ফাউলের দৌরাত্ম্য!

রাজু চাকলাদার
Published : 27 Jan 2016, 09:17 PM
Updated : 27 Jan 2016, 09:17 PM

লালফিতার দৌরাত্ম্যের চেয়েও সুক্ষ্মতরভাবে নিকৃষ্ঠ ফাউলদের দৌরাত্ম্য। সমাজ-রাষ্ট্র পেরিযে এখন আন্তর্জাতিক পার্যায়ে বিস্তৃত হচ্ছে ফাউলরা। আমেরিকা(USA) নিজে একটি ফাউল রাষ্ট্র (Rouge State) অথচ দুনিয়াব্যাপি ফাউলদের ( ইরান, উত্তর কোরিয়া, কিউবা, আল -কায়েদা, আই.এস ইত্যাদি) নির্মূলের বাণী কপচায়! মানবাধিকার, গণতন্ত্রের দোহাই দিয়ে তেল সমৃদ্ধ দেশগুলোতে সামরিক অভিযান চালানো, মিছেমিছি একটা যুদ্ধ-যুদ্ধ ফ্লেভার দিয়ে নিজের কব্জায় নেওয়ার ধান্দাকরাটা তো ঐতিহাসিক ভাবে সত্য! Cold War Period, Post-Cold War Period এবং সর্বশেষ ৯/১১ এর পরবর্তী বিশ্বব্যবস্থায় তাকিয়ে দেখুন,সমগ্র বিশ্বে যারা সবচেয়ে বড় ফাউল, তারাই/ফাউলরাই শোষণ করছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় অংশ। জাতিসংঘ হলো বিশ্বের শ্রেষ্ঠ সার্কাস সংগঠন যার কাজীর গরুর মত ফাউল নিয়ন্ত্রণাধিকার বিদ্যমান কিন্তু আদতে সবই ভেল্কিবাজি। আসল কাজ করতে না পারলেও ভেরেন্ডা ভাজতে ওস্তাদ! বাস্তবতা হলো, গিরিঙ্গিবাজির দৌরাত্ম্যের কাছে সবাই অসহায়! এই অসহায়ত্বের শেষ কোথায়?

সামন্ত যুগে শ্রম ও শ্রমিকদের কোন স্বীকৃতি ছিল না । দাসত্ব করতে হতো শ্রমজীবীশ্রেণিভুক্তরা। অভিজাতের বক্তব্য ছিল, দাসেরা পয়দাই হয় শুধু শ্রম দেওয়ার জন্য। অভিজাতরা জন্মগত ভাবেই শাসক। রক্তাক্ত বিপ্লবোত্তর সময়ে বিশ্বব্যাপী স্বীকৃতিপেল শ্রমিকের ঘাম। যে ঘামের প্রতিটি ফোটায় ফোটায় গড়ে উঠেছে প্রতিটি সভ্যতা ।বাংলাদেশ শিক্ষা-সংস্কৃতি-অর্থনীতিতে পিছিয়ে থাকায় শ্রমজীবীদের কাঙ্খিত সম্মান ও সম্মানি এই দেশে দেওয়া হয় না। বাংলাদেশে এখনও শ্রমজীবীদের চাষা, জোলা, খুলু, মুচি, চামার, ধোপা, ডোম, নাপিত, মেথর ইত্যাদি নামে ডেকে তাদেরকে সামাজিকভাবে অপদস্থ করা হয় প্রতিনিয়ত অথচ পেশাজীবীদের যেমনঃ ক্যাডার-ব্যাংকার-ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ারদের সঙ্গে একই সামাজিক অবস্থানে তাঁদেরও থাকার কথা ছিল।

