ফুটবল এবং একটি প্রস্তাবনা

জাদু
Published : 14 Oct 2017, 09:17 AM
Updated : 14 Oct 2017, 09:17 AM

বাংলাদেশের ফুটবল নিয়ে অনেক আলোচনা সমালোচনা হচ্ছে। অনেক টাকা বিনিয়োগ ও হচ্ছে। কিন্তু ফলাফল শুণ্য। কারণ একটিই। ব্যবসায়ীক চিন্তার অভাব। আমরা যদি ফুটবলকে ব্যবসায়ীকভাবে লাভজনক খাতে নিয়ে যেতে না পারি, তাহলে কখনোই এই খেলার কোন উন্নতি হবে না। নিরবিচ্ছিন্নভাবে বিনিয়োগ আসবে না, খেলোয়াড় ও বের হবে না। একজন খেলোয়াড় ক্যারিয়ার হিসাবে ফুটবলকে কেন বেছে নেবে? তার আর্থিক, সামাজিক নিরাপত্তা কই? তেমনি একজন ব্যবসায়ী কেন একটি দলের দায়িত্ব নিবে? তার অর্থ লগ্নির নিরাপত্তা কোথায়? আসলে ফুটবলকে ঢেলে সাজাতে হবে। এই খেলাকে লাভজনক ব্যবসায়ীক পদ্ধতিতে নিয়ে আসতে হবে। তাহলেই প্রাণ ফিরে পাবে এই দেশের ফুটবল। কিছু আইডিয়া শেয়ার করছি –

১। কী ধরণের লীগ হতে পারে-
আমাদের দেশে ৬৪টা জেলা রয়েছে। ১৬টা করে জেলা ধরে আমরা ৪টা গ্রুপে ভাগ করতে পারি। ঢাকা গ্রুপ, উত্তরবঙ্গ গ্রুপ, পূর্ববঙ্গ গ্রুপ এবং দক্ষিণবঙ্গ গ্রুপ। এখানে ঢাকা গ্রুপের ১৬টি জেলা খেলবে ঢাকা প্রিমিয়ার লীগ। তেমনিভাবে বাকি গ্রুপ গুলো খেলবে উত্তরবঙ্গ প্রিমিয়ার লীগ, পূর্ববঙ্গ প্রিমিয়ার লীগ এবং দক্ষিণবঙ্গ প্রিমিয়ারলীগ। এদের মাঝে ৪ লিগের টপ ৪ দল মোট ১৬ দল নিয়ে হবে বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়নস লীগ। ইংলিশ প্রিমিয়ারলীগ, স্প্যানিশ লীগ বা উয়েফার আদলে এটি খুব সহজেই করা যায়। খেলা হতে হবে হোম এবং এয়োয়ে ভিত্তিতে। প্রতিটি জেলার দল নিশ্চিত করার পাশাপাশি তাদের নিজেদের মাঠের খেলাও নিশ্চিত করতে হবে।

২। প্রতিযোগিতা নিশ্চিত করা
প্রতিটা জেলাই যদি কনফরমেশন পেয়ে যায় তারা লীগ থেকে বাদ যাবে না, তাহলে তাদের স্পিরিটটা একটু হলেও কমে যাবে। সেই স্পিরিট ঠিক রাখতে এবং তৃণ মুলে ফুটবলকে ছড়িয়ে দিতে আন্তঃ জেলা লীগ চালু করতে হবে। যেখানে প্রতিটা জেলার থানা গুলো সরাসরি নিজেদের মাঝে হোম এন্ড এয়োয়ে ভিত্তিতে খেলবে। প্রতিটা জেলার টপ থানা মিলে ২য় বিভাগ লীগ অনুষ্ঠিত হবে। ১৬ টি জেলার ১৬টি টপ থানার লীগের টপ দুই অথবা তিন থানা সরাসরি প্রিমিয়ারলীগে অংশ নিবে। এবং প্রিমিয়ারলীগের শেষ দুইদল রেলিগেশনে চলে যাবে। তাহলে প্রিমিয়ারলীগের প্রতিটা জেলা তাদের নিজেদের উন্নতি সাধনে সচেষ্ট থাকবে, রেলিগেশন থেকে বাঁচার জন্য।

৩। পরিচালনা পরিষদ
কমিটিঃ প্রতিটি লীগের একটি করে নির্দিষ্ট কমিটি থাকবে। কমিটি প্রিমিয়ার লীগ এবং ২য় বিভাগ লীগ পরিচালনা করবে। এরা সম্প্রচার স্বত্ব এবং মাঠের টিকেট বিক্রির একটা অংশ পাবে নিজেদের কমিটি পরিচালনার জন্য। চ্যাম্পিয়ন্স লীগের খেলা পরিচালনা বাবদ খরচের একটা অংশ ও তারা পাবে। কমিটির মেম্বার হবে প্রতি জেলা থেকে একজন। এদের মাঝ থেকেই প্রতি বছরের জন্য চেয়ারম্যান এবং নির্বাহী কমিটি গঠিত হবে।

