চক্ষু বিহীন এক চক্ষু বিশেষজ্ঞের কথা

Published : 21 April 2014, 09:15 AM
Updated : 21 April 2014, 09:15 AM

আজ একজন ডাক্তারের গল্প শোনাবো আপনাদের। তিনি একজন নামকরা চক্ষু বিশেষজ্ঞ। তিনি মানুষের চোখের চিকিৎসা করেন, অন্যের চোখে আলো দেন। অথচ তিনি নিজেই খানিকটা অন্ধ।
চমকে গেলেন তো?
তিনি শুক্রবার ছাড়া সপ্তাহের বাকী ছয়দিন গুনে গুনে ১৮০ জন রোগী দেখেন। গড়ে প্রতিদিন ৩০ জন। নতুন রোগী হোক কিংবা পুরনো, এর বেশী তিনি দেখেন না। প্রতিটি নতুন রোগীর কাছ থেকে নেন ১০০০ টাকা (ধারনা করছি, কারন দুই বছর আগে ৮০০ নিতেন)। চার সপ্তাহের মধ্যে আবার দেখালে পুরনো রোগী হিসেবে বিবেচিত হবেন এবং এক্ষেত্রে তাকে দিতে হবে ৮০০ টাকা (এটাও ধারনা কারন আগে নিতেন ৬০০) । অর্থাৎ এই চেম্বার থেকে গড়ে তার মাসিক আয় প্রায় ৭ লক্ষ টাকা। বৎসরে ১ কোটি টাকার কাছাকাছি !!!!!! চেম্বারের বাইরে অপারেশন, বিভিন্ন পরীক্ষা নিরীক্ষার কমিশন অবশ্যই আছে, সেটা বাদ দিলাম। রিপোর্ট দেখাতে হলে টাকা দিতে হয় না। তা না হলে আয় আরেকটু বেশিই হত।

তার রোগী দেখার নিয়মও ভালই। আপনি নির্দিষ্ট দিনে চেম্বারে হাজির হবেন, সিরিয়াল কনফার্ম করবেন, ডাক এলে ভেতরে যাবেন। প্রথমে একজন সহকারী ডাক্তার রোগীর কেস হিষ্ট্রি লিখবেন। তারপর অপেক্ষা। আবারো সময় এলে ডাকা হবে, এবার তিনি অর্থাৎ প্রায় অন্ধ এই ডাক্তার দেখবেন। বেশ সময় নিয়েই দেখবেন। ভাল ঔষধ পত্র লিখে দিবেন, চশমা লাগলে সেটার পাওয়ার লিখে দেবেন। যেখান থেকেই চশমা বানান না কেন, তার চেম্বার সংলগ্ন একটি দোকানে এসে আবার পরীক্ষা করে নেবেন যে পাওয়ার ঠিক আছে কি না।

বছরের পর বছর ধরে এভাবেই তিনি হাজার হাজার রোগী দেখছেন। কিভাবে তিনি অন্ধ? রাজধানী ঢাকায় বসে, এই ডিজিটাল যুগে একজন অন্ধ ডাক্তার কিভাবে এত পসার জমিয়েছেন?

এই প্রশ্নের উত্তর জানতে কিছুদিন পূর্বে কোন এক শুক্রবারে এই ডাক্তারের চেম্বারে গিয়েছিলাম। আমার মেয়েটির চোখে সমস্যা। মেয়েটিকে এর আগেও এই ডাক্তারই দেখেছেন। তবে আমি অফিসের কাজে ঢাকা- ঢাকার বাইরে এত বেশী দৌড়াদৌড়ি করি যে, বাচ্চাদের অসুখ বিসুখে আমার প্রিয়তমা স্ত্রীই নিজে এসে ডাক্তারের কাছে নাম লেখান, ডাক্তার দেখিয়ে নিয়ে যান। আমি বোধকরি একবারমাত্র ডাক্তার দেখানোর সময়টাতে সাথে থেকেছি। অধিকাংশ সময় আমার স্ত্রী নিজেই মেয়েকে নিয়ে এসেছেন। এরকম হাজারো কাজ তিনি হাসিমুখে করে দেন। নাম লেখানোর জন্য গিন্নীকে নিয়ে সকাল ঠিক আটটায় যখন ধানমন্ডির Harun Eye Foundation এ পৌছেছি, তখন বেশ দেরী হয়ে গেছে। একটা হাসপাতালের নীচতলায় অবস্থিত চেম্বারের বারান্দায় বা ব্যালকনিতে যে পরিমান মানুষ জায়গা নিতে পারে তার তুলনামুলক বিচারে লোকে লোকারন্য বলা যায়। নীচ তলা থেকে শুরু করে ৭ তলার সিড়ি পর্যন্ত মানুষ লাইন ধরে আছে । এত বড় ডাক্তার বলে কথা! এই একদিন, শুক্রবার তার এসিস্টেন্টরা সিরিয়াল দেবেন (অথবা নেবেন)। তারপর সারা সপ্তাহ ধরে আর সিরিয়াল দেয়া হবে না। একবার মিস হলে আবার আগামী সপ্তাহে আসতে হবে। ধরুন আপনি খুব সকালেই গেলেন, কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে আপনি ১৮১ তম ব্যাক্তি। ব্যাস হয়ে গেল। আসুন আবার আগামী সপ্তাহে। আবার নিজের ভাগ্য পরীক্ষা করুন।

