জুয়েলার্স সমিতির কাছে নিবেদনঃ ধর্মঘট চলুক

Published : 11 June 2017, 05:54 PM
Updated : 11 June 2017, 05:54 PM

বনানীর রেইন ট্রি হোটেলে দুই তরুনী ধর্ষন, ধর্ষনের ভিডিও চিত্র ধারন এবং এ বিষয়ে রুই কাতলাদের সন্তানেরা জড়িত থাকার বিষয়টি নিঃসন্দেহে এ সময়ের বেশ আলোচিত বিষয়। নির্যাতিতা দুই তরুণীর অভিযোগ আমলে নিতে গড়িমসি, অভিযোগ ধামাচাপা দেয়ার অপপ্রয়াসে বনানী থানার ওসি'র সাথে অন্যতম প্রধান অভিযুক্তের পিতার আর্থিক লেনদেন এর আরেকটি অভিযোগ, সরকারের মন্ত্রীর ফেসবুকে মন্ত্যব্য সবই আমাদের গোচরে এসেছে। ধর্ষিতাদের অনানুষ্ঠানিক জবানবন্দীতে প্রধান অভিযুক্ত সাফাত কর্তৃক তার পিতার পেশা এবং ক্ষমতার দাম্ভিকতা দেখেও আমরা অবাক হইনি। অবাক হইনি দৈনিক দুই লক্ষ টাকা হাত খরচের হিসাবেও। এদেশে সবই সম্ভব। অথচ আমি অবাক হয়েছি স্বর্ন আমদানী নীতিমালার দাবীতে বাংলাদেশ জুয়েলারী সমিতির দেয়া হরতালের হুমকিতে। এরপর দাবী পূরন হবার আগেই বাংলাদেশ জুয়েলারী সমিতি হরতাল কর্তৃক প্রত্যাহার করে নেয়াতে আরো বেশী অবাক হয়েছি।

আপন জুয়েলার্সের পাঁচটি শো রুমে প্রায় ৩০০ কোটি টাকার স্বর্ন পাওয়া গেছে। স্বাভাবিক ভাবেই ধরে নেয়া যায় তাদের দৈনিক টার্ন ওভার পনের কোটি টাকা (মোট বাহ্যিক ক্যাপিটালের ৫%) বা তার চেইয়ে সামান্য বেশী-কম। পনের কোটি টাকা দৈনিক টার্ন ওভার হলে দৈনিক লাভ কমপক্ষে পচাত্তর লক্ষ টাকা (টার্ন ওভারের ৫%)। কিন্তু কথায় আছে সোনারু নিজের মায়ের গয়নাতেও খাদ মেশায় অর্থাৎ চুরি করে। আমাদের দেশের জুয়েলারী ব্যবসায়ীরা ২১-২২ এর নামে আসলে কত ক্যারেটের সোনা গছিয়ে দিচ্ছে সেটা এক বিরাট রহস্য। ২৪ ক্যারেট মানে ৯৯.৯৯ ভাগ খাঁটি সোনা। ২২ ক্যারেট মানে ২৪ ভাগ সোনার মধ্যে ২২ ভাগ সোনা এবং ২ ভাগ খাঁদ। অর্থাৎ কোন অলংকারে শতকরা হিসেবে ৯১.৬৬% ভাগ সোনা থাকলে সেটাকে ২২ ক্যারেট বলা যাবে। খাঁটি সোনা খুব নরম। ৮-১০ ভাগ খাঁদ না মেশালে সেই সোনা দিয়ে তৈরী অলংকার কিছু দিনের ভেতর ভেংগে যাবে এটাই বাস্তব। কিন্তু আমাদের দেশের জুয়েলারদের বানানো অলংকার এর মান এমনই যে স্বনামখ্যাত এক জুয়েলার আরেক স্বনামখ্যাত জুয়েলারের দোকানে বানানো অলংকার কিনতে চায় না। মূল কারণ জোচ্চুরি। ২২ ক্যারেটের সোনার অলংকারে ১৮ ক্যারেটের বেশী আপনি কখনোই পাবেন না। যদি পান সেটা ব্যাতিক্রম, ব্যাতিক্রম কখনো উদাহরণ হতে পারে না। সুতরাং ১৫ কোটি টাকার দৈনিক টার্ন ওভারে লাভ আরো অনেক অনেক বেশী হতে বাধ্য। এটাতো শুধু ব্যবসা খাতে লাভ। অবৈধ পথে কম দামে সোনা এনে বেশী দামে বিক্রি করাতেও তো অনেক মুনাফা থাকে। সেই হিসাব ধরলে আপন জুয়েলার্স এর মত বনিকরা দৈনিক ১-২ কোটি টাকা মুনাফা করেন – এটা সহজেই অনুমেয়।

