প্রসঙ্গঃ জাকির নায়েক ভূপাতিত, রমজান মাস ও রোজার স্বাস্থ্যগত, সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাষ্ট্রীয় কুপ্রভাব

মুশফিক ইমতিয়াজ চৌধুরী
Published : 13 July 2020, 02:42 PM
Updated : 21 July 2011, 05:58 PM

( সমাজ এবং রাষ্ট্রে রোজার স্বাস্থ্যগত – সামাজিক – অর্থনৈতিক এবং রাষ্ট্রীয় প্রভাব নিয়ে আজ পর্যন্ত কোন ব্লগে কোন লেখা আমার চোখে পড়েনি, যারা নিজেদের মুক্তমনা ব্যক্তি বলে মনে করেন, তাদেরও এই বিষয়টি নিয়ে নীরবতা আমাকে ভেতরে ভেতরে তাদের প্রতি ক্ষুব্ধ করেছে । তাই বসে পড়লাম এই লেখাটি লিখতে এবং লেখায় এতটা ডুবে ছিলাম যে দেখলাম জীবনে রোজা না রাখা ব্যক্তি লেখার নেশায় নাওয়া খাওয়া ছেড়ে অলরেডি রোজা করে ফেলেছে । আশা করি, আমার এই রোজা, ইসলামিক "রোজা"র স্বপক্ষে দীর্ঘদিন গড়ে ওঠা মিথ বা অবৈজ্ঞানিক মিথ্যেগুলো ভাঙতে সমর্থ হবে । সকল পাঠক এবং পাঠিকাদের লাইন বাই লাইন মেডিক্যাল যুক্তিগুলো তথ্যসূত্রসহ পড়ে এবং সম্যকভাবে বুঝে অতঃপর মন্তব্য করার জন্য বিনীত অনুরোধ জানালাম । সকলে ভাল এবং সুস্থ থাকুন । )

রোজা রাখা স্বাস্থ্যকর নিরোগ জীবনের জন্য চরম ক্ষতিকর । রোজার মাধ্যমে শরীরকে দীর্ঘ সময়ের জন্য পানি এবং প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান থেকে বঞ্চিত রেখে দৈনন্দিন জীবনে খাদ্যগ্রহণের ডিসিপ্লিনটিকে নষ্ট করা হয় এবং অনেক স্বাস্থ্যগত সমস্যাকে দাওয়াত দিয়ে ডেকে আনা হয় । তাছাড়া দীর্ঘক্ষণ খাদ্যগ্রহণ না করার কারণে ক্ষুধার চাহিদা খুব বেশি থাকে বলে মানুষ অতিভোজনে লিপ্ত হয়, যেই ভোজনের অনেকটা জুড়েই থাকে ডুবো তেলে ভাজা মশলাদার রিচ ফুড যা স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। যারা দাবী করেন যে " আল্লাহ যেহেতু বলেছেন রোজা রাখতে সেহেতু রাখতে হবে " –তাদের কথা থেকে এটাই প্রমাণিত হয় যে, তারা ধর্মের অন্ধ অনুসারী । এটিও প্রমাণিত হয় যে, প্রকৃতপক্ষে ইসলামের যুগই ছিল অন্ধকারাছন্ন আইয়্যামে জাহেলিয়ার যুগ, নাহলে চরম অবিজ্ঞানময় এবং স্বাস্থ্যগত, সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাষ্ট্রীয় ক্ষতির কারণ রোজা প্রথা তারা প্রবর্তন করতো না ।

প্রথমেই কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের উত্তর খোলসা করবো যাতে সামনে পড়তে যেয়ে কোনরূপ দ্বিধাদ্বন্দ্ব বা সন্দেহের অবকাশ না থাকে । এখানে উল্লেখ্য যে, রোজা সম্পর্কে বিভিন্ন বাংলা সাইটে কিছু চিকিৎসকদের স্বাস্থ্য বিষয়ক আর্টিকেল রয়েছে যেখানে তারা আমতা আমতা করে বলেছেন, ইয়ে, মানে রোজা ভালোই কিন্তু কিছু বিষয় মেনে চলতে হবে বা উপেক্ষা করে চলতে হবে । এবং তারপরে কিছু বিষয়ের জায়গায় অজস্র ক্ষতিকর বিষয়ের উল্লেখ করে পাঠকদের সচেতন করেছেন । সেই প্রসঙ্গে বলি, রোজা যদি সত্যিই ভালো হতো তাহলে তাদের "রোজা ভালোই" কথাটার সঙ্গে আর কোন লেজ লাগানোর প্রয়োজন ছিলোনা ( যেমনঃ কিছু বিষয় মেনে চলার ব্যাপারটি )। আবার কিছু বিষয়ের নাম করে তারা কিন্তু রোজার অনেক ক্ষতিকর দিকের কথা তুলে ধরেছেন এবং এমনভাবে তুলে ধরেছেন যাতে ইসলাম ও চিকিৎসাবিজ্ঞান – দুইয়ের মাঝে একটা সমঝোতাপূর্ণ অবস্থান রাখা যায় । আমি সেটি করিনি, কোন লেজ লাগাইনি, চিকিৎসা বিজ্ঞানের আলোকে যা ইনভেস্টিগেশন-অবজারভেশন-সার্ভে ও রিসার্চ নির্ভর সত্য, সেগুলোকেই তথ্যসূত্র সহকারে উল্লেখ করেছি । আসুন প্রশ্নোত্তর পর্ব শুরু করা যাক –

প্রশ্নঃ মেডিক্যাল ফাস্টিং বনাম ইসলামিক ফাস্টিং (রোজা), একই কথা?

উত্তরঃ না । মেডিক্যাল ফাস্টিং এবং ইসলামিক ফাস্টিং দুটি ভিন্ন ভিন্ন বিষয় । আপনারা যারা গুগল করে ফাস্টিংয়ের উপকারিতা জানার চেষ্টা করেন, তারা মেডিক্যাল ফাস্টিংয়ের উপকারিতা সম্পর্কেই জ্ঞাত হন এবং সেটিকেই ইসলামিক ফাস্টিং বা রোজা বলে ভুল করেন, কিছু গোঁড়া মুসলিম সেটিকেই অসৎভাবে রোজার নামে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন । মেডিক্যাল ফাস্টিংয়ের কিছু উপকারিতা রয়েছে, তবে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও কম নয়, একটানা ৩ দিনের বেশি মেডিক্যাল ফাস্টিং করলে মেডিক্যাল সুপারভিশন খুবই প্রয়োজন, পক্ষান্তরে ইসলামিক ফাস্টিং বা রোজার উপকারিতা নেই, বরং অনেক স্বাস্থ্যগত সমস্যার আধার এটি ।

প্রশ্নঃ অনেকেই তো রোজা করছেন, তাদের দেখা যাচ্ছে তারা সুস্থই আছেন, তাহলে রোজার আবার কুফল কী?

উত্তরঃ একটি সিগারেটের মধ্যে যেই পরিমাণ নিকোটিন আছে তা কোন ব্যক্তিকে ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে পুশ করলে সে মারা যাবে কিন্তু সেটিকে ধূমপান করার মাধ্যমে গ্রহণ করলে একদিনেই তার লাং ক্যান্সার/ব্রংকাইটিস/ অন্যান্য অসুখ বিসুখ হবেনা, সময় লাগবে, কারো কয়েক বছরে সমস্যার সূত্রপাত হবে, কারো আবার জীবনের মধ্যভাগে বা সায়াহ্নে সমস্যাটি দেখা দেবে। রোজা করার কারণে একিউট সমস্যা তুলনামূলকভাবে কিছুটা কম হলেও ক্রনিক সমস্যা অত্যন্ত বেশি হয়, অর্থাৎ সময়ের প্রবাহে রোজার কারণে সৃষ্ট শারীরিক সমস্যাগুলো একে একে আত্মপ্রকাশ করতে থাকে । যেহেতু তাৎক্ষণিক সমস্যা সকলের হয়না, তাই অনেকেই এটা নিয়ে অতটা মাথা ঘামায় না । এইডসের জীবাণুর আত্মপ্রকাশে ১০-১৫ বছর লেগে যেতে পারে, তেমনি রোজার ক্ষতিগুলো সাথে সাথে প্রতিভাত না হলেও মধ্যবয়সে বা তার পরে প্রতিভাত হয়, শরীরের বিভিন্ন তন্ত্র রোজা রাখা এবং অন্যান্য বদভ্যাসের কারণে ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে পড়ে, তাই রোজাকে সুপ্ত ঘাতক বললেও অত্যুক্তি হয়না । কমিউনিটি মেডিসিনে হেলথ সিকনেস বা হেলথ ডিজিজ স্পেক্ট্রামে বলা হয়েছে স্বাস্থ্যের ভালো এবং মন্দ দুটি দিক রয়েছে –

ভালোর স্তরবিন্যাস হলো – Positive Health < Better Health < Health Free from sickness.

মন্দের স্তরবিন্যাস হলো – Unrecognized Sickness < Mild Sickness < Severe Sickness < Death.

রোজাদারেরা মূলত Unrecognized Sickness স্তরে অবস্থান করেন। বয়স বাড়ার সাথে সাথে ক্রমাগত অবনতির মাধ্যমে ধীরে ধীরে রোজাদারেরা মাইল্ড ও সিভিয়ার সিকনেসে আক্রান্ত হন ।

প্রশ্নঃ কেন মেডিক্যাল ফাস্টিং শরীরের জন্য বিশেষ বিশেষ কন্ডিশনে উপকারী এবং কেন ইসলামিক ফাস্টিং উপকারী নয়?

উত্তরঃ আগে জেনে নেই ইসলামিক ফাস্টিং এবং মেডিক্যাল ফাস্টিংয়ের নিয়মাবলী –

ইসলামিক ফাস্টিং বা রোজা রাখার নিয়মাবলীঃ

ক) রমজান মাসে পুরো এক মাস যাবত ভোর হওয়ার পূর্বে আহার সম্পন্ন করা এবং রোজা রাখার জন্য প্রস্তুতি (বাস্তবে অতিভোজন)

খ) ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত আহারাদি ও পানি পান থেকে নিবৃত্ত থাকা

গ) সূর্যাস্তকালে রোজা ভেঙে ইফতার করা এবং রাতে স্বাভাবিক আহারাদি করা ( বাস্তবে তেলজাতীয় গুরুপাক খাদ্যগ্রহণ)

মেডিক্যাল ফাস্টিংয়ের নিয়মাবলীঃ

ক) পানি পানে কোনরূপ বাধা নেই, যখনই পিপাসা অনুভূত হবে, তখনি পানি পান করতে হবে

খ) অন্যান্য যে কোন ধরনের আহারাদি থেকে ৩-১৪ দিন পর্যন্ত সম্পূর্ণ বিরত থাকা, এটি শরীরের ক্ষমতা ও সহ্যশক্তির ওপর নির্ভরশীল, যখনি শরীরের ফ্যাট এবং/অথবা মাসল ভাঙন শুরু হওয়ার উপক্রম হবে, অর্থাৎ স্টারভেশন বা উপোসের উপক্রম হবে তখনি ফাস্টিং বন্ধ করতে হবে।

গ) জুস পান ও ফল খাওয়া যেতে পারে, যদিও এটি মতভেদ রয়েছে কেননা এতে ডিটক্সিফিকেশন হতে পারেনা বলে অনেক গবেষক ও বিজ্ঞানীদের অভিমত। ডিটক্সিফিকেশন প্রসেসের সূচনার জন্য বেশ কয়েকদিন একটানা ফাস্টিং করা প্রয়োজন।

প্রশ্নঃ রোজা করতে বয়োবৃদ্ধ এবং অসুস্থ ব্যক্তিদেরকে নিষেধ বা সতর্কতার সাথে রাখতে বলা হয় কেন ?

