গুলশান ট্রাজেডি এবং আহাম্মকদের কাণ্ড কারখানা

Published : 17 July 2016, 04:51 PM
Updated : 17 July 2016, 04:51 PM

গত ১ জুলাই রাতে গুলশান ২ নম্বরের ৭৯ নম্বর রোডে অবস্থিত হলি আর্টিজান বেকারিতে ঢুকে এলোপাতাড়ি গুলি চালিয়ে দেশি-বিদেশি অন্তত ৩৩ জনকে জিম্মি করে একদল অস্ত্রধারী জঙ্গি। মুহুর্তেই ঘটনাটি নিরাপত্তা বাহিনী বিশেষ করে পুলিশ, র‍্যাব এবং মিডিয়ায় জানাজানি হয়ে যায়। শত শত সাংবাদিক ছুটে যায় ঘটনাস্থলে। পাছে দেরী হয়ে যায় কিংবা 'কিছু মিস করে ফেলি' , এই ধারণা থেকে প্রথমে মোবাইল ফোনের মাধ্যমে সরাসরি সাক্ষাতকার/প্রচারণা এবং অল্প কিছু পরে টিভি ক্যামেরার সাহায্য নিয়ে লাইভ সম্প্রচার শুরু হয়ে যায়। এরই মধ্যে পরিস্থিতি সামাল দিতে গিয়ে জঙ্গিদের ছোড়া বোমায় পুলিশের দুই কর্মকর্তা নিহত হন, আহত হন আরো অনেকে। গোয়েন্দাদের পাশাপাশি আস্তে আস্তে পুলিশ, র‍্যাব সহ নিরাপত্তা বাহিনীর সর্বোচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাবৃন্দ ঘটনাস্থলে হাজির হতে থাকেন। চলতে থাকে লাইভ কাভারেজ। কার আগে কে, কিভাবে, কত বেশি তাজা খবর জানাতে পারবে সেটার একটা অলিখিত প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়।

পাঠক নিশ্চয়ই খেয়াল করে থাকবেন যে, একই সময়ে হলি আর্টিজান বেকারীতে বসে খুনী জঙ্গিরা শুধু মানুষ খুন নিয়েই ব্যস্ত ছিল না, বরং তারাও টেলিভিশনে প্রচারিত লাইভ কাভারেজের মাধ্যমে বাইরের পরিবেশ সম্মন্ধে অবগত হচ্ছিল। বাইরে থেকে শত শত গোয়েন্দা, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার লোকজন যখন ভেতরে কি হচ্ছে সেটা জানতে এবং পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনে আনতে গলদঘর্ম, তখন বিনা প্রয়াসে ভেতরের জঙ্গিরা জেনে যাচ্ছিল বাইরে কি হচ্ছে। হায় সেলুকাস!

বিভিন্ন চ্যানেলের নিউজ রুম থেকে সংবাদ পাঠক এবং পাঠিকারা যখনই স্পটে থাকা লাইভ কভারেজরত সাংবাদিকদেরকে পরিস্থিতি জিজ্ঞেস করছিলেন, তখন এরা কথার ঝাঁপি খুলে বসে যাচ্ছিলেন। এখই কথা, একই তথ্য ইনিয়ে-বিনিয়ে, রঙ-চং মেখে , ভুল-শুদ্ধ উচ্চারণে বার বার বলে যাচ্ছিলেন। " এখানে কিন্তু একটি কথা আপনাকে জানিয়ে রাখি", "এখানে বলে রাখা ভাল", "যে কথাটা আপনাকে বলতে চাচ্ছিলাম " বলে বার বার একই তথ্য (হোক সেটা প্রাসংগিক কিংবা অপ্রাসঙ্গিক) জানাচ্ছিলেন। আর একবার শুরু করলে থামতেই চাচ্ছিলেন না। সাধারণ বোধ সম্পন্ন যে কেউ বুঝবেন যে, কোন ঘটনার লাইভ কাভারেজ করার ন্যুনতম প্রশিক্ষণ এসব টিভি সাংবাদিকদের নেই বা ছিল না।

এরই মধ্যে অতি উৎসাহী একজন টিভি সাংবাদিক বলে ফেললেন " আমরা এইমাত্র গোপন সুত্রে জানতে পারলাম, দর্শক তিনি হলি আর্টিজান বেকারির ভেতরের একজন কর্মচারী যিনি জিম্মি আছেন তিনি জানালেন যে ভেতরে ৭-৮ জন জংগী রয়েছে। দর্শক আমরা আরো জানতে পেরেছি যে তিনি সহ আরো কয়েকজন ভেতরে বাথরুমে লুকিয়ে আছেন। নিরাপত্তার খাতিরে আমি তার নাম বলছিনা কিন্তু এইমাত্র তার সাথে আমার কথা হল………" ইত্যাদি ইত্যাদি। ভাবতেই আমার গা শিউরে উঠে যে, কি করে একজন সাংবাদিক তার গোপন সুত্রের পরিচয় এবং জিম্মি সংকট এর মত ভয়াবহ অবস্থার ভেতর তার সেই কথিত গোপন সুত্রের অবস্থান এভাবে লাইভ কাভারেজের মাধ্যমে ফাঁস করে দিলেন? একটি বারও ভাবলেন না যে, জঙ্গিরা ঐ মুহুর্তেই তার সেই গোপন সুত্রকে খুঁজে বের করে হত্যা করতে পারে। নিরাপত্তার খাতিরে নাম বললেন না, কিন্তু ঐ ব্যাক্তি বেকারীর একজন কর্মচারী যিনি আরও কয়েকজন সহ বাথরুমে লুকিয়ে আছেন এটা বলে তিনি যে নিরাপত্তার নামে অসহায় জিম্মিদের উপর জংগিদের চাপাতির কোপ নিশ্চিত করে দিলেন সেটা বোঝার মত সাধারণ বুদ্ধি বা কমনসেন্স সেই সাংবাদিকের ছিল না। নিজের কৃতিত্ব জাহির করতে গিয়ে তিনি একজন জিম্মির জীবনকে বিপন্ন করছিলেন। কত বড় আহাম্মক হলে একজন মানুষ এধরণের একটা কাজ করতে পারে ? ইংরেজীতে একটা কথা আছে – "Common sense is a sense which is most uncommon in nature" এটার জলজ্যান্ত উদাহরণ আর কি হতে পারে?