বাংলাদেশ সোনা আমদানী হয় না। তাহলে বিমানবন্দর কেন্দ্রিক যে সোনার খনি গড়ে উঠেছে সেই সোনা যায় কোথায়? পুরোটাই ভারতে চলে যায়? এই যে মধ্য আয়ের দেশ হয়ে ওঠা, মানুষের ক্রয় ক্ষমতা কি বাড়েনি? ক্রয় ক্ষমতা বেড়ে থাকলে মানুষ কি কিনছে? জমি-জমা-ফ্লাট-গাড়ি? নিঃসন্দেহে এগুলো অনেকের পছন্দের তালিকায় উপরের দিকেই থাকবে। কিন্তু যেই হারে মানুষের সংখ্যা এবং জমি জমার দাম বাড়ছে, সেখানে সীমিত আয়ের মধ্যবিত্ত কিংবা নিম্ন মধ্যবিত্তের পক্ষে আজকাল আর জমি জমার দিকে নজর দেয়া সম্ভব না। ফ্লাট ব্যবসায়ে চরম মন্দা যাচ্ছে। রাজনৈতিক ব্যবসায়ীদের (যারা ব্যবসার জন্য রাজনীতি করেন) দখলে চলে গেছে জমি, ফ্লাট আর বড় বড় সব ব্যবসা বানিজ্য। কিন্তু বিশাল মধ্যবিত্ত শ্রেণী এবং নিম্ন বিত্তের একটু আহ্লাদ মানে স্বর্নের গহনা। পাশাপাশি নব্য ধনিক অর্থাৎ রাজনৈতিক ছত্র ছায়ায় লুটপাটকারী, ঘুষখোর এবং উচ্চ শ্রেণী এবং উচ্চ মধ্যবিত্তের স্বততঃ চাহিদা তো আছেই। এই আকাশচুম্বী চাহিদার সাথে সামঞ্জস্য রাখতেই দেশে এত সোনা আনা হচ্ছে এবং তার শতকরা ৯৫-৯৮ ভাগই আসছে অবৈধ চোরাচালানের মাধ্যমে। কিন্তু সেটা নিয়ে কারো কোন মাথাব্যাথা কখনো ছিলনা। কেউ একবারও জিজ্ঞেস করে নি দেশে এত সোনা আসছে কেন? মাঝে মাঝে প্রশ্নটা উঠলেও – ভারতে পাচার হয়ে যাচ্ছে এই ধুয়া তুলে বালিতে চোখ ঢুকিয়ে রেখেছেন আমাদের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।

আজ দিলদার আহমেদ তার সু (?) পুত্রের কল্যানে মিডিয়ার এক নম্বর খবর হিসেবে উঠে আসার প্রেক্ষিতে সবাই একটু আধটু নড়ে চড়ে বসছেন। এনআরবি আপন জুয়েলার্সের পাঁচ শোরুম থেকে তের- চৌদ্দ মন সোনা জব্দ করেছেন। এরপর আরো একটা জুয়েলার্সে অভিযান চালিয়েছেন। বাকী জুয়েলার্সরাও আতসী কাঁচের নীচে আছেন – সেটা বলাই বাহুল্য। এরকম একটা আপাত ভীতিকর পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতি গত মাসে একবার ধর্মঘট ডাকে। এক-দুইদিন ধর্মঘট যেনতেন ভাবে পালনের পর কোন সুস্পষ্ট কারণ ছাড়াই সে ধর্মঘট তুলে নেয়া হয়। এরপর আবারো গত সপ্তাহে এই সমিতিটি আজ (রবিবার, ১১ জুন ২০১৭) থেকে ধর্মঘটের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল। তাদের মূল দাবী দুইটি। আপন জুয়েলার্সের জব্দ করা সোনা ফেরত দিতে হবে এবং কার্যকরী স্বর্ণ নীতিমালা তৈরী করতে হবে। (দ্বিতীয় দাবিটির আড়ালে প্রথম দাবিটিই মূখ্য কিনা পাঠক বিবেচনা করবেন)। আপন জুয়েলার্স যে অপরাধে অপরাধী – অন্য সব রথী মহারথীরাও একই দোষে দুষ্ট। এক যাত্রায় পৃথ ফল হতে পারে না। আজকে অন্যান্য যে কোন বড় জুয়েলার্সের শোরুমে অভিযান চালালে তাদের কেউই মজুদ সোনার যথাযথ কাগজ দেখাতে পারবেন না। তাই কি এত ভয়? স্বর্ণ নীতিমালার বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে ইতিবাচক আশ্বাস পেয়ে আজ থেকে ঘোষিত অনির্দিষ্ট কালের ধর্মঘট প্রত্যাহার করেছে বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতি। গতকাল শনিবার তিনটার দিকে রাজধানীর মতিঝিলের ফেডারেশন ভবনে ধর্মঘট প্রত্যাহারের ঘোষণা দেন জুয়েলার্স সমিতির সহসভাপতি এনামুল হক খান। খুব শিগগিরই স্বর্ণ নীতিমালা হবে – এ আশ্বাসের পরিপ্রেক্ষিতেই নাকি ধর্মঘট প্রত্যাহার করা হলো। তাহলে আপন জুয়েলার্সের জব্দ করা সোনার কি হবে?

