জ্বিনের বাদশাহর টেলিফোন নম্বর ০১৭৭৪৫০০৪৮৭

Published : 30 Oct 2014, 06:21 AM
Updated : 30 Oct 2014, 06:21 AM

৩০ অক্টোবর, রাত ৩টা। মোবাইল ফোন বেজে উঠল। ঘুমাতে গেলে বেড সাইড টেবিলে তিনটা মোবাইল ফোন পাশাপাশি রাখা থাকে। একটা আমার অফিসের, একটা আমার ব্যাক্তিগত আর একটা আমার স্ত্রীর।রিং টোন শুনেই বুঝলাম বাজছে আমার স্ত্রীরটা। তার ঘুম না ভাংগিয়ে আমিই ফোনটি তুলে নিলাম। হ্যালো বলতেই লম্বা এক সালাম-

– আসসালামু আলাইকুম ওয়া …

পুরুষ কণ্ঠে মহিলাদের মত চিকন স্বরে সালামের প্রথম অংশ শুনতেই আমি বুঝে গেলাম অপর প্রান্তে কে আছে বা থাকতে পারে। যাই হোক ফোনের আওয়াজে আমার স্ত্রীও জেগে গেছেন ইতোমধ্যে। আমি ঠোটে আংগুল দিয়ে ইশারায় তাকে চুপ করে থাকতে বললাম। অপর প্রান্তের উনি তখন সালামের বাকী অংশ শেষ করছেন –

– রহমতুল্লাহে ওয়াবারাকাতুহু।

আমি প্রতি উত্তর দিলাম – ওয়ালাইকুম আসসালাম। অতি সতর্কতার সাথে।

– কে? আমার প্রশ্ন শুনে অপর প্রান্তের উনি মনে হয় উৎসাহ পেলেন। আমিও এর পরের নাটকীয়তার জন্য শারিরীক এবং মানসিক ভাবে প্রস্তুত হলাম।

– বাবা আমি পরিচয় না দিলে তুই আমার পরিচয় পাবি না। আল্লাহ তোর উপর রহমত করেছেন। তুই খুব ভাগ্যবান রে বাবা। —– বাবারে আল্লাহ কখন কার কাছে রহমতের দরজা খুলে দেন কেউ জানে না, জানে শুধু ভাগ্যবান নিজে আর যিনি ভাগ্যের দরজা খুলে দেন তিনি। বল আলহামদুলিল্লাহ। (এখন তার গলা চিকন থেকে চিকনতর হয়েছে, সাথে একটা ফ্যাসফেসে আওয়াজ।) ময়না তুই কি আমার সাথে আছিস রে বাবা?

– আমি ইচ্ছা করে খুব আগ্রহ আর দরাজ গলায় বললাম, হ্যাঁ বাবা আছি। আপনি কে?

– বাবারে আমি তো আগেই বলেছি আমি পরিচয় না দিলে তুই আমার পরিচয় পাবি না। বাবারে আমি তোকে কিছু সম্পদ দিতে চাই, নিবি তুই ? হাতের লক্ষী পায়ে ঠেলিস নারে বাবা। উপরে আল্লাহ আর জমিনে আমি আগুনের তৈরী জীব রে বাবা। (আমি তখন মুচকি হাসছি)। আল্লাহ যখন যাকে ইচ্ছা সম্পদ দান করেন, যার থেকে ইচ্ছা তার থেকে সম্পদ কেড়ে নেন –( এরপর আরবীতে কিছু একটা বললেন, যেন কোরআনের আয়াত)। ময়না আমার —– বল সুবহানাল্লাহ।

– আমার তখন হাসিতে পেট ফেটে যাবার উপায় হয়েছে। এত সাধারণ অভিনয় আমি কখনো শুনিনি, দেখিনি। তারপরও নিজেকে সংযত করে বললাম, সুবহানাল্লাহ।

– দেখিরে বাবা আমার, ময়না আমার, তুই সত্যিই কিছু সম্পদ চাস কিনা? আমার নাম্বারে একটা কল করে আয় না বাবা? (অপর প্রান্তের তিনি টোপ দিয়ে লাইনটা কেটে দিলেন)।

স্ত্রী সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকালেন। মাঝরাতে কখনোই আমার বা আমাদের ফোন আসে না। জিজ্ঞেস করলেন অপর প্রান্তে কে? আমি বললাম দুই মিনিট সময় দাও। একটু খেলি। স্ত্রী বিরক্ত হয়ে অপর দিকে পাশ ফেরালেন।

