গ্লানিমুক্তির বাংলাদেশ

মুহম্মদ জাফর ইকবালমুহম্মদ জাফর ইকবাল
Published : 24 April 2011, 06:11 PM
Updated : 19 Dec 2013, 05:39 PM

১.

গত সপ্তাহটি ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি সপ্তাহ। একাত্তরের এই সপ্তাহে বাংলাদেশকে মুক্ত করার যুদ্ধটি শুরু হয়েছিল। আকাশে যুদ্ধবিমান, বোমা পড়ছে, শেলিং হচ্ছে, গুলির শব্দ। আকাশ থেকে পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর উদ্দেশে হ্যান্ডবিল বিলি করা হচ্ছে, ভারতীয় বাহিনী সেখানে লিখেছে, ''মুক্তিবাহিনীর হাত থেকে রক্ষা পেতে হলে আমাদের কাছে আত্মসমর্পণ কর।''

আমরা বুঝতে পারছি আমাদের বিজয়ের মূহুর্তটি চলে আসছে; তারপরেও বুকের ভেতর শঙ্কা, আমেরিকার সপ্তম নৌবহর পাকিস্তানের পক্ষ নিয়ে বঙ্গোপসাগর দিয়ে এগিয়ে আসছে। গত নয় মাসে এই দেশে কত মায়ের বুক খালি হয়েছে তার হিসাব নেই। মানুষের প্রাণের কোনো মূল্য নেই, যখন খুশি যাকে ইচ্ছা তাকে নির্যাতন করা যায়, হত্যা করা যায়। চারিদিকে শুধু মৃতদেহ আর মৃতদেহ, আগুনে পোড়া ঘরবাড়ি, বিধ্বস্ত জনপদ, মানুষের হাহাকার।

তার মাঝে জামায়াতে ইসলামীর তৈরি করা বদর বাহিনী খুঁজে খুঁজে এই দেশের কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, শিক্ষক, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ারদের বাড়ি থেকে তুলে নিচ্ছে। তাদের অত্যাচার করছে, চোখের ডাক্তারের চোখ তুলে নিচ্ছে, হৃদরোগের ডাক্তারদের হৃৎপিন্ড বের করে আনছে, তারপর হত্যা করে মৃতদেহ ছুঁড়ে ফেলছে। দেশটি যেন কোনোদিন মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে তারা সেটি নিশ্চিত করতে চায়।

সেই হত্যাকারীদের বিচার করে বিচারের রায় হয়েছে। প্রথম রায় কার্যকর হয়েছে সেই একই সপ্তাহে, ডিসেম্বরের ১২ তারিখে। আমি বিয়াল্লিশ বছর ধরে এই দিনটির জন্যে অপেক্ষা করেছিলাম। শুধু আমি নই, আমার মতো স্বজনহারানো অসংখ্য মানুষ অপেক্ষা করেছিল। মুক্তিযোদ্ধারা আপেক্ষা করেছিল, নির্যাতিতেরা অপেক্ষা করেছিল, আর অপেক্ষা করছিল এই দেশের নূতন প্রজন্ম।

আমাদের প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধের প্রজন্ম, আমরা মুক্তিযুদ্ধকে তীব্র আবেগ দিয়ে অনুভব করি। আমি কখনও কল্পনা করিনি এই দেশের নূতন প্রজন্মও মুক্তিযুদ্ধকে ঠিক আমাদের মতোই তীব্রভাবে অনুভব করবে। তাদের জন্মের আগে ঘটে যাওয়া মুক্তিযুদ্ধের সেই অবর্ণনীয় কষ্ট আর অকল্পনীয় আনন্দ তারা এত তীব্রভাবে অনুভব করতে পারে সেটি আমাদের জন্যে এক অবিশ্বাস্য স্বপ্নপূরণ।

