবছি, কাঞ্চনজংঘা কখন দেখব। ঝিকমিক চিক চিক করছে ঝর্নার পানি। সোনার মতো। কাঞ্চন…কাঞ্চন…কাঞ্চনজংঘা…মাথার মধ্যে ঝন্ ঝন্, ঝন ঝন শব্দ। এ কী উড়ো গাড়ি রে! পিছন থেকে কে যেন বলছে এ কী উজবুগ গাড়ি রে…এ কী উজবেগী নাচ শুরু করে দিল গাড়িটা? এইটাই হচ্ছে কবিতাটা। মারুফ রায়হান কোনো এক সময় লিখেছিল, মনে হবে সমস্ত পাহাড়টাই বুঝি নাচছে। হয়তো আমিই তাকে বলে থাকব।

নববসন্ত বেরিয়েছিল ১৯৪০-এর সেপ্টেম্বরে। জুনে দার্জিলিঙ ভ্রমণ থেকে ফিরে পাঁচ ছয় মাস পরে নভেম্বর-ডিসেম্বরে লিখি 'ডি. এইচ. রেলওয়ে'।

দারুণ এক ঘোরের মধ্যে লেখা হয়েছে কবিতাটি। আমি তো লেখার সময় ভীষণ কাটাকুটি করি। কিন্তু এটা যখন লিখি তখন একবারেই লেখা হয়ে গিয়েছিল। প্রায় এক বসাতেই লিখেছি। প্রায় ৬৫ বছর হলো এই কবিতার বয়স। তখন আমি কলেজের ছাত্র। বিএ পড়ি।

ট্রেন নিয়ে আমার আরো একটা কবিতা আছে। 'ডি. এইচ. রেলওয়ে'র আগেই কবিতা পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল। এই যে যন্ত্র নিয়ে কবিতা লেখা, বাংলায় তখন খুব বেশি ছিল না। আমার 'ডায়নামো' কবিতাটাও তখন অনেকের মুখে মুখে ছিল। আমার প্রথম বই নববসন্তেই আছে। এটা বেরিয়েছিল যদ্দূর মনে পড়ে ১৯৩৯-এ যুগান্তর শারদীয় সংখ্যায়। তখন আমার বাসা ছিল কলকাতায় ২৪ নম্বর হায়াত খাঁ লেনে। হায়াত খাঁ লেনের উল্টোদিকেই ছিল রিপন কলেজ। ওখানেই ডায়নামোটা ছিল। মানুষের বুকের মধ্যে হৃদপিণ্ডে যেমন ধকধক শব্দ হয়, রাত্রির বুকের মধ্যে ডায়নামোতেও বুঝি সেই রকম আওয়াজ শুনছিলাম আমি।

ওই কবিতাটাও খুবই ভালো লাগে আমার। খুবই স্যাটিসফাইং একটা কবিতা। এরও কিছু বদলাতে পারি না আমি।

২০০৫-২০০৭

—–

লেখকের আর্টস প্রোফাইল: আবুল হোসেন
ইমেইল: szareen11@yahoo.com


ফেসবুক লিংক । আর্টস :: Arts