একটু পরে আরেকজন সাংবাদিক জঙ্গিদের ছোড়া গ্রেনেডে কতজন হতাহত হয়েছেন সেই পরিসংখ্যান বলে যাচ্ছিলেন আর এতে করে হলি আর্টিজানের ভেতরে তখন জঙ্গিরা নিশ্চয়ই খুব খুশী হচ্ছিল। তিনি এবং তার মত আরো অনেক "আবাল" সাংবাদিক তখন ঘটনাস্থলে মোট কতজন উর্ধ্বতন কর্মকর্তা সেখানে উপস্থিত হয়েছেন সেটা জাহির করে প্রকারান্তরে ভয়ংকর জঙ্গীদেরকে আরো বড় টার্গেট উপস্থিত হবার খোশ খবর দিচ্ছিলেন। অর্থাৎ জঙ্গিরা যদি চাইত তবে আরো কয়েকটি গ্রেনেড ছুড়ে আরো কিছু উচ্চ পর্যায়ের অফিসার হত্যা করতে পারতো। মনে হচ্ছিল ওইসব আবাল সাংবাদিক গুলোকে যদি একটু নিরাপত্তা সচেতনতা এবং লাইভ সাংবাদিকতা শেখাতে পারতাম।

এরপর র‍্যাব এর ডিজি লাইভ কাভারেজ বন্ধ রাখার আহবান জানালেও বেশ কয়েকটি চ্যানেল তার এই আহবানকে বৃদ্ধাংগুলি দেখিয়ে সারারাত ঘটনার কাভারেজ দিয়ে গেছে। ধিক জানাই সেসব চ্যানেল ও তার সাংবাদিকদেরকে যারা লাইভ কাভারেজের মাধ্যমে প্রকারান্তরে বাইরের পরিবেশ সম্মন্ধে জংগীদেরকে লাইভ আপডেট জানিয়ে তাদেরকে সহায়তা করছিলেন। আমি সরকারের কাছে কয়েকটি অনুরোধ করবোঃ

ক। অবিলম্বে টিভি মিডিয়ায় লাইভ কভারেজ সংক্রান্ত একটা নীতিমালা/গাইডলাইন/দিকনির্দেশনা জারী করুন।

খ। টিভি মিডিয়ার যেসব সাংবাদিক লাইভ কাভারেজ দিয়ে থাকেন তাদের জন্য প্রশিক্ষনের ব্যবস্থা করুন।

গ। র‍্যাবের ডিজি'র অনুরোধ (প্রকারান্তরে আদেশ) উপেক্ষা করে যেসব সাংবাদিক এবং টিভি চ্যানেল সেদিন লাইভ কাভারেজের মাধ্যমে বাড়াবাড়ি করেছে তাদের সবাইকে অবিলম্বে আইনের আওতায় আনুন এবং বিচার করুন।

পরদিন সকালে সেনা বাহিনীর কমান্ডো অভিযানে (অপারেশন থান্ডারবোল্ট) নিরাপত্তা বাহিনী ওই ক্যাফের নিয়ন্ত্রণ নেয়। পরে সেখান থেকে ১৭ বিদেশি এবং তিনজন বাংলাদেশী সহ মোট ২০ জনের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। অভিযানে নিহত হয় ৬ (মতান্তরে ৫) জঙ্গি। অপারেশন থান্ডারবোল্ট নিয়ে আমার নিজস্ব ভাল-খারাপ কিছু এনালাইসিস আছে। কিন্তু অনেকের রোষানলে পড়ার ভয়ে সেগুলো আপাততঃ লিখলাম না। অপারেশন সাক্সেসফুল হয়েছে সেটাই বড় কথা। কিন্তু পুরো বিষয়ে কিছু গলদ, কিছু দুর্বলতা এবং সমন্বয়হীনতা যেটা সাধারণ জনগণ হিসেবে আমাদের চোখে পড়েছে সেগুলো বলার সুযোগ করে দিলে সেটা সবার জন্যই ভাল হবে। একারণেই আহাম্মক সাংবাদিকদের নিয়ে লিখলাম।

বিঃদ্রঃ এই লেখাটি ঢালাওভাবে কোন দল, গোষ্ঠী বা পেশাজীবিদেরকে টার্গেট করে লেখা নয়।