পণ্য হুমায়ূন আহমেদ

ডা: আহমাদ যায়নুদদিন সানি
Published : 7 Nov 2012, 08:08 PM
Updated : 7 Nov 2012, 08:08 PM

কিছুদিন আগে মারা গেলেন এদেশের একজন প্রথিতযশা সাহিত্যিক (?), হুমায়ুন আহমেদ। সাহিত্য জগতের জন্য দারুণ ক্ষতির একটি মৃত্যু। আমি ইদানীং কিছু লেখালেখি করি… সাহিত্য জগতে প্রবেশের জন্য আপ্রাণ হাত পা ছোঁড়াছুঁড়ি করছি। তাই মনে প্রবল আশা নিয়ে পত্র পত্রিকার পাতায় চোখ বোলাতে লাগলাম, তাঁর সাহিত্য নিয়ে সমালোচনা মূলক কোন লেখা পাই কি না। উদ্দেশ্য নিজের লেখার উন্নতি সাধন।

প্রথম দিকে দুই ধরণের খবরে পত্রিকা সয়লাব ছিল। 'তাঁর মৃত্যুর কারণ' এবং 'তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রীর ভূমিকা' । কিছু লেখা ছিল দায়সারা গোছের—তাঁর মৃত্যুতে সাহিত্য জগতের কত ক্ষতি হল… ইত্যাদি নিয়ে। কিছু লেখা ছিল স্মৃতি চারণ ধাঁচের—তিনি ব্যক্তিজীবনে কেমন ছিলেন—বেশ কিছু উদাহরণ সহ প্রমাণ দাখিল করা।

তাঁর মৃত্যু নিয়ে কিছু ডাক্তার লিখলেন—চিকিৎসায় ভুলভ্রান্তি নিয়ে। কেউ বোঝানোর চেষ্টা করলেন, ১২ টি কেমো দেয়া ঠিক হয়নি, কেউ বললেন, কেমো দেয়ার পর পরই অপারেশান অনুচিত হয়েছে। লেখালেখি হল চিকিৎসকের ভুল না অবহেলা এই নিয়ে ও। চেয়ার থেকে পড়ে যাওয়ার পর পরই তাঁকে হাসপাতালে নেয়া উচিত ছিল। হাসপাতাল পরিবর্তন, অর্থের অপ্রতুলতা—হেন বিষয় নেই যে ব্যাপারে পাঠককে অবহিত করা হয় নি।

কেউ আবার তাঁর ব্যক্তি জীবন নিয়ে ও মাতামাতি শুরু করলেন। শেষ দিনগুলিতে তাঁর মেয়েরা তাঁকে দেখতে গিয়েছিলো কি না, প্রথম স্ত্রী তাঁর সঙ্গে ফোনে কথা বলেছিলেন কি না ইত্যাদি।
দ্বিতীয় স্ত্রী তাঁর দ্বায়িত্ব কর্তব্য পালনে কতটা নিপুনতা দেখিয়েছেন, কখন শপিং করেছেন, কখন পার্টি দিয়েছেন—সেখানে কি খাইয়েছেন। মেনু সিলেকশান ঠিক ছিল কি না, মাংস কতটা সিদ্ধ হয়েছিল—সেটা হুমায়ুন সাহেবকে খাওয়ানো ঠিক হয়েছিল কি না?

এরপরে শুরু হল আরেক নাটক। 'দাফন' নাটক। কার অধিকার বেশী—দাঁড়িপাল্লা দিয়ে মাপা শুরু হল। নুহাশ পল্লী। হিমঘর, ছাড় দেয়া, জেদ সব মিলিয়ে করুন এক পরিস্থিতি। অবশেষে সব শেষ হল। 'ডেথ রিপোর্ট' 'মায়ের কবর জিয়ারত' পুত্র কন্যাদের নুহাশ পল্লিতে যাওয়া—এসব খবর ও একসময় কমে এলো।

আমি অধীর আগ্রহে তখন ও অপেক্ষা করছি—কখন তাঁর সাহিত্য নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণধর্মী কোন লেখার দেখা পাব। সমকালীন কোন বিশিষ্ট সাহিত্যিকের সমালোচনা— তাঁর লেখা শুধুই আকর্ষণীয় না সেগুলো সাহিত্য হিসেবে ও উচু দরের। কিংবা নিন্দা। কিংবা তাঁর ক্ষমতা—পুরোটা ব্যবহার করে গেছেন নাকি আরও ভালো লেখার যোগ্যতা তাঁর ছিল।

আশায় আশায় দিন কাটছিল। এমন সময় সবচেয়ে মজার লেখাটি লিখলেন তসলিমা নাসরিন। দারুণ পুরুষ বিদ্বেষী এই লেখিকা—একজন পুরুষ লেখক কে ছেড়ে দিবেন না—জানতাম। তাঁর ব্যক্তিগত জীবনের কিঞ্চিত অবতারণা ও আশা করেছিলাম। দুটোই যথারীতি স্বর্ণাক্ষরে জ্বলজ্বল করছে। মজার যে কাজটা তিনি করলেন, এই সুযোগে তিনি নিজের কিছু প্রচারণা করে ফেললেন। পশ্চিম বঙ্গে তিনি যেহেতু একটি 'আনন্দ পুরস্কার' পেয়েছেন—তাই ওখানকার পাঠক অনেক অনেক শিক্ষিত—তাই তিনি সেখানে নন্দিত—হুমায়ুন আহমেদ এর চেয়ে তিনি ভালো সাহিত্যিক—এমনটা বোঝানোর সুযোগ হাতছাড়া করলেন না।

একজন স্বনামধন্য মানুষ মারা গেলে—তাঁকে নিয়ে আলাপ আলোচনায় কোন ব্যপারটি প্রাধান্য পাওয়া উচিত। তাঁর ব্যক্তি জীবন—না তাঁর কর্ম জীবন? ব্যক্তিজীবনে তিনি যা করেছেন—তা দিয়ে পাঠকের কি যায় আসে? আমরা কেন তাঁকে মনে রাখবো? আমাদের জন্য তিনি রেখে গেছেন—কিছু সাহিত্য, চলচ্চিত্র আর অল্প কিছু কবিতা ও গান। আমরা এগুলো নিয়ে বিশ্লেষণ কেন করছি না?

তাঁকে নিয়ে যেসব লেখালেখি হয়েছে—সবই অপ্রয়োজনীয় এমনটা আমি বলছি না। তাঁর ব্যক্তি জীবন নিয়ে আকর্ষণ বোধ করে এমন পাঠক অনেক। চিকিৎসা বিভ্রাট ও আমাদের অতি প্রিয় একটি বিষয়। সাহিত্য নিয়ে গুরুগম্ভীর আলোচনা কেউ পরবে কি না—এ নিয়ে বোধহয় পত্র পত্রিকা সন্দেহে আছে। পত্রিকা ও প্রথমে চিন্তা করে কি লিখলে পাঠক পরবে। যে কোন লেখার ই প্রথম বিবেচ্য হয়—পাঠক কি চায়—পত্রিকার কাটতি বাড়াতে হবে।

আমি ক্ষুদ্র একজন মানুষ। জ্ঞান এমন কিছু বেশী না। গত কিছুদিনের পত্রপত্রিকা পাঠ করে মনে হয়েছে—'হুমায়ুন আহমেদ' নামের একজন সাহিত্যিকের মৃত্যু হয় নি—বরং মৃত হুমায়ুন আহমেদ দারুণ চটকদার একটি 'পণ্য'। তাঁকে নিয়ে যাই লেখা হোক—পাবলিক পরবেই। সুযোগটা আমি ও নিলাম।