বাংলাদেশের রাজনীতির কৌশলগত ব্যবচ্ছেদ করেন, দেখবেন তেলেঙ্গা অর্থাৎ তেলবাজ, বণিক ও আর্মফাউলদের ছড়াছড়ি। যে দেশের রাজনীতিতে ৭০% বণিক, নির্বাচনের ফান্ড আসে বণিকদের কাছ থেকে সেদেশে নীতির রাজনীতি কিভাবে বিস্তার ঘটবে? আদর্শিক রাজনীতিকগণ বাংলাদেশে আজ কোণঠাসা। ভুঁইফোড় নেতা-নেতৃ এবং '৭৫ পরবর্তী বিভিন্ন সরকারের আমলের সুবিধাবাদীতে ভরে গেছে সরকারী দল। আশির দশক ও নব্বইয়ের দশকে যারা ছিল মোশতাকীয় ভাবশিষ্য তারা আজ ক্ষমতার ধার্মিকচূড়ামনি। আজকের রাশেদ খান মেনন, হাসানুল হক ইনু, বেগম মতিয়া চৌধুরী, নুরুল ইসলাম নাহিদের প্রমুখদের সঙ্গে সরকারের দহরম-মহরম সম্পর্ক চলছে। ইতিহাস ঘাটুন, দেখবেন ১৯৯০ সালের আগ পর্যন্ত এরা সকলেই ছিল আওয়ামিলীগের ঘোর বিরোধী! বোমফাটানো বক্তব্যে বেগম মতিয়া চৌধুরী যেখানে বলেছিলেন, "শেখ মুজিবের চামড়া ছিলে ডুগুডগি বাজাবো" সেখানে আর তাদের বিরোধীতার মাত্রাটা নতুন করে বলার প্রয়োজন রাখে না।
বাংলাদেশের অফিস-আদালতের অবস্থাও কম খারাপ না। সরকারী অফিসারদের উপর আছে ঘুষ খাওয়ার অভিযোগ, চুরি করা এবং বিশেষায়িত ক্ষেত্রে ডাকাতির অভিযোগ। ডাকাতি বললাম এই কারণে যে, সরকারী চাকুরীতে ডাকাতি করতে পারে তারাই যাদের সাথে অস্ত্র রাখার বৈধতা আছে! গণমাধ্যমে চোখ রাখুন, আমার বক্তব্যের প্রমাণ পাবেন অজস্র। আপনি সিনিয়র সচিব হলেও ডাকাতি করতে পারবেন না। ঘুষখোর অথবা চোর হতে পারবেন। ডাকাতির ক্ষমতা শুধু অস্ত্রধারী অফিসারদেরই থাকে। তবে, এই চোর-ডাকাতদের সংখ্যা নেহায়েতই হাতে গোনা। সৎ-অফিসারদের সংখ্যাই কিন্তু বেশি। অল্পসংখ্যক চোর-ডাকাত সব সৎ-অফিসারদের অর্জনকে ম্লাণ করে দিচ্ছে প্রতিনিয়ত। আর কতোকাল কালিমা লেপন করবে এই সকল ফাউলরা?
বাংলাদেশে উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা মধ্যম পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে চরম রূঢ় আচরণ করেন। আর মধ্যম পর্যায়ের কর্মকর্তারা মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে করেন তার অনুরূপ আচরণ। মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তারা অবশেষে জনসাধারণের সঙ্গে করেন অশালীন আচরণ । এগিয়ে থাকা জনগোষ্ঠীর আচরণে সভ্যতা না থাকায় পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠীও অসভ্য আচরণ করছে সমানতালে। আপনি লক্ষ্য করেছেন হয়তো,পাবলিক বাসে অর্থাৎ জনপরিবহণে সামান্য দু-এক টাকার জন্য একজন কোট-টাই পরিহিত ভদ্রলোক বাসের কন্ডাক্টরকে মারধর করার ঘটনা প্রায়শই দেখা যায়। এটা খুবই পরিচিত দৃশ্য আমাদের নষ্ট নগরে। অথচ শিক্ষিত মানুষটার (পোশাক-পরিচ্ছদে তাই মনে হয়) উচিত ছিল ভালো আচরণ করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করার । দুর্নীতিতে বাংলাদেশের চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পিছনেও তো এইসব ফাউলরাই দায়ী।
পশ্চিমাবিশ্বে/উন্নত বিশ্বে যারা অশালীন আচরণ করেন তাদেরকে সামাজিক ভাবে বয়কট করা হয়। সেখানে অনুমতি নিয়ে কথা বলা, অনুচ্চস্বরে কথা বলা, স্বীকৃতি ও সম্মান দেওয়া খুবই স্পর্শকাতর বিষয়। শিষ্ট আচরণের অভাবে বাংলাদেশে বহু অঘটন ঘটে থাকে। অথচ সামান্য শিষ্ট আচরণের মাধ্যমে সর্বত্র শান্তি এবং কর্মসন্তুষ্টি ফিরিয়ে আনা সম্ভব। আর এই শিষ্ট আচরণের অভাব ব্যক্তিগত জীবন থেকে শুরু করে জাতীয় পার্যায়েও ব্যাপকভাবে পরিলক্ষিত হয়। টিভি গুলোতে রাত-বিরাতে যখন টকশো-ঝালশো নামের আজাইরা প্যাঁচাল প্রচার করা হয়, বকবক করতে করতে,চিল্লাইতে-চিল্লাইতে হাতাহাতির ঘটনা এখন খুবই কমন বিষয়।

