নীল নদ। ইংরেজীতে " The Great River Nile". আফ্রিকা মহাদেশ তো বটেই, সারা পৃথিবীর অন্যতম দীর্ঘ নদী। অনেকে এটাও বলেন যে, নীল নদ পৃথিবীর একমাত্র নদী যেটা দক্ষিন থেকে উত্তরে বয়ে গেছে! সমগ্র পৃথিবীর কথা জানি না, কিন্তু এটা আফ্রিকার একমাত্র নদী যেটা দক্ষিন থেকে উত্তরে বয়ে গেছে। ছেলেবেলার ভুগোল- ইতিহাস জুড়ে কত জায়গায় যে নীল নদ আর নীল নদের দুপারে গড়ে ওঠা সভ্যতা নিয়ে লেখা পড়েছি, তার হিসেব মনে নেই। অনেক আগে থেকেই জানতাম উগান্ডার লেক ভিক্টোরিয়া হচ্ছে নীল নদের উৎস স্থল। তবে সেই উৎস স্থলটি দেখার জন্য যাবো যাবো করেও সময় বের করতে পারছিলাম না। তবে সময়ের যতটা না অভাব, তারচে' বেশী আলসেমী। হাতের কাছেই তো, যাব ক্ষন একদিন। এরকম একটা ব্যাপারও মনের মধ্যে কাজ করছিল । প্রায় দু' বছর হতে চলল উগান্ডায়। শেষমেশ মনের আর শরীরের সব আলসেমী ঝেটিয়ে বিদায় করে এক রবিবার (২২ নভেম্বর ২০১৫) বের হয়ে গেলাম নীল নদের উৎস দেখার জন্য।
আমি থাকি রাজধানী কাম্পালা থেকে ৪০ কিলোমিটার দক্ষিনে এনটেবে শহরে। লেক ভিক্টোরিয়ার প্রায় মাঝামাঝিতে পশ্চিম পাড়ে অবস্থিত এনটেবে। আর নীল নদের উৎসস্থলটি লেক ভিক্টোরিয়ার একেবারে উত্তরে জিনজা শহরের এক প্রান্তে। এনটেবে থেকে মোট দুরত্ব প্রায় ১২০ কিলোমিটার। তবে কাম্পালার ভেতর দিয়ে যেতে হয় বলে ট্রাফিক জ্যামের কারণে ৩ থেকে ৪ ঘন্টা সময় লাগে। আমি খুব সকালেই বেরিয়ে পড়লাম। সাথে আমার অফিসের এক কলিগ (উগান্ডার নাগরিক) যিনি লাঞ্চের বিনিময়ে গাইড হিসেবেও কাজ করতে রাজী হয়েছেন।
যেতে যেতে আগে নীল নদ সম্মন্ধে দু'য়েকটি কথা বলার লোভ সামলাতে পারছিনা। নীল নদের উৎস হিসেবে জিনজা শহরের পাশে লেক ভিক্টোরিয়ার এই অংশটুকু বলে দাবি করা হলেও এই নিয়ে কিছুটা বিতর্ক আছে। পাশের দেশ রুয়ান্ডা, তানজানিয়া এবং বুরুন্ডির সবাই মনে করে নীল নদ তাদের ওখান থেকে শুরু হয়েছে। একথা আংশিক সত্য। লেক ভিক্টোরিয়া আসলে Great African Rift Valley' অংশ। আশেপাশের দেশ তানজানিয়া, রুয়ান্ডা, বুরুন্ডি, কেনিয়া এবং ডিআর কংগো থেকে অসংখ্য নদী এসে লেক ভিক্টোরিয়ায় ক্রমাগত পানি ভরাট করে চলেছে। আর এই বিপুল পানি নির্গমনের একমাত্র পথ নীল নদ।
আফ্রিকা মহাদেশের বাইরের মানুষের মধ্যে মিঃ স্পেক ১৮৫৮ সর্বপ্রথম লেক ভিক্টোরিয়া খুঁজে বের করেন। ১৮৬২ সালে তিনি পুনরায় লেক ভিক্টোরিয়ায় ফিরে এসে এটাকে নীল নদের উৎস হিসেবে ঘোষনা করেন। তবে লেক ভিক্টোরিয়াকে নীল নদের উৎস হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য যার নাম আলোচিত হয় তিনি মিঃ ষ্ট্যানলি। মিঃ ষ্ট্যানলি ১৮৭২ সালে লেক ভিক্টোরিয়ার চারিদিকে প্রদক্ষিন করেন এবং লেক ভিক্টোরিয়াই যে নীল নদের উৎস সেই তথ্য সুনিশ্চিত করেন। ৬৮০০ কিলোমিটারের বেশী লম্বা এই নদ জিনজা শহরের পাশে লেক ভিক্টোরিয়ায় শুরু হয়ে আফ্রিকার উগান্ডা, দক্ষিন সুদান, সুদান এবং মিশর হয়ে ভুমধ্যসাগরে গিয়ে পড়েছে।
