পাটই বদলে দিতে পারে গ্রামীন অর্থনৈতিক চালচিত্র ও দেশের অর্থনীতি।

আকাশের তারাগুলি
Published : 8 April 2011, 08:23 AM
Updated : 8 April 2011, 08:23 AM

সোনালী আঁশ পাট, প্রাকৃতিক তন্তু। আবহমান বাংলাদেশের গ্রামীন অর্থনীতির সাথে মিশে আছে। সেই সাথে পাটই ছিলো আমাদের প্রধান বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের পন্য। বর্ষার ঠিক আগে আগে পাট চাষ শুরু করতে হয়। এসময়ে নিচু জমিতে অন্য ফসল হওয়া কিছুটা অসম্ভব হয়ে পড়ে।

ছোটবেলায় যখন বিলের মধ্য দিয়ে নৌকা পাড়ি দিতাম তখন দেখতাম বিস্তীর্ণ জমিতে পাট বুক সমান পানিতে দাঁড়িয়ে আছে। অথবা নদীর তীরে দাঁড়িয়ে দেখতাম বিশাল বিশাল পাট বোঝাই নৌকা পাল তুলে যাচ্ছে । অথবা দেখতাম বাড়ীর আঙ্গিনায়, রাস্তার পাশে পাট শুকোতে দেয়া হচ্ছে। কিংবা বাড়ির শিশু কিশোর পুরুষ মহিলা গাছ থেকে পাট ছাড়িয়ে নিচ্ছে। এছাড়াও দেখা যেত বিশেষ ভাবে বেঁধে দাঁড় করিয়ে পাট খড়ি শুকোতে দেয়া হচ্ছে। গ্রামীন এ চিত্র টাই ছিলো এসময় অন্য রকম।


কালের বিবর্তনে শকুনের চোখ পড়েছিলো এই পাটের উপরে, অনেকটাই বিলীন হয়ে যাচ্ছিল। বদলে গিয়েছে গ্রামীন এই চিত্র। কৃষকরা আর পাট চাষের বদলে বর্ষায় চা দোকানে আড্ডা কিংবা তাস খেলে সময় ব্যয় করে কিংবা অন্য কোন অনুৎপাদনশীল কাজে।

স্বাধীনতার পর থেকেই আসলে মুক্তবাজার অর্থনীতির মারপ্যাঁচে পাট শিল্প ধংস হয়ে যায়। বন্ধ হতে থাকে একের পর এক পাটের কল। পাটের বাজার দখল করে কৃত্রিম তন্তু। যুগের চাহিদা অনুযায়ী পাট শিল্পকে আধুনিকায়ন করার দিকে নজর দেয়া হয়নি। সাথে সাথে পাটশিল্পকে ঘিরে তৈরী হয় এক কালো বলয়। নানান দুর্নীতি, অপ রাজনৈতিক ব্যবহার, অব্যবস্থাপনা, সদুর প্রসারী কোন পরিকল্পনা না থাকায় পাটকল গুলো একের পর এক লোকসান দিতে থাকে। এর ফলে সরকার গুলো মাথা ব্যথার ঔষধ না দিয়ে মাথা কেটে ফেলার মত পাট কলগুলোকে বন্ধ করে দিতে থাকে। সর্ববৃহৎ পাটকল অবিবেচকের মত বন্ধ করে দিলে দেশে পাটের অর্থনীতি বিশাল আকারে হোঁচট খায়। কৃষকরা পাটের উৎপাদন খরচ তুলতে না পেরে পাট চাষ একরকম বন্ধ করে দেয়।

এখন সময় বদলে গেছে, বিশ্বে এখন পাটের বাজার নতুন করে তৈরী হয়েছে। কৃত্রিম তন্তুর পরিবর্তে প্রাকৃতিক তণ্তুর চাহিদা বেড়েছে। সরকারী ভাবে পাটকে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। নতুন করে পরিকল্পনা করা হচ্ছে। বন্ধ পাটকল গুলো ধীরে ধীরে খুলে দেয়া হয়েছে। বেসরকারী উদ্যোক্তারাও পাটের অর্থনীতিতে অবদান রাখছে, নতুন নতুন শিল্প কলকারখানার দিকের মনোনিবেশ করছে। যা দেশে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের প্রয়োজন মত উৎপাদন হলে শিল্পটি পুনঃ বিবেচিত হবার অপেক্ষায় রয়েছে।

এর মধ্যেই সোনায় সোহাগা হিসেবে এসেছে বাংলাদেশী সায়েন্টিস্টসের অভাবনীয় সাফল্য পাটের জিনোম সিকোয়েন্সিং আবিষ্কার যা পাটকে বিপ্লবে পরিনত করবে।

পাটের জিনোম সিকোয়েন্সিং টিম

দেশে এখন পাট চাষ বেড়েছে, বেড়েছে কৃষক লেভেলে পাটের বিক্রয় মুল্য। যদিও এখনো ব্যপক হারে আগের মত পাটচাষ শুরু হয়নি। প্রয়োজন সরকারী বা বেসরকারী পর্যায়ে কৃষকদের দিকনির্দেশনা। পাটের নতুন নতুন বাজার তৈরী করা। তাহলে বর্ষায় যে সময়ে কৃষকরা অলস বসে থাকে তখন কৃষকরা জড়িয়ে যাবে পাটের অর্থনীতিতে। আবার ভরে উঠবে বিলের পর বিল। মাঠের পর মাঠ। আনাচে কানাচে পাটের প্রাথমিক প্রক্রিয়াজাত করনে চিত্র। নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে নৌকোতে পাটের বোঝা হয়তো দেখা যাবেনা, নদী গুলোর যা বিচ্ছিরি অবস্থা। গঞ্জে বাজারে আবার দেখা যাবে পাটের নির্দিষ্ট হাট। আমরা বলতাম হাড আঁডা:) (পাটের হাট)। সময়ের অনাবাদি জমি হবে আবাদি। কৃষকের হাতে ফিরে আসবে নতুন অর্থ(মৌসুমি), বদলে যাবে দিন, এই খাতে বাড়বে কর্ম সংস্থান, যা থেমে গিয়েছিলো কায়েমি স্বার্থবাদী শকুনের থাবায়।

সবশেষে এই শিল্প পুণর্জাগরনের এবং এর বিস্তৃতি লাভের জন্য সরকারকেই পর্যাপ্ত মনিটরিংয়ে রাখতে হবে। যাতে লাভের গুড় শিয়ালে না খায়। ফড়িয়ারা একটা ব্যাধি ছিলো তখন। এটাকে পুনরায় মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে দেয়া যাবেনা। বেসরকারী পর্যায়েও অনেক কিছু করার আছে।

এই খাতকে নিয়ে যেন আর কোন অবিবেচকের মত কাজ দেখতে চাইনা। কোন শকুনের চোখ যেন আর না পড়ে। নিজের বোনা পাটের রশি যেন কৃষকের গলার ফাঁস না হয়।

একটি সুখী, সুন্দর, সচ্ছল গ্রামীন জীবন তৈরী হবে। দেশের অর্থনীতির চাকা নতুন মোড় নিবে।