উত্তরঃ কেননা রোজা আসলেই স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর, তাই বয়োবৃদ্ধ এবং অসুস্থ রোগীরা রোজা একেবারেই সহ্য করতে পারেনা, কিন্তু যারা তরুণ এবং মধ্যবয়সী, তারা কিছুটা হলেও সহ্য করতে পারে তবে এই সহ্য করাটা কষ্ট এবং শারীরিক ক্ষতির বিনিময়ে,ক্ষতি যদি দৃশ্যমান নাও হয় তবু কিছু ক্ষতি হয়ই, এই কন্ডিশনকে চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয় সাব ক্লিনিক্যাল বা ল্যাটেন্ট কন্ডিশন । ঘুণপোকা যেভাবে ধীরে ধীরে নিঃশব্দে কাঠ খেয়ে ফেলে, রোজাও ঠিক তেমনি ধীরে ধীরে শরীরের বিভিন্ন তন্ত্রের ক্ষতিসাধন করে, যার তাৎক্ষণিক পরিণাম অনেকেই টের পায়না, দেরীতে শারীরিক সমস্যা হলেও সেটির পেছনে যে রোজার বিশাল ভূমিকা রয়েছে, সেটি সময়ের প্রবাহের দরুন উপেক্ষিত থেকে যায় ।

প্রশ্নঃ প্রায়ই বলা হয় যে রোজা করলে শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বিশ্রাম পায় । এটি কি ভালো নয় ?

উত্তরঃ রোজা করার ফলে শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বিশ্রাম পায় একেবারেই হাস্যকর এবং অবান্তর একটি কথা। কেননা, একজন মানুষ রোজ ৬-৭ ঘন্টা যখন ঘুমায়, তখনই সেই ৬-৭ ঘন্টা শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বিশ্রাম পায় যা একেবারেই পর্যাপ্ত । অতিরিক্ত ঘুম যেমন স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর, তেমনি অতিরিক্ত বিশ্রাম শরীরের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গের স্বাভাবিক কার্যকলাপের জন্যও ক্ষতিকর । অতএব, রোজার মাধ্যমে শরীররের অঙ্গপ্রত্যঙ্গকে বিশ্রাম দেওয়ার সুফল রয়েছে – এটি একেবারেই বাজে কথা !

প্রশ্নঃ রোজা রাখার ফলে কি শারীরিক স্থুলতা হ্রাস পায়না ?

উত্তরঃ বাস্তবে রোজার দিনে মানুষ বেশি মোটা হয়। এর কারণ –

ক) শেষরাতে সেহরীতে হাই এনার্জি কার্বোহাইড্রেট জাতীয় খাবার বেশি করে খাওয়া, ফলে ক্যালোরী ইনটেক বৃদ্ধি পায়

খ) সন্ধায় অন্যান্য মাসে হালকা নাস্তার বদলে ইফতারীতে ডুবো তেলে ভাঁজা পেয়াজু, বেগুনী, চপ, পাকোড়া খাওয়া যা হাই ক্যালোরীযুক্ত ।

গ) চিনিমিশ্রিত বা খেজুরের রসের শরবত পান করা, উভয়েই হাই ক্যালোরীযুক্ত এবং চিনি, ফ্যাট শোষণে প্রভাবক ।

ঘ) হাই ক্যালোরী খেজুর খাওয়া এবং রাতেও বেশি বেশি করে খাওয়া ।

তাই রোজার মাসে মানুষ পাতলা নয়, বরং আরো মোটা হয় ।

আসুন দেখি রোজার উপকারিতা সম্পর্কে তথাকথিত ইসলামিক গুরু জাকির নায়েক কি বলেন চলুন দেখি –

http://www.youtube.com/watch?v=qSlb0Keavbo

ভিডিও থেকে দেখা যায়, দ্রুত কথা বলার ক্ষমতাসম্পন্ন এই শ্রুতিধর ব্যক্তিটি দাবী করেছেন রোজা রাখার অনেক শারীরিক উপকার রয়েছে, কিন্তু বাস্তবে চরম আড়ষ্টভাবে এবং একই পয়েন্ট টেনেটুনে পুনরাবৃত্তির মাধ্যমে শেষমেষ মাত্র কয়েকটি পয়েন্টের কথা উল্লেখ করেছেন যেগুলোর মধ্যে বিন্দুমাত্র সত্যতা নেই বা চরম ভুল । ভুলগুলো হলোঃ

ভুলঃ রোজা ফ্যাট বা কোলেস্টেরল কমায়, এজিং প্রসেস ব্যহত করে

সঠিকঃ দীর্ঘসময় রোজার কারণে প্রচণ্ড ক্ষুধা থেকে ইফতারিতে ডুবো তেলে ভাজা খাবার, সফট ড্রিংক, চিনি মিশ্রিত সিরাপ রুহ আফজা বা এপি শরবত ইত্যাদি মুখরোচক খাবার খাওয়ার প্রতি লোভ জন্মায় এবং সেসব খাদ্য গ্রহণে ফ্যাট ও তার শোষণ আরো বৃদ্ধি পায়, উপরন্তু দীর্ঘ সময় উপোস থাকতে হবে দেখে সেহরীতে সকলে বেশি বেশি করে খেয়ে নেয়, এই অতিভোজনেও বেশ ক্ষতি হয় । তাহলে সব মিলিয়ে রোজার মাসে ফ্যাট বৃদ্ধি পায়, কমে না । আর এসবের কারণেই শরীরে ফ্রি র‍্যাডিক্যাল অত্যন্ত বেড়ে যায় যা কোষের জারণ ঘটিয়ে এজিং প্রোসেস ত্বরান্বিত করে।

ভুলঃ রোজা শরীরের ডিটক্সিফিকেশন করে ও ইম্যুনিটি বৃদ্ধি করে

সঠিকঃ টক্সিন নাশের মাধ্যমে শরীরের ডিটক্সিফিকেশনে রোজার ভূমিকা রয়েছে – এমনটি অনেকেই বলে থাকেন । কিন্তু বাস্তবে সেটি রোজা বা ইসলামিক ফাস্টিংয়ের মাধ্যমে নয় বরং মেডিক্যাল ফাস্টিং/থেরাপিউটিক ফাস্টিংয়ের মাধ্যমে, দুটি ভিন্ন ভিন্ন প্রক্রিয়া । ডিটক্সিফিকেশনের জন্য একটানা ৩-১৪ দিন খাদ্যগ্রহণ বন্ধ রাখতে হয় এবং এসময়ে শুধু পানি কিংবা জুস পান করতে হয় । কিন্তু রোজায় এই ডিটক্সিফিকেশন সম্ভব নয়, কেননা সারাদিন পানি পান না করে শরীরের ক্ষতি করা হয় এবং সন্ধ্যার পরপরই আবার খাদ্যগ্রহণ শুরু হয়ে যায় । তাহলে ডিটক্সিফিকেশন হবে কিভাবে ? বরং পানির অভাবে কিটোন বডি শরীর থেকে বের হতে পারেনা এবং জমে জমে কিটোসিসই ত্বরান্বিত করে চলে, উপরন্তু অতি ভোজনে শরীরে ফ্রি র‍্যাডিক্যাল ও অক্সিডেশন ম্যাটেরিয়াল আরো বৃদ্ধি পায় ।

ভুলঃ রোজা হজমতন্ত্রের এসিড নিঃসরণ কমায়

সঠিকঃ হজমতন্ত্র নিয়মের দাস, ব্যক্তির প্রতিদিনের খাদ্য গ্রহণের টাইমটেবলের ওপর নির্ভর করে এটি নির্দিষ্ট সময়ের নিয়মতান্ত্রিকতায় পাকস্থলিতে এসিড নিঃসরণ করে এবং দীর্ঘসময় খাবার না পাওয়ার দরুণ সেই এসিড পাকস্থলিগাত্রের প্রোটেকটিভ মিউকাসে ক্ষত সৃষ্টি করে, ফলে আলসার হয় । এই এসিড যদি ঊর্ধ্বমুখী হয়ে খাদ্যনালীতে এসে পড়ে, তবে হয় হার্টবার্ন ।

ভুলঃ রোজা কিডনী স্টোন হওয়ার ঝুঁকি কমায়

সঠিকঃ পানিশূন্যতার দরুন প্রসাব কনসেনট্রেটেড গাঢ় হলুদ বর্ণের হয়, ইউরিনারী রিটেনশন ঘটে, কিডনীতন্ত্রে পানিবিহীন শুষ্কতায় কিডনীতে স্টোন হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায় ।

ভুলঃ নন ইনসুলিন ডিপেন্ডেন্ট ডায়াবেটিস কমায়

সঠিকঃ একেবারেই ভিত্তিহীন, নিচে উভয় প্রকার ডায়াবেটিসে রোজার ভূমিকা ব্যাখ্যা করা হয়েছে ।

ভুলঃ হার্ট আর্টারি প্রেশার এবং লিভার আর্টারি প্রেশার কমায়

সঠিকঃ হাস্যকর, চলুন সারাজীবন রোজা করে প্রেশার কমাই, জাকির নায়েককে দিয়েই শুরু করা যাক, কিন্তু উনি নিজেই এটি করবেন না ! মধ্যবয়সী এবং বর্ষীয়ান ব্যক্তিরা এমনটি করলে বছরও কমপ্লিট করতে পারবেন না, তার আগেই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চলে যেতে হবে ।

ভুলঃ হার্ট ডিজিজ, এজমা, আর্থরাইটিস, লুপাস , ডাইজেস্টিভ ডিজঅর্ডার

সঠিকঃ একেবারেই বাজে কথা, এগুলোর প্যাথোফিজিওলজী এবং মেকানিজম তিনি উদ্দেশ্যমূলকভাবেই ব্যাখ্যা করেননি, আমি এসব সম্পর্কে নিম্নে আলোচনা করেছি ।

এবার চলুন দেখে নেওয়া যাক রোজা রাখা এবং রমজান মাসের স্বাস্থ্যগত, সামাজিক-অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক ক্ষতিগুলোকে –

