যুগে যুগে গো হত্যা নিষিদ্ধকরণ

পাহলোয়ান এরশাদ
Published : 3 March 2016, 07:07 PM
Updated : 3 March 2016, 07:07 PM


মানব জাতির গৃহে পালিত পশুর মধ্যে গরুই সর্বাপেক্ষা। ইস্কুলের পাঠ্য বইয়ের গরুর রচনা মুখস্ত করে নাই এমন ছাত্র-ছাত্রী খুঁজে পাওয়া দুষ্কর হবে। পৃথিবীর কৃষি ভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রাণীটির নাম গরু, যাকে বলদ বা ষাঁড় নামেও ডাকে। কৃষি ভিত্তিক সমাজে গরু জমি চাষ থেকে শুরু করে মাড়াই পর্যন্ত প্রত্যেকটি ধাপেই গরুর ভূমিকা তুলনা হীন। আপনি যদি মনে করে থাকেন শুধু সনাতন ধর্মাবলম্বী রাই গো-হত্যা নিষিদ্ধ করনে তাহলে আপনার ভাবনাটা ভুল। যীশু খ্রিস্টের জন্মের ৫০০ বছর আগেই বর্তমান ইরানে রাজা কাইরাস-২ জরথুস্ত্র ধর্মের নবী জরাষ্টার পরামর্শে গো-হত্যা নিষিদ্ধ করেন। মূলত জরথুস্ত্রবাদ কৃষি কাজকে ধর্মীয় কর্তব্য মনে করা হত, আর যেহেতু গরু কৃষি কাজে সাহায্য করে তাই গরুকে শ্রদ্ধা ও ভক্তির চোখে দেখা হত অন্যদিকে লোভী পুরোহিতরা দেবতার উদেশ্যে পশু ও মদ উত্সর্গ করত যা জরাস্টার বন্ধ করতে চেয়েছিলেন। কারন গবাদি পশুর ধ্বংস কৃষি কে বিপন্ন করতে পারে। জরথুস্ত্রবাদ অনুযায়ী একদিন তাদের দেবতা আহুরামজাদা কে একটি ষাঁড় এই অনুরোধ জানালেন যে তিনি যেন মানুষ ও দানবের হাত থেকে গুরুর জীবন রক্ষা পায়। এরপর আহুরামজাদা জরাষ্টার কে গো-হত্যা বন্ধের নির্দেশ দেন। এরপর থেকে গো-হত্যা নিষিদ্ধ হয়ে যায়।

এরপর জরথুস্ত্রবাদ অনুসারীরা বহুদেবতাবাদ থেকে একেশ্বরবাদ বিশ্বাসের চর্চা শুরু করেন। তাদের কাছে গরু হত্যা নিষিদ্ধ হলেও তারা কিন্তু পূনরজন্মবাদকে অস্বীকার করে যা ইহুদিবাদ, খ্রিষ্টমতবাদ ও ইসলামের ধর্মীয় বিশ্বাসের সাথে অনেকটাই মিল। যদিও রাজা কাইরাস-২ গো-হত্যা নিষিদ্ধ করেন কিন্তু তিনি প্রাচীন ব্যাবিলনের দেবতা মারডকের পূজা করতেন। ঐতিহাসিকগণ তার এই কাজটিকে রাজনৈতিক কৌশল বলে মনে করেন। শত শত বছর ধরে গ্রিক, রোম, বাইজেন্টাইন এবং সর্বশেষ খ্রীষ্টীয় দশম শতকে আরব শাসকদের অত্যাচারে এদের একটি শাখা ভারতের উত্তর প্রান্তে এসে আশ্রয় লাভ করে। এরা গুজরাট এবং মহারাষ্ট্রে কৃষি কাজের সাথে জড়িত হয় এবং তাদের গো-হত্যা নিষিদ্ধ করনের মতবাদ প্রচার করতে থাকে। তাদের এই মতবাদ তাদের ই পুর্ব-পুরুষ আর্যদের ঋগবেদ অনেকটাই সমর্থন করে যদিও ঋগবেদ গরুর উতসর্গ করা বা খাওয়ার কথা বলে থাকে। সম্রাট আকবর ও জাহাঙ্গীর গরু জবাই নিষিদ্ধ করেন, দাক্ষিণাত্যের টিপু সুলতান গো হত্যার অপরাধে হাত কেটে ফেলার আইন করেন। ভারতে এখনো বিভিন্ন জোনে গরু জবাই করার বিভিন্ন আইন রয়েছে।

উত্তর পূর্বের রাজ্য নাগাল্যান্ড, মনিপুর মেঘালয়ে গরু জবাইয়ে কোন বিধি নিষেধ নেই। কেরালা রাজ্যে কোন নিষেধাজ্ঞা নেই তবে গরুটা বেশ বয়স্ক হতে হবে। তামিল নাড়ু, পশ্চিম বাংলা, আসাম এ গরু জবাই করতে সরকারের সার্টিফিকেটই লাগে এবং এই তিন রাজ্যে সরকারি নিয়ন্ত্রণে গরু জবাই চলে। অন্ধ্রপ্রদেশ, তেলাংগানা, বিহার, গোয়া, উড়িষ্যা গরুর বয়স ছয় মাসের বেশি হতে হবে, সার্টিফিকেট প্রাপ্তি সাপেক্ষে। মহারাষ্ট্র, গুজরাট, মধ্য প্রদেশে গরু জবাই নিষিদ্ধ। সর্বশেষ মোদি সরকার গঠনের পরেই এই গো-হত্যা নিয়ে ধর্মীয় অসহিস্নুতা চরম পর্যায়ে এসেছে কারন এই দুটি রাজ্য সেই জরাষ্টারের মতবাদ প্রচারের আদিভুমি। একেশ্বরবাদের বিশ্বাসী জরাষ্টারের মতবাদ নিয়ে বহুশ্বরবাদের ভারতীয়দের মৌলবাদী আচরণ সতিই অবাক করে। যে ভারত পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি গো-মাংস রাপ্তানি করে এমনকি গরুর রক্ত চা শিল্পে, হাড্ডি-বিশাল ওষুধ শিল্পে ব্যবহৃত হচ্ছে। এই ব্যবসায়ীরা সমস্ত গরু এক অঞ্চল থেকে নিয়ে জবাই করছে কেরালা আর পশ্চিম বাংলায়। ওখান থেকে মাংস, চামড়া ইত্যাদি বিদেশে রফতানি হচ্ছে, ওষুধ শিল্পে ব্যবহৃত ক্যাপসুলের আবরনের প্রধান প্রস্তুতকারক ভারত যা আসে গরুর হাড্ডি থেকে। গো-হত্যা নিষিদ্ধ করনের পেছনে মোদির কোন ধর্মীয় অনুভুতি নেই আছে অশুভ ধর্মভিত্তিক রাজনীতি। গোমাংস ভক্ষণ না করা আপনার যেমন অধিকার ঠিক তেমনি ভক্ষণ করা অন্যের অধিকার। অন্যদিকে মুসলমানদের গো-মাংস খেতেই হবে তাও কিন্তু ফরজ না। এ সবকিছুই ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার বহিঃপ্রকাশ।

ফেইসবুকে আমিঃ https://www.facebook.com/ershad.pahlowan