এখানে বলে রাখা ভাল যে, নীল নদের মূল স্রোতধারা (Tributories) দু'টি। লেক ভিক্টোরিয়া হতে উৎসারিত ধারাটির নাম সাদা নীল নদ ( White Nile)। অপর স্রোতধারাটি এসেছে ইথিওপিয়ার লেক তানা (Lake Tana) হতে যার নাম Blue Nile । আবার সাদা নীল নদ বলে যেটা পরিচিত সেটারও কয়েকটি অংশ রয়েছে। ভিক্টোরিয়া লেক থেকে উৎসারিত অংশটি'র প্রাথমিক নাম ভিক্টোরিয়া নাইল (Victoria Nile)। এই ভিক্টোরিয়া নাইল উগান্ডা এবং ডিআর কঙ্গোর সীমান্তে অবস্থিত এলবার্ট লেক (Lake Albert) এর উত্তর প্রান্তে গিয়ে মিশেছে। এলবার্ট লেক এর উত্তরে নীল নদের এই অংশের নাম এলবার্ট নাইল। মূলতঃ এলবার্ট নাইল এবং ভিক্টোরিয়া নাইল একসাথে মিশে তৈরী হয়েছে White Nile বা সাদা নীল নীল নদ। সাদা নীল নদ এবং Blue Nile এর এই দু'টি ধারা বর্তমান সুদানের রাজধানী খার্তুমে একত্রিত হয়ে একক নীল নদ বা River Nile নাম ধারণ করেছে। এরপর নদটি আরও উত্তরে বয়ে গিয়ে সবশেষে মিশরের আলেকজান্দ্রিয়ার পাশে ভুমধ্য সাগরে মিশেছে। আমি খুবই সৌভাগ্যবান যে, খার্তুমে যেখানে দুই নীল নদ একত্র হয়েছে এবং আলেকজান্দ্রিয়ার রসেট্টা শহরের পাশে যেখানে নীল নদ সাগরে মিশেছে, সে দুটি স্থান আমি ইতোমধ্যেই দেখে ফেলেছি। শুনেছি কায়রোর কাছে বিখ্যাত আসওয়ান বাঁধের পর নীল নদ আবারও দুই ভাগে ভাগ হয়েছে যার এক ভাগ রসেট্টার উপর দিয়ে আর অন্য ভাগ দামিয়েত্তা দিয়ে সাগরে পড়েছে। আজ নীল নদের উৎসস্থল দেখলে আমার একটা বিরল অভিজ্ঞতা হবে। অবশ্য বলে রাখা ভাল যে, উৎস স্থলে না গেলেও বেশ অনেক বার ভিক্টোরিয়া নাইলের ওপর স্থাপিত সেতু অতিক্রম করে কঙ্গোর সীমান্তে যেতে হয়েছে। সেতুর ওপর থেকে নীল নদের যে ভয়ংকর চেহারা আমি দেখেছি সেটা ভাষায় বর্ননা করার মত নয়। লেক তানা'র অপর উৎসস্থল দেখার আগ্রহ মনের গহীনে জমা করে রাখা ছাড়া আপাতত উপায় নেই।
জিনজা শহরটি বেশী বড় নয়। শহরে ঢুকতে হলে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য স্থাপিত জিনজা বাঁধের উপর দিয়ে যেতে হবে। এখানে বাঁধের দুই পাশে সশস্ত্র কমান্ডো পাহারা। ছবি তোলা নিষেধ। আমি লুকিয়ে মোবাইলে ছবি তোলার চেষ্টা করতেই সংঙ্গী বন্ধুটি নিষেধ করে দিলেন। মূল বাঁধ পেরিয়ে হাতের ডানে গেলে জিনজা শহর। শহরে ঢুকে মূল সড়ক এড়িয়ে ডানে নিরিবিলি আবাসিক এলাকার ভেতর দিয়ে এঁকে বেঁকে কয়েক কিলোমিটার যাবার পর জিনজা গলফ ক্লাব। হতশ্রী গলফ কোর্সের পাশের রাস্তা দিয়ে যেতে যেতেই চেক পোষ্ট। টিকেট কাটতে হবে। আমি একটু অবাক হলাম। বিদেশী বলে আমার জন্য প্রায় পাঁচ ডলার, আমার সংগী'র জন্য এক ডলার এবং গাড়ী পার্কিং