তেঁতুল তলা মাঠ ও ‘পুটিমাছে’র সংগ্রাম

প্রিসিলা রাজপ্রিসিলা রাজ
Published : 21 Feb 2012, 06:18 PM
Updated : 25 April 2022, 01:38 PM

কলাবাগানের তেঁতুল তলা মাঠ বাঁচাও আন্দোলনের অন্যতম প্রধান সংগঠক সৈয়দা রত্না ও তার কলেজপড়ুয়া ছেলে প্রিয়াংশুকে আটক করেছিল কলাবাগান পুলিশ। দীর্ঘ ১৩ ঘণ্টা পর পরিবেশ অধিকার কর্মী ও কলাবাগানবাসীর প্রতিবাদ এবং সোশাল মিডিয়ায় তীব্র সমালোচনায় পুলিশ মুচলেকা নিয়ে তাদের ছেড়ে দেয়।

এখানকার বহুদিনের বাসিন্দা হিসেবে আমিও এ আন্দোলনে শরিক আছি। মাঠটিতে গরিব-ধনী সব শ্রেণির শিশু-কিশোরদের একত্র সমাবেশ ঘটতো। আমরা যারা ঘরের পাশে খালি জমি বা মাঠে হুটোপুটি করে বড় হয়েছি তারা জানি সেসব খালি জায়গা আমাদের জীবনটকে কতটা ভরিয়ে রেখেছিল। সংস্কৃতি কর্মী সৈয়দা রত্না এই আন্দোলনে সামনে থেকে সংগঠিত ও সমন্বয় করার পেছনে যে সময় ও শ্রম ব্যয় করে চলেছেন তার পেছনেও আছে নিজের শৈশবকে বাঁচিয়ে রাখার তীব্র তাগিদ। সেই শৈশব বেঁচে থাকবে যদি প্রজন্মান্তরের শৈশবে তাকে প্রবাহিত করে দেওয়া যায়।

আমরা শুনেছি, এ ভূমিখণ্ডটির মূল মালিক ছিলেন এক বিহারী প্রকৌশলী যিনি সত্তর সালে বিদেশে চাকরি নিয়ে চলে যাওয়ার পর আর ফেরেননি। গত পঞ্চাশ বছরে জমিটি বেদখলের বহু চেষ্টা করেছে ভূমিদস্যুরা। কিন্তু কলাবাগানের স্থানীয় কিছু বাসিন্দার চেষ্টায় মাঠটি রক্ষা পেয়ে এসেছে। এতদিনে সেটি এলাকাবাসীর একটি নিঃশ্বাস ফেলার জায়গায় পরিণত হয়েছে। ইংরেজিতে যাকে 'কম্যুনিটি স্পেস' বলে এমন একটি জায়গা রাজধানী ঢাকায় ঠিক কয়টি আছে? পাড়ার ভেতরে মুরুব্বিরা এসে বসতে পারেন, শিশুরা খেলতে পারে, নারীরা বিকেল-সন্ধ্যায় একটু হাঁটতে পারেন, মরদেহকে শেষ গোসল দেওয়া যায়- এমন বহু উদ্দেশ্য পূরণ করার মতো ছোট্ট একটু জায়গা আমার জানামতে কলাবাগান, ভূতের গলি, আল-আমিন রোড, কাঁঠাল বাগান, অর্থাৎ পুরো গ্রিনরোড এলাকায় আর একটিও নেই।

বিঘাখানেকের কিছু কম জমিটি বেদখলে নেওয়ার ইতিহাস শুনতে শুনতে ক্লান্ত লাগে। এলাকার একজন পুরানো বাসিন্দা যিনি বিহারী প্রকৌশলীর জমিটি ভূমিদস্যুদের হাত থেকে রক্ষায় দীর্ঘ লড়াই চালিয়ে আসছেন তিনি এর পূর্বাপর জানেন। এই আন্দোলনে শামিল হয়েছেন তিনিও। সঙ্গত কারণে তার নামটি উহ্য রাখছি। আজ সেই জমির দিকে হাত বাড়িয়েছে রাষ্ট্র নিজে। সে এমন এক প্রতিষ্ঠান যার লাঠির জোর খুব বেশি।

তেঁতুল তলা মাঠ বাঁচানোর আন্দোলনে কলাবাগানবাসী ছাড়াও দেশের আইনজীবী, সাংবাদিক, পরিবেশ আন্দোলনকর্মী, শিশু-কিশোর সংগঠনসহ বিভিন্ন স্তর শ্রেণি-পেশার মানুষ যুক্ত হয়েছেন। কিন্তু তারপরও পুলিশ বিভাগ তার দাবি থেকে সরে না এসে, একটার পর একটা পদক্ষেপ নিয়েই চলেছে। এ থেকে বোঝা যায় রাষ্ট্রের অনেক ওপরতলার মহল এতে জড়িত।

দেশের সুপরিচিত পরিবেশবাদী ও মানবাধিকার কর্মীরাসহ কলাবাগানবাসীর দাবি উপেক্ষা করে রত্না ও তার কিশোর ছেলের বিরুদ্ধে মামলার প্রস্তুতি নেওয়া হয়। যদিও পরে মত বদলে তাদেরকে ছেড়েও দেয় পুলিশ। ভাববার বিষয় হলো, এত জনমতের চাপ থাকার পরও আটক করা ও আন্দোলন না করার মুচলেকা নেওয়ার মতো পদক্ষেপ নিয়েছে পুলিশ, যার পেছনে অত্যন্ত ক্ষমতাশালী কোনো মহলের জড়িত থাকার সন্দেহটি জোরদার করে।

ভেতর মহলের কোন ক্ষমতার জোরে পুলিশ এটি করতে পারছে- এর উত্তর এখনও জানা নেই আমাদের।

২৫ এপ্রিল সংবাদ সম্মেলনে স্থপতি ইকবাল কবির আরও একবার স্পষ্ট করে বলেছেন, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের ঢাকা এরিয়া প্ল্যানের নকশায় তেঁতুল তলা মাঠটিকে শিশুদের খেলাধুলার স্থান হিসেবে ব্যবহার করার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এই তৎপরতায় দশটি পরিবেশ সংরক্ষণ বিষয়ক আইন লঙ্ঘন করেছে। লঙ্ঘিত হয়েছে, আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহার। প্রধানমন্ত্রী তার বেশিরভাগ বক্তৃতায় একবার করে মাঠ সংরক্ষণের আহ্বান করে যাচ্ছেন।

রত্না ও তার সন্তানকে আটক করে পুলিশ প্রধানমন্ত্রীর সেই আহ্বান কেবল উপেক্ষাই করেনি, অসম্মানও করলো।

হাজত থেকে বেরিয়ে কিশোর প্রিয়াংশু সাংবাদিকদের জানিয়েছে, ধরে নেওয়ার সময় পুলিশ সদস্যরা তাকে হুমকি দিয়ে বলেছেন, "পুটিমাছ বেশি লাফাবি না। বেশি লাফালে সমস্যা হবে।" এই হুঁশিয়ারির মধ্য দিয়ে পুলিশ সদস্যরা কী বোঝাতে চেয়েছেন? প্রিয়াংশু 'পুটি মাছ' হলে 'রাঘব বোয়াল' কারা?

রাঘব বোয়ালের গ্রাস থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখাই পুটিমাছের আজীবন সংগ্রাম। তেঁতুল তলা মাঠের মতো লোভনীয় খাদ্যটিকে বোয়ালের গ্রাস থেকে বাঁচাতে আর কত পুটিমাছকে কতবার লাফাতে হয় সেটাই দেখার বিষয়।