প্রসঙ্গঃ জনগণ নিয়ে বিতর্ক, জনগণ আসলে কারা?

মুশফিক ইমতিয়াজ চৌধুরী
Published : 9 June 2011, 03:58 AM
Updated : 9 June 2011, 03:58 AM

ইদানীং কতিপয় দৈনিক পত্রিকা এবং বাংলা ব্লগগুলোতে কিছু নব্য কলামিস্টদের আবির্ভাব ঘটেছে, তারা বিশেষ কিছু পত্রিকা, ব্যক্তি এবং রাজনৈতিক দলের ভাড়াটে সাংবাদিক হয়ে তাদের অপলেখনীর মাধ্যমে বিশেষ রাজনৈতিক উদ্দেশ্য এবং দর্শনের বহিঃপ্রকাশ ঘটাচ্ছেন । আমাদের দেশের জনগণ বলতে তারা শুধুমাত্র নিজেদেরকেই বোঝেন, এদেশের কৃষকসমাজ, নারীসমাজ, শ্রমিকসমাজ যেন অচ্ছুত সম্প্রদায়, কৃষক, নারী ও শ্রমিক সমাজ যেন জনগণের অংশই নন। আসলেই তো, নির্মম বাস্তবতার প্রেক্ষিতে, তারা জনগণের অংশ হবেন কিভাবে ? জনগণ হতে হলে তো আমাদের দেশের জ্ঞানপাপীদের মত পেটে কিছু বিদ্যে থাকা লাগে, পকেটে পয়সা থাকা লাগে, সমাজে প্রভাবশালী হওয়া লাগে, প্রিন্ট ও কেবল মিডিয়াতে শক্ত অবস্থানে থাকা লাগে। তাই, এই ২০% তথাকথিত শিক্ষিত লোকজনই দেশের জনগণ, ৮০% কৃষক, নারী ও শ্রমিক সমাজ এদেশের যেন জনগণ নন (!) ।

আমাদের দেশের শিক্ষিত মানুষদের কার্যকলাপ দেখলে স্বভাবতই মনে প্রশ্ন জাগে, হয়তো জ্ঞান ও শিক্ষা সবক্ষেত্রে মহান নয়। প্রকৃতপক্ষে, জ্ঞান ও শিক্ষা মহান, তবে জ্ঞানীর মত জ্ঞানী এবং শিক্ষিতের মত শিক্ষিত হওয়া লাগে, অর্ধশিক্ষিত , কুশিক্ষিত বা জ্ঞানপাপী হলে সমাজ ও রাষ্ট্রে তার ভয়ানক কুপ্রভাব পড়তে বাধ্য। আমাদের দেশের তথাকথিত শিক্ষিত শ্রেণীর শিক্ষিত হওয়ার পেছনে জ্ঞানচর্চার প্রতি ন্যূনতম অনুরাগ নেই, আছে শুধুই জীবিকা নির্বাহের তাড়না। অর্থ এবং অর্থলব্ধ সুযোগসুবিধার কারণে মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত শ্রেণীর লোকেদের সন্তানেরা শিক্ষিত হয় এবং প্রান্তিক ও নিম্নবিত্ত শ্রেণীর লোকেদের সন্তানেরা শিক্ষা না পেয়ে কৃষক ও শ্রমজীবী হয়ে থাকতে বাধ্য হয়। একটু বিদ্যে অর্জন করেই আমাদের দেশের এই তথাকথিত শিক্ষিত ব্যক্তিবর্গ তাদের অভাবনীয় শিক্ষাবাজী শুরু করে দেন। এই শিক্ষিত শ্রেণী সমাজের সুবিধাবাদী মধ্যবিত্ত এবং উচ্চবিত্ত শ্রেণীর সদস্য, তাই তাদের মজ্জাগত স্বার্থবাদী, সুযোগসন্ধানী এবং প্রতিক্রিয়াশীল চরিত্রটি তাদের কার্যকলাপের মাধ্যমে সহজেই বের হয়ে আসে। দেশের রাজনীতিতে এই তথাকথিত শিক্ষিত শ্রেণী তাদের তথ্য সন্ত্রাসের মাধ্যমে দেশের রাজনীতির গতিধারা পাল্টে দিতে সদা সক্রিয় ভূমিকা পালন করে এবং যদি সরকার এই ২০% শিক্ষিত শ্রেণীর স্বার্থরক্ষা না করে ৮০% কৃষক-শ্রমিক ও নারীসমাজের স্বার্থরক্ষা করতে যায়, তাহলে এই প্রতিক্রিয়াশীল চক্রটি এভাবে ওভাবে ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে গোজামিল দিয়ে যে কোন উপায়ে সরকারকে দোষী প্রমাণিত করতে চেষ্টা করে এবং সরকার পতনের উন্মত্ত ক্রীড়ায় মত্ত হয়ে পড়ে ।