ইদানিং আমাদের দেশে অরাজনৈতিক যে কোন দাবী আদায়ের মোক্ষম হাতিয়ার হচ্ছে ধর্মঘট। বাস ভাড়া বাড়াতে চান – ধর্মঘট ডেকে দিন। লঞ্চে কিংবা ট্রাকে অতিরিক্ত যাত্রী কিংবা মালামাল তুলবেন? ডাকুন ধর্মঘট। সেবা খাতের যেসব বিষয়ে ধর্মঘট ডাকলে মানুষের ভোগান্তি হবে – সেরকম যে কোন বিষয়ে ধর্মঘট ডাকলে সরকার তথা প্রশাসন মাথা নোয়াতে বাধ্য। এর অনেক কারণ আছে আমি সেই কারন বিশ্লেষনে যাব না। তবে অন্যতম কারণ হল ঐসব সেবা খাতের একচ্ছত্র অধিপতিদের অনেকেই সরকারের অংশীদার বা পলিসি মেকার। তাই তাদের স্বার্থটাই বড়।
সুখ কিংবা দূঃখের বিষয় হলো জুয়েলারী খাতের চেনা জানা কোন মাফিয়া অধ্যবদি ক্ষমতার আশে পাশে যেতে পারে নি। তাই তাদের পক্ষে সরকারের উপর কঠোর চাপ প্রয়োগ করার মত কেউ নেই।

জুয়েলারী খাত এমন একটা খাত যেখানে ধর্মঘট হলে মানুষের জীবন যাত্রার কোথাও কোন ব্যঘাত ঘটে না বরং হাতের পয়সা বাঁচে। দেশের টাকাও বাইরে যাবে না। আর সবচে যে বড় পাওনাটা হবে সেটা হলো একটা কার্যকরী স্বর্ন আমদানী নীতিমালা হবে যেখানে দেশের ভেতর সোনার দাম আন্তর্জাতিক বাজারের সমান হবে বা কাছাকাছি হবে। কিন্তু শুধু মাত্র স্বর্ন আমদানী নীতিমালা হবে এই আশ্বাসের প্রেক্ষিতেই ধর্মঘট প্রত্যাহার নাকি আপন জুয়েলার্সের সোনা ফেরত পাবার পাশাপাশি নিজেদের শোরুমে আর কোন অভিযান হবে না সেই নিশ্চয়তা পেয়েই ধর্মঘট প্রত্যাহার?

সত্যি কি আপনারা কার্যকর আমদানী নীতিমালা চান? এখন সিংগাপুর কিংবা দুবাই থেকে কোন ভ্রমনকারী ব্যাগেজ রুলের আওতায় দশ-বিশ গ্রাম সোনা বা সোনার অলংকার আনলে আপনারা এমন দাম বলেন যা শুনে মানুষের হার্টফেল করার অবস্থা হয়ে যায়। দুবাইতে এই মুহুর্তে প্রতি গ্রাম ২২ ক্যারেট সোনার দাম ৩৯.২৭ ডলার অর্থাৎ ৩১৬৫/- টাকা। আমিন জুয়েলার্সে গেলে দেখবেন উনারা বিক্রি করছেন প্রতি গ্রাম ৩৯৩৫ টাকা। এই সোনা বা সোনার অলংকার আপনি বিক্রি করতে গেলে প্রথমতঃ তারা কিনতে চাইবেন না আর কিনতে চাইলেও প্রতিগ্রাম ৩০০০ টাকার বেশী দিবেন না। তাহলে মজুরীর দাম সহ দশ গ্রাম সোনার অলংকারে আপনার নেট লস হবে ৭০০০ টাকা আর একই অলংকার বেশী দামে এবং পূনরায় মজুরী সহ ধরে বিক্রি করে আমিন জুয়েলার্সের লাভ হবে প্রায় ১৪ হাজার টাকা।

দুবাইতে যখন সোনার দাম ৩১৬৫/- প্রতি গ্রাম তখন বাংলাদেশে চোরাচালানের মাধ্যমে আনা সোনার দাম অবশ্যই ৩৯৩৫/- টাকা হতে বাধ্য।
বেশী মুনাফার জন্যই তো চোরাচালান করা হয়। আমদানী নীতিমালা হলে দাম নিয়ে জুয়েলার্স সমিতি নয় ছয় করতে পারবেন না। আমরা সাধারণ ক্রেতারা ভাল দামে (আন্তর্জাতিক বাজারের কাছাকাছি দামে সোনা কিনতে পারবো। বৈধ পথে সোনা আমদানী হলে সরকারও কিছু রাজস্ব পাবে। এই খাতে অর্থ পাচার ও বন্ধ হবে।

তাই আমার দাবী – স্বর্ন আমদানী নীতিমালা না হওয়া পর্যন্ত জুয়েলার্স সমিতির ধর্মঘট চলুক। আমরা আছি আপনাদের সাথে। দেখি নৈতিকভাবে আপনারা কতটা সৎ।