গত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ কথা দিয়েছিল তাদেরকে নির্বাচিত করলে তারা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করবে। এই দেশের মানুষ বিশেষ করে তরুণ প্রজন্ম তাদের কথা বিশ্বাস করে বিপুল ভোটে তাদের নির্বাচিত করে এনেছিল। সরকার তাদের কথা রেখেছে, ট্রাইব্যুনাল তৈরি করে বিচার করে বিচারের রায় দিয়ে রায় কার্যকর করতে শুরু করেছে। এই সরকারের কাছে আমার আর কিছু চাওয়ার নেই, তাদের প্রতি আমার কৃতজ্ঞতা এই দেশকে গ্লানিমুক্ত করার জন্য।

এতদিন যখন এই দেশের শিশুরা আমার চোখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করত, ''যারা এই দেশ চায়নি, যারা এই দেশের মুক্তিযোদ্ধাদের হত্যা করেছে, তারা কেমন করে এই দেশে এখনও স্বাধীনভাবে ঘুরে বেড়ায়? কেমন করে রাজনীতি করে, মন্ত্রী হয়? যে পতাকাটি ধ্বংস করার জন্যে হত্যাকাণ্ড করেছে সেই পতাকা গাড়িতে লাগিয়ে ঘুরে বেড়ায়?''

আমি কখনও তাদের প্রশ্নের উত্তর দিতে পারিনি। মাথা নিচু করে থেকেছি।

আর আমার মাথা নিচু করে থাকতে হবে না, কেউ আর আমাকে এই প্রশ্ন করবে না। সেই প্রশ্নের উত্তর তারা পেয়ে গেছে। সত্যি কথা বলতে কী, সেই প্রশ্নের উত্তরটি তারাই আমাদের উপহার দিয়েছে।

২.

আজ থেকে চল্লিশ বছর আগে এই বিচারের কাজটি যতটুকু সহজ ছিল, এতদিন পর সেটি আর সহজ থাকেনি। যুদ্ধাপরাধীর দল ক্যান্সারের মতো সারাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে, মিলিটারি শাসনের আড়ালে শক্তি সঞ্চয় করেছে, অর্থ উপার্জন করেছে, সেই অর্থ দিয়ে অপপ্রচার করেছে, দেশে-বিদেশে বন্ধু খুঁজে বের করেছে। হুবহু তাদের মুখের কথাগুলো আমরা বিদেশি গণমাধ্যমে শুনতে পেয়েছি। জাতিসংঘ, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্রের মতো শক্তিধর দেশগুলো আমাদের সরকারকে শুধু মুখের কথা বলে বাধা দেয়নি, চোখরাঙানি দিয়েছে। ১৯৭১ সালে যারা পাকিস্তানের পক্ষে ছিল এত বছর পরও তারা আবার সেই পাকিস্তানের পদলেহীদের পক্ষে।

আমাদের অনেক সৌভাগ্য এই প্রচণ্ড চাপেও আমাদের সরকার দিশেহারা হয়নি, এক যুদ্ধাপরাধীর বিচারের রায় কার্যকর করেছে। নির্বাচন নিয়ে আমাদের দেশের সব পেশাদার বুদ্ধিজীবীর এখন প্রথম কাজ হচ্ছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে এক হাত নিয়ে নেওয়া। সেটা আমি বুঝতে পারি। কিন্তু যখন হরতাল-অবরোধ কার্যকর করার জন্য পেট্রোল বোমা দিয়ে মানুষ পুড়িয়ে মারা হয়, ট্রেনের লাইন উপড়ে ট্রেন লাইনচ্যুত করা হয়, যাত্রীসহ বাস-ট্রাক পুড়িয়ে দেওয়া হয়, রাস্তা কেটে এলাকা বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়– তখনও এই বুদ্ধিজীবী, পত্রিকার সম্পাদকেরা তার জন্যে প্রধানমন্ত্রীর 'অদূরদর্শিতা'কে দায়ী করেন– তখন আমি একটা ধন্দের মাঝে পড়ে যাই।

এই কাজটি করে এই দেশের বড় বড় পত্রিকার বড় বড় সম্পাদকেরা যে এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডগুলোকে এক ধরনের নৈতিক সমর্থন দিয়ে ফেলছেন সেটি কি তারা একবারও বুঝতে পারছেন না? যে ভয়ংকর তাণ্ডব দেখে তাদের আতঙ্কিত হওয়ার কথা সেটা দেখে তারা এই সরকারের ব্যর্থতার 'অকাট্য প্রমাণ' পেয়ে উল্লসিত হচ্ছেন এটি কেমন করে সম্ভব?