সপ্তাহে যারা আমার মত একদিন ছুটি পান, তারা বাজার সদাই রেখে কিংবা দূর দুরান্ত থেকে ছুটে আসুন এই অন্ধ ডাক্তারের চেম্বারে। ডাক্তার বাবুও কিন্তু একদিনই অর্থাৎ শুক্রবার ছুটি নেন। এই দিন তিনি তার পরিবারকে নিয়ে কিছু Quality সময় কাটাচ্ছেন। আর আপনি বেকুবের মত নিজের প্রিয়জনের চোখে আলো ফোটাবেন অথবা চোখের আলো বাচিয়ে রাখবেন বলে ছুটে আসছেন এই অন্ধের চেম্বারে।

আলাপ হল সিরিয়ালে প্রথম ব্যাক্তিটির সাথে। ভোর পাঁচটায় নারায়নগঞ্জ থেকে এসেছেন। সকাল নয়টায় সিরিয়াল দেয়া শুরু হবে। তখন তিনি জানতে পারবেন কবে ঐ অন্ধ ডাক্তার তার মায়ের জন্য একটু সময় দিতে পারবেন। লাইনের শুরু হয়েছে সিড়ির কাছ থেকে। তাকিয়ে দেখছি কতদুর যেতে পারে এই লাইন। একজনকে জিজ্ঞেস করতেই ৬-৭ তলার দিকে যেতে পরামর্শ দিলেন। আমি লিফট দিয়ে প্রথমে ছয় তলায় গেলাম, এর পর সিড়ি বেয়ে সাত তলায় গেলাম সাপের (পড়ুন সিরিয়ালের) লেজটিকে খুজে বের করে নিজের জায়গা দখল করতে। যা ভেবেছিলাম তার চেয়েও অবাক হলাম। সাত তলা শেষ হয়ে অষ্টম তলায় অর্থাৎ ছাদেও প্রায় ৩০-৪০ জন। আমি যেখানে জায়গা নিলাম তার সিরিয়াল কত, কে জানে? ১৮০ ? নাকি ১৮১?

ঢাকার অনেক নামী দামী ডাক্তার টেলিফোনে সিরিয়াল দেন। কিন্তু এখানে সিরিয়াল নিতে হলে আপনাকে স্বশরীরে আসতে হবে। আসার পর, অপেক্ষা আর লাইন ধরে ধরে সকাল নয়টা কিংবা হয়তো তার কিছুটা সময় পরে আপনি যখন তার এসিস্টেন্ট এর ডেস্ক এর সামনে হাজির হবেন বহুল কাংখিত সেই সিরিয়ালের জন্য, তার আগ মুহুর্ত পর্যন্ত আপনি জানতেও পারবেন না, আপনার জন্য ঐ অন্ধের দরজা বন্ধ হয়ে গেছে কিনা। হতে পারে আপনিই ১৮১ তম ব্যাক্তি, অর্থাৎ প্রথম অভাগা।

এখানেই শেষ নয়। যেদিন আপনার ডাক পড়বে, সেদিন তার এসিস্টেন্টদের অসভ্য ব্যবহার আপনাকে সহ্য করতে হতে পারে। গিন্নি জানালেন, সেই অভিজ্ঞতা তার ইতোমধ্যেই হয়েছে। ঐ অন্ধের কাছে অভিযোগ করেছিলেন যার উত্তর পেয়েছিলেন "এত সমস্যা বোধ করলে আসেন কেন?" অর্থাৎ এর কাছে রোগী দেখাতে আসার আগে আপনার মান-সন্মান বা Self Respect টুকু বাসায় রেখে আসবেন।

এই সাইবার যুগে এরকম মধ্যযুগীয় কায়দায় সিরিয়াল লেখার জন্য আমাদের যে তোড়জোড়, তাতে আর ঐ অন্ধকে দোষ দেব কেন? আমরা ও তো অন্ধ। কি এমন ডাক্তারী বিদ্যা তিনি আয়ত্ব করেছেন যে সকাল পাঁচটায় গিয়ে লাইন ধরে নাম লিখিয়ে তার কাছেই রোগী দেখাতে হবে?