স্বাস্থ্যগত ক্ষতিসমূহ

১) পানিশূন্যতা

সারা দিন ঘাম, প্রস্রাব ও শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে প্রচুর পানি শরীর থেকে বেরিয়ে যায়; কিন্তু রোজা রাখায় তা আর পূরণ করা সম্ভব হয় না । বয়স্কদের এ সমস্যা বেশি হয়। আবার যাঁরা রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য ডাইইউরেটিকস ওষুধ সেবন করেন, তাঁদেরও হয়। রোজা রাখার কারণে দীর্ঘসময় পানি থেকে বঞ্চিত হওয়ার ফলে ডিহাইড্রেশন বা পানিশুন্যতা দেখা দেয় যার ক্লিনিক্যাল সিম্পটমগুলো হলো –
১) হৃদস্পন্দনের উচ্চহার
২) ক্লান্তি
৩) অস্থিরতাবোধ
৪) কিডনীতে পাথর
৫) বমিভাব
৬) ইউরিক অ্যাসিড আধিক্য এবং ক্লিয়ারেন্স না হওয়া
৭) গাউট
৮) হেমাটোক্রিট, সেরাম প্রোটিন, ইউরিয়া, ক্রিয়েটিনিনের আধিক্য
৯) ইলেক্ট্রোলাইট ভারসাম্যহীনতা
১০) গাঢ় হলুদ রঙের প্রস্রাব এবং ডিফিক্যাল্ট ইউরিনেশন ।

এছাড়া অন্যান্য পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার মধ্যে রয়েছে –


১) ইরিটেবিলিটি এবং মুড সুইয়িং
২) উদ্বিগ্নতা এবং রেস্টলেসনেস
৩) বডি ও জয়েন্ট পেইন
৪) ইরেগুলার মেন্সট্রুয়েশন এবং স্পটিং
৫) সাইনাস প্রেশার এবং ন্যাজাল ডিসচার্জ
৬) ডায়রিয়া
৭) ডিপ্রেশন ও স্যাডনেস
৮) ঘেমে যাওয়া
৯) মাসল সোর
১০) ফ্লু লাইক সিন্ড্রোম
১১) মাথা ঘোরা ও মূর্ছা যাওয়া
১২) অ্যাবডোমিনাল ফুলনেস বা পেট ফাঁপা এবং ফ্ল্যাটুলেন্স বা পায়ুপথ দিয়ে অত্যাধিক বায়ু নিঃসরণ
১৩) বেলচিং
১৪) কোষ্ঠকাঠিন্য
১৫) কুইন্সিস
১৬) রেনাল ক্লিচ
১৭) স্পাইনাল পেইন
১৮) মাসল পেইন
১৯) ঠান্ডা জনিত সমস্যা
২০) গায়ে ও মুখে দুর্গন্ধ ( দিনের বেলায় গোসল না করা, অনেকক্ষণ ধরে পানিপানে বিরত থাকা এবং পানিশুন্যতার কারণে) ।

সূত্রঃ

চিকিৎসাঃ প্রচুর পরিমাণে পানি এবং প্রয়োজনবোধে স্যালাইন খেতে হবে ।

২) ক্লান্তি ও অবসন্নতা (রক্তচাপ কমে যাওয়া)

রোজার মাসে বেশি ঘাম, দুর্বলতা, বলশক্তির অভাব, মাথা ঝিমঝিম, (বিশেষ করে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালে), ফ্যাকাসে চেহারা, মূর্ছা যাওয়ার মতো ভাব, হাইপোটেনশন ইত্যাদি সমস্যা হতে পারে, এসব উপসর্গ প্রধানত বিকেলের শেষভাগে হয়ে থাকে । খুব কম পানি ও তরল পান করলে, খাদ্যে লবনের পরিমাণ একেবারে কম থাকলে এমনটি হতে পারে।

চিকিৎসাঃ বিশুদ্ধ পানি ও তরল পান বাড়াতে হবে। রক্তচাপ মেপে দেখতে হবে, কমে গেলে তাৎক্ষণিকভাবে কাঁচা লবন দেওয়া যেতে পারে।

৩) হার্টবার্ন ও হায়াটাস হার্নিয়া

নিম্নলিখিত কারণে বুক জ্বলা বা হার্ট বার্নের সমস্যা সৃষ্টি হয়ঃ

ক) ক্ষুধা পেলে বা খাবারের কথা চিন্তা করার কারণে

খ)পাকস্থলীতে প্রয়োজনের অতিরিক্ত এসিড তৈরি হওয়ার কারণে

গ)পাকস্থলীতে খাবার না থাকার সময় এসিড নিঃসরিত হওয়ার ফলে অথবা

ঘ) পাকস্থলী থেকে এসিড ইসোফেগাসে (খাদ্যনালির অংশ) চলে আসার কারণে

তাই, রোজার সময় এই হার্টবার্ন বা বুক জ্বলা সমস্যাটি খুবই লক্ষ্যণীয়, এজন্য রোজা না রাখা, তৈলাক্ত, ভাজাপোড়া, বাসি ও অতিরিক্ত মসলাযুক্ত খাবার খাবার না খাওয়া এবং ধূমপান না করাটাই যুক্তিযুক্ত । যাঁদের টক ঢেঁকুর আসে বা বুক জ্বলে, তাঁরা শোয়ার সময় একটু উঁচু বালিশ ব্যবহার করলে উপকার পাবেন।

চিকিৎসাঃ ডমপেরিডোন ১০ মিগ্রা খাওয়ার ১০ মিনিট আগে দিনে দুবার ৭-১৪ দিন ।

৪) পেপটিক আলসার, গ্যাস্ট্রাইটিস

শরীর অভ্যাসের দাস, খাওয়া দাওয়া সময় মাফিক বা নিয়মানুবর্তিতার সঙ্গে করলে শরীরে একটি অ্যাডাপ্টিং সিস্টেম তৈরি হয়, কেউ প্রত্যহ যেই সময়ে খাদ্যগ্রহণ করে সেই সময়ের আশপাশ দিয়ে খাদ্যের হজম এবং জীবানুনাশের জন্য শরীর স্টমাক ও ডিওডেনামে হাইড্রোক্লোরিক এসিড নিঃসৃত করে। সেখানে খাদ্যদ্রব্য থাকলে হাইড্রোক্লোরিক এসিড খাদ্যদ্রব্যের সঙ্গে মিশে নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়, ফলে পেপটিক আলসার হওয়ার ঝুঁকি কম থাকে, কিন্তু খাদ্যদ্রব্য না পেলে শুরু হয় বিপত্তি । পেপটিক আলসারের প্রধান কারণ হেলিকোব্যাক্টার পাইলোরি ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ, যেটি ইসোফ্যাগাস, স্টমাক এবং ডিওডেনামে মাত্রাতিরিক্ত এসিড নিঃসরণ করে সেগুলোর ক্ষয় করে, ফলে ইসোফ্যাজিয়াল/স্টমাক/ডিওডেনাল আলসারের সৃষ্টি হয় । একে তো এইচ পাইলোরির কারণে এসিড নিঃসরণ বেশি হয় এবং সেটি প্রতিরক্ষাকারী ইউরিয়েজ এনজাইম সংশ্লেষ না হতে দিয়ে স্টমাক/ডিওডেনামের প্রোটেকটিভ মিউকাস লাইনিং ড্যামেজ করে ফেলে , তার ওপর দীর্ঘসময় রোজা করার ফলে শরীর নিঃসৃত হাইড্রোক্লোরিক এসিড খাদ্যদ্রব্য না পেয়ে সরাসরি স্টমাক এবং ডিওডেনাম গাত্র ও মিউকাস লাইনিংয়ের ওপর ক্রিয়া করে এবং এসিডের ক্ষয়কারী ভূমিকার কারণে উল্লেখিত স্থানে আলসারের সৃষ্টি হয় । অর্থাৎ, পেপটিক আলসারের প্রধান কারণ এইচ পাইলোরি যা এশিয়ান জনগোষ্ঠীর পরিপাকতন্ত্রে খুবই কমন একটি জীবাণু এবং উপবাস বা রোজা এই জীবাণু দ্বারা রোগ সৃষ্টির একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবক । এই কারণেই দেখা যায়, রোজাদারদের মধ্যে গ্যাস্ট্রিক অ্যাসিডিটি, পেপটিক আলসার, ইসোফ্যাগাইটিস, গার্ড ডিজিজসহ পরিপাকতন্ত্রের রোগগুলো অত্যন্ত বেশি ।

সূত্রঃ

চিকিৎসাঃ ম্যাগালড্রেট,এন্টাসিড প্লাস, রেনিটিডিন, ফ্যামোটিডিন, অমিপ্রাজল, প্যান্টোপ্রাজল,ইসোমিপ্রাজল খাওয়া যেতে পারে (খাওয়ার ৩০ মিনিট আগে), সাথে ডমপেরিডোন ১০ মিগ্রা (খাওয়ার ১০ মিনিট আগে) তবে প্রথমদুটি ব্যতীত বাকি ঔষধে কোর্স কমপ্লিট করা অত্যন্ত জরুরী ।

৫) বদহজম ও পেটে গ্যাস

রোজায় ভাজাপোড়া খাবার প্রায় সবারই প্রিয়, কিন্তু এই ভাজাপোড়া জাতীয় ইফতারি গ্রহণের ফলেই অনেক রোজাদার শারীরিক অস্বস্তিতে ভোগেন বলে উল্লেখ করেছে এই গবেষণা। অতিভোজন, ভাজাপোড়া ও চর্বিযুক্ত খাবার, অতিরিক্ত তেল মসলাযুক্ত খাবার, ডিম, বাঁধাকপি, ডাল, কোমল পানীয় বেশি খাওয়ার কারণে পেট ফেঁপে যায়,পেটে ভটভট শব্দ হয় এবং পায়ুপথ দিয়ে বায়ু নির্গমিত হয়। ডিম গ্যাস উৎপাদক বলে এটি রোজার মাসে কম খাওয়াই শ্রেয় ।

চিকিৎসাঃ পেপটিক আলসার চিকিৎসার অনুরূপ, অত্যাধিক বাতকর্মের জন্য সিমেথিকন বিশিষ্ট এন্টাসিড।

