জন্ম আমার ধন্য হলো মাগো

এম. হামিদুজ্জামান সুমন
Published : 29 July 2011, 06:17 PM
Updated : 29 July 2011, 06:17 PM

শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে রংপুর জেলার শিক্ষর্থীদের সংগঠন 'বহমান তিস্তা'য় আমি তখন প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি'র পদে ছিলাম। ২০০৮ সনের শীতে গরম কাপড় বিতরণের জন্য রংপুর জেলার গঙ্গাচড়া উপজেলার একটি হতদরিদ্র গ্রামে গিয়েছিলাম। ওখানে খুব কাছ থেকে বসতিদের জীবন ও জীবিকা দেখেছি। দেখেছি শিশু কিশোরদের দৈন্য জীবন।

পেটের তাগিদে খড় কুটা কুড়ানো সহ বিভিন্ন কাজ করে ওরা। নদী ভাঙ্গা দূর্গম এলাকা চরাঞ্চলে বাস করে মালেক (৮), সুমন (১০), বাবু (৭), কেন্দু (৭), বাবলা (১২), শাপলা (৮), রহিমাসহ অনেক শিশু কিশোর। আসল পরিচয় ওরা নদী ভাঙ্গা অবহেলিত দূর্গম চরাঞ্চলের মানুষ। ওরা অতীত বর্তমান, ভবিষ্যৎ বোঝে না। ভবিষ্যত মানে অন্ধকারের প্রাচীর। সবার জন্য শিক্ষা এ স্লোগান ওদের বেশির ভাগ শিশুকে স্পর্শ করতে পারেনি। ওরা স্কুল যায় না। পড়া লেখার মর্মও বুঝে না ওরা। ঐসব এলাকায় অনেক গ্রামে স্কুল নেই। পার্শ্ববর্তী চরে একটি প্রাইমারী স্কুল থাকলেও তা আবার যাতায়াতের পথ থেকে বিচ্ছিন্ন। বর্ষায় ডুবা চর পাড়ি দিয়ে স্কুলে যাবার সাহস পায়না তারা। তাই উদাম তামাটে শরীর নিয়ে ঘুরে বেড়ায় সারা চরে। সব সময় প্রকৃতির মাঝে থাকে। প্রকৃতির মাঝে আনন্দ করে আকাশে ঘুড়ি উড়ায়, কখন একজনের পিঠে আর একজন উঠে, কখন ঘুরে বেড়ায় আবার কখনো নদীতে মাছ ধরে। চরের বিভিন্ন ডোবা ও নদীর পানিতে ও খোলা মাঠে খেলা করে কাটিয়ে দেয় সারা বেলা।

নেই ওদের মাথায় তেল ও গায়ে সাবান দেয়ার উপার্জন ক্ষমতা। মেয়েরা একটু বড় হলেই গায়ে ওঠে মায়ের ছেঁড়া পেটিকোট, আর বুকে এক টুকরো ছেঁড়া ব্লাউজের পুরনো কাপড়। ছেলেদের শরীরের নিচের অংশে জুটে বাবার পুরনো লুঙ্গি। এটা যেন ওদের লজ্জা নিবারণের চেষ্টা। তারা শুধু অপুষ্টিতে ভুগে না, প্রায় অসুখ বিসুখ ওদের লেগে থাকে। কিন্তু তা তারা পরোয়া করে না । অসুখ হলে নেই কোন ওষুধের যোগান। চিকিৎসা নামে চলে ওদের ঝাড়ফুঁক ও তাবিজ কবজ। এখানে পরিবার পরিকল্পনা তাদের জানা নেই, একের পর এক শিশু জন্ম নেয় তাদের ঘরে।

পৃথিবীর সব জায়গার মত সূর্য ওঠে আর সূর্য ডুবে এটাই শুধু ওরা জানে । পরের ও সরকারী খাস জমিতে ওদের বসবাস। পেটের যোগান দিতে অন্যের জমিতে চাষাবাদের কাজ করতে হয়। বাবা মায়েদের সঙ্গে কাজে যোগ দিতে হয় তাদের। কাজ শেষ করে ছোট ছোট বাচ্চারা নদীর ধার দিয়ে খড় কুটা কুড়িয়ে নিয়ে যায়। জোতদারদের দাসত্বের শিকলে আটকিয়ে ওদের শৈশব। আছে শুধু মাথা গোজার একটু ছনের ছায়া। বেড়ে ওঠে ওরা প্রকৃতির সঙ্গে যুদ্ধ করে।

ওরা যেন সমাজ থেকে অনেক দূরে। ওদের জন্য সমাজের উচ্চস্তরের মানুষের যেন কোন মাথা ব্যথা নেই। তবুও ওদের মনের সুখে গাইতে দেখেছি, হয়তো বুঝেই গেয়ে চলেছে কিংবা না বুঝেই – জন্ম আমার ধন্য হলো মাগো .. এমন করে আকুল হয়ে আমায় তুমি ডাক …

***
লেখক: প্রকৌশলী, খাদ্য প্রযুক্তি।