চিত্রঃ এই দরিদ্র কৃষকসমাজ কি কেজিপ্রতি ১০ টাকার কমে চাল বিক্রি করে তাদের পরিবার চালাতে পারবে ?

প্রথমেই আসা যাক, চালের মূল্যবৃদ্ধির প্রসঙ্গে। আওয়ামীলীগের নির্বাচনী প্রচারণার একটি বিষয় ছিল, তারা নাকি ১০ টাকায় চাউল খাওয়াবে। এতে এই প্রতিক্রিয়াশীল শিক্ষিত সমাজ খুশী হয়েছিল, কেননা, তারা তো আর কৃষক নয়, তাই চালের দাম কমলে তাদের খাদ্য বাজেট কমবে এবং এই খাতের খরচটা থেকে বিলাসব্যসন ও ভোগবিলাসের জন্য বেশি খরচ করা যাবে। যত দেরিতেই হোক না কেন, সরকার বুঝতে পেরেছে যে, দেশের ৮০% কৃষকদের শ্রমের প্রকৃতমূল্য না দিলে বা স্বার্থরক্ষা না করলে আগামী নির্বাচনে কৃষকসমাজের ভোট পাওয়া যাবেনা। তাছাড়া, সরকার দেশের চাকরীজীবী শ্রেণীর বেতন স্কেলের প্রভূত বৃদ্ধি সাধন করেছে, তাই কৃষক সমাজেরও বেতন বৃদ্ধি পাওয়া আবশ্যক। তাই চালের মূল্য পুনঃ নির্ধারণের মাধ্যমে সরকার চাকরীজীবী ও কৃষকসমাজের অর্থগত বিষয়ে একটি ভারসাম্য তথা বৈষম্য দূরীকরণ করার চেষ্টা করেছে। এতে ২০% শিক্ষিত সমাজ সরকারের ওপর প্রচণ্ডভাবে ক্ষিপ্ত হয়েছে, তাই কতিপয় পত্রিকা ও ব্লগে সরকারবিরোধী প্রচারণার উন্মত্ততায় ফেটে পড়েছে। তাদের লেখায় অন্য দশজন সাধারণ শিক্ষিত ব্যক্তিগণ সরকারবিরোধী মনমানসিকতায় প্রভাবিত হচ্ছেন। তবে তারা এই বিষয়টির কথা ভুলে যাচ্ছেন যে, সরকারবিরোধী কলামগুলো একেবারেই একপেশে ও পক্ষপাতদুষ্ট, কেননা, এগুলো দেশের মাত্র ২০% জনগণের মনের কথা, ৮০% কৃষক-শ্রমিক ও নারী সম্প্রদায় পত্রপত্রিকায় লেখালেখি করেন না, তাই তাদের মনের কথা সাধারণ জনগণের কাছে অব্যক্তই থেকে যায়। তাই, পত্রপত্রিকায় সরকারবিরোধী লেখালেখি করলে শুধু ঢাকা বা বিভাগীয় শহরগুলোতেই কিছুটা ফায়দা হতে পারে, কিন্তু গ্রামাঞ্চলে কৃষক ও শ্রমিক সম্প্রদায়ের মধ্যে এসব লেখালেখির তেমন কোন প্রভাব পড়বে না, কেননা, তারা পত্রপত্রিকা পাঠক কিংবা ইন্টারনেট ব্যবহারকারী নন। প্রশ্ন দাঁড়ায়, এই ২০% শহুরে শিক্ষিত লোকজনই কি শুধু জনগণ, ৮০% কৃষক-শ্রমিক-নারী সম্প্রদায় কিছুই নন ?