আমি ফোন দিলাম। টেলিফোন নম্বর ০১৭৭৪৫০০৪৮৭ ।

প্রথমে ব্যস্ত পেলাম। এরপর আবারও কল দিলাম। এবার রিং এর সাথে সাথে ফোন ধরে আবার ও নাকি সুরে সেই লম্বা সালাম, পরিচয় না দিলে পরিচয় না পাওয়ার পুরনো গল্প আর কিছু সম্পদের প্রলোভন । আমিও সুতা টান টান করে রাখলাম। অনেক দিনের শখ। পত্র পত্রিকায় পড়েছি, টিভিতে দেখেছি, অনেকের কাছে শুনেছি, মাঝ রাতে টেলিফোন আসে। নাকি সুরে কথা বলে। আমি শুধু আফসোস করেছি। এরকম একটা টেলিফোন আমার কাছে আসে না কেন?

– বাবা আপনি কে? আমার তো খুব ভয় ভয় লাগতেছে। আমি খুব অভাগা। যেদিকে তাকাই সাগর শুকিয়ে যায় রে বাবা। কোন বিপদ হবে না তো বাবা?

– ময়না আমার ভয় পাসনে। তুই খুব ভাগ্যবান। তোর লক্ষী, সতী স্বাধ্বী স্ত্রী, আমার মা কোথায় রে বাবা?

– বাবা, সে তো বাবার বাড়ী ( আমার ফিস ফিসানো শুনে স্ত্রী এবার উঠে পাশে বসেছেন)।

– বাবা, ভাল স্ত্রী পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার রে বাবা। তুই সেদিক দিয়েও ভাগ্যবান। কিন্তু বাবা, স্বয়ং আল্লাহ পাক আদেশ দিয়েছিলেন হজরত আদমরে, ওরে আদম তুই গন্ধম ফল খাস নি। কিন্তু বাবা, আমার মা হাওয়ার প্ররোচনায় পড়ে বাবা আদম গন্দম ফল খাওয়ার লোভ সামলাতে পারলেন না। বল নাউজুবিল্লাহ।

– নাউজুবিল্লাহ (আমার তাতক্ষনিক উত্তর)।

– বাবারে, আমি যা বলবো, তুই কাউকে বলবি না, আমার মা জননীকেও না। মনে রাখিস বাবা, আল্লাহ সময়ে সময়ে মানুষকে পরীক্ষা করেন। আজ সেরকম এক পরীক্ষার মুখোমুখী তুই। এই দুনিয়ার সব কিছুই তিনি উপর থেকে নিয়ন্ত্রন করেন। মানুষ যা চোখে দেখে সেটা আসলে সে দেখে না। (এরপর আরবীতে আরো কি যেন বললেন)। ময়না আমার, আমি পাগলা পীরের মুরিদ, তুইও আজ থেকে তার মুরিদ হয়ে গেলি, বল আলহামদুলিল্লাহ। বাবা আমার আল্লাহ, আর আমার পাগলা পীর বাবা আমার মাধ্যমে তোকে কিছু সম্পদ দান করবেন রে বাবা। বল সুবহানাল্লাহ। (আমি উচ্চারণ করলাম সুবহানাল্লাহ)। বাবা, এই সম্পদ সবাই পায় না, যারা পায় তারা সবাই ধরে রাখতে পারে না। কিন্তু আমি গায়েবী ক্ষমতায় দেখেছি বাবা তুই পারবি। কিন্তু বাবা, আল্লাহ যেমন মানুষ কে পরীক্ষা করেন, আমি ও তোকে একটু পরীক্ষা করবো। দেখি তুই জ্বিনে বিশ্বাস করিস কি না।
– আমি তখন প্রায় ধৈর্য হারা, অস্থির। বেকুবের মত প্রশ্ন করে ফেললাম, বাবা আপনি কে?