আমি পেশাদার বুদ্ধিজীবী নই, বড় পত্রিকার সম্পাদক নই, বাজারে সত্য এবং মিথ্যার মাঝখানে কিংবা ন্যায় এবং অন্যায়ের মাঝখানে নিরপেক্ষ থাকার আমার কোনো চাপ নেই। তাই আমার যে কথাটি বলার ইচ্ছা করে সোজাসুজি বলতে পারি। নির্বাচন নিয়ে কী হবে সেটা আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো নিষ্পত্তি করুক। কিন্তু যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায় কার্যকর না করার জন্যে আমেরিকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরির হুমকিকে তোয়াক্কা না করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রায় কার্যকর করার জন্যে দেশের মানুষের কাছে যে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন সেই প্রতিজ্ঞটি বাস্তবায়ন করেছেন, সে জন্যে তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা, তাঁর প্রতি অভিনন্দন। তাঁর বাবা বঙ্গবন্ধু আজ যদি বেঁচে থাকতেন নিশ্চয়ই তার মেয়ের বুকের পাটা দেখে খুশি হতেন।

৩.

১৯৭১ সালের পর আমি কখনও পাকিস্তানের কোনো জিনিস হাত দিয়ে স্পর্শ করিনি। অনেক টাকা বেঁচে যাবে জানার পরও যে প্লেন পাকিস্তানের ভূমি স্পর্শ করে যায় আমি কোনোদিন সেই প্লেনে উঠিনি। পাকিস্তানের উপর দিয়ে যখন কোনো প্লেনে উড়ে যাই, যতক্ষণ পর্যন্ত সেই দেশটির ভূমি সীমার বাইরে না যাই ততক্ষণ নিজেকে অশুচি মনে হয়। পাকিস্তান দল যত ভালো ক্রিকেট খেলুক না কেন আমি তাদের কোনো খেলা দেখি না (ষাটের দশকে টোকিও অলিম্পিকে স্বর্ণবিজয়ী পাকিস্তান হকি টিমের একজন প্রাক্তন খেলোয়াড় পাকিস্তান মিলিটারির অফিসার হিসেবে আমার বাবাকে একাত্তরে হত্যা করেছিল বলে আমি জানি)।

কেউ কেউ আমাকে বোঝানোর চেষ্টা করেছে ইতিহাসের একটা বিশেষ সময়ে একটা বিশেষ গোষ্ঠীর একটা সামরিক কাজকর্মের জন্যে সারাজীবন একটা দেশের সকল প্রজন্মকে দায়ী করা যায় না। কথাটি নিশ্চয়ই সত্যি, কিন্তু আমার কিছু করার নেই। একাত্তরে আমি আমার নিজের চোখে পাকিস্তান নামের এই দেশটির মিলিটারির যে নৃশংস বর্বরতা দেখেছি সেটি থেকে আমার কোনো মুক্তি নেই।

দেশটি যদি নিজের এই নৃশংসতার দোষ স্বীকার করে নতজানু হয়ে বাংলাদেশের মানুষের কাছে ক্ষমা চাইত তাহলে হয়তো আমার বুকের মাঝে ধিকি ধিকি করে জ্বলতে থাকা আগুনের উত্তাপ একটু কমানো যেত। তারা সেটি করেনি, আমার বুকের ভেতর জ্বলতে থাকা আগুনের উত্তাপও কমেনি।