চিত্রঃ সবসময়ই লাভ করতে উন্মুখ শেয়ার ব্যবসায়ীদের (নাকি জুয়াড়ি ?) আকস্মিক ক্ষতির কারণে জ্বালাও পোড়াও উৎসব এবং দেশের সম্পদ তথা শান্তি বিনষ্টকরণ

এবার আসা যাক, শেয়ার বাজার প্রসঙ্গে। শেয়ার বাজার পুঁজিবাদী সমাজের লটারি,যেহেতু শেয়ার বাজারে ঢুকতে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না হলেও চলে এবং যেহেতু এটি ভাগ্য ও অনুমানের ওপর নির্ভরশীল সেহেতু,শেয়ারবাজারের পতন তো কখনো কখনো হতেই পারে,এই তুচ্ছ ঘটনা নিয়ে এত ঢালাওভাবে অতিরঞ্জিত করে প্রচার করার কি আছে ? তাছাড়া শেয়ার বাজারের ঘটনা একটি আকস্মিক ঘটনা, এর পেছনে একটি অসৎ ব্যবসায়ী চক্র জড়িত আর শেয়ার বাজারের খদ্দের বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ নয়,বরং একটি ক্ষুদ্র অংশ, গ্রামের ৮০% কৃষকসমাজ কি এই শেয়ারবাজার করে ? করে ১০-২০%,,১০-২০% কখনো কখনো লোকসানের সম্মুখীন তো হতেই পারে,এই খেলায় কি বলা আছে,সবসময়ই লাভ হবে ? শেয়ার বাজার বিষয়টিই একটি জুয়া খেলা, তাই এখানে কখনো কখনো ভাগ্য সুপ্রসন্ন হবে আবার কখনো বা ভাগ্যবিড়ম্বিত হতে হবে,এটিই স্বাভাবিক ।

দেশপ্রেম মানে দেশের মানুষকে ভালবাসা এবং তাদের জন্য কাজ করা, আমরা যখন ক্রিকেটে বাংলাদেশকে সমর্থন করি, তখন বাংলাদেশকে সমর্থন বলতে বাংলাদেশের ঐ ১১ জন ক্রিকেটারকেই সমর্থন করা বোঝাই, নির্দিষ্ট ব্যক্তি প্রীতির চেয়ে দলীয় প্রীতিই এখানে মুখ্য থাকে। কিন্তু আমাদের তথাকথিত ২০% এর কাছে এদেশের গ্রামীণ জনগণের সমষ্টিগত উন্নয়নের চেয়ে ডঃ ইউনূসের ব্যক্তিগত উন্নয়নের গুরুত্ব অনেক বেশি। তাই দেশের গরীব মানুষ বাঁচল না মরলো, তারা চরম হাড়ভাঙা খাটুনি করে গ্রামীণ ব্যাংকের ঋণ শোধ করলো তাতে তাদের বিন্দুমাত্র চিন্তা নেই, আসল জনগণ কারা ? ঐ ৮০% অশিক্ষিত কৃষক শ্রমিক সমাজ নাকি এই ২০% শিক্ষিত চাকরীজীবী ব্যবসায়ী ও লেখক সমাজ ? আমার বিচারে তো দুপক্ষই, কিন্তু এই ২০% এর বিচারে শুধু তারাই জনগণ, তারাই নাগরিক, ৮০% মানুষ জনগণই নয় ! এই ২০% জনগণ বিদেশীদের দেওয়া পদক ও পুরষ্কারের মোহে মোহাবিষ্ট, ঐদিকে যে বিদেশীদের পুরষ্কার পাওয়া লুটেরারা কোটি কোটি টাকা চুষে নিয়ে বিদেশে পাচার করছে আর নিজেদের আর্থিক অবস্থার পরিবর্তন ঘটাচ্ছে, তাতে তাদের ভ্রূক্ষেপ নেই, কেননা এই ২০% শিক্ষিত লুটেরা সদস্যদের অনেকেই লুটপাট ও দুর্নীতির অর্থে আর্থিক ও সামাজিকভাবে চরম প্রভাবশালী ।