দলীয় কমিটিঃ দলীয় কমিটি গঠিত হবে দুই স্তরে। দল পরিচালনা কমিটি হবে জেলার বিশিষ্ট ব্যবসায়ী এবং সমাজ সেবকদের দ্বারা। কিন্তু কাজ্র নির্বাহী কমিটি গঠিত হবে জেলার ফুটবলের সাথে সম্পৃক্ত লোকজনদের মাধ্যমে। পরিচালনা কমিটির কাজ হবে, দলের বেতন ভাতা পরিশোধ করা এবং দলের ব্যবসায়ীক লাভের দিক বের করা। প্রতিটি জেলা টিমের নিজেদের ব্র্যান্ডিং টিম থাকবে। তারা দলের ব্র্যান্ড ভ্যালু বৃদ্ধির পাশাপাশি তাদের খেলোয়াড়দের ব্রান্ড ভ্যালু ও বাড়াবে। যার ফলে প্রতিটি দলের নিজস্ব আয় বাড়বে। এই টিম পরিচালনা পরিষদের তত্বাবধানে থাকবে।

আর কার্যনির্বাহী কমিটি ঠিক করবে কোন খেলোয়াড় তাদের কেনা উচিত, কোন খেলোয়াড় বিক্রি করে দেয়া উচিত, কোচিং সহ তাদের দলের মান উন্নয়ন এবং খেলা সংক্রান্ত যাবতীয় কাজ।

৪। আয়ের উৎস
– সম্প্রচার স্বত্বঃ
প্রতিটি লীগ নিলামে তার সম্প্রচার স্বত্ব বিক্রি করবে। নুন্যতম দুইটি চ্যানেল সেই সম্প্রচার স্বত্ব কিনতে পারবে। চ্যানেলগুলো সেই লীগের সব খেলা সরাসরি প্রচার করবে। বিজ্ঞাপন থেকে চ্যানেলের আয় নিশ্চিত হবে। সম্প্রচার স্বত্বের পুরোটাই লীগ কমিটির কোষাগারে জমা হবে।

– টিকিট বিক্রি
প্রতিটি দলের মুল আয়ের উৎস হবে টিকিট বিক্রি। প্রতি সপ্তাহের শুক্রবার আর শনিবার খেলা অনুষ্ঠিত হবে। সেই খেলার বিক্রিত টিকেটের ৬০ শতাংশ জেলা লীগ পরিচালনা কমিটির কোষাগারে জমা হবে, ১০ভাগ জেলা ফুটবলের নিজস্ব ভবিষ্যৎ উন্নত মাঠের জন্য বরাদ্দ থাকবে, ১৫ ভাগ যে মাঠে খেলা হবে তাদের খরচ বাবদ ব্যয় হবে, যার ৫ ভাগ সরাসরি বাফুফের ফান্ডে জমা হবে। বাকি ১৫ ভাগ অর্থ লীগ কমিটির কোষাগারে জমা হবে।

– জার্সি এবং দলীয় স্যুভেনির
প্রতিটি জেলা দলের নিজস্ব শোরুম থাকবে। দলের সব খেলোয়াড়ের নামের এবং দলের সাধারণ জার্সি বিক্রির জন্য সেখানে থাকবে। দলীয় বিভিন্ন স্যুভেনির, স্মারক থাকবে সেইসব শো রুমে। এইসব বিক্রি বাবদ পুরা টাকাটাই যাবে জেলার দলীয় ফান্ডে।

– খেলোয়াড় বিক্রিঃ
খেলোয়াড় কেনা এবং তাদের বিক্রি করে দেয়াও দলের অন্যতম আয়ের উৎস হতে পারে।

– খেলোয়াড় তৈরিঃ
প্রতিটা জেলার বয়স ভিত্তিক ট্রেনিং এবং খেলোয়াড় বাছাই চলবে বছরজুরে। ট্রেনিং সেন্টারে অবশ্যই ভর্তি ফি এবং মাসিক বেতনের মাধ্যমে একজন খেলোয়াড়কে ভর্তি হতে হবে।

অনেকেই বলতে পারেন বর্তমানে যে ক্লাব ফুটবল হচ্ছে, তার কী হবে? ক্লাব ফুটবল তার মতই চলবে। ক্লাব ফুটবল থেকে টপ ৩ টা টিমকে খুব সহ্যেই চ্যাম্পিয়ন্স লীগে নিয়ে নেয়া যায়। এভাবে পুরা বছরের ফুটবলের ক্যালেন্ডার ফিক্স করা যাবে। এমনকি প্রতিটা জেলায় আগামী ১০ বছরের মাঝে আধুনিক সুযোগ সুবিধা সম্পন্ন ফুটবলের মাঠ তৈরি করা সম্ভব।

বাফুফের ভূমিকা এই ক্ষেত্রে কী হবে?
প্রতিটা লীগ প্রতি মাসের শেষে তাদের আয়ের একটা অংশ সরাসরি বাফুরের কোষাগারে জমা দিবে। বিনিময়ে বাফুফে তাদের উন্নত প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত রেফারী সরবরাহ করবে, সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে। প্রতিটা লীগ কমিটির জবাবদিহিতা বাফুফে নিশ্চিত করবে। প্রতিটি খেলার টিকিট বিক্রির ৫ভাগ বাফুফের কোষাগারে জমা পড়বে। আর্থিক ভাবে তাদের লাভ ছাড়া লস হবার কোন কারণ নাই।

প্রথম দিকে খেলোয়াড় সঙ্কট থাকবে, আর্থিক সঙ্কট থাকবে, অনেক বাধা আসবে। কিন্তু চেষ্টা থাকলে মনে হয় ৫ বছরের মাঝেই এই দেশের ফুটবলে আর্থ সামাজিক বিপ্লব সম্ভব। এই ধরণের চিন্তা নিয়ে কেউ কি ফুটবলের উন্নয়নে এগিয়ে আসবে না?