মূত্রকথাঃ হুনা মামনু আততাবুল

ফারদিন ফেরদৌসফারদিন ফেরদৌস
Published : 10 May 2015, 06:25 PM
Updated : 10 May 2015, 06:25 PM

ভাষাতাত্ত্বিকদের মতে, ইসলামের আবির্ভাবের ঠিক আগের যুগে আরব উপদ্বীপে আরবি ভাষার (العربية) উৎপত্তি ঘটে। প্রাক-ইসলামী আরব কবিরা যে আরবি ভাষা ব্যবহার করতেন, তা ছিল অতি উৎকৃষ্ট মানের। তাঁদের লেখা কবিতা মূলত মুখে মুখেই প্রচারিত ও সংরক্ষিত হত। আরবি ভাষাতে সহজেই বিজ্ঞান ও শিল্পের প্রয়োজনে নতুন নতুন শব্দ ও পরিভাষা তৈরি করা যেত এবং আজও তা করা যায়। মধ্যযুগে আরবি গণিত, বিজ্ঞান ও দর্শনের প্রধান বাহক ভাষা ছিল। বিশ্বের বহু ভাষা আরবি থেকে শব্দ ধার করেছে। তবে ইদানিং ধার করা আরবি ভাষার একটি বিশেষ বাক্যাংশের সর্বোৎকৃষ্ট ও সর্বোত্তম ব্যবহার যে বাংলাভূমেই ঘটেছে; এ কথায় আপনারাও নিশ্চয় সহমত পোষণ করবেন।

নেফ্রনের বিভিন্ন অংশের সক্রিয়তার ফলে মানবদেহের পক্ষে ক্ষতিকারক অথবা অপ্রয়োজনীয় জৈব ও অজৈব পদার্থ দিয়ে তৈরী স্বল্প অম্লধর্মী ও সামান্য হলুদ বা বর্নহীন তরল তৈরী হয়ে গোবিনী দিয়ে গিয়ে সাময়িকভাবে মূত্রাশয়ে সঞ্চিত হয় এবং পরে মূত্রনালী দিয়ে দেহের বাইরে নির্গত হওয়া এক ধরণের পদার্থ মূত্রকে যথাস্থানে নির্গমন নির্দেশনার ক্ষেত্রে বাঙালি ধর্মীয় অনুভূতিকে জাগ্রত করবার কাজে আরবি ভাষার সাবলীল ও সুন্দর ব্যবহার নগরের দেয়ালে দেয়ালে শোভা পাচ্ছে। আর সেই শব্দবন্ধটি যে, 'হুনা মামনু আততাবুল' তা সকলেই জানেন।

পৃথিবীর ইতিহাসে মাতৃভাষার রাষ্ট্রীয় মর্যাদার দাবিতে বিক্ষোভ, তাঁর জের ধরে রক্তপাতের ঘটনা বিরল, তবে যেটুকু আছে তাও এই বাংলাদেশের প্রায় একার গর্ব। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর পূর্ব বাংলার প্রতিনিধি কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ফজলুর রহমান ঐতিহাসিক নির্বোধের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে প্রতিনিধি পরিষদে বাংলাকে মুসলমান করার জন্য আরবী হরফে বাংলা লেখার প্রস্তাব করলেন। কিন্তু তার এহেন অপদার্থ প্রস্তাব এ অঞ্চলের জনগন ঘৃনাভরে প্রত্যাখ্যান করেছিল। বাঙালি তাঁর স্বকীয়তার গুণেই চাপিয়ে দেয়া পরভাষা আরবিকে সেসময় বর্জন করে। পরবর্তীতে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে পাকিস্তানী জান্তাদের চাপিয়ে দেয়া আরবি প্রভাবিত উর্দু ভাষাকে পায়ে ঠেলতে গিয়ে প্রাণ দেন রফিক, সালাম, জব্বার ও শফিউরসহ আরও অনেকে। আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারির পর থেকে প্রাণের দামে পাওয়া সেই প্রিয় মায়ের ভাষা বাংলা মর্যাদা্র আসনে অভিষিক্ত হয়। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসটিও হয় আমাদের ।

কিন্তু সেই আমরা এতোদিনে এতোটা কট্টর মুসলমান হয়ে উঠেছি যে, বহু ঘাত প্রতিঘাতে সোনা হয়ে উঠা আমার প্রিয় বাংলা ভাষাটির মর্ম না বুঝবার ভান করতে শিখে গেছি। নগরে যত্রতত্র মূত্রপাত ঠেকাতে বাংলা নয়, ব্যবহার করা হচ্ছে আরবি! ভাবখানা এমন যে, আমাদের পর্যাপ্ত পাবলিক টয়লেট নির্মাণের কোনো দরকার নাই। আরবিতেই মূত্র নিয়ন্ত্রণ তপঃ!

বাংলা লেখাকে আমলে না নিলেও ৯০ শতাংশের বেশি মুসলিম জনসংখ্যা অধ্যুষিত বাংলাদেশের মানুষ আরবি লেখাকে নিশ্চয়ই আমলে