এর জন্য প্রায় ৩ ডলার দিয়ে টিকেট কেটে ঢুকতে হল। পার্কিং এ গাড়ি থেকে নামতেই অনেক লোক এসে ঘিরে ধরলো। ওরা স্থানীয় গাইড। লাইসেন্সপ্রাপ্ত । আমি ভাবলাম একটু দরদাম করি। সন্মানীটা কত দিতে হবে জিজ্ঞেস করলে স্মিত হেসে জানাল, আমি খুশী হয়ে যা দিব সেটাই। পার্কিং থেকে সামনে এগোতেই একটা ছোট্ট মনুমেন্ট। ২০০৭ সালে কমনওয়েলথ সম্মেলন উপলক্ষে এটি স্থাপিত হয়েছিল যেখানে অংশগ্রহনকারী সকল দেশের নাম লেখা আছে। বাংলাদেশের নাম খুঁজে পেতে একটুও কষ্ট করতে হলো না।
এর পর খাড়া সিঁড়ি বেয়ে নীচে নামার আগেই চোখে পড়লো নীল নদ। এখানে নীল নদের সেই ভয়ংকর রূপ নেই। শান্ত-স্নিগ্ধ তার চেহারা, তবে স্রোতের টান দূর থেকেই বোঝা যাচ্ছে। নীচে নেমে এসে সোজা একটি জেটি, সেখানে এত সাত সকালে কোন নৌকা নেই। ডানে আরেকটা ঘাটলা মত। সেখানে কয়েকটি লম্বা নৌকা, পেছনে স্পীড বোটের ইঞ্জিন লাগানো। ঘাটলার পাশেই মহাত্মা গান্ধী'র আবক্ষ মূর্তি। সাথে সুন্দর বর্ননা। মহাত্মা গান্ধীর দেহভস্ম পদ্মা-যমুনার মিলন স্থল, আরব সাগর সহ পৃথিবীর অনেক জায়গায় ছড়িয়ে দেয়া হয়েছিল। তার মধ্যে নীল নদের উৎস স্থল একটি।
সাত সকালে ঘাটে বসে কয়েকজন যুবক ছেলে চা-নাস্তা খেতে খেতে আড্ডা দিচ্ছে। আমাদের দু'জনকে দেখে তেমন আগ্রহ দেখালো না। আমরা খুব বেশী সকালে এসে পড়েছি কিনা? তারপরও একজন কোন মতে উঠে এসে জিজ্ঞেস করলো আমাদের বোট লাগবে কিনা। আধ ঘন্টার জন্য ২ লক্ষ শিলিং, এক ঘন্টা হলে তিন লক্ষ। (এক ডলার সমান ৩৫০০ শিলিং প্রায় )। আমি হিসেব কষে দেখলাম ডলারে কত হয়? আধ ঘন্টার জন্য ৬০ ডলার ! সঙ্গী বন্ধুও বেশ অবাক হলেন। তিনি স্থানীয় লুগাণ্ডা ভাষায় দরদাম করে শেষমেশ ১ লক্ষ শিলিং এ আধ ঘন্টার জন্য বোট ভাড়া করে ফেললেন।
এবার সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। বোটে চেপে বসতেই গাইড তার ধারাবর্ণনা শুরু করলো। নদীতে বেশ ভাল স্রোত। একটু দূরে ভাটিতে জিনজা রেল ব্রীজ দেখা যায় তবে জিনজা বাঁধ দেখা যাচ্ছিল না। নদীর উজান বেয়ে চলছিল বোট। ২০০ মিটার যেতে না যেতেই দেখলাম নদীর অপর পাড়ে একটা খাড়ি মত যায়গা যেখানে কোন স্রোত নেই। সেখানে অনেক জেলে বড়শি দিয়ে মাছ ধরছে। বেশ কয়েকটা গিরগিটি দেখলাম, জলকেলীতে মত্ত।
শত শত পান কৌড়ি, এখানে সেখানে, আরও আছে হরেক নাম না জানা পাখী। এবার বোট ঘুরিয়ে নিয়ে গেল ছোট্ট একটা মনুষ্য নির্মিত দ্বীপে, বার্ড আইল্যান্ড নামেই যেটা বেশী পরিচিত। হাজার হাজার পাখীর কল কাকলীতে মুখরিত। এখানকার পাখীগুলো মানুষ দেখে ভয় পায় না। আমার আর তর সইছিল না। আমি এসেছি নীল নদের উৎস মুখ দেখতে। কিন্তু নৌকার মাঝি আর ব্যাটা গাইড দেখাচ্ছে গিরগিটি, পাখী। ওদিকে সময় বয়ে যাচ্ছে। ভাবলাম কোন কারসাজি নাকি? একটু অনুযোগ করতেই নৌকার মুখ ঘুরিয়ে দিল। মাত্র ৫০ গজের মধ্যে এনে যা দেখাল সেটার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিলাম না। সামনে বিশাল লেক ভিক্টোরিয়ার একটি শাখা মুখ, সেখান থেকে হঠাৎ একটা ধারা শুরু হয়েছে, এটাই নাকি নীল নদের উৎস। আমি অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তাকাতেই যেন ওরা নড়ে চড়ে উঠল। ভাল করে দেখতে বলল, সামনের সাইনবোর্ড। পরিস্কার লেখা " Source of the River Nile" । সেই সাইনবোর্ডের দিকে এগিয়ে যেতেই গাইড আমাদের দৃষ্টি আকর্ষন করে দেখাল ঠিক লেক আর যেটাকে নদীর উৎস বলে দেখানো হচ্ছে সেই জায়গাটাতে নদীর মধ্যে নীচ থেকে বিপুল বেগে পানি উঠে আসছে। আরে তাইতো !!! বিশাল জলরাশি উঠে আসছে নীচ থেকে। গাইডের ভাষায় নীল নদের ৭০% ভাগ পানি আসে লেক ভিক্টোরিয়া থেকে আর বাকী ৩০% ভাগের উৎস এই মাটির (অথবা পানির) নীচ থেকে উঠে আসা পানি।
যেখানটায় সাইনবোর্ড সেখান থেকে তীব্র স্রোত বয়ে যাচ্ছে ভাটির দিকে। এবার আমাদের বোট এগিয়ে গেল লেকের একটু ভিতরে। বেশী না ২০-২৫ মিটার হবে। আশ্চর্য হয়ে দেখলাম সেখানে কোন স্রোত নেই। পানি একেবারে স্থির । বোটের ইঞ্জিন বন্ধ করে দিল। লেকে বাতাস নেই। বোট এক চুলও নড়লো না। আবার ইঞ্জিন চালু করে পূর্বের জায়গায় ফেরত আসতেই দেখা গেল সেই জায়গা ঠিক যেখান থেকে স্রোত শুরু হয়েছে। নীল নদের শুরু। নীল নদের জন্মস্থান।
আমি অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে রইলাম। এক মুহুর্তে মন ভাল হয়ে গেল। যথাশীঘ্র IMO অন করে দেশে পরিবার পরিজনের সাথে অভিজ্ঞতাটা ভাগাভাগি করে নিলাম। নদীর এখানটায় কিছু পাথর দিয়ে আরো একটা দ্বীপ তৈরী করা হয়েছে, যেখানে স্যুভেনির বিক্রি হয়। চাইলে পানিতে নামা যায়। নীচে অতি পিচ্ছিল পাথর, একবার হোচট খেলে অজ্ঞান হয়ে কোথায় ভেসে যাব কে জানে? তারপরও লোভ সামলাতে না পেরে গাইডের হাত ধরে পানিতে পাথরের উপর নেমে কয়েকটা ছবি তুলে রাখলাম। নাতি নাতনীরা দেখবে।
সময় বয়ে যাচ্ছিল। ৩০ মিনিট কোন সময়ই না। মাঝি বোট ঘুরিয়ে দিল। মিনিট তিনেকের মধ্যে আবার সেই ঘাট, গান্ধীজির মনুমেন্ট, জিনজা শহর। দুপুরে জিনজা শহরে অনেক লোক। পর্যটন এবং বানিজ্যিক শহর। সুন্দর, পরিপাটি করে সাজানো-গোছানো। এতটুকু ময়লা আবর্জনা নেই কোথাও। অনেক পর্যটক এসে গেছে। শহরে বেশ কিছু স্যুভেনির শপ আছে। লেকের পাড়েও আছে অনেক, তবে অনেক বেশী দাম সেখানে । শহরের ভেতর দাম কিছুটা সহনীয় পর্যায়ে। আমি আফ্রিকার বিখ্যাত ইবোনী কাঠের তৈরী একজোড়া পুতুল (কিংবা মূর্তি) আর সুন্দর এক সেট তীর ধনুক কিনলাম। দেশে আনতে পারবো কিনা কে জানে? মতিমহল নামের ইন্দো-উগান্ডান রেষ্টুরেন্টে লাঞ্চ করে ৩০ কিলোমিটার দূরে ইতান্দা ফলস (Itanda Falls) দেখতে গেলাম যেটা নিয়ে আরেকদিন লিখবো।