চিত্রঃ লিমন প্রসঙ্গে তারেক আহমেদ সিদ্দিকীর মন্তব্য গ্রহণযোগ্য নয়, ইনি দায়িত্বজ্ঞানহীন বক্তব্য দিয়ে লিমন-র‌্যাব ইস্যুতে আওয়ামী লীগকে জড়িয়ে দলটিকে বেকায়দায় ফেলেছেন, অথচ আওয়ামী লীগ এতে যুক্ত নয়

ইদানীং লিমন নিয়ে খুব মাতামাতি হচ্ছে, দৈনিক প্রথম আলো তাদের অপ সাংবাদিক মতিউর রহমান এবং তাদের শ্রদ্ধাস্পদ মুহাম্মদ ইউনূসের প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কড়া বক্তব্যের প্রতিশোধ হিসেবে একের পর এক মিথ্যে সংবাদ প্রকাশ করে তাদের আসল চরিত্র উন্মোচিত করেছে। রিভিউ কমিটির ৮৯ পৃষ্ঠার প্রতিবেদন এবং আদালতে তিনবার শোচনীয় পরাজয়ের পরও মুহাম্মদ ইউনূসকে নিয়ে তাদের হলুদ সাংবাদিকতা জারি রেখেছে, এখন লিমন ইস্যু নিয়ে মিডিয়াতে অতিরঞ্জন করে চলেছে। আরেকটি ১/১১ করার পাঁয়তারা করে চলেছে এই অসৎ পত্রিকাটি। লিমন যে নিরীহ ছাত্র তার কোন সুস্পষ্ট প্রমাণ আছে কি ? নিরীহ ছাত্রকে কেন সন্ত্রাসীদের সঙ্গে এক জায়গায় পাওয়া যাবে ? যারা লিমনের পক্ষে গলাবাজি করে বেড়াচ্ছে, তারা আদৌ ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিল কি ? তারা কি চাক্ষুষ দেখেছে যে, বিনা কারণেই র‌্যাব সদস্য লিমনের পায়ে গুলি করেছে ? পূর্বশত্রুতা না থাকলে অপরিচিত মানুষকে বিনা কারণে কেউ গুলি করে ? এটি বিশ্বাসযোগ্য ? অন্য ১০ জনের তো গুলি লাগলো না, লাগলো শুধু লিমনের, অন্য ১০ টা নিরীহ ছাত্র তো সন্ত্রাসীদের সঙ্গে একই স্থানে ছিলো না, লিমন কেন ঐখানে উপস্থিত ছিল ? লিমনের পায়ে এমনি এমনি গুলি করা হলে তো ইমন, সুমন, স্বপন নামের আরো ১০ জন ছেলের পায়ে র‌্যাব এমনি এমনি গুলি করতো ! মিডিয়া যে কত অসৎ এবং সরকার বিরোধী প্রচারণার মাধ্যমে দেশের মানুষ এবং সরকারকে মুখোমুখি করার অপচেষ্টায় লিপ্ত, তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ প্রথম আলোসহ চারদলীয় জোটপন্থী কিছু পত্রপত্রিকা ! ইমন লিমন ইস্যু পেলে মানবাধিকার কমিশনের লোকজন সজাগ হয়ে ওঠে, তাদের মুখ ফুটতে শুরু করে মানবতার মহামন্ত্রে আর অশ্রু ভেজানো মায়াকান্নার মাধ্যমে, অসৎ সাংবাদিকেরা সজাগ হয়ে ওঠে, কারণ ঐ সংবাদ যতদিন ধরে চলবে, ততদিন তাদের ইনকামের পোয়াবারো ! বছরের বাকি সময়টা এসব তথাকথিত মানবাধিকার কর্মীর খোঁজই পাওয়া যায়না, দেশের মানবাধিকার কমিশনের নেতাদের অসৎ উপায়ে অর্জিত ব্যক্তিগত সম্পদের কজন হিসেব রাখেন ? তবে তদন্ত শেষ হওয়ার আগে আওয়ামী লীগ নেতাদেরও বোকার মত লিমন নিয়ে মন্তব্য করা উচিত হয়নি, এতে আওয়ামী লীগের উপর অনেকে ক্ষুব্ধ হয়েছে ! কেন র‌্যাব এবং লিমনের মধ্যেকার ঘটনার দায়ভার আওয়ামী লীগের কতিপয় নেতা বোকার মত তাদের নিজেদের ঘাড়ে নেবে ? শেখ হাসিনা কিন্তু এমন অবিচক্ষণতা দেখাননি, দেখিয়েছেন তার দলের অদূরদর্শী কিছু লোকজন এবং আওয়ামী লীগ লিমন ইস্যুতে সংশ্লিষ্ট না হয়েও তাদের কারণে বিপদে পড়েছে ! আমি লিমনকে দোষী বা নির্দোষ কোনকিছুই বলছি না, আমার কথা হলো, যুক্তির বিচারে লিমন নির্দোষ এমন তত্ত্ব ধোপে টেকেনা, আর লিমন যে দোষী তা তদন্ত ছাড়া বলাও অসঙ্গত, আমার কথা হলো, লিমন যেটিই হয়ে থাকুক না কেন, তার সম্পর্কে তদন্তের পরেই মন্তব্য করা বাঞ্ছনীয়, এটি আওয়ামী লীগের মন্ত্রী এবং নেতাদের ক্ষেত্রে যেমন প্রযোজ্য, তেমনি রিপোর্টার ও সাধারণ জনগণের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য ।

