ক্রমাগত গ্যাস সংকট এবং চৌধুরি সাহেব

পাহলোয়ান এরশাদ
Published : 11 Feb 2016, 08:12 PM
Updated : 11 Feb 2016, 08:12 PM


"পাইপলাইনে গ্যাস থাকবে না, এলপিজিই সমাধান" চলমান গ্যাস সংকটের মধ্যে ঠিক এই ধরনের পথ বাতলে দেন[১ ] বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের মাননীয় প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ[২ ]।মাননীয় মন্ত্রী ঢাকাবিশ্ববিদ্যালয় হতে বি.এ. পাশ করেন পরে তিনি F. Kennedy School, University of Harverd, Boston, USA থেকে Certificate Program on Leadership কোর্স সম্পন্ন করেন[৩]। আবাসিক এলাকায় গ্যাস সংকটের কথা বললে নানা মুনি নানা মত বাতলে দেন কেউ বলেন শীতে গ্যাস জমে পাইপ বন্ধ, কনডেনসেট জমে পাইপ বন্ধ, গ্যাসের চাপ কমে গেছে, সঞ্চালন লাইনে ছিদ্র আরও অনেক সমস্যা। ঢাকার যে সব এলাকায় এই সংকট দেখা দিয়েছে তার মধ্যে বেশি নিম্নবিত্ত-মধ্যম মধ্যবিত্ত বসবাস করে[৪] । খোদ প্রধানমন্ত্রীর জাতীয় সংসদে প্রশ্নোত্তর পর্বে জাতীয় পার্টির সাংসদ জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলুর এক সম্পূরক প্রশ্নের জবাবে যে উত্তর দিয়েছেন তাতে আমি খুবই বিস্মিত হয়েছি। প্রধানমন্ত্রীর উত্তরটি ছিল "শীতে গ্যাসের সংকট আছে। আমরা স্বীকার করছি, কিছু সমস্যা আছে। এই সমস্যা প্রতি শীতেই হয়। তবে আমরা বসে নেই। সংকট কাটানোর চেষ্টা করছি।'প্রধানমন্ত্রী বলেন, শীতকালে সাধারণত গ্যাস জমে যায়, গ্যাসের চাপ (ফ্লো) কমে যায়। সে জন্য সব সময় শীতকালে গ্যাসের সমস্যা দেখা যায়"[৫] কিন্তু ঢাকার সেই নামিদামী এলাকায় কেন গ্যাস সংকট দেখা দিল না কেন? তাদের সঞ্চালন লাইন কি এতই গরম যে সেখানে কোন গ্যাস জমতে পারেনি। আবার গ্যাস উৎপাদন শুধু শীতকালেই কেন হ্রাস পাবে।? সারাবছর কেন নয়? যদি না রিজার্ভারে কোন সমস্যা দেখা না দেয় অথবা সেন্ট্রাল প্রোসেসিং টার্মিনালে কোন সমস্যা না হলে সাধারন গ্যাসর চাপ কমার কথা নয় যদি ডিষ্টিবিউশন লাইন সঠিক থাকে?নাকি ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির কারসাজি নাকি সিনেমার চৌধুরি সাহেবের অদৃশ্য হাতের ইশারায় এসব হচ্ছে? কারন বাংলা সিনেমায় চৌধুরি সাহেবেরা তো সে সব এলাকায় বসবাস করেন যেখানে দেশের বড় বড় চোর আর বাটপার রা বসবাস করে।