আমি যে রূপ দেখে অভ্যস্ত, দীর্ঘদিন পর এই দেশটির রূপ আমাদের নূতন প্রজন্ম নূতন করে দেখার সুযোগ পেয়েছে। যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লার বিচারের রায় কার্যকর করার পর প্রথমে তাদের একজন মন্ত্রী প্রতিবাদ করেছে; তারপর তাদের পার্লামেন্ট থেকে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে নিন্দা প্রস্তাব নিয়েছে। নিন্দা প্রস্তাবের সময় আলোচনার বিষয়বস্তু অত্যন্ত চমকপ্রদ। তারা জোর গলায় বলেছে, কাদের মোল্লা হচ্ছে একজন "সাচ্চা পাকিস্তানি, একাত্তরে সাচ্চা পাকিস্তানি থাকার জন্যেই তাকে ফাঁসি দেওয়া হয়েছে।''

শাহবাগের তরুণ ছেলেমেয়েরা দিনের পর দিন এই কথাটি বলে শ্লোগান দিয়েছে– ''জামায়াতে ইসলাম মেড ইন পাকিস্তান।'' যাদের মনে বিন্দুমাত্র সন্দেহ ছিল জামায়াতে ইসলামী একাত্তরে এই দেশে কী করেছিল, এখন তাদের কারও ভেতরে কি আর কোনো সন্দেহ আছে?

পাকিস্তান থেকে বক্তব্য দেওয়ার সময় তারা ইনিয়ে বিনিয়ে বলেছে একাত্তরে 'ঢাকা পতন' হওয়ার এতদিন পর সেই পুরানো 'ক্ষত' নূতন করে উম্মোচন করার কোনো প্রয়োজন নেই। আমার 'ঢাকা পতন' কথাটি নিয়ে আপত্তি আছে। একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর মোটেও ঢাকার পতন হয়নি, পাকিস্তানের পতন হয়েছিল। ঢাকা কিংবা বাংলাদেশের সেদিন উত্থান হয়েছিল। 'ক্ষত' কথাটি নিয়েও আমার গুরুতর আপত্তি আছে; এটি আমাদের জন্যে ক্ষত নয়, এটি পাকিস্তানের জন্যে 'ক্ষত'। শুধু ক্ষত নয়, এটি হচ্ছে দগদগে ঘা। চল্লিশ বছরেও সেই ঘা শুকায়নি, শত বছরেও সেই ঘা শুকাবে না।

পৃথিবীর ইতিহাসে পাকিস্তানকে পরাজয়ের এই দগদগে ঘা নিয়ে আজীবন বেঁচে থাকতে হবে। মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ, গণহত্যা এবং সবশেষে পরাজয়ের এই দগদগে ঘা তাদের অবশ্যই লুকিয়ে রাখতে হবে। কিন্তু আমাদের কেন সেটি লুকিয়ে রাখতে হবে? ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরের সেই বিজয় দিবস আমাদের ক্ষত নয়, সেটি আমাদের গৌরব, আমাদের অহংকার, আমরা শত সহস্রবার সেটি দেখতে চাই। তাই প্রত্যেক বছর এই বিজয় দিবস আমাদের কাছে আগের চাইতেও বেশি উদ্দীপনা নিয়ে আসে।

