আফ্রিকার হাট বাজার

Published : 10 Dec 2015, 07:37 PM
Updated : 10 Dec 2015, 07:37 PM

সেই কবে ছোট বেলায় নানা বাড়ী বেড়াতে গিয়ে নানার হাত ধরে গ্রাম্য বাজার দেখেছিলাম। নানা বাড়ী থেকে প্রায় ২ কিলোমিটার পায়ে হেঁটে সেই বাজারে পৌঁছাতে হতো। বর্ষায় বাহন নৌকা। এরপর সপ্তম শ্রেনীতে পড়ার সময় দাদা বাড়ির পাশে গ্রামের হাটে গিয়েছিলাম। সাথে ছিলেন বড় চাচা। এরপর কখনো নিজে একা, কখনো চাচাত-মামাত ভাই কিংবা চাচা-মামাদের সাথে গ্রামের হাটে গিয়েছি। শহরে জন্ম নিয়ে শহরে বড় হওয়া আমার মত শহুরে বালকদের জন্য গ্রাম্য বাজার বিশেষ করে সাপ্তাহিক হাটের দিন বাজারে যাওয়া ছিল এক উৎসবের মত। আমার কাছে দাদা বাড়ী কিংবা নানা বাড়ী যাবার অন্যতম আকর্ষন ছিল সাপ্তাহিক হাট দেখা। এরপর অনেক দিন পেরিয়ে গেছে। কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় শেষ করে যৌবনে চাকুরীতে ঢুকেছি। চাকুরীর সুবাদে দেশের বিভিন্ন জায়গায় গিয়েছি। সব জায়গাতেই আমি কেন জানিনা স্থানীয় হাটে যাবার এক দুর্নিবার আকর্ষন বোধ করতাম। চাকুরী কিংবা ভ্রমনের জন্য যখন বিভিন্ন দেশে যেতাম কিংবা এখনও যাই, বড়বড় শপিংমল গুলোর চেয়ে শহরের শেষ প্রান্তে কিংবা শহর ছাড়িয়ে দূরে গ্রাম্য অঞ্চল গুলোতে গ্রাম্য বাজার ঘুরে দেখতে কেন জানিনা আমার খুব ভাল লাগে।
উগান্ডাতে যখনই সময় পাই, কাম্পালার পথে কিংবা কাম্পালার বাইরে রাস্তার পাশে বাজার দেখলেই নেমে পড়ি । প্রয়াত জাতীয় অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক নাকি বলতেন, যখন তুমি কোন একটা দেশে যাবে তখন সেখানকার তিনটি জিনিষ অবশ্যই দেখবে। তার প্রথমটি হল সেখানকার মানুষ কি খায়? এ কারনেই কিনা, আমি বাজারে ঢুকেই দেখি সেখানে কি কি জিনিষ বিক্রি হয়, কারা বিক্রি করে, দাম কেমন? ইচ্ছে বা প্রয়োজন হলে কিছু কিনি, না হলে ঘুরে ফিরে চলে আসি। এনটেবে থেকে কিছুদিন আগে গিয়েছিলাম মাসিংদি। কাম্পালার উত্তর পশ্চিমে আনুমানিক ৩০০ কিলোমিটার দুরে মার্চিসন রিজার্ভ ফরেষ্ট। রিজার্ভ ফরেষ্টে ঢুকার আগে সর্বশেষ শহর মাসিংদি। দুই রাত মাসিংদি কাটিয়ে এরপর গেলাম সাউথ সুদানের বর্ডারে। এখানে ডি আর কঙ্গো, উগান্ডা এবং সাউথ সুদানের একটা যৌথ সীমান্ত পয়েন্ট রয়েছে। ইচ্ছে ছিল সদ্য স্বাধীন দেশ সাউথ সুদানের রাজধানী জুবা পর্যন্ত যাবো, কিন্তু সহকর্মী রাজী হলেন না। তাছাড়া জুবা যেতে হলে সহজ এবং নিরাপদ রাস্তা আছে যেটা নিমুলে (Nimule) হয়ে গেছে। আমরা ছিলাম নিমুলে থেকে অনেক পশ্চিমে গুলুতে। যাইহোক দাপ্তরিক কাজ শেষ করে পরদিন গেলাম ডি আর কঙ্গোতে। কঙ্গো সীমান্ত অতিক্রম করে আনুমানিক ৫০০ গজ যেতেই একটা বড় হাট। এখানে প্রতি সোমবার হাট বসে। এই হাটে কঙ্গোর স্থানীয়রা ছাড়াও পার্শবর্তী উগান্ডা থেকে প্রচুর ক্রেতা-বিক্রেতা আসে। এটা একটা সীমান্ত হাট। দুই দেশের সম্মতি ক্রমে না হলেও বহু বছর ধরেই ঐতিহ্যগতভাবে এই হাট বসে যেখানে দুই দেশের মানুষই ক্রেতা-বিক্রেতা। কঙ্গো হতে উগান্ডা যেতে হলে প্রতিবার আপনাকে ১০০ ডলার দিতে হবে (তিন মাসের জন্য সিংগেল এন্ট্রি)। আগে এটা ছিল ৫০ ডলার। আর উগান্ডা থেকে ডি আর কংগোতে যেতে হলেও দিতে হবে ৫০ ডলার তবে সেটা দুই সপ্তাহের জন্য। মজার ব্যাপার হল, সীমান্তের কাছাকাছি বসবাসকারী মানুষগুলো এসবের ধার ধারে না। এপারে-ওপারে মূলতঃ আলুড় (Alur) সম্প্রদায়ের বসবাস। সীমান্তের ওপারে উগান্ডায় আছে আলুড় রাজার বাড়ী। সীমান্ত ভাগাভাগির সময় ব্রিটিশ বেণিয়া আর বেলজিয়ান শাসকরা আলুড় রাজ্যকে দ্বিখন্ডিত করে দিয়েছে। কিন্তু হৃদয়ের বন্ধন হয়তো ছিড়ে দিতে পারেনি। তাই সাপ্তাহিক হাট মানেই দুই পারের মানুষের অবারিত বাণিজ্য।