চিত্রঃ দেখুন অনলাইন জরিপ যে কতটা অকার্যকর এবং হাস্যকর তার উৎকৃষ্ট নমুনা !

আরো একটি বিষয়, সেটি হলো পত্রপত্রিকার অনলাইন পাঠক জরিপ ! বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার একটি সামান্য অংশ ইন্টারনেট ব্যবহারকারী প্রবাসী বাংলাদেশী এবং দেশী শিক্ষিত সমাজ । এরা যে মতামত প্রদান করে তাতে কি দেশের সামগ্রিক অবস্থার চালচিত্র প্রকাশ পায় ? এদের বিপুল অংশ প্রবাসী এবং বাংলাদেশের ভোটার নয় । আর দেশের অধিকাংশ জনগণই কৃষক ও শ্রমিক, তাই তাদের মতামতের তোয়াক্কা না করে শুধু সংখ্যালঘু শিক্ষিত শ্রেণীর মতামত পত্রপত্রিকায় প্রকাশ করে কি মানুষকে বিভ্রান্ত করে তোলা হচ্ছেনা দেশের সামগ্রিক অবস্থা সম্পর্কে ? দেশের স্বার্থবাদী ও সুবিধাবাদী মধ্যবিত্ত উচ্চবিত্ত শ্রেণীর ভণ্ডামি আর কত দেখতে হবে ? তাই অনলাইন জরিপের বিষয়টি বর্জন করাই শ্রেয় কেননা, এতে একটি খণ্ডিত ধারণা জন্ম নেয়, পুরো দেশের জনগণের অবস্থান বোঝা যায়না, আর পত্রপত্রিকাও ইচ্ছাকৃতভাবে বেশি বেশি করে সরকারের ভুলভ্রান্তি তুলে ধরার চেষ্টা করে, তাতে তাদের পত্রিকার কাটতি বাড়বে ! যখন কৃষক শ্রমিক ট্যাক্সি চালক গৃহবধূ বয়স্ক ব্যক্তিবর্গের একটি বিরাট অংশ রেগুলার ইন্টারনেট ব্যবহারকারী হবে, তখন অনলাইন জরিপ চালু করা যেতে পারে, তার আগে নয় ।

চিত্রঃ একটি সিএনজি কিংবা বাসচালক/কন্ডাক্টর/হেল্পার আমাদের চেয়েও গরীব, তাদের দশটি টাকা বেশি দিলে কি আমরা ফকির হয়ে যাবো ? তারা দশটি টাকা বেশি পেলে কি দরিদ্র এবং মধ্যবিত্তের মধ্যে বৈষম্য কমবে না ?

জ্বালানি তেল বা সিএনজির দাম বাড়লে প্যাসেঞ্জারের হয়তো ক্ষতি কিন্তু চালক ও মালিক সমিতির তো লাভ, প্রশ্ন হলো, শুধু প্যাসেঞ্জারই জনগণ ? চালক/হেলপার/কন্ডাক্টর এবং মালিক কি জনগণের অংশ নয় ? আবার, প্যাসেঞ্জারের অনেকেই মধ্যবিত্ত কিংবা অর্থশালী কিন্তু চালক শ্রেণী তো নিম্নবিত্ত, সুতরাং চালক শ্রেণীর ভাড়া একটু বৃদ্ধি পেলে কি তা দেশের মধ্যবিত্ত-নিম্নবিত্তের মধ্যকার বৈষম্যকে কিছুটা হলেও লাঘব করবে না ? চাকুরীজীবী ও ব্যবসায়ী সমাজ যেভাবে ভাবে, কৃষক ও শ্রমিক সমাজ নিশ্চিতভাবেই অনেক ক্ষেত্রে সেভাবে ভাবে না, কারণ তাদের পেশা ভিন্ন এবং তাই স্বার্থও ভিন্ন ভিন্ন। দুপক্ষই জনগণ এবং তাই দুপক্ষের স্বার্থই দেখতে হবে, সরকার সেটি দেখার চেষ্টাও করছে, একদিকে চাকুরীজীবীদের বেতন বাড়িয়েছে, আরেকদিকে কৃষক ও শ্রমিকের স্বার্থটাও দেখছে, কিন্তু এদেশের শিক্ষিত সমাজ কৃষকের স্বার্থ দেখতে নারাজ, এদেশের রিপোর্টার সমাজ যানবাহন মালিক ও চালকের স্বার্থ দেখতে নারাজ !

চিত্রঃ ইদানীং র‌্যাববিরোধী করে তোলার জন্য এই ছবিটি ব্লগে ব্লগে উদ্দেশ্যমূলকভাবে ব্যবহৃত হয়, প্রশ্ন হলো, চেহারা খারাপ হলেই কি নিশ্চিতভাবে মানুষ খারাপ হবে ?

এবার কতগুলো প্রশ্ন, র‍্যাব যদি দুর্ঘটনাবশত গুলি করেও থাকে, তার দায় সরকারকে বহন করতে হবে কেন ? লঞ্চডুবি হলে তার দায় সরকার নেবে কেন ? শেখ হাসিনা কি পিস্তল দিয়ে লিমনকে গুলি করেছেন ? শেখ হাসিনা কি লঞ্চ নিজে ডুবিয়ে দিয়েছেন ? শেখ হাসিনা কি ইউনূস মামলায় বিচারকের আসনে বসেছিলেন ? শেখ হাসিনা কি শেয়ারবাজারে বসে শেয়ার কেলেঙ্কারি ঘটিয়েছেন ? শেখ হাসিনা কি ঈশ্বরের মতই সর্বশক্তিমান যে বরিশালে লঞ্চডুবি হলে তা ঢাকা থেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন ? ঝালকাঠিতে লিমন গুলিবিদ্ধ হলে তা আগেই জেনে তার প্রতিরোধ করতে পারবেন ? শেখ হাসিনাকে কি এখন থেকে তার কার্যালয় ছেড়ে শেয়ার মার্কেটে বসে শেয়ারবাজার তদারকি করতে হবে ? দোষ দেওয়া অনেক সোজা, এভাবে অন্ধকারে ঢিল ছুড়ে শেখ হাসিনা বা সরকারকে হাজার ভাবে দোষারোপ করা শিশুসুলভ চপল তারই নামান্তর। আমি কোন রাজনীতিক নই, আওয়ামী লীগের সদস্যও নই, কিন্তু অন্ধকারের ঢিল ছোড়া কতিপয় শিশু এখন আমাকে শেখ হাসিনার দালাল বলে অভিহিত করবে, গালাগালি করবে, ধমকাধমকি করবে ! এই হলো বাংলাদেশের রাজনীতির ধারা, এই হলো বাংলাদেশের তথাকথিত শিক্ষিত জনগণের কারো প্রতি সমালোচনা করার স্টাইল। এখানে কাঁদা ছোঁড়াছুঁড়ি হয়, অন্ধকারে ঢিল ছোঁড়াছুঁড়ি হয়, গালাগালি করা হয়, গঠনমূলক সমালোচনা করার মেধা ও যোগ্যতা কারো নেই !

চিত্রঃ গরীব ১০টি টাকা বেশি চাইলে তার ১০০০ টাকার ক্ষতিসাধন, ভাংচুর সংঘর্ষ, এই কি জনগণের নমুনা ?