একটা সামান্য ওয়েব সাইট খুলে দিলেই যে যার মত করে লগ ইন করে নামটা লেখাতে পারেন। একটা SMS এর মাধ্যমেও অটোমেটিক নাম লেখানো, সিরিয়াল পাওয়া সম্ভব। অথবা যে যখন আসছেন নামটা লিখে সিরিয়াল নিয়ে চলে গেলেই হয়। ইচ্ছে থাকলে এর চেয়েও ভাল কোন ব্যবস্থা করে মানুষের হয়রানি কমানো সম্ভব। কিন্তু এই ডাক্তারের সেটা দেখার চোখ নেই। মানুষের অবর্ননীয় কষ্ট তিনি দেখতে পান না। দেখতে পাওয়ার কোন ইচ্ছাই তার মধ্যে নেই, তাইতো শুক্রবারে আমরা সিরিয়াল নিচ্ছি আর তিনি বিশ্রানে আছেন। অন্যের Quality সময় কেড়ে নিয়ে নিজের Quality সময় নিশ্চিত করে নিচ্ছেন। আর তাই তিনি আমার কাছে এক অন্ধ ডাক্তার ছাড়া আর কিছু নন।

না আমার দৃষ্টি খুলেছে। আমি চলে এসেছি। মেয়েকে অন্য কাছে দেখিয়েছি। মেয়ের চোখ আল্লাহ ভাল রেখেছেন। স্ত্রীর হাত ধরে ক্ষমা চেয়েছি। এর আগে যতবারই তিনি সিরিয়াল লেখাতে এসেছেন, এভাবেই নাম লিখিয়ে চলে গেছেন, পরে এসে মেয়েকে দেখিয়েছেন, কোনদিনও কোন অভিযোগ করেন নি। কোনদিন আমাকে জানতেও দেননি কিভাবে এই অন্ধ ডাক্তারের দ্বারা তিনি এবং এই ঢাকা সহ বাংলাদেশের আনাচে কানাচে থেকে আসা হাজার হাজার, লক্ষ লক্ষ মানুষ "বিভীষিকাময়" অদ্ভুত এক নিয়মের স্বীকার হয়েছেন। আমি এটাকে নির্যাতন বললেও বোধহয় কম বলা হবে।

ডিজিটাল বাংলাদেশ -ডিজিটাল বাংলাদেশ বলে এই যে এত আওয়াজ তুলছি আমরা, কোথায় সেই ডিজিটালাইজেশন? আমি এক নবীন ডাক্তারের সাথে কথা বললাম। ডিজিটাল যুগে ডিজিটাল পদ্ধতিতে সিরিয়াল দিতে বা নিতে অসুবিধা কোথায়? উত্তর বেশ মজার। "এনালগ" পদ্ধতিতে সিরিয়াল দিলে ডাক্তার সাহেবদের দৈনিক, মাসিক এবং বাৎসরিক উপার্জনের হিসাবটি সহজেই সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগের চোখের আড়ালে রাখা যায়। ফলে বিশাল আয়করের উৎপাত থেকে বাচা যায়। বাচানো যায় আয়কর বিভাগের সংশ্লিষ্ট কর্মচারী-কর্মকর্তাদেরকে!! ডিজিটাল পদ্ধতি হলে আমাদের সুবিধা, কিন্তু ডাক্তার- এবং আয়কর বিভাগের কর্মকর্তা/কর্মচারীদের জন্য অসুবিধা। তাই এনালগ পদ্ধতি বহাল আছে এবং থাকবে।

এই লেখাটি অনেক আগে বিডি ব্লগের জন্য লিখেছিলাম। বেশ কিছুদিন পেন্ডিং পোষ্টে পড়ে থাকায় রাগে প্রত্যাহার করেছিলাম। তখনও ভেবেছি, আজও ভাবছি ঐ অন্ধ ডাক্তারের নামটা প্রকাশ করবো কি করবো না? গতবার পোষ্ট করার সময় নামটা উল্লেখ করেছিলাম। আজ নামটা মুছে দিলাম। তবে এরকম অন্ধদের চোখের পর্দা খুলতে হলে তাদের কান্ডজ্ঞানহীন নিয়মের কারনে মানুষ কি অবর্ননীয় ভোগান্তি সহ্য করছে সেটা বুঝি এদেরকে চোখে হাত দিয়ে না দেখিয়ে দিলেই নয়।

এরপরও কি এইসব চক্ষু বিহীন "চক্ষু বিশেষ অজ্ঞের" চোখ খুলবে? নাকি এদের মনের চোখটাও অন্ধ হয়ে গেছে?