বিক্রেতা হিসেবে হাটে ঢুকতে গেলে প্রথমেই আপনাকে টোল দিতে হবে। দিন শেষে পন্য বিক্রয় হোক বা না হোক, কিংবা যতটুকুই বিক্রি হোক না কেন, টোল আপনাকে দিতেই হবে এবং সেটার পরিমান নির্ধারিত। সবচেয়ে প্রথমে যে জিনিষ দেখে অবাক হলাম সেটা হল, আমরা ডি আর কঙ্গোর ভেতরে থাকলেও এখানে শতকরা ১০০ ভাগ কেনা কাটা হচ্ছিল উগান্ডান মুদ্রা শিলিং এ। কংগোলীজ ফ্রাঙ্ক এর কোন অস্তিত্বই পেলাম না। আমরা কিছু বীন্স কেনার সময় শিলিং এর পরিবর্তে ডলার দিলাম। প্রতি ডলার ৩০০০ শিলিং ধরে দোকানী নিয়ে নিল।
এখানে বিদ্যুৎ নেই। ছোট জেনারেটরের সাহায্যে ডিভিডি প্লেয়ার আর মাত্র ২১ ইঞ্চি রংগিন টেলিভিশনে দেখানো হচ্ছে হলিউডের সিনেমা। এটাই এখানকার থিয়েটার বা সিনেমা হল!

সবজি'র বাজারে গেলাম। বিক্রি হচ্ছে টমেটো, ভুট্টা, কচি পেঁয়াজ সহ নানা সবজি। আখ বিক্রি হছে দেদার। মাছের বাজারে তাজা মাছ নেই। প্রচুর শুটকি উঠেছে। লেক এলবার্ট থেকে ধরা মাছের শুটকি। ফলের মধ্যে আছে কমলা লেবু, কলা আর এভোক্যাডো। আফ্রিকার এ অঞ্চলে প্রচুর এভোক্যাডো জন্মে। খেতে একদম স্বাদহীন কিন্তু খুবই পুষ্টিকর।

কামার-কুমারের দোকান আছে। দা, ছুরি পাওয়া যায়। কঙ্গো, উগান্ডার অনেক জায়গায় আমি সাধারণ মানুষকে হাতে একটি বড় আকারের ছুরি নিয়ে ঘুরতে দেখেছি যেটাকে ম্যাসেটি ( Machete ) বলা হয়। ম্যাসেটি বিক্রি হতে দেখলাম না কোথাও। পেলে একটা কিনে নিতাম। একটা ফার্মেসী দেখলাম। ভেতরে খুব কম ঔষধ। আফ্রিকার প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষেরা এখনও ভেষজ-লোকজ ঔষধ আর ঝাড় ফু'কে অভ্যস্ত।

আছে জুতা স্যান্ডেলের দোকান। ছোলা আর চীনা বাদাম দিয়ে বানানো এক প্রকার খাবার বিক্রি হচ্ছে দেদারসে। আরো আছে বিভিন ধরণের তৈরী খাবার যার কোনটা বাড়ি থেকে তৈরী করে নিয়ে এসেছে, আবার কোনটি বাজারেই তৈরী হচ্ছে।

পাম অয়েলও আছে। আর আছে চোলাই মদ । অবশ্য চোলাই বলতে যা বুঝায় অর্থাৎ পাতন করা হয় নি। কাসাভা পচিয়ে সরাসরি মদ বানানো হয়েছে। পুরুষ-মহিলা সবাই মিলে পান করছে।

একটা উৎসব উৎসব ভাব। আমারও খুব ভাল লাগছিল। সেই ভাল লাগা নিয়েই প্রায় এক ঘন্টা সেই বাজারে কাটিয়ে দিলাম। ফেরার পথে ঘুরে গেলাম কফি বাগানে যেটা নিয়ে ইতোমধ্যে লিখে ফেলেছি।

প্রায় শতাধিক ছবির মধ্যে থেকে বেছে অল্প কিছু ছবি দিয়ে দিলাম পাঠকদের জন্য। আশা করি আপনাদের ভাল লাগবে। খেয়াল করে দেখুন বাজারের মধ্যে ৯৫% মহিলা। এটাই আফ্রিকার প্রতিচ্ছবি। পুরুষগুলো শুধু মদ্যপান আর সন্তান উৎপাদনে ব্যস্ত। সংসারের ঘানি টানতে হয় মেয়েদেরকেই। এই হাটে আসতে অনেককেই হয়তো ২০ – ৩০ কিলোমিটার পথ হেঁটে আসতে হয়েছে। অথচ আমি ছবি তোলার সময়ে হাসি মুখেই পোজ দিচ্ছিল। এত কষ্টের মাঝেও হাসি মুখে থাকার ব্যাপারটা ওরা কিভাবে আয়ত্ব করলো, কে জানে?