তো ফিরে যাই মূল প্রসঙ্গে, জনগণ কারা ? ২০% শিক্ষিত সমাজ নাকি উপেক্ষিত ৮০% কৃষক শ্রমিক নারী সমাজ ? আমার বিচারে উভয় সমাজই বাংলাদেশের নাগরিক, ৮০% কৃষক শ্রমিক নারী সমাজ যেমন জনগণ, তেমনি ২০% শহরবাসী শিক্ষিত চাকরীজীবী এবং ব্যবসায়ী সমাজও জনগণ। কিন্তু ২০% শিক্ষিত সমাজ শুধু তাদের নিজেদেরকেই জনগণরূপী ভেবে থাকেন, তাই বাকি ৮০% কৃষক সমাজ যদি চালের একটু বেশি মূল্য পায়, তখন এই ২০% এর গাত্রজ্বালা শুরু হয় । যখন দেশের ৫০% নারী সমাজের উন্নয়নের জন্য কোন নীতি সরকার প্রণয়ন করতে চায়, তখন এই ২০% তাদের ওপর শারীরিক আক্রমণে এবং তাদের যানবাহন ভাংচুরে মত্ত হয়ে পড়ে । সবাই আছে তাদের নিজ নিজ ধান্ধা নিয়ে, নিজ নিজ স্বার্থ নিয়ে, গরীব মানুষের পক্ষে কেউ নেই , তাদের কে নিয়ে ভাবার কারো সময় নেই, তারা যেন অচ্ছুত সম্প্রদায়, চিরকালের শোষিত নিপীড়িত, বঞ্চিত সম্প্রদায় !

পুনশ্চঃ একটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা মনে পড়ে গেল। তখন আমি পাকিস্তানে প্রেসিডেন্ট অ্যাওয়ার্ডের স্কলারশিপে অধ্যয়নরত, আমাকে এক লোকাল পাকিস্তানি জিজ্ঞাসা করলেন আমার স্কলারশিপের ব্যাপারে, স্কলারশিপ মানির ব্যাপারে। আমি বললাম তাকে স্কলারশিপ অ্যামাউন্ট। একটু পড়ে উনি যখন অন্য আরেক পাকিস্তানির সঙ্গে কথা বলছিলেন, তখন তাদের কথা থেকে অস্পষ্টভাবে বুঝতে পারলাম, একজন আরেকজনকে বলছেন " আমাদের দেশের কত গরীব লোক না খেয়ে থাকে, কত ছাত্র দারিদ্রের কারণে পড়তে পারেনা, আর সেখানে এদেরকে সরকার স্কলারশিপ দিচ্ছে " – কথাটা শুনে প্রথমে খারাপ লাগলো, কিন্তু পরক্ষণেই রাগ উবে গেল, কেননা অসত্য বা অন্যায় কিছু তো বলেননি তারা ! কৃষকের সন্তানদের শিক্ষাদানের জন্য পয়সা খরচ না করে আমাদের জন্য কেন পয়সা খরচ করা হবে ? অগ্রাধিকার তো সেই কৃষক শ্রমিকদের সন্তানদেরই, যারা অর্থের অভাবে শিক্ষালাভ করতে পারেনা, কৃষক যদি হাড়ভাঙা খাটুনি না করে ফসল ফলাতো, দেশ গড়ত, তাহলে আজকে আমরা কোথায় থাকতাম ? দুদিনের বিদ্যা লাভ করে আজকে আমরা লাটসাহেব সাজি, অথচ আমাদের লাটসাহেবগিরি বের হয়ে যেত যদি না ঐ কৃষক শ্রমিক সমাজ তাদের মাথার ঘাম পায়ে ফেলে নামমাত্র মূল্যে আমাদের জন্য ফসল ফলাতো, দেশ গড়তো । আমরা শিক্ষিত সমাজই দুর্নীতিবাজ, কৃষক শ্রমিক অতটা নয় যতটা আমরা । বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সত্যই বলেছিলেন " দুর্নীতি আমাদের দেশের কৃষক সমাজ করেনা, দুর্নীতি করে আমার দেশের শিক্ষিত জনগণ ! "