অন্যরকম পথ চলাঃ প্রেক্ষিত এই শহর

ঈশিতা বিনতে শিরীন নজরুলঈশিতা বিনতে শিরীন নজরুল
Published : 6 July 2017, 04:14 AM
Updated : 6 July 2017, 04:14 AM
বেশ কয়েক মাস তো হয়েই গেলো..! বহু প্রতীক্ষিত সময় ! ছেলে নিয়ে অবশেষে বরের কাছে চলে আসার সুযোগ! আমার অতি দুষ্ট পুত্রকে সাথে নিয়ে দীর্ঘ ক্লান্তিকর যাত্রা শেষ করে যখন ফ্র্যাঙ্কফুর্ট এয়ারপোর্টে পৌঁছলাম তখন প্রায় সন্ধ্যা। ট্যাক্সি নিয়ে যখন রওনা দিলাম তখন শুধু মনে হচ্ছে এ কোন ভ্যাম্পায়ারের শহরে চলে আসলাম রে বাবা!! মানুষ-গাড়ির কোন ভীড় নেই, হর্নের শব্দ নেই!! জন্মের পর থেকে দীর্ঘ ৩০ বছর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো নিঃশব্দ জায়গা থাকার কারনেই কিনা জানি না, কোলাহল আমার খুব পছন্দের। অনেক কোলাহলের মাঝে আমি একা, ভাবতেই যেন খুব ভাল লাগে! তাই তো ঢাকা আমার প্রাণের শহর। ঢাকা শহরের ওপর বিরক্তির কোন সীমা পরিসীমা নেই, তারপরেও…  কোথাও যেন একটা ভাল লাগা, ভালবাসা রয়েই যায়….
খুব সুন্দর একটি জায়গায় আমাদের বাসাটি। একদম আমার মনের মতো একটি জায়গাতে। বলে রাখা ভাল যে, এখানে বাসা পাওয়া অত্যন্ত কঠিন কাজগুলোর মধ্যে একটি। বিশেষ করে বিদেশীদের জন্য, অার ভাড়ার কথা নাই বা বললাম। সব কিছুর পরেও সেন্ট্রাল পয়েন্টে বাসা খুঁজে বের করায় আমি সত্যিই যারপরনাই আনন্দিত; নইলে বোধকরি সময় কাটানোই হতাশাপূর্ণ হয়ে উঠতো আমার কাছে। বাসার কাছে সব কিছু, ঠিক রাস্তার পাশে পুরোনো ধাঁচের একটি বাসা! জার্মানরা ‍ঐতিহ্যকে বড় ভালবাসে, তাই সব কিছুতেই যেন সেই ছোঁয়া!! অভ্যাস এমন জিনিস, শুধুমাত্র গাড়ির শব্দ শোনার জন্য আমি ঠান্ডা লাগলেও দরজা-জানালা খুলে রাখি। বাংলাদেশী বলে কথা!
চাকরী-বাকরী বাদ দিয়ে হঠাৎ বেকার জীবনে  অভ্যস্ত হওয়াও বড় চ্যালেঞ্জ বই কি!! ছোট্ট ছেলেকে নিয়েই সময়টা কাটে। আর আশেপাশের বাসার সাজসজ্জা দেখে। এত সৌখিন এই জাতি। মায়ের কথা মনে পড়ে তখন খুব। তিনিও খুব শৌখিণ একজন মানুষ। তার বাসা ভর্তি কত রকমের যে গাছ!! এখানেও ঠিক তাই। গাছ ছাড়া বারান্দা প্রায় চোখেই পড়েনি আমার। আর জানালা ভেদ করে ঘরগুলোও যখন চোখে পড়ে, সেখানেও বাহারি গাছ কতভাবেই না সাজিয়ে রাখা!
তবে ভাষা….. এটাই এখন আপাতত আমার একমাত্র প্রতিবন্ধকতা। নিজের কাছেই যেন কেমন অস্বস্তি লাগে। গবেষকের চাকরী জীবনে কত জায়গাতে একা একা গিয়েছি, সেই আমি যেন কিছুটা হলেও ভাষায় বাঁধা পড়ে সংকুচিত!! তবে আশার কথা হলো অামার পাশের বাসাতেই জার্মান বৃদ্ধ-বৃদ্ধা হাসিমুখে কত কথাই যে বলে আমার পুত্রের সাথে, আমার সাথেও!! তাদের বারান্দা থেকে মাঝে মাঝেই উঁকি দিয়ে তাঁরা অামার দুষ্ট পুত্রকে খোঁজে!! এই আন্তরিকতা বোধকরি ভাষাকেও টপকে যায়। অামার বাসার ওপর তলার মানুষটি তাদের জন্য কিছু ভাল রান্না করলেই অবধারিতভাবেই যেন আমার বাসাতেও একটি কলিং বেলের শব্দ শোনা যাবেই!! আমি একা নিজের মতো থাকতে পছন্দ করি, কিন্তু এই সৌহার্দ্যকে যেন চাইলেই অবজ্ঞা করা যায় না!
