রায় নিয়ে বিতর্ক ও বিপজ্জনক প্রবণতার কবলে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা

দেলোয়ার জাহিদ
Published : 20 August 2017, 09:48 AM
Updated : 20 August 2017, 09:48 AM

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও বিরোধী দল বিএনপি সংবিধানের ষোড়শ সংশোধন অবৈধ ঘোষণার রায় নিয়ে দৃষ্টিকটু এক রাজনীতিতে মেতে উঠেছে। তিন বছর আগে আনা আওয়ামী লীগের সরকারের সংবিধানের ষোড়শ সংশোধন অবৈধ ঘোষণা করে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ সম্প্রতি এক রায় দিয়েছে। স্পষ্টতঃই সরকার এতে সংক্ষুব্ধ। সরকারী দল ষোড়শ সংশোধনে বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের কাছে ফিরিয়ে নিয়েছিল; আদালত তা বাতিল করে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল পুনঃপ্রতিষ্ঠার রায় দিয়েছে।

এক প্রতিক্রিয়ায় বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সরকার বিচার বিভাগকে অশ্রদ্ধা করছে বলে মন্তব্য করেছেন, অপর দিকে আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে আদালতের রায় নিয়ে বিতর্ক বন্ধ করার আহ্বান জানিয়েছেন সাবেক আইনমন্ত্রী মতিন খসরু। তার মতে, "সু‌প্রিম কো‌র্টের রায় নি‌য়ে বিতর্ক চ‌লে না, রাজনী‌তিও চ‌লে না। ইদানিং আমরা দেখ‌তে পা‌চ্ছি আমা‌দের প্রতিপক্ষরা রায় নিয়ে অপব্যাখ্যা দি‌চ্ছে।

এটা দুর্ভাগ্যজনক। তারা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে রাজ‌নৈ‌তিক স্বার্থ হা‌সি‌লের জন্য এটা কর‌ছে।"…

বিচার বিভাগের বিরুদ্ধে জনমত সৃষ্টির চেষ্টার বিপজ্জনক প্রবণতা নিয়ে আওয়ামী লীগের সরকারের মন্ত্রী মহোদয়গণ ও রায় বিরুধী নানাহ তীর্যক বক্তব্য রাখছেন। যা নি‌য়ে বিতর্ক চ‌লছে, রাজনী‌তির মাঠ উতপ্ত হচ্ছে যা এখানে উদৃত না করাই ভাল।

ষোড়শ সংশোধনীর রায়ে সরকারি দল হিসেবে আওয়ামী লীগ নিজেকে সংক্ষুব্ধ ভাবতেই পারে। এই সংশোধনী, এবং এর আলোকে খসড়া আইনটির মাধ্যমে উচ্চ আদালতকে সম্পূর্ণভাবে নিজের করায়ত্ত রাখতে চেয়েছিল সরকার। ষোড়শ সংশোধনী বাতিল হওয়ার কারণে আপাতত তা আর করা সম্ভব হবে না । ষোড়শ সংশোধনীর রায়ে নিম্ন আদালতের স্বাধীনতা রক্ষার্থে ১৯৭২ সালের ১১৬ অনুচ্ছেদ পুনঃস্থাপনের গুরুত্বও তুলে ধরা হয়েছে। কিন্তু আওয়ামী লীগের প্রতিক্রিয়া এখানে সীমাবদ্ধ থাকেনি। রায়ে প্রধান বিচারপতির পর্যবেক্ষণে রাজনৈতিক ইতিহাস, দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের দুর্বলতা, রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও নির্বাচনী ব্যবস্থার দুর্বলতা নিয়েও সমালোচনা করা হয়েছে। আওয়ামী লীগ বেশি ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে এসব নিয়ে।আওয়ামী লীগের বক্তব্য হচ্ছে, এসব পর্যবেক্ষণ অপ্রাসঙ্গিক ও উদ্দেশ্যমূলক।

বাংলাদেশে উচ্চ আদালতের রায়ে এ ধরনের পর্যবেক্ষণ নতুন কিছু নয়। রায়ের পর্যবেক্ষণে কী বলা যাবে, তা নিয়ে বিচারিক দর্শন বা সুপ্রতিষ্ঠিত কোনো রেওয়াজ নেই। রায়ের পর্যবেক্ষণে পরিমিতিবোধ একটি আইনী গবেষনার বিষয়.ষোড়শ সংশোধনীর রায়ের পর্যবেক্ষণে কতটা প্রাসঙ্গিক বক্তব্য রয়েছে তা নিয়ে ভিন্নমত থাকতেই পারে. মামলার মূল বিষয়ের সংগে কোনো সম্পর্ক নেই এবং রায়ে ইতিহাস বর্ণনার সময়ও কোন দৃষ্টিকটু বিচ্যুতি থাকলে তা অবশ্য রিভিউতে তুলে ধরা যেতে পারে।

সংসদের হাতে উচ্চ আদালতের বিচারকদের চাকরিচ্যুতির পুরো ক্ষমতা তুলে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছিল, তার (সংসদের ) পরিপক্বতা নিয়ে আদালতে প্রশ্ন উঠেছে ও রায়ে সংসদীয় গণতন্ত্রকে অপরিপক্ব বলে আখ্যা দেয়া হয়েছে। যা দৃষ্টিকটু ধরনের শাব্দিক বিচ্যুতি বলে মনে হতে পারে। সংসদীয় গণতন্ত্রের বিকাশ একটি দীর্ঘ চর্চা ও অনুশীলনের ব্যাপার. সে বিবেচনায় আমাদের সংসদীয় গণতন্ত্র এখনো বিকাশমান.