পাকিস্তানের সঙ্গে আমার কোনো যোগাযোগ নেই। যদি থাকত তাহলে অবশ্যই আমি তাদের কিছু উপদেশ দিতাম। আমি তাদের বলতাম– ''তোমরা তোমাদের দগদগে ক্ষত দেখতে চাও না, খুব ভালো কথা, তোমরা চোখ বন্ধ করে থেকো। কিন্তু আমরা কী করব সেটি নিয়ে ধৃষ্টতা দেখাতে এসো না। ১৯৭১ সালে এই দেশ থেকে তোমাদের বিতাড়ন করে আমরা অনেকদূর এগিয়ে এসেছি, অনেক বিষয়ে আমরা সারা পৃথিবীর মডেল। একটু ধৈর্য ধর, যখন দেখবে আমরা ঠিক ঠিকভাবে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করে রায় কার্যকর করে সারা পৃথিবীকে দেখাব কীভাবে সেটি করা যায়, তখন সেটিও সারা পৃথিবীর একটা মডেল হয়ে যাবে। আপাতত তোমরা নিজেদের নিয়ে মাথা ঘামাও। মিলিটারির দাস হয়ে দেশের রাজনৈতিক দলগুলো যা করছে সেখান থেকে বের হতে পার কিনা দেখো। লেখাপড়া করতে চাইলে মেয়েদের মাথায় গুলি যেন করতে না পারে সেটা খেয়াল করো। সারা পৃথিবীতে সন্ত্রাস রপ্তানি করার যে সুনামটুকু কুড়িয়েছ সেই সুনাম থেকে মুক্ত হতে পার কিনা দেখো।''

পাকিস্তানের সঙ্গে আমার কোনো যোগাযোগ নেই; যদি থাকত তাহলে এই তালিকাটি আমি আরও দীর্ঘ করে দিতাম!
কাদের মোল্লার পক্ষে বাংলাদেশের বিপক্ষে পাকিস্তান রাষ্ট্রীয়ভাবে যে নিন্দা প্রস্তাবটি নিয়েছে সেটি আমার কাছে এই রাষ্ট্রটির সঙ্গে মানানসই একটি কাজ বলে মনে হয়েছে। এই দেশে তাদের যে অনুচরেরা আছে তাদের চেহারাটি মনে হয় বেশ ভালোভাবে উম্মোচন করা হয়েছে।

আমাদের নূতন প্রজন্ম এর মাঝে ভয়ানকভাবে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে। আমি ঠিক এ ধরনের প্রতিক্রিয়াই আশা করেছিলাম। তারা আমাকে নিরাশ করেনি।

৪.

১৬ ডিসেম্বর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে লক্ষ মানুষের মাঝে দাঁড়িয়ে আমি বিকাল ৪টা ৩১ মিনিটে জাতীয় সঙ্গীত গেয়েছিলাম। সৃষ্টিকর্তা আমার গলায় কোনো সুর দেননি, আমার মাঝে মাঝে সেজন্যে খুব দুঃখ হয়। আমার মনে হয়, যদি আমার গলায় একটু সুর থাকত তাহলে "আমার সোনার বাংলা" গানটি আমি না জানি কত সুন্দর করে গাইতে পারতাম।

যত বেসুরো গলাতেই গাই না কেন এই গানের চরণগুলো উচ্চারণ করার সময় প্রতিবার আমার চোখ ভিজে আসে। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বেসুরো গলায় আমি যখন গানটি গাইছিলাম, যখন একটি একটি করে চরণ গাওয়া হচ্ছিল আর আমার মনে হচ্ছিল, আহা, আরও একটি লাইন শেষ হয়ে গেল! আমার মনে হচ্ছিল, আহা, যদি অনন্তকাল এই গানটি গাওয়া যেত! যদি কোনোদিন এই গানটি শেষ না হত!

জাতীয় সঙ্গীত শেষ হবার পর সাবধানে আমি আমার চোখ মুছেছি। আমাদের প্রজন্মের কাছে এটি তো শুধু কষ্ট, বেদনা। আমাদের আনন্দ, আমাদের উল্লাস।

আমার পাশে কমবয়সী একটি মেয়ে দাঁড়িয়েছিল, জাতীয় সঙ্গীত শেষ হবার পর আমাকে বলল, "স্যার, জানেন, যতবার আমি আমার সোনার বাংলা গান গাই আমার চোখে পানি চলে আসে!"

আমি অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম, আমাদের নূতন প্রজন্ম কেমন করে আমাদের সকল স্বপ্ন, আমাদের সকল ভালোবাসা, সকল মমতাকে এমনভাবে গ্রহণ করতে পারল?

ডিসেম্বর ২০১৩