চলমান গ্যাস সংকট নিয়ে যে সব তত্ব আছে সেগুলো সাইদির চন্দ্রাগমন তত্ত্বের সাথে পুরো মিলে যায়। কেন বললাম এটি বোঝার আগে, গ্যাস কিভাবে রিজার্ভার থেকে আপনার বাড়ির রান্না ঘরে পৌছে তা জানা প্রয়োজন। স্বভাবিক ভাবে সাব-সার্ফেসে গ্যাস ও তেল এবং পানি আলাদা আলাদা স্তর হিসেবে থাকে। সবার উপরে থাকে গ্যাস তারপর তেল এরপর সবার নিচে থাকে পানি। গ্যাস উত্তলন কারী পাইপের মধ্যে দিয়ে একইসাথে এই তিনটি স্তর উপর উঠে আসে তাছাড়া এর সাথে নানা রকমের বিষাক্ত ও অদ্বাজ্য গ্যাস উঠে আসে। এরপর সেপারেটর নামক যন্ত্রের মধ্যমে গ্যাস থেকে তেল এবং পানি কে আলাদা করা হয়। এরপর গ্যাস যায় সেন্ট্রাল প্রসেসিং ফ্যাসিলিটিতে পাঠানো হয় । গ্যাস কে ওয়েল থেকে সেন্ট্রাল প্রসেসিং ফ্যসেলিটি তে পাঠানোর জন্য ব্যষ্টার স্টেশন গুলো কাজ করে থাকে। এখানে দুটি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হয় ১. ভেজাল দূরীকরণ ২. ন্যাচেরাল গ্যাস লিকুইড দুরীকরন। গ্যাসের ভিতর ভেজাল হিসেবে থাকে পানির বাষ্প, হাইড্রোজান সালফেট, কার্বন-ডাইঅক্সাইড ও নাইট্রোজেন। পানি দুরকারার জন্য ডিহাইড্রেশন প্রক্রিয়া অনুসরন করা হয়, এই প্রক্রিয়ায় ট্রাই-ইথিলিনগ্লাইকল দ্বারা গ্যাস থেকে পানি দূর করা হয়। এছাড়া মলিকুলার সিভ ও মিথানল ইঞ্জেশন মেথড ব্যাবহার করা হয় পানি দুরীকরনে। এই পানি দূর করতে না পারলে এটি গ্যাস সঞ্চালন লাইন ক্ষয় করে থাকে। হাইড্রোজেন-সালফাইড ও কার্বনডাই অক্সাইড এসিড গ্যাস যা বিষাক্ত এবং ক্ষয়কারক। এই দুই গ্যাস কে অপসারন করা হয় তিনটি প্রক্রিয়ায় ১. রাসায়নিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে,২. মেমব্রেন সেপারেশন, ৩. বেচ প্রসেসিং । আমিন সুইটেনিং এর মাধ্যেম গ্যাস থেকে হাইড্রোজেন- সালফাইড গ্যাস দূর করা হয়, এই প্রক্রিয়ায় অ্যামিন এসিড গ্যাস থেকে হাইড্রোজেন- সালফাইড শুষে নেয় । আয়ারন স্পঞ্জ, জিংক অক্সাইড এবং কষ্টিক ওয়াশ এই তিন প্রক্রিয়াকে একত্রে বলা হয় ব্যাচ প্রোসেসিং, এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমেও গ্যাস থেকে হাইড্রোজেন- সালফাইড দূর করা হয়। প্ল্যন্ট এর ডিজাইন অনুযায়ী প্রক্রিয়া নির্বাচন করা হয়। এছাড়া নাইট্রোজেন ও কার্বন-ডাইঅক্সাইড দূরীকরণে এনআরইউ সিস্টেম ব্যাবহার করা হয়।