– অত অস্থির হোসনেরে আমার ময়না। আমি তোকে দেখা দেব। তুই হাজারো জনের মধ্যে একজন ভাগ্যবান। আমি তোকে দেখা দেব। তার আগে তোকে আমার বিশ্বাস অর্জন করতে হবে। আগামী শুক্রবার বাদ জুমা পাগলা পীরের মাজারে আসবি। খালি হাতে, একা আসবি। মাজারের উত্তর পূর্ব কোনায় একটা জামরুল গাছের নীচে দাঁড়াবি। চোখ বন্ধ করে দাঁড়াবি। আমি দেখা দেব। কিন্তু বাবা ভয় পাসনে। আমি তোর কোন ক্ষতি করবো না। আমি তোকে কিছু সম্পদ দেব। যদি সেই সম্পদ নিতে চাস, তাহলে পাগলা পীরের মাজারের গিলাফের নীচে পাঁচ হাজার পাঁচশত পঞ্চান্ন টাকা হাদিয়া হিসেবে রেখে দিবি। কলা পাতায় মুড়ে রাখবি। যদি খাস দিলে রাখতে পারস, তাহলে আমি তোকে কিছু সম্পদ দেব। তোকে আর জীবনে কোনদিন কারও কাছে হাত পাততে হবে নারে বাবা। বল সুবহানাল্লাহ।

– (আমি বললাম সুবহানাল্লাহ) কিন্তু বাবা আমি তো পাগলা পীরের মাজার কোথায় জানি না। কেমনে আসবো? আপনাকে চিনবো কিভাবে?

– ওরে সোনা যাদু আমার, আমি তোকে দেখা দেব। আমি দেখা না দিলে তুই আমাকে খুঁজে পাবি না। কাল সকালে আমার এই নম্বরে এক হাজার এক টাকা পাঠাবি। দেখি তুই আমাকে বিশ্বাস করিস কিনা।

– বাবা, আমার তো বিকাশ একাউন্ট নাই। টাকাটা হাতে হাতে নেন না …

ব্যস, কটাস করে লাইন কেটে দিলেন আমার জ্বিনের বাদশাহ। নামটা বলেন নি। তার উপস্থাপনা, বাচন ভংগি আমাকে একটুকুও আকর্ষন করে নি। বিশ্বাস তো দুরের কথা। একটা বাচ্চা ছেলেও বুঝবে যে অপর প্রান্তে কোন পুরুষ মহিলাদের কন্ঠ নকল করে নাকি সুরে কথা বলছে। কথায় আকর্ষন না থাকলেও আমার জ্বিনের বাদশাহ কিন্তু তিনি অতি সতর্ক। আমার অভিনয়ে কোথাও কিছু খুঁত ছিল তাই তিনি আর কোন রিস্ক নেন নি।

এভাবে মাঝরাতে পুরুষ কন্ঠে উচ্চারিত নারীর কথায় বিমোহিত কিংবা হিপনোটাইজড হয়ে সর্বস্ব খোয়াচ্ছেন আমাদের দেশের অগনিত মানুষ। গ্রাম গঞ্জের সহজ সাধারণ চাষা-মুটে-মজুরের কথা বাদ দিলাম, ঢাকা শহরে বসবাসকারী ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, প্রখ্যাত এনজিও নেত্রী এবং গৃহিনী সহ অনেকেই ধরা খেয়েছেন এসব জ্বীনের বাদশাহদের কাছে (ডাক্তার এক ভদ্র মহিলা সাড়ে বার লক্ষ টাকা, এনজিও নেতৃ আড়াই লক্ষ, এক গৃহিনী সাড়ে তিন লক্ষ টাকা খুইয়েছেন)। পত্র পত্রিকায় এত লেখালেখি হচ্ছে, কিন্তু থেমে নেই ওদের অপতৎপরতা ।

যাই হোক লাইন কেটে দেবার পর আমি সাথে সাথে আবার ফোন দিলাম। "The mobile can't be reached at the moment. Please try later. এই মুহুর্তে মোবাইল সংযোগ দেয়া সম্ভব হচ্ছে না, একটু পরে আবার ডায়াল করুন। আপনার মোবাইল থেকে ভয়েস এসএমএস পাঠাতে …"।

এখন সকাল ১১ টা। সেই সীম এখন ও বন্ধ। সারা রাত নানা অপকর্ম করে আমার জ্বীনের বাদশাহ হয়তো এখন ঘুমাচ্ছেন। কিংবা সীম খুলে নিয়ে একই মোবাইল সেটে অন্য আরেক কোন সীম দিয়ে আবারও হয়তো অন্য কোন মক্কেল ধরার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। হয়তো কাল রাতে অন্য কোন মক্কেল পেয়েছেন। এখন তাকে নিয়ে ব্যাস্ত আছেন।