আমাদের বাসার ঠিক পিছনেই Kurpark! প্রায় ৪৪ হেক্টর জমির ওপর খুব সুন্দর এই পার্ক। এই পার্কে যে শুধু গাছপালা রয়েছে তাই নয় কিন্তু! আরও অনেক কিছুই আছে; যেমনঃ Elisabethenbrunnen,  স্মৃতিস্তম্ভটি গ্রীক দেবী হিগিয়ার একটি গোলাকার মন্দির এবং মার্বেল ভাস্কর্যের আকারে সুরক্ষিত, যার ভাস্কর হান্স ড্যামমান ১৯১৮ সালে এটি নির্মাণ করেন; অথবা রাশিয়ান চ্যাপেল, টেনিস ক্লাব, গলফ ক্লাব, ছোটদের জন্য প্লে গ্রাউন্ড, রেস্তোরা আরও কত কিছু।
বাসা থেকে কিছুদূর হাঁটলেই বাড হোমবুর্গ ক্যাসেল। সত্যি বলতে কি ছোট  এই ক্যাসেটটির একভাবে প্রেমেই পড়ে গিয়েছি। কেন যেন একটা ভাল লাগা কাজ করে ক্যাসেল প্রাঙ্গনে ঘরে বেড়ালে। উপ থেকে একদিকে পাহাড় আর নিচে তাকালে সবুজ আর লেক, কেমন যেন শান্তি আর স্বপ্নীল সব কিছু। স্কলস হমবুর্গ  ১৬৭৯-৮৬ সালের মাঝামাঝি দ্বিতীয় ফেড্রিকের অধীনে নির্মিত হয়েছিল। এটি একটি মধ্যযুগীয় ক্যাসেল। প্রাসাদটি ১৮৬৬ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত হেস-হ্যামবুর্গের জমিদারদের আবাসস্থল এবং পরে জার্মান সম্রাটদের জনপ্রিয় গ্রীষ্মকালীন বাসভবনও ছিল। সাথেই বড় একটি পার্ক, সবুজে সবুজে ঘেরা পাহাড় কেটে বানানো, চড়াই-উৎরাই সবই যেন বহাল তবিয়তেই রয়েছে। সব কিছুতেই যত্নের ছাপ স্পষ্ট। খুব আফসোস হয় এগুলো দেখলে, মনে হয় কেন আমার দেশটাও এভাবে যত্নে সাজিয়ে ওঠানো যায় না!!!
শুধু একটি বিষয় নিয়েই চূড়ান্ত অশান্তি; পুত্রকে শাসন করা সম্ভব হচ্ছে না এখানে। একটু ধমন দেয়ার ভাব করলেই পুত্র আমার এমন বিকট চিৎকার দেয় যে মনে হতে থাকে আমি একজন পাষন্ড মা!! আমি নিতান্তিই শঙ্কার মাঝে আছি যে কোন দিন যেন প্রতিবেশিরা চড়াও হয়  অথবা পুলিশ আমাকে ধরে নিয়ে যায় শিশু নির্যাতনকারী সন্দেহে!! দেশে আশেপাশের বাসা থেকে, বাসে উঠলে, রাস্তাতে কত জায়গাতে বাবা-মায়েরা তাদের সন্তানদের 'শাসন' নামের বস্তুটি করতেই থাকে, এমন কি আমাদের ওপরেও তো কম-বেশি এই জিনিসের চর্চা নিতান্ত 'ভালো'র জন্যই হয়েছে। পুত্রের অসাধারণ দুষ্টমিতে সকলের সামনে কি পেছনে রাগে-ক্রোধে ফেটে গেলেও এখানে যেন শান্তি মতো ধমকও দিতে পারি না। 
দেশ থেকে অনেক দূরে এসে শুরু হয়েছে অামাদের তিনজনের অন্যরকম নতুন জীবন। অন্যরকম ভাষা, অন্যরকম প্রকৃতি ও পরিবেশ….. সব ছাপিয়ে আমাদের তিনজনের ভালবাসার বন্ধন,টুকরো কিছু সময়  সকলই যেন একভাবে প্রকৃতির অকৃত্রিমতাকে ছুঁয়ে যায়!!