রোজার সময় বেশ কিছু খাবার খাওয়া স্বাস্থ্যসম্মত নয়। দুঃখজনক হলো, এই খাবারগুলোই আমাদের দেশের মানুষ খেতে পছন্দ করে । যেমনঃ বেশি করে ভাজা খাবার (পিঁয়াজু, বেগুনি, পাকোরা, সিঙাড়া, সমুচা ইত্যাদি), ভুনা মাংস বা মাংসের ফ্রাই, বেশি তেলযুক্ত বা বেশি তেলে রান্না করা খাবার, উচ্চ চর্বিযুক্ত খাবার (পেস্ট্রি), উচ্চমাত্রার চিনিযুক্ত খাবার (সব রকম মিষ্টি, জিলাপি), বেশি মসলাযুক্ত খাবার, রিফাইন্ড সুগারসমৃদ্ধ খাবার বা প্রসেস করা খাবার ও ক্যাফেইনযুক্ত পানীয় (চা, কফি, কোলা)। ক্যাফেইনযুক্ত খাবারে ডাইইউরেটিকস থাকে বলে প্রস্রাবের পরিমাণ বেশি হয়, শরীর থেকে প্রয়োজনীয় পানি রোজার সময় বের হয়ে যায়। খুব বেশি লোনা ও মসলাজাতীয় খাবার না খাওয়া ভালো। চিপস, আচার বর্জন করা উচিত। তবে প্রশ্ন হলো, মানুষ কেন খাবেনা এগুলো ? রোজার ১০-১২ ঘণ্টা উপোসের ফলে মানুষ স্বাভাবিকভাবেই এই সকল রসনাদায়ক খাবার খেতেই বেশি উৎসাহী হবে । রোজার ট্র্যাডিশন না থাকলে এসব খাবার মানুষ খেতোনা, ফলে স্বাস্থ্যগত এত সমস্যারও সৃষ্টি হতো না ।

৬) কনস্টিপেশন বা কোষ্ঠকাঠিন্য

কোষ্ঠকাঠিন্যের অন্যতম কারণ পানিশূন্যতা ও ফাইবারসমৃদ্ধ খাবার কম খাওয়া যা রোজার মাধ্যমে সহজেই হতে পারে। কোষ্ঠকাঠিন্য প্রতিরোধে বেশি শাকসবজি ও ফলমূল খেতে হবে। লাল আটা ও ঢেঁকিছাঁটা চাল কোষ্ঠ কাঠিন্য প্রতিরোধক।


চিকিৎসাঃ ইসবগুলের ভুষি, ল্যাকটিটল বা ল্যাকটুলোজ জাতীয় ল্যাক্সেটিভ ওষুধ খেতে পারেন। বিসাকোডিল এবং সেন্না (ল্যাক্সেনা) সহজে খাবেন না ।

৭) মাথাব্যথা

রোজার মাসে পানিশূন্যতা, ক্ষুধা, ঘুম ও রেস্ট কম হওয়া, চা-কফি পান না করা, দিনের শেষ দিকে ক্ষুধা বেড়ে যাওয়া এবং সাথে রক্তচাপ হ্রাস পেলে তীব্র মাথাব্যাথা, মাথা ঝিমঝিম করতে পারে। এক্ষেত্রে রোজা না রাখাই যুক্তিযুক্ত ।

চিকিৎসাঃ সেহরীর সময় ভরাপেটে একটি নাপা ৫০০ মিগ্রা (নাপা এক্সট্রা নয়) ট্যাবলেট খেতে পারেন । আর রোদ পরিহার করতে ছাতা বা সানগ্লাস ব্যবহার করা উচিত ।

৮) ওজনবৃদ্ধি এবং ওজনহ্রাসের ফ্লাকচুয়েশন

রমজানে শরীরের ওজন কারো বাড়ে,কারো কমে । এই অস্থিত অবস্থার জন্য দায়ী –

ক) ওজন হ্রাসের ক্ষেত্রেঃ

১) রমজানের প্রারম্ভে পানিশূন্যতা ২) প্রতিদিন উপোস থাকার ফলস্বরূপ শরীরের ফ্যাট ক্যাটাবোলিজম

খ) ওজন বৃদ্ধির ক্ষেত্রেঃ

১) ইফতার এবং সেহরীতে অতিভোজন ২) ডুবো তেলে ভাজা কোলেস্টেরলযুক্ত অস্বাস্থ্যকর খাদ্যগ্রহণ ৩) প্রতিদিন হাই ক্যালোরি ফ্রুটস, ক্যাফেইন্যাটেড সফট ড্রিংক, এনার্জি ড্রিংক এবং চিনিযুক্ত শরবত ৪) দীর্ঘ এক মাস শুয়ে, ঝিমিয়ে এবং ঘুমিয়ে থাকার অভ্যাস ৫) স্লো মেটাবলিজম

যদি ভাবেন রোজা রেখেছি তাই বেশি বেশি বিশ্রাম নেব, বেশি নড়চড়া করব না তাহলে এই এক মাসে আপনার ওজন আরো বেড়ে যেতে পারে। সারাদিন উপবাস থাকার জন্য খাওয়ার পরিমাণটা একটু বেড়েই যায়। তাই হালকা কিছু ব্যায়াম যেমন হাটা বা স্ট্রেচিং করলে এবং সাথে কম ক্যালোরিযুক্ত সুষম খাবার খেলে মাস শেষে ওজন বাড়া প্রতিরোধ করা যাবে । যাদের ওজন অতিরিক্ত তারা যথাসম্ভব কম খেয়ে এবং ব্যায়াম বাড়িয়ে ওজন কমিয়ে নিতে পারেন।

চিকিৎসাঃ ওজন হ্রাসের জন্য লিপিড প্রোফাইল টেস্ট করে অতঃপর এটরভাসটাটিন, সিমভাসটাটিন, জেমফিব্রোজিল, ফেনোফাইব্রেট, মেটফরমিন, অ্যালি, সিবুট্রামিন, জেনিক্যাল ইত্যাদি ঔষধ রোগীর অবস্থা অনুযায়ী প্রেস্ক্রাইব করা হয় ।

৯) নিদ্রাহীনতা, অমনোযোগিতা, স্মৃতিশক্তিহ্রাস ও স্মৃতিভ্রংশতা

সূত্রঃ 6. Ahmed BAHAMMAM/Sleep Disorders Center, Respiratory Unit, Department of Medicine, College of Medicine, King Saud University, Riyadh, Saudi Arabia

ক) রোজা রাখার ফলে স্লিপ ল্যাটেন্সি এবং র‍্যাপিড আই মুভমেন্ট স্লিপ কম হয়, নিদ্রা উদ্দীপক হরমোন মেলাটোনিন নিঃসরণ বেসলাইন থেকে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে হ্রাস পায়,

ফলে ঘুমের সার্কাডিয়ান রিদম চরমভাবে ব্যহত হয় যা থেকে
১) ইনসমনিয়া বা অনিদ্রা ২) ল্যাথার্জি ৩) অমনোযোগিতা ৪) প্রেষণা বা মোটিভেশনে ঘাটতি ৫) ক্যালসিয়াম ঘাটতি সহ বিভিন্ন সমস্যা দেখা দেয় ।

অনিদ্রার কারণে ১) শারীরিক দৌর্বল্য ২) স্বাস্থ্যক্ষয় ৩)ক্লান্তি ৪) মুড অফ সমস্যা ৫) বিষণ্ণতা ৬) দৃষ্টি ও মনঃসংযোগের অভাব ৭) স্ট্রে হরমোন বৃদ্ধি ও অস্থিরতা ৮) সৃতিশক্তিহ্রাস ও স্মৃতিভ্রংশতা ৯) দ্রুত বার্ধক্য উপনীত হওয়া ১০) টিস্যুক্ষয় ১১) ইনফেকশনের প্রকোপ ১১) স্থূলত্বের ঝুঁকিগুলো বেড়ে যায় ।

ঠিকমত ঘুম না হলে ক্রনিক ডিজিজগুলো – ১) হৃদরোগ ২) স্ট্রোক ৩) ডায়াবেটিস ৪) আর্থরাইটিস ৫) হাইপারটেনশন ৬) ক্যান্সার –এর ঝুঁকি বেড়ে যায় ।

সূত্রঃ 22.International Journal of Food Science and Nutrition 2000 Mar 51:125-34

রোজার আরেকটি সমস্যা বিহ্যাভেরিয়াল পরিবর্তন, শারীরিক এক্সজশন, খাদ্যাভাসে পরিবর্তন । আবার, আরইএম স্লিপের কারণে মানুষ রঙিন স্বপ্ন দেখে যেটি মুড অন রাখতে এবং সদাউৎফুল্ল থাকতে সহায়ক। আরেকটি বড় প্রাপ্তি হলো, এই ঘুমের কারণে মানুষের সৃজনশীলতা এবং চিন্তাশক্তি বৃদ্ধি পায় । অথচ রোজা এর বড় প্রতিবন্ধক।

সূত্রঃ

রোজা রাখার ফলে ঘুমের স্বাভাবিক টাইমটেবলে বিঘ্ন ঘটে, দেখা গেছে রোজার আগে রোজাদারেরা রাত ১২টার মধ্যে ঘুমিয়ে পড়ে সকাল ৬-৭টার মধ্যে ঘুম থেকে ঊঠে পড়তো কিন্তু রোজার সময় দেখা যায়, তারা বেশি রাত অবধি জাগে এবং রাতে তাদের ৬-৭ ঘন্টার প্রশান্তির ঘুম হয়ই না কেননা ভোর ৪-৫টায় সেহরী খাওয়ার জন্য আবার জাগতে হয় এবং কাঁচা ঘুম থেকে ওঠার ফলে তারা খুবই অবসন্ন বোধ করে, দেখা যায় ঘনঘন হাই তুলছে ।

সূত্রঃ 8.Annals of Nutrition and Metabolism 2000 44:101-7

যেহেতু শরীর ভোরবেলা পুষ্টি উপাদান পাওয়ার পর দীর্ঘ সময় পর্যন্ত পানি ও পুষ্টি উপাদান পায়না, সেহেতু তারা শারীরিকভাবে খুবই দুর্বল অবসন্ন ও ক্লান্তি বোধ করে, এজন্য দিনের বেলায় দ্রুত ঝিমুনী চলে আসে, ওরাল তাপমাত্রা হ্রাস পায়, অ্যালার্টনেস ও মনঃসংযোগ সমস্যার সূত্রপাত হয় । নিদ্রাচ্ছন্নতা চলে আসে, কাজ করার মুড থাকেনা ।

সূত্রঃ 7. Journal Therapie, 2007, 54:567-72

রোজাদারদের মধ্যে দিবানিদ্রার বিষয়টি অত্যন্ত বেশি । রোজা রাখার ফলে ঠিকমত ঘুম হয়না, দেহমন অবসন্ন থাকে, তাই মনমেজাজও খারাপ থাকে। দেখা গেছে, রোজার মাসে রোজাদারদের মধ্যে খিটখিটে মেজাজ বেশি থাকে ।

চিকিৎসাঃ ইনসমনিয়ার জন্য মিডাজোলাম, ব্রোমাজিপাম, লোরাজিপাম, জোলপিডেম, জালেপলন ঘুমানোর আগে সেবন নির্দেশিত, তবে এবিউজ পোটেনশিয়ালের বিষয়টি স্মর্তব্য ।

