মবিল কোর্টঃ আইন বনাম হয়রানি

Published : 24 Nov 2012, 03:42 AM
Updated : 24 Nov 2012, 03:42 AM

২২ নভেম্বর বিকাল ৪ টা। কারওরান বাজারের (কাচা বাজার) সামনের রাস্তায় হঠাত একটু চঞ্চলতা, একটু দৌড়ঝাঁপ। ব্যাপারটা কি বুঝতেই গাড়ি থেকে নেমে চারিদিকে চোখ বুলিয়ে নিলাম। প্রথমে ভেবেছিলাম জামায়াত-শিবিরের চোরাগোপ্তা হামলা বা নৈরাজ্য শুরু হবার কোন ইঙ্গিত কি না? একটু ধাতস্থ হতেই দেখলাম রাস্তার পশ্চিম পাশে বেশ কিছু অস্থায়ী ফল, বিস্কুট, আর মুড়ির দোকান লন্ড ভন্ড। কি হচ্ছে দেখার জন্য সাহস করে এগিয়ে গিয়ে যা দেখলাম তাতে বেশ অবাক হলাম। একটি মটরলা ওয়াকিটকি হাতে কেতাদুরস্ত একজন সাহেব, সাথে মাত্র একজন মোসাহেব কর্মচারী – এই দুজন মিলে রাস্তার পাশে ফুটপাতে এবং গলিতে বসা অস্থায়ী বিক্রেতাদের উচ্ছেদের মহান কর্মে নিজেদের নিয়োজিত করেছেন। তাদের দুজনের কারো সাথেই দৃশ্যমান কোন পরিচয়পত্র নেই। সাইনবোর্ড বলতে হাতে ধরা সেই ওয়াকিটকি সেট। একের পর এক দোকান মাটিতে মিশিয়ে দিচ্ছেন আর বীরদর্পে এগিয়ে যাচ্ছেন। দেখাদেখি অন্য সব দোকানদার যারা তখনো হামলার শিকার হননি, তারা ত্রস্ত হাতে দোকান গুটিয়ে নিচ্ছেলেন। আর তাতেই এই আপাত শান্ত এলাকাটি হঠাত ব্যস্ত চঞ্চল হয়ে উঠল। আমি এক বিক্রেতাকে জিজ্ঞেস করলাম কি হচ্ছে এখানে? উত্তর – "মবিল কোর্ট"। আসলে আম জনতার কাছে মোবাইল কোর্ট " মবিল কোর্ট" নামেই পরিচিত। যাইহোক, রাস্তার পশ্চিমে ব্যাপক ধ্বংসষজ্ঞ চালিয়ে খানিক পর সাহেব এলেন রাস্তার পুর্ব পাশে এবং মুরগীর দোকানে হামলা চালালেন। দোকানীর অপরাধ, তিনি জবাই করা মুরগী রাস্তায় বসে ড্রেসিং করছিলেন। সাহেবের হুকুমে দোকানদারের ওজনের মেশিনটি কেড়ে নিতেই দোকানদার করজোড়ে ক্ষমা চাইলেন, কিন্তু সাহেবের মন গললো না। তখন মোসাহেবটি চোখের ইশারায় বুঝিয়ে দিল সাহেব চলে গেলেই মেশিনটি ফেরত দেয়া হবে। এর পর আরেক দোকান। তবে সাহেবটি নিজ হাতে কিছু করছিলেন না। তিনি শুধু মুখে হুকুম দিচ্ছিলেন, মোসাহেবটি হুকুম তামিল করছিলেন। তাও আবার ১০০% তামিল করছিলেন না। এখানে এসেই বুঝলাম – মোসাহেবটি দোকানদারদের পুর্ব পরিচিত এবং সম্ভবত বখরা আদায়কারী। একটা পেয়ারার ঝুড়ি উলটে ফেলার পর বিক্রেতার অভিশাপ শুরু হয়ে গেল। সে এক বিরল দৃশ্য। "আল্লাহ, যে গরীব মানুষের পেটে লাত্থি দিল, তুমি তারে লাত্থি দিও" – এবং এই জাতীয় ভাষা প্রয়োগে গলমন্দ চলল কিছুক্ষন। সাহেব নির্বিকার। চারিদিকে দর্শকও বেশ আনন্দ পেল বৈকি।

আমি ফিরে গেলাম নিজ কাজে। কাজ শেষে ঘন্টা খানেক পর উচ্ছেদ এর পরবর্তী অবস্থা বা এফেক্ট দেখার জন্য কোন কাজ না থাকা সত্বেও ফিরে গেলাম কারওরান বাজারে। দেখি কোথায় কি? সেই আগের মতই সব চলছে। উলটে দেয়া টং ঘর, কিংবা ফেলে দেয়া ফলের ঝুরি আবার নিজ জায়গায়। ব্যবসাও চলছে ভাল। স্বাভাবিক ব্যস্ততা। গাড়ীর ভিড় লেগে আছে । সন্ধ্যা হবে হবে। আমি একনজর দেখেই বুঝলাম – "মবিল কোর্টের" নামে গরীব মানুষগুলোর পেটে লাথি মারা ছাড়া আর কোন কাজ হয়নি।

সারা ঢাকা শহর ছেয়ে গেছে অবৈধ দোকান পাটে। প্রতিদিন ঢাকায় অসংখ্য লোক আসছে সোনার হরিণ ধরার আশায়। নবাগতদের একটা অংশ এখানে সেখানে কিছু বিক্রি করে তার সংসারের ঘানি টেনে চলছে। এটা করতে না দিলে তারা হয় রিক্সা চালাবে, নয়তো দিনমজুরী। কিছুই না মিললে – রাহাজানি বা ছিনতাই।

অস্থায়ী দোকান পাট তো হঠাত গজিয়ে উঠে না। এক্টি-দুটি করে, একজনের দেখাদেখি আরেকজন এভাবেই হাট-বাজার গড়ে উঠে। শুরুতেই বাধা না দিয়ে যখন তখন এভাবে গরীবের পেটে লাথি মারা নৈতিকতার মানদন্ডেও বেশি নম্বর পাবে না। লক্ষ্য করেছি, অবৈধ দোকান পাট উচ্ছেদের ঐ পর্ব চলাকালিন রাস্তায় অসংখ্য গাড়ী অবৈধভাবে পার্কিং করা ছিল। ডিসিসি'র ঐ সাহেব কিন্তু একটিবারও ঐসব গাড়ীর দিকে তাকিয়ে দেখেন নি। তাকিয়ে দেখার সাহসও তার আছে কিনা সন্দেহ। কারন গাড়ী চালকদের রয়েছে বিশাল সংগঠন। অবৈধভাবে পার্ক করা ট্রাক চালকদের কিছু বললে তারা একজোট হয়ে ঐ সাহেবের বারোটা বাজিয়ে দিতে পারে। কিন্তু রাস্তার পাশে ফুটপাতে একটি ঝুড়িতে সামান্য ফলমুল বা মুড়ি-বিস্কুট নিয়ে বসা গরীব মানুষ গুলো খুবই অসহায়। বিশাল কারওয়ান বাজারের বাইরের অংশে যত দোকান পাট আছে তার একটিও বৈধ নয়। অবৈধ এবং ভাসমান এসব দোকান, টং ঘরের সংখ্যা কয়েক হাজার। তাই সার্বিক এবং সমন্বিতভাবে এসব উচ্ছেদ না করে বাজারের একটি অংশে লোক দেখানো মবিল কোর্ট বসিয়ে কার কি লাভ হল আমি বুঝতে পারিনি।