এই সব প্রক্রিয়া শেষে এই গ্যাসকে আরো দুটি পরিশোধন প্রক্রিয়ার মধ্যদিয়ে যেতে হয় ১. এন.জি.এল দূরীকরণ ২। ফ্র্যাকশিনেশন । এন. জি.এল বা ন্যাচেরাল গ্যাস লিকুইড যত কম হবে গ্যাসের মান তত বৃদ্ধি পাবে। এই এন.জি.এল দুরকরার করার কয়েকটি আছে এগুলোর মধ্যে ক্রায়জেনিক, রেফিজারেশন, লীন অয়েল এবসরপশন। এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ব্যাবহার করা হয় ক্রায়জেনিক সিস্টেম। এই ক্রায়োজেনিক সিস্টেমে তিনটি ধাপ অনুসরন করে এগুলো হচ্ছে ডি-হাইড্রেশন, চিলিং এবং ফ্র্যাকশিনেশন। এখানে গ্যাস কে -৫০ ডিগ্রি ফারেনহাইট এ গ্যাস কে তরলে পরিনত করলে মিথেন বাদে বাকি গ্যাস গুলো তরলে পরিণত হয়। এর ফলে মিথেন কে আলাদা করা হয়। এর পর বাকি তরল গ্যাসকে আবারো ফ্র্যাকশিনেশন এর মধ্যে দিয়ে চালনা করা হয় ফলে ইথেন,প্রোপেন, বিউটেন কে আলাদা করা হয়। কিন্তু মার্কেট ভ্যালুর উপর নির্ভর করে বেশিভাগ সময়ে গ্যাস কোম্পানি মিথেন, ইথেন, প্রোপেন ও বিটেন কে এক সাথে সঞ্চালন লাইনে সরবরাহ করে । যেখানে আপনার শুধু মাত্র মিথেন এবং ইথেন গ্যাস পাবার কথা এর সাথে ভেজাল হিসেবে থাকে প্রপেন এবং বিউটেন। এই সব প্রক্রিয়ার মধ্যেদিয়ে যাবার পর গ্যাস আপনার বাড়িতে এবং শিল্পকারখানায় যাবার জন্য প্রস্তুত হয়। এই বিশুদ্ধ গ্যাস সরবরাহ করলে পাইপ লাইনে গ্যাস হাইড্রেট জমে লাইনবন্ধ হওয়া, চাপ কমে যাওয়া, শীত কালে গ্যাস জমে যাওয়ার প্রশ্নই আসে না। তাই কারাগারে আটক সাইদি যেমন চাঁদে যেতে পারে না ঠিক তেমনি ভাবে শীতে গ্যাস জমে যায় না। যেহেতু এই সব সমস্যা দেখা দিয়েছে তার মানে এখানে প্রসেসিং প্ল্যান্টের ত্রুটি আছে বা অন্য কোন ভেলকিবাজি আছে। এবার আসি তিতাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির কথায়, বিজিএফসিএল এর তথ্য অনুযায়ী তিতাস গ্যস ফিল্ড তাদের গ্যাস প্রসেসিং প্ল্যান্ট এ দুটি প্রক্রিয়া ব্যাবহার করে[৬] । প্রথমত গ্লাইকল ডিহাইড্রেশন এবং এল টি এস বা লো টেম্পারেচার সেপারেশন; গ্লাইকল ডি হাইড্রেশন এর মাধ্যমে গ্যাস থেকে পানি অপসারন করা হয় এবং এল টি এস দ্বারা বাকি এন জি এল দূরকরা হয়। এই এল টি এস হচ্ছে সবচেয়ে সস্তা এবং বেশি ব্যবহৃত একটি সিস্টেম। এই এল টি এস এর কর্মদক্ষতাও অন্য সিস্টেম গুলো থেকে অনেক বেশি। এই সিস্টেম ঠিকমত কাজ করলে পাইপলাইনে হাইড্রেট জমে যাবার কথা নয়। যেহেতু বার বার হাইড্রেট জমে যাচ্ছে তাই এটা ধরে নিতে হবে এই সিস্টেম ঠিকমত কাজ করছে না বা এই সিস্টেম কে ঠিকমত কাজ করতে দেওয়া হচ্ছে না।

এ জন্য নিশ্চয় সাধারন গ্রাহক দায়ী নয় কিন্তু আমাদের মাননীয় মন্ত্রী যে ধরনের বডি ল্যঙ্গুয়েজ প্রদর্শন করে এবং সমাধান হিসেবে আবাসিক গ্রাহকদের এলপিজিতে যাবার পরামর্শ দেন তাতে মনে অনেক প্রশ্ন জাগে। ১২ শতাংশ আবাসিক গ্রাহক কে যদি গ্যাস লাইনের গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করা হয় তাহলেই কি এই গ্যাস সরবরাহ লাইনের অবস্থার উন্নতি ঘটবে ? নাকি অবস্থা যা আছে তাই থাকবে। যদি তাই হয় তাহলে এল পি জি তা যাওয়ার জন্য এত তোর জোড় কেন? কারন চোধুরি সাহেবের মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে এই এল পি জি ব্যাবসায়। যদি ১২ শতাংশ ব্যাবহারকারী কে এলপিজি তে পরিবর্তন করা যায় তাহলে চৌধুরি সাহেবের বিনিয়োগ খুব দ্রুত উঠে আসবে এবং পরিধি বৃদ্ধি পাবে। তাহলে কি চৌধুরি সাহেবের বানিজ্যিক মওকার জন্যই এই চাপাচাপি। আমরা সবাই জানি আমাদের এই প্রাকৃতিক গ্যাস কতটা মুল্যবান, এই গ্যাস আবাসিক খাঁতে ব্যাবহার করা ব্যায়বহুল কিন্তু আবাসিক গ্রাহক কে সংযোগ দেওয়ার পর সংযোগ বন্ধ করে দেওয়ার হুমকি বা অন্যের সার্থে এই পলিসি গ্রহন করা কতটুকো যুক্তি পূর্ন্য?