১০) ডুবো তেলের ভাজাপোড়া খাদ্যের কুফল কার্ডিওভাস্কুলার ডিজিজ ও অন্যান্য সমস্যা

রোজার মাসে ঘুমের ব্যাঘাতে শরীরের অটোনমিক সিস্টেম এবং মেলাটোনিন হরমোনের ছান্দনিক নিঃসরণতা প্রভাবিত হয় এবং তার কুপ্রভাব লক্ষ্যণীয় হয় হৃদগতি, ব্লাড প্রেশার, ভাস্কুলার টোন এবং কোয়াগুলেশন ফাইব্রিনোলাইসিসের মাধ্যমে । যেসকল রোগীর হৃদসমস্যা আছে বা হৃদসমস্যার ঝুঁকি অত্যাধিক, তারা যদি রোজা রাখেন তো সেটি কুপ্রভাবে কার্ডিওভাস্কুলার সমস্যা নিয়ে অচীরেই হাসপাতালে ভর্তি হন । তাছাড়া রোজা করার কারণে অনেক মেডিসিন সময়মত খাওয়া সম্ভব হয়না এবং সময়মত না খাওয়ার কারণে অসুখ ভালো হয়না ।

রোজার সময়সহ সারা বছর রাজধানীসহ দেশব্যাপী পাড়ায়-মহল্লায়, অলিতে-গলিতে, হাট-বাজারে, হোটেল কিংবা অনেক নামিদামি বেস্তোরাঁ ও খাবার হোটেল – ইফতার হিসেবে জিলাপী, সিঙ্গারা, সমুচা, পিঁয়াজু, বেগুনি, পুরিসহ নানা ধরনের ভাজাপোড়া খাদ্য তৈরির জন্য দিনের পর দিন একই সয়াবিন ও সরিষার তেল ব্যবহার করে । ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাণ রসায়ন ও অনুপ্রাণ বিভাগ এবং খাদ্য ও পুষ্টি বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট হোটেল ও রেস্তোরাঁর পোড়া তেলের গবেষণা চালিয়ে এই বিষয়টি আবিষ্কার করেন । শুধু তাই নয়, অতি মুনাফালোভী হোটেল ও রেস্তোরাঁর মালিকগণ সিঙ্গারা, সমুচা, জিলাপী, বেগুনি, পুরি ভাজা ও অন্যান্য খাদ্যসামগ্রী দীর্ঘক্ষণ মচমচা রাখার জন্য গাড়ির পোড়া মবিল পোড়া তেলের সঙ্গে ব্যবহার করেন। জানা যায়, পোড়া তেল কোন কোন হোটেল ও রেস্তোরাঁয় মাস পর্যন্ত ব্যবহার করা হয়। পোড়া তেল কমে আসলে ঐ তেলের সঙ্গে নতুন করে তেল দিয়ে ভর্তি করে নেয়। এইভাবে চলতে থাকে হোটেল ও রেস্তোরাঁর পোড়া তেল এবং পোড়া মবিলের ব্যবহার। এসব কড়াইতে ঢাকনাও দেয়া হয় না অধিকাংশ হোটেল ও রেস্তোরাঁয়। রাতে পোকামাকড় ও ধুলাবালি ঐ বিষাক্ত তেলে পড়ে বলে জানায় হোটেলে কর্মরত শ্রমিকরা। পোড়া তেল ও মবিলের সংমিশ্রণে তৈরি খাদ্যসামগ্রী মানবদেহের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর, এই খাদ্য খেলে হজম হবে না এবং পেটে তেল ও মবিলের বিষাক্ত পদার্থ অক্ষত অবস্থায় থেকে যায়।

গাইনী, শিশু, কিডনী, মেডিসিন, লিভার ও ক্যান্সার বিশেষজ্ঞগণ বলেছেন,

পোড়া তেল ও পোড়া মবিল সংমিশ্রণে তৈরি সিঙ্গারা, সমুচা, জিলাপী, বেগুনি, পুরিসহ নানা খাদ্যসামগ্রী খেলে ক্যান্সার, কিডনী ও লিভারসহ মরণব্যাধি হবেই এবং মায়ের পেটের বাচ্চা বিকলাঙ্গ হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাণ রসায়ন ও অনুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক হারুন কে এম ইউসুফ বলেন,

দিনের পর দিন পোড়া তেল খাদ্যে ব্যবহার করার সময় উচ্চ তাপমাত্রা গেলে পারঅক্সাইড ও ট্রান্সফ্যাট তৈরি হয়। এই খাদ্য খাওয়ার পর মাত্রাতিরিক্ত কোলেস্টোরেল দেহে তৈরি হয়। এছাড়া নানা ধরনের মরণব্যাধি সৃষ্টিতে দ্রুত সহায়তা করে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ওষুধ প্রযুক্তি বিভাগের অধ্যাপক আবম ফারুক বলেন,

পোড়া তেলে খাদ্যসামগ্রী ভাজার সময় উচ্চ তাপমাত্রা গেলে অক্সিডেশন হয়। ঐ খাদ্য খাওয়ার পর লিভারের স্বাভাবিক প্রক্রিয়া নষ্ট করে দেয়। মরণব্যাধির পাশাপাশি গ্যাসট্রিক ও আলসার রোগ হওয়ার আশংকা বেশি বলে তিনি অভিমত পোষণ করেন।

একই বিশ্ববিদ্যালয় পুষ্টি ও খাদ্য বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. শাহ মোঃ কেরামত আলী পোড়া তেল সম্পর্কে অনুরূপ মতামত পোষণ করেছেন।

সারা বছর এই প্র্যাকটিস চললেও রোজার সময়ে এটি মাত্রাতিরিক্তভাবে বেড়ে যায়, কেননা পুরো একমাস জুড়ে সারা দেশব্যাপী ডুবোতেলে ভাজা ট্রান্স ফ্যাট ও স্যাচুরেটেড ফ্যাটে পরিপূর্ণ ভাজাপোড়া খাবার খাওয়ার ধুম পড়ে যায় । ট্রান্স ফ্যাট এবং স্যাচুরেটেড ফ্যাট শরীরে কোলেস্টেরল, লো ও ভেরি লো ডেনসিটি লাইপোপ্রোটিন এবং ট্রাইগ্লিসারাইডের পরিমাণ বৃদ্ধি করে এবং উপকারী হাই ডেনসিটি লাইপোপ্রোটিনের পরিমাণ হ্রাস করে । ফলে নিম্নলিখিত ডিজিজগুলোর সমস্যা দেখা দেয় –

১) ওবেসিটি ২) করোনারি হার্ট ডিজিজ ৩) মায়োকার্ডিয়াল ইনফারকশন ৪) ডায়াবেটিস ৫) এথেরোস্ক্লেরোসিস ৬) পেরিফেরাল আর্টেরিয়াল ডিজিজ ৭) হাইপারটেনশন ৮) কলোরেকটাল ক্যান্সার ৯) ওভারিয়ান ক্যান্সার ১০)প্রোস্টেট ক্যান্সার ১১) স্মল ইন্টেসটাইন ক্যান্সার ১২) আলঝেইমার্স ডিজিজ ১৩) ডিপ্রেশন ১৪) লিভার ডিজফাংশন ১৫) ডিজলিপিডেমিয়া ১৬) ফিমেল ইনফার্টিলিটি ইত্যাদি ।

চিকিৎসাঃ রোগীর অবস্থা এবং সমস্যা ভেদে একেক ঔষধ ব্যবহৃত হয়, তাই অনতিবিলম্বে হার্ট স্পেশালিস্টের শরণাপন্ন হোন ।

১১) গর্ভবতী নারী এবং লো বার্থ ওয়েট বেবি

গর্ভবতী নারীদে্র রোজা রাখা নিজের ও ভবিষ্যতের সন্তানের জন্য চরম ক্ষতিকর । রোজা রাখলে লো- বার্থ ওয়েট শিশু (<২.৫ কেজি) জন্মদানের সম্ভাবনা বেশি থাকে এবং এই শিশুরা ভবিষ্যতে লার্নিং ডিজেবিলিটি প্রবণ হয় । এছাড়াও রিসার্চে প্রমাণিত হয়েছে, স্বাভাবিক পুত্র সন্তান জন্মদানের সম্ভাবনার ১০% হ্রাস পায় রোজাদার গর্ভবতী মায়েদের ক্ষেত্রে । অ্যাডাল্ট ডিজেবিলিটি রেটও নন মুসলিমদের রেট থেকে ২০% বেশি থাকে ।

চিকিৎসাঃ গর্ভবতী নারীদের রোজা রাখা একেবারেই উচিত নয় ।

১২) রোজা এবং কিটোসিস

রোজা রাখার একটি অন্যতম পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কিটোসিস যেটি দীর্ঘ সময় কার্বোহাইড্রেট (গ্লাইকোজেন) জাতীয় খাদ্যের অভাবে ঘটে থাকে এবং লিভার কর্তৃক ফ্যাট ভাঙনের মাধ্যমে শরীরে ক্ষতিকর কিটোন বডি তৈরি করে। এটির প্রভাবে শরীর থেকে সোডিয়াম এবং পানি মাত্রাতিরিক্ত পরিমাণে নিঃসরিত হয় এবং শরীরের স্বাভাবিক ওজন কমে যায়। কিটোসিসের প্রভাবে ক্ষুধামান্দ্য বৃদ্ধি পায় এবং শরীর অতি দ্রুত ক্লান্ত হয়ে পড়ে । এমন ব্যক্তি শরীরে লো এনার্জি স্টেটের কারণে কাজকর্মে দ্রুত হাফিয়ে ওঠে, গতিমন্থরতা অনুভব করে । শরীরের শারীরবৃত্তিক পরিবর্তনের কারণে হজমতন্ত্রের ব্যাকটেরিয়া এবং এনজাইমগুলো অধিক সক্রিয় হয়ে ওঠে, ফলে তাদের মুখে দুর্গন্ধ হয়। এমন ব্যক্তি যদি রোজা ভাঙার পরে আর্টিফিশিয়াল সুইটেনার, কতিপয় শাকসবজি এবং চা-কফি পান করে, তবে দীর্ঘ একমাস সেটি করার ফলে ব্লাড ভেসেল ড্যামেজ হওয়ার ঝুঁকি এবং রক্তে ক্ষতিকারক মিথাইলগ্লোক্সালের পরিমাণ বেড়ে যায় ।

কিটোসিসের কারণে সৃষ্ট সমস্যাগুলো হলোঃ ১) চরম ক্লান্তি ২) শারীরিক দৌর্বল্য ৩) মাথা ব্যথা ৪) স্টমাক পেইন ৫) মুখে মেটালিক স্বাদ অনুভব ৬) হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসা ৭) চরম পিপাসা ৮) দুর্গন্ধময় নিঃশ্বাস ৯) মাথা ঘোরা ।

এছাড়া একমাস রোজা রাখার ফলে এটির কমপ্লিকেশন হিসেবে ১) হার্ট পালপিটেশন ২) কিডনী স্টোন ৩) ক্যালসিয়াম ঘাটতি ৪) অস্টিওপরোসিস হওয়ার ঝুঁকি অনেক বেড়ে যায় । ডায়াবেটিক রোগী রোজা রাখলে কিটোসিস পরিণত হয় কিটোএসিডোসিসে এবং সেখান থেকে রক্ত এসিডিক হয়ে পড়ে, কনফিউশন এবং বমি হতে পারে এবং সমস্যাটি উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়ে কোমা এবং এমনকি মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।