সরকার বিশেষভাবে ক্ষুব্ধ হয়েছে বঙ্গবন্ধুকে ইঙ্গিত করে রায়ে একটি বক্তব্য প্রদান করার ধারনা থেকে. তবে পর্যবেক্ষণে প্রাসঙ্গিক বক্তব্য ও রয়েছে। প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা বলে মন্তব্য করেছেন যে সরকার বা বিরোধী দল-কারও ট্র্যাপে আমরা পড়ব না' প্রধান বিচারপতি ষোড়শ সংশোধনীর রায় নিয়ে গণমাধ্যমে প্রকাশিত আইন কমিশনের বক্তব্য আইনজীবীদের তুলে ধরার প্রেক্ষাপটে এ কথা বলেন। এছাড়াও তিনি বলেন রায় ঘোষণার পর রায়ের গঠনমূলক সমালোচনা যে-কেউ করতে পারেন। গঠনমূলক সমালোচনাকে আমরা স্বাগত জানাই।

বিচার বিভাগের সমালোচনায় অনেক দৃষ্টিকটু ও আক্রমনাত্বক প্রচারনা চলছে যা অপরিপক্ক রাজনীতিরই অংশবিশেষ। এখানে ও পরিমিতিবোধ এর যথেষ্ট অভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে।

সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলে আপিল বিভাগের রায়কে অপরিপক্ক, পূর্বপরিকল্পিত ও অগণতান্ত্রিক বলে মন্তব্য করেছেন আইন কমিশনের চেয়ারম্যান সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক। তিনি জাতীয় আইন কমিশনে এক সংবাদ সম্মেলনে সম্প্রতি এ মন্তব্য করেন…তিনি আরো বলেন, 'ষোড়শ সংশোধনীর রায়ে সংবিধানের অপব্যাখ্যা করা হয়েছে। তাই সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল ফিরিয়ে আনতে হলে আবারও সংবিধান সংশোধন করতে হবে। সংবিধানে যেহেতু সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল ছিল না, সেহেতু এটা রাখা সংবিধান পরিপন্থী।' ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় সম্পর্কে তিনি বলেন, 'আপিল বিভাগের রায়টি অপরিপক্ক, পূর্বপরিকল্পিত ও অগণতান্ত্রিক।'সাবেক প্রধান বিচারপতি আক্ষেপ করে বলেন, 'সংবিধানে ১ নম্বর অনুচ্ছেদে গণপ্রজাতন্ত্রের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু এই রায় দেশকে বিচারিক প্রজাতন্ত্রের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। এর মাধ্যমে মার্শাল ল' আমলে চলে যাওয়ার চেষ্টা চলছে।' তিনি আরও বলেন, 'যেখানে দুদককে চিঠি দিয়ে সাবেক বিচারপতির বিরুদ্ধে তদন্ত বন্ধ করতে নির্দেশ দেওয়া হয়, সেখানে তাদের ওপর (সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের সদস্য বিচারপতিদের) নির্ভর করবো কিভাবে?'

আইন কমিশনের চেয়ারম্যান আরো বলেন, 'সংসদ সদস্যরা ভুল করলে সুপ্রিম কোর্ট দেখে সংশোধন করবেন। সেখানে সুপ্রিম কোর্ট (বিচারপতিরা) ভুল করলে আমরা যাবো কোথায়?' এই রায়ের মাধ্যমে জুজুর ভয় দেখানো হচ্ছে এবং সংসদ সদস্যদের হেয় করা হয়েছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

উচ্চ আদালতের একটি রায় আইন হিসেবে বিবেচিত হবে। প্রধান বিচারপতি রায়ের মধ্যে যে সব কথা বলেছেন সেটা এ মুহুর্তে আইন. এ কারণেই এই আপত্তি মাঠে ময়দানে নয় বরং আইনী প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আশু সমাধানের পদক্ষেপ নেয়া উচিত।

মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণা অনুযায়ী, বিচার বিভাগের সদস্যরা মত প্রকাশের স্বাধীনতা, বিশ্বাস, সমিতি এবং সমাবেশের অধিকারী অন্যান্য নাগরিকের মতো; যাহোক, এই অধিকারগুলি প্রয়োগ করার ক্ষেত্রে, বিচারকরা সবসময় তাদের কার্যকারিতা মর্যাদা সংরক্ষণ এবং বিচার বিভাগের স্বাধীনতা এবং স্বাধীনতার স্বার্থ রক্ষা করতে সর্বদা নিজেদেরকে পরিচালনা করবেন।

অপরিমিত আলোচনা সমালোচনায় পরিস্থিতিকে ঘোলাটে না করে এ বিষয়ে সংক্ষুব্ধ পক্ষের জরুরী ভিত্তিতে আইনী পদক্ষেপ নেয়া উচিত। তা না হলে মানুষের শেষ ভরসাস্থল টুকুর সণ্মান ধুলায় মিশে যাব। আমাদের বিকাশমান গনতন্ত্র আবারও মুখ থুবরে পড়বে।
…………………………………………………………………………………………

দেলোয়ার জাহিদ :সভাপতি, বাংলাদেশ প্রেসক্লাব সেন্টার অব আলবার্টার, বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কানাডা ইউনিট নির্বাহী এবং সভাপতি, বাংলাদেশ হেরিটেজ মিউজিয়াম