বর্তমান সময়ে বিনয়কে দেখা হয় মানুষের দুর্বলতা হিসেবে। উগ্রতাকে ভাবা হয় উন্নত ব্যক্তিত্ব। সমাজ-রাষ্ট্র-বৈশ্বিক সকল পর্যায়েই যারা চরম বেয়াদবি করতে পারে, সিনিয়রদের গালে যারা কশিয়ে চড়-থাপ্পড় বসিয়ে ‍দিতে পারে, গুরু মারা বিদ্যায় যারা সিদ্ধহস্ত সেসব কুলাঙ্গারের আজ, এই সময়ে জয়জয়কার! বাঙ্গালীরা জাতি হিসেব বীরের জাতি। বীরেরা ক্ষিপ্রতা সম্পন্ন হয়ে থাকে অথচ বাঙ্গালী আজ উগ্রতায় গা-ভাসিয়ে দিয়েছে। পাড়ায়-মহল্লায়-স্কুল-কলেজ-পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়-সরকারী অফিস-রাজনীতির ময়দান ইত্যাদি সবখানে আজ ফাউলের ব্যাপক প্রাদুর্ভাব। যে যত বড় ফাউল সে তত বড় মস্তান/নেতা। গত ১৮ ডিসেম্বর, ২০১৫ইং তারিখ সকালে বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাকে (অতিরিক্ত মহাব্যবস্থাপক) পিটিয়েছে সিবিএ নেতা।

বাস্তবতা হল, সিবিএ নেতাদের কন্ট্রোল করার ক্ষমতা কর্মকর্তাদের হাতে নেই। সরকারী প্রতিষ্ঠানে ইউনিয়ন করা হয় ILO সনদ মোতাবেক কিন্তু হারহামেশাই উক্ত সনদের অপব্যবহার করা হচ্ছে । সরকারী কর্মকর্তাগণ রাজনীতি করতে না-পারার দুর্বলতার সুযোগে সরকারী প্রতিষ্ঠানে ইউনিয়ন করা কর্মচারীরা কর্মকার্তাদের উপর মাতব্বরী করে। গোদের উপর বিষফোঁড়ার মত বিষয় হলো রাজনৈতিক লেজুঁড়বৃত্তি যার মাধ্যমে কর্মচারীরা কর্মকার্তাদের সহজেই কোণঠাসা করতে সক্ষম হয়ে থাকে। শুধু বাংলাদেশ ব্যাংক নয়,সরকারী সব ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানেই চরম দুরাবস্থা পরিলক্ষিত হয়।

দেশব্যাপী এই দুরাবস্থা থেকে পরিত্রানের সহজ ও মৌলিক উপায় হলঃ- ফাউলদের বিরুদ্ধে রুখে দাড়ানোর মানসিকতা (অফিস পলিটিক্স যারা করে তার এমন আহামরি কেউ না। কয়েক জন মিলে একসাথে দাড়িয়ে যান, বিশ্বাস করুন সব সাইজ হয়ে যাবে! এটা পরিক্ষীত সত্য।), অশালীন/ফাউল আচরণকারীদেরকে সামাজিক ভাবে বয়কট করা, রাষ্ট্রীয়ভাবে শুদ্ধাচারের ব্যাপক প্রচার, সর্বক্ষেত্রে ফাউল নিধন, রাজনৈতিক সাদিচ্ছা, সরকারী ভাবে বেয়াদবদের প্রত্যাখান অর্থাৎ গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক পদ বা নির্বাহী পদে কোন উগ্র/ফাউল ব্যক্তিকে দায়িত্ব না দেওয়া অথবা ফাউল বলে অভিযুক্তদের অপসারণ করা। বাংলার আপামর জনতা একবার জেগে উঠুন,স্বাধীনতার চেতনায় ত্রাসের বাণিজ্য শেষ হয়ে যাবে। ফাউলরা লেজগুটিয়ে পিছু হঠবে। আবার সুবাতাস বইবে এ নগরে, পৃথিবী আবার শান্ত হবে। গুড লাক বাংলাদেশ।