সূত্রঃ

চিকিৎসাঃ রোজা না রাখলে এবং পানি নিয়মিত খেলে শরীর পানিশূন্যতায় ভুগবে না এবং প্রস্রাব পাতলা হবে যেটির মাধ্যমে কিটোন বডি শরীর থেকে ফ্লাশ আউট হয়ে যাবে ।

১৩) পেশিতে খিচুনি ও গিটে ব্যথা

রোজার মাসে ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম ও পটাশিয়াম জাতীয় খাদ্য কম গ্রহণ করার কারণে এমনটি হয়ে থাকে। এসব খনিজ যেসব খাবারে বেশি থাকে সেগুলো খেতে হবে যেমন- শাকসবজি, ফল, দুধ/দুধজাত খাদ্য, মাংস ও খেজুর।
রোজার সময়ে অতিরিক্ত নামাজ পড়ায় হাটুর গিঁটে বেশি চাপ পড়ে। বয়স্কদের মধ্যে আর্থারাইটিস থাকলে ব্যথা, ফোলা, নিশ্চলতা, অস্বস্তি হতে পারে। অতিরিক্ত ওজন কমানো দরকার। যাতে বাড়তি ভার বহন না করতে হয়। পায়ের ব্যায়াম করা আবশ্যক । শরীর ফিট থাকলে সবই করা সম্ভব।

চিকিৎসাঃ পেশীতে খিঁচুনির জন্য টলপেরিসোন (মায়োল্যাক্স) বা এপেরিসোন (মায়োনিল) বা সাইক্লোবেঞ্জাপ্রিন (ফ্লেক্সর) , গিঁটে ব্যথার জন্য এন্টি আলসারেন্ট মেডিকেশনের সঙ্গে ন্যাপ্রোক্সেন বা ডাইক্লোফেন বা সেলেকক্সিব । গাউটের জন্য এলোপিউরিনল নির্দেশিত।

১৪) স্ট্রেস/উদ্বিগ্নতা

রোজার মাসে খাবার ও পানিপান কম করা, ঘুম ও বিশ্রাম কম হওয়া, জীবনযাপনের রুটিন পরিবর্তন হওয়ায় স্ট্রেস বা মানসিক চাপ বাড়ে। রোজার সময় রাতে উঠতে হয় বলে ঘুম কম হয়, বিকেলে ক্ষুধা বেশি লাগে বলে শরীর দুর্বল হয় ও বিশ্রামের প্রয়োজন হয়। তাই সকালে একটু বেশি সময় ঘুমিয়ে নিন বা বিকেলে একটু রেস্ট নিন অথবা রাতে এক ঘণ্টা আগে ঘুমাতে যান । তবে এসব করলে চাকুরীজীবি এবং ব্যবসায়ীরা তাদের কাজকর্ম করবেন কিভাবে ? অর্থাৎ রোজা রাখায় স্বাস্থ্যগত এবং অর্থনৈতিক উভয় দিক থেকেই নিজের এবং দেশের ক্ষতি ।

চিকিৎসাঃ ফ্লুক্সেটিন, সারট্রালিন, ভেনলাফ্যাক্সিন, মিরটাজাপিন, প্রিগাবালিন, বেনজোডায়াজেপিন ইত্যাদি নির্দেশিত ।

১৫) মাইগ্রেন

রমজানে মাইগ্রেনের সমস্যা তিনগুন বেড়ে যায়, প্রায় ৯০ মিলিয়ন মুসলিম রমজানে মাইগ্রেন আক্রান্ত হয়। এর পেছনে কারন হলো রোজা করার ফলে ডিহাইড্রেশন, ইনসমনিয়া এবং লো ব্লাড সুগার লেভেল সমস্যার সৃষ্টি হয়, স্ট্রেস রিলেটেড হরমোনগুলো অধিক হারে নিঃসরিত হতে থাকে । তাছাড়া দিনের বেলায় ক্লান্ত ও অবসন্ন থাকার কারণে প্রখর সূর্যালোক বা হাই ইনটেনসিটি আলো এবং দিনের বেলায় নয়েজের কারণে অনেকের সহ্য হয়না । এগুলোর প্রত্যেকটিই মাইগ্রেন ট্রিগার হিসেবে কাজ করে ।

সূত্রঃ

Judy Siegel-Itzkovich – Beduin doctor: Migraines common during Ramadan fast – The Jerusalem Post, August 9, 2010

চিকিৎসাঃ একিউট মাইগ্রেনের জন্য জোলমিট্রিপটান, ফ্লুনারিজিন, গাবাপেণ্টিন এবং ক্রনিক কেসের জন্য পিজোটিফেন, এমলোডিপিন, প্রোপানলল, টোপিরামেট ইত্যাদি ।

১৬) অকুপেশনাল ও ইন্ডাস্ট্রিয়াল হ্যাজার্ড

সূত্রঃ 5.Polish Journal of Occupational Medince 1991 4:3 219-28

জার্মানিতে কর্মরত রোজাদার তুর্কী মুসলিমদের ওপর সার্ভে চালিয়ে তাদের মধ্যে রোজার মাসে ১) হৃদস্পন্দনের উচ্চগতি ২) তীব্র মাথাব্যথা ৩) মাথা ঘোরা ৪) বমিভাব এবং বমি ৫) সার্কুলেটরি কল্যাপস ৬) তীব্র পানিশূন্যতা এবং তা থেকে সৃষ্ট ৭) ইউরিক অ্যাসিড আধিক্য এবং ক্লিয়ারেন্স না হওয়া ৮) গাউট ৯) হেমাটোক্রিট, সেরাম প্রোটিন, ইউরিয়া, ক্রিয়েটিনিনের আধিক্য এবং ১০) ইলেক্ট্রোলাইট ভারসাম্যহীনতা ইত্যাদি বিভিন্ন মেডিক্যাল কন্ডিশন দেখা গেছে ।

১৭) ডায়াবেটিস

এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, সারা বিশ্বের প্রায় ৫০ মিলিয়ন ডায়াবেটিসের রোগী রোজা রাখে। তারা বেশ কিছু জটিল সমস্যার সম্মুখীন হয়, বিশেষ করে রক্তে সুগারের স্বল্পতা (হাইপোগ্লাইসেমিয়া), রক্তে সুগারের আধিক্য (হাইপারগ্লাইসেমিয়া), ডায়াবেটিস কিটোএসিডোসিস ও পানিশূন্যতার। সালফোনাইলইউরিয়া ও ইনসুলিন গ্রহণকারী রোগীদের মধ্যে ঝুঁকি বেশি, মেটফরমিন ও গ্লিটাজোনস জাতীয় ওষুধ গ্রহণকারীদের মধ্যে ঝুঁকি কম। আসুন দেখি –

রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা কমে যাওয়া (হাইপোগ্লাইসেমিয়া)

কারণঃ ১) দীর্ঘ সময় না খেয়ে থাকা ২) অতিরিক্ত কাজ বা শারীরিক পরিশ্রম ৩) অতিরিক্ত ইনসুলিন অথবা ট্যাবলেট গ্রহণ করা ৪) ইনসুলিন ও সিরিঞ্জ ভিন্নমাপের হওয়া ৫) বরাদ্দের চেয়ে খাবার খুব কম খেলে বা খাবার খেতে ভুলে গেলে এ অবস্থা হতে পারে।

হাইপোগ্লাইসেমিয়ার লক্ষণ

১) অসুস্থ ও দুর্বল বোধ করা ২) বুক ধড়ফড় করা ৩) শরীর কাঁপতে থাকা। ৪) চোখ ঝাপসা হয়ে আসা ৫) অজ্ঞান হয়ে যাওয়া। ৬) খিদে বেশি পাওয়া। ৭) বেশি ঘাম হওয়া। ৮) শরীরের ভারসাম্য হারিয়ে ফেলা ৯) অস্বাভাবিক আচরণ করা। ১০) খিঁচুনি হওয়া ১১) মনোযোগের অভাব ১২) শারীরিক কাজে অক্ষমতা

করণীয়ঃ

রোজাদার ব্যক্তির এসব লক্ষণ দেখা দিলে অথবা রক্তে সুগারের পরিমাণ ৬০ মিলিগ্রামের (৩•৬ মিলিমোল) নিচে হলে রোজা ভেঙে ফেলতে হবে । হাইপোগ্লাইসেমিয়া একটি মেডিকেল এমারজেন্সি, রোগীকে সঙ্গে সঙ্গে চা চামচের চার থেকে ছয় চামচ গ্লুকোজ বা চিনি এক গ্লাস পানিতে গুলে খাওয়াতে হবে। অন্যথায় যেকোনো খাবার সঙ্গে সঙ্গে দিতে হবে। রোগী অজ্ঞান হয়ে গেলে মুখে কিছু খাওয়ানোর চেষ্টা না করে গ্লুকোজ ইনজেকশন দিতে হবে এবং দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে।
গ্লুকোজের মাত্রা বেড়ে যাওয়া (হাইপারগ্লাইসেমিয়া)

কারণঃ ১) ইনসুলিনের ঘাটতির কারণে কম সময়ে এসিটোন বেড়ে জটিল আকার ধারণ করতে পারে

লক্ষণঃ ১)মাথা ঘোরা ২) শক্তি কমে যাওয়া ৩) ঝিমুনি, বমি, দুর্বলতা ৪) অতিরিক্ত প্রস্রাব ৫) পিপাসা ও পানিশূন্যতা ৬) নিম্ন রক্তচাপ ৭) শুষ্ক ত্বক ৮) প্রস্রাবে গ্লুকোজাধিক্য মাত্রায় প্রকাশ পায় ৯) প্রস্রাবে এসিটোনের আধিক্য ।

করণীয়ঃ

এ অবস্থায় যদি দ্রুত চিকিৎসা করানো না হয়, তাহলে কিটোএসিডোসিস হবে এবং রোগী বিপজ্জনক অবস্থায় পৌঁছাবে। রোজা থাকা অবস্থায় হলে রোজা ভেঙে দ্রুত হাসপাতালে নেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। কিটোএসিডোসিস ছাড়াও যদি রক্তের সুগার বিপজ্জনক অবস্থায় পৌঁছায় (16.7mmol/L বা 300 mg/dl), তাহলে ত্বকের নিচে ইনসুলিন দিয়ে সুগার নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। পরবর্তী সময়ে ডায়াবেটিসের ওষুধ সমন্বয় করতে হবে।

রোজার এত ক্ষতির পরেও যারা রোজা রাখতে চান তাদের জন্য ডায়েটঃ

ক) সেহরির খাবার সেহরির শেষ সময়ের অল্প কিছুক্ষণ আগে খাওয়া।

খ) ইফতারের সময় বেশি পরিমাণে মিষ্টি ও চর্বিজাতীয় খাবার গ্রহণ না করা।

গ) ডায়াবেটিসের রোগীদের পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি ও পুষ্টিকর খাবার খেতে হবে, যেন তারা পানিশূন্যতায় না ভোগে।

ঘ) খেজুর -১টি, ফলমূল, শাকসবজি, ডাল ও টকদই – ঐচ্ছিক, ডাবের পানি, চিনিমুক্ত কোমল পানীয়, সুইটেনারঃ ক্যানডেরেল/সুইটেক্স/জিরো । ভাজাপোড়া খাবার, যেমন পেঁয়াজু, বেগুনি, পুরি, পরোটা ও কাবাব বর্জনীয় ।

ঙ) পরিমিত ক্যালরীর খাদ্য সঠিক সময়ে সঠিক পরিমাণে খাওয়া প্রয়োজন।

চ) দিনের বেলায় খুব বেশি পরিশ্রম বা ব্যায়াম করা উচিত নয়। ইফতার বা রাতের খাবারের এক ঘণ্টা পর ব্যায়াম করা যেতে পারে।

ডায়াবেটিসের রোগীর ওষুধ

ক) যারা দিনে একবার ডায়াবেটিসের ওষুধ খায়, তারা ইফতারের শুরুতে (রোজা ভাঙার সময়) ওই ওষুধ একটু কম করে খেতে পারে।

খ) যারা দিনে একাধিকবার ডায়াবেটিসের ওষুধ খায়, তারা সকালের মাত্রাটি ইফতারের শুরুতে ও রাতের মাত্রাটি অর্ধেক পরিমাণে সেহরির আধা ঘণ্টা আগে খেতে পারে।

গ) যেসব রোগী ইনসুলিন গ্রহণ করে, তাদের রমজানের আগেই ইনসুলিনের ধরন ও মাত্রা ঠিক করে নেওয়া উচিত। সাধারণত রমজানে দীর্ঘমেয়াদি ইনসুলিন ইফতারের সময় বেশি এবং প্রয়োজনে শেষ রাতে অল্পমাত্রায় দেওয়া উচিত। দীর্ঘমেয়াদি ও কম ঝুঁকিপূর্ণ ইনসুলিন (যা দিনে একবার নিতে হয়) বর্তমানে আমাদের দেশে পাওয়া যায় (Lantus), তা ব্যবহার করা যায়। এতে হাইপোগ্লাইসেমিয়ার আশঙ্কা অনেকটা কম।

ঘ) রমজানের কমপক্ষে তিন মাস আগে ডায়াবেটিসের রোগীর অবস্থা অনুসারে চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে খাওয়ার ওষুধ ও ইনসুলিন ঠিক করা উচিত। রমজানের প্রথম ও শেষ দিনে ওষুধ সমন্বয় করে নিতে হবে। এই দুই দিন খাবার ও জীবনযাত্রায় বিশেষ পরিবর্তন হয়ে থাকে।

সুগার টেস্ট ও ইনসুলিন দেওয়া

ক) দিনে ও রাতে রক্তের সুগার মেপে ওষুধের মাত্রা ঠিক করা ।

খ) সেহরির দুই ঘণ্টা পর এবং ইফতারের এক ঘণ্টা আগে রক্তের সুগার পরীক্ষা করানো যেতে পারে। সুগারের পরিমাণ কমে 3.3mmol/L বা 60 mg/dl হলে রোজা ভেঙে ফেলতে হবে । সুগারের পরিমাণ বেড়ে (16.7mmol/L বা 300 mg/dl) হলে প্রস্রাবে কিটোন বডি পরীক্ষা করে জরুরি ভিত্তিতে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। প্রয়োজনে ইনসুলিন দিতে হবে ।

গ) হাইপোগ্লাইসেমিয়া একটি জরুরি অবস্থা, এমতাবস্থায় রোগীকে খাবার দিয়ে রক্তের সুগার বাড়ানোই প্রধান দায়িত্ব ।

ঘ) ব্রেইনের সঠিক কার্যক্রমের জন্য সার্বক্ষণিক সুগারের প্রয়োজন । দীর্ঘ সময় ব্রেইন সুগারহীন থাকলে ব্রেইনের ইরিভারসিবল ক্ষতি সাধিত হয়, যা পরে আর ঠিক হয় না।

ঙ) রোজাদার ডায়াবেটিস রোগীরা দিনের বেলায় সুগার টেস্ট করতে পারবেন ও ত্বকের নিচে ইনসুলিন নিতে পারবেন।

রমজান মাসে ডায়াবেটিসের ওষুধ ব্যবহারে পরিবর্তন
রোজার আগে

১• সালফোনাইলইউরিয়া, দিনে একবার, যেমন গ্লাইমেপেরাইড (অশথড়ীল), গ্লিক্লাজাইড এমআর গ্রহণ করেন।
২• সালফোনাইলইউরিয়া, দিনে দুইবার, যেমন গ্লিবেনক্লেমাইড, গ্লিক্লাজাইড গ্রহণ করেন।
৩• মেটফরমিন ৫০০ মিলিগ্রাম দিনে তিনবার গ্রহণ করেন।
৪• থায়াজলিনিডিয়ন দিনে একবার গ্রহণ করুন।
৫• রিপাগ্লিনাইড অথবা নেটিগ্লিনাইড।

রোজা চলাকালীন

ইফতারের শুরুতে (রোজা ভাঙার সময়) ওষুধটি একটু কম করে খেতে পারেন।
সকালের মাত্রাটি ইফতারের শুরুতে ও রাতের মাত্রাটি অর্ধেক পরিমাণে সেহরির আধা ঘণ্টা আগে খেতে পারেন।
ইফতারের পর মেটফরমিন ১০০০ মিলিগ্রাম ও সেহরির পর ভরা পেটে ৫০০ মিলিগ্রাম খেতে পারেন।
ওষুধটি একই মাত্রায় রাতের যেকোনো সময় খেতে পারেন।
ইফতারের শুরুতে ও সেহরির আগে খেতে পারেন অথবা সন্ধ্যা রাতে খাবার খেলে তার আগেও খেতে পারেন।

এত কিছুর পরেও যারা রোজা রাখতে চান তাদের জন্য উপদেশঃ

রোজার সময় খাবারের বিভিন্ন দিক নিয়ে 'ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অব রামাদান ফাস্টিং রিসার্চ' জার্নালে প্রকাশিত ওয়েস্ট ভার্জিনিয়া ইউনিভার্সিটির একদল গবেষকের গবেষণায় দেখা গেছে, রোজার সময় বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই রোজাদাররা অসুস্থ হয়ে পড়েন যথাযথ খাবার গ্রহণ না করার কারণে। বিশেষ করে অতিরিক্ত খাবার গ্রহণের কারণেই এই অসুস্থতা দেখা দিয়ে থাকে। এর সঙ্গে অপর্যাপ্ত ঘুম শরীরটাকে কিছুটা বিপাকে ফেলে দেয়।

অতিভোজন পরিহার করুন

রোজায় এই শারীরিক বিপত্তি এড়ানো সম্ভব নয়, তবে যতটা সম্ভব প্রতিরোধ করার জন্য কিছু পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা । সারা দিন রোজা রাখার পর সারা দিনের খাবার একসঙ্গে খেতে হবে এরকম মানসিকতা থেকেই এই বিপত্তি দেখা দেয়। এ প্রসঙ্গে বিশেষজ্ঞের কথা হচ্ছে, একথা ভুলে গেলে চলবে না যে পাকস্থলির একটা নির্দিষ্ট আয়তন ও খাবার ধারণের ক্ষমতা রয়েছে; শুধু একদিন কেন, তিন দিন না খেয়ে থাকার পরও পাকস্থলি তার ধারণক্ষমতার বেশি খাবার গ্রহণ করতে পারবে না। সুতরাং বেশি খেলে বিপত্তি ঘটবেই। তাই এ ধরনের বিপত্তি এড়াতে গবেষকদের প্রথম উপদেশ হচ্ছে সাহরি ও ইফতারে অতিভোজন পরিহার করা। দ্বিতীয়ত শরীর নিয়ন্ত্রণের পদ্ধতি স্বনিয়ন্ত্রিতভাবে রোজার সময় বিপাক ক্রিয়ার হার কমিয়ে দেয় এবং শরীরে জমাকৃত চর্বি ক্ষুধা নিবারণে ব্যবহৃত হয়। রোজার সময় খাবারের ব্যাপারে অধিকাংশ লোকজনই রুচিকর খাবার গ্রহণের দিকে বেশি মনোযোগী থাকে, কিন্তু সুষম খাবার বা ব্যালান্স ডায়েটের কথা মনে রাখেন না। রোজায় সুস্থ থাকার জন্য সব ধরনের খাবার মিলিয়ে খাদ্য তালিকা তৈরি করতে হবে। বিশেষ করে আটা বা চাল, দুধ ও দুগ্ধজাতীয় খাবার, মাছ, মাংস এবং ডিম, শস্যদানা, শাকসবজি এবং সর্বোপরি ফল জাতীয় খাবার রাখা উচিত। সাহরি এবং ইফতার উভয়ের পরই ফল খাওয়ার ব্যাপারে বিশেষভাবে উপদেশ দেয়া হয়েছে এই গবেষণায়। গবেষকরা বলেছেন, রোজার খাবার যত সাধারণ হবে ততই ভালো। রোজা হচ্ছে বাড়তি ওজনসম্পন্ন লোকদের জন্য ওজন কমানোর উপায়। কিন্তু অতিভোজনের কারণে সে উদ্দেশ্য অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।

সেহরির সময় খাবারে থাকতে হবে জটিল শর্করা। এতে খাদ্য শরীরে থাকে দীর্ঘ সময়, তাই ক্ষুধাও সহজে লাগে না। খেজুর শর্করা, আঁশ, শ্বেতসার, পটাশিয়াম ও ম্যাগনেশিয়ামের চমৎকার উৎস। বাদামেও আছে বেশ প্রোটিন, আঁশ, চর্বি কম। কলায় রয়েছে পটাশিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম ও শ্বেতসার।

সাধারণভাবে যে পরিমাণ ক্যালরি গ্রহণ করা হয়, রোজার সময়ও সে পরিমাণই গ্রহণ করা উচিত। কাজকর্মও একই পরিমাণকরা উচিত, কমবেশি নয়। দীর্ঘ সময় না খেয়ে থাকতে হয় বলে খেতে হবে ধীরে ধীরে হজম হয় এমন খাদ্য, যাতে রয়েছে বেশি আঁশ। দ্রুত হজম এমন খাদ্য হলো চিনি, মিষ্টি, মিঠাই ও ময়দার খাবার। এগুলো না খাওয়াই ভালো।ধীরে হজম হয় এমন খাদ্য শরীরে টিকে থাকে আট ঘণ্টা পর্যন্ত। অথচ দ্রুত হজম হয় এমন খাদ্য শরীরে থাকে মাত্র তিন-চার ঘণ্টা।

ধীরে হজম হয় এমন খাদ্যের মধ্যে রয়েছে শস্য ও বীজ খাদ্য, যেমন-বার্লি, গম, ভুট্টা, শিম, ডাল, আটা, ঢেঁকিছাঁটা চাল। এগুলোকে বলে জটিল শর্করা। সেহ্রির সময় এ ধরনের খাবার খাওয়া অবশ্য উচিত। – হালিম – হলো ধীরে হজম হয় এমন একটি চমৎকার খাদ্য।

প্রচুর আঁশ আছে এমন খাবার বেছে নেওয়া ভালো। যেমন-তুষ, ছাতু, আটা, ভুট্টা, শিম, ডাল, বিটমূল, শাকসবজি, ডুমুর, আপেল, কমলা, শুকনো ফল, নাশপাতি, তরমুজ, পেয়ারা ও কুলবরই।

রমজান মাসের সামাজিক-অর্থনৈতিক এবং রাষ্ট্রীয় কুপ্রভাব

১) রমজান মাস এবং অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের প্রাবল্য

সূত্রঃ

অপরাধ, ভিক্ষাবৃত্তি এবং পতিতাবৃত্তি রোজার মাসে বেড়ে যায়, খুন (১.৫%) এবং চুরি (৩.৫%) হারে বৃদ্ধি পায়, রোজার মাসে শপিং করা এবং দেশের বাড়িতে ঈদ করতে যাওয়ার দরুণ ছিনতাই ও ডাকাতি বেশ পরিমানে বৃদ্ধি পায় ।

ভিক্ষাবৃত্তি, চৌর্যবৃত্তি এবং ছিনতাই করার জন্য রোজার মাসে মধ্যপ্রাচ্য এবং বাংলাদেশে শিশুপাচার বেড়ে যায়, ১৫০০ ইয়েমেনি শিশুকে শিশুপাচারকারীদের হাত থেকে রোজার মাসে উদ্ধার করা হয়, এছাড়া রোজার মাসে অর্থনৈতিকভাবে দুরবস্থাপন্ন নারীকে দিয়ে ভিক্ষাবৃত্তিও করানো হয় ।

২) ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের প্রতি মুসলিমদের সহিংসতা

রোজার মাসে অমুসলিমদের প্রতি মুসলিম জনগোষ্ঠীর অত্যাচার ও সহিংসতার হার মাত্রাতিরিক্তভাবে বেড়ে যায়, এরকম একটি উদাহরণ হলো ২০০৯ সালে রোজার মাসে মিসরে খ্রিষ্টানদের বিরুদ্ধে মুসলিমদের সহিংসতা যেখানে একটি চার্চ আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেওয়া হয়, ১৫৫ খ্রিষ্টানকে রোজা না রাখার দায়ে আটক করা হয় । ২০১০ সালে আফগানিস্তান সোমালিয়া পাকিস্তানসহ বেশ কিছু দেশে রোজার মাসে খ্রিষ্টানদের প্রতি ব্যাপক আক্রমণ নির্যাতন নিপীড়ন করা হয় ।

সূত্রঃ

আলজেরিয়াতে হোসাইন হোসাইনি এবং সালেম ফালাক নামের দুজন খ্রিষ্টানকে দুপুরের আহাররত অবস্থায় স্পটিং করে গ্রেফতার করা হয় এবং তিন মাসের সশ্রম কারাদন্ডে দন্ডিত করা হয় ।

সূত্রঃ

২৫ শে আগস্ট, ২০০৯ সালে পাকিস্তানেও দুজন খ্রিষ্টানকে আহাররত অবস্থায় পেয়ে আটক করা হয় । ভাবতে অবাক লাগে, ইসলামিক দেশগুলোতে মানবাধিকারের কি করুণ আর মানবেতর অবস্থা, অন্য ধর্মের অনুসারীদেরও তারা জোর জবরদস্তি করে ইসলাম মানাতে চায় ।

আগস্ট ২০১০ সালে ফ্রান্সে দুজন মুসলিম টিনএজ যুবক একজন ইহুদী ধর্মাবলম্বী মহিলাকে "ডার্টি জিউ" বলে গালি দেয় এবং মাথায় আঘাত করে ।সেন্ট্রাল লিও রেস্টুরেন্টে একজন মুসলিমকে তার ধর্মের ৩ জন টিনএজ যুবক গ্লাস বোতল এবং চেয়ার নিক্ষেপ করে মাথায় আঘাত করে, মুসলিম ব্যক্তিটির অপরাধ, মুসলিম হয়েও তিনি রোজা কেন করেননি !

অস্টেলিয়ার সিডনিতে মাত্র ১১ বছরের ছেলে অ্যান্টোনিও গ্রিগোরিওকে কতিপয় মুসলিম ছাত্র নির্মমভাবে পেটায়,কেননা সে রোজার সময়ে সালামি স্যান্ডউইচ খাচ্ছিলো ।

৩) রমজান মাস ও ট্র্যাফিক দুর্ঘটনা

রোজার মাসে রোড ট্র্যাফিক দুর্ঘটনার মাত্রা অত্যাধিক হারে বৃদ্ধি পায়, কেননা সারারাত নিদ্রাহীন থাকার কারণে কিংবা দীর্ঘ সময় পানিশূন্যতা এবং পুষ্টি উপাদান শরীরে না পড়ার কারণে দেহমন চরম অবসন্ন থাকে, ক্লান্তি ও ঝিমুনি আসে এবং কাজেকর্মে (ড্রাইভিংয়ে) মন বসেনা, তাই অসাবধানতা খুবই স্বাভাবিক এবং মুহূর্তের অসাবধানতায় ঘটে যায় মারাত্মক দুর্ঘটনা ।

রোজার মাসে মানুষ কাজকর্মে ফাঁকি দেয়, হাসপাতাল ও অফিস আদালতেও চিকিৎসক এবং কর্মকর্তা কর্মচারীরা ঠিকমত আসেন না, আসলেও সারাদিন ঝিমোন, দায়সারা গোছে কাজ করেন এবং ভাবেন কখন বাড়ি ফিরতে পারবেন । চিকিৎসক স্বল্পতার কারণে হাসপাতালের রোগীর তত্ত্বাবধানে অনেক সমস্যা হয়, এমারজেন্সি বিভাগে চরম সমস্যার সৃষ্টি হয়, রোজার সময়ে চিকিৎসকের অভাবে এমারজেন্সি রোগী মারা যাওয়ার বেশ কিছু উদাহরণ রয়েছে ।

৪) রমজান মাস ব্লাড ডোনেশনের আকাল

পুরো একমাস ১২-১৫ ঘন্টা অনাহারে থাকার কারণে শরীরে দুর্বল হয়ে পড়ে, তাই মানুষ রক্ত দিতে এই এক মাস অনেকটাই নিরুৎসাহী থাকে, ব্লাড ডোনেশনের হার রোজার মাসে ৩৫% হ্রাস পায়, প্রতি ব্লাড ইউনিট তিনজন মানুষের জীবন বাচাতে পারে, সেক্ষেত্রে রোজার সময়টি সার্জারি, লিউকেমিয়া, হিমোফেলিয়া এবং জরুরী অবস্থার রোগীদের জন্য চরম ক্রাইসিস পিরিয়ড বা ক্রান্তিকাল ।

৫) রমজান মাস অনুৎপাদনশীলতা এবং ফাঁকিবাজির মাস

সূত্রঃ

রমজান মাসে আরবসহ অন্যান্য মুসলিম অধ্যুষিত দেশগুলোতে ব্যবসায়িক উৎপাদন ৭৮% হারে হ্রাস পায়, স্কুল কলেজে পড়াশোনা হয়না, ক্লাস পড়ে শুরু ও আগে ছুটি হয়ে যায় এবং সকল প্রকার সরকারী বেসরকারী কর্মকাণ্ড ক্ষতিগ্রস্ত হয় যার পেছনে উল্লেখযোগ্য কারণগুলো হলো –

সূত্রঃ

১) রোজার মাসে ওয়ার্কিং আওয়ার কমিয়ে আনা হয় ২) শারীরিক দুর্বলতা এবং অবসন্নতারর কারণে কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকার প্রবণতা ৩) রোজার মাস ভেবে অসুস্থতাজনিত ছুটি নেওয়ার প্রবণতা ৪) ইফতারী বানাতে হবে দেখে কর্মজীবী মহিলা ছুটি হওয়ার আগেই জলদি বাসায় ফেরার প্রবণতা ৫) ইফতারের সময় ট্র্যাফিক জ্যাম বেশি হবে দেখে আগেভাগেই বাড়ি ফেরার প্রবণতা ।

উপসংহারঃ

উল্লেখিত দিকগুলো ছাড়াও যুক্তির দিক থেকেও রোজা প্রথা একেবারেই অযৌক্তিক কেননা, যুগ যুগ ধরে রোজা রাখার পরও বাংলাদেশ, পাকিস্তান, ভারতসহ বিভিন্ন মুসলিম অধ্যুষিত জনগণের দেশে দারিদ্র দূরীভূত হয়নি, রোজা মানুষের মনে সংযমের সামান্যতম ধারণা ঢোকাতে যারপরনাই ব্যর্থ হয়েছে যা রোজার সময় চরম ভাজাপোড়া ও রিচ ফুড গ্রহণের মাধ্যমে প্রমাণিত হয় । গরীবেরাও যে মানুষ – সেটিও রোজা মুসলিম জনগোষ্ঠীর মনে প্রতিষ্ঠিত করতে পারেনি যার প্রমাণ সমাজের চরম স্তরবিন্যাস ও ধনী গরীবে নিদারুণ বৈষম্য । তাছাড়া, গরীবের কষ্ট বোঝার জন্য একটি ভালো মন ও ভালো নিয়্যতের প্রয়োজন, এভাবে নিজের শরীরকে কষ্ট দিয়ে গরীবের কষ্ট বোঝার অলীকতত্ত্ব নিতান্তই শিশুসুলভ চপলতা, এভাবে গরীবের কষ্ট বোঝা যায়না । গরীবের ভাল চাইলে তাকে অর্থ দিয়ে সাহায্য করা যায়, সমাজের অসঙ্গতিগুলো দূর করার ব্যবস্থা নিয়ে এবং অর্থনীতির সংস্কার সাধন করে তাদের অবস্থার উন্নতি করা যায়, কিন্তু রোজা করে সেটি একেবারেই সম্ভব নয়। অর্থাৎ তত্ত্বীয়ভাবে ইসলাম রোজার মাসে সংযমের কথা বললেও রোজা করার সিস্টেম একেবারেই অপরিকল্পিত এবং অবৈজ্ঞানিক এবং স্বাস্থ্যসম্মত নয়, তাই এরকম অবৈজ্ঞানিক মেথডে ফাস্টিংয়ের কারণে ফলিতভাবে রোজা একটি ব্যর্থ সিস্টেমে পরিণত হয় এবং তার শিকার হয় কোটি কোটি মুসলিম জনসংখ্যা ।


এবার একটু মন এবং মস্তিষ্ক উভয়টি দিয়েই চিন্তা করে দেখুন, এক বছর পর আবারো রোজা আসছে, এবারের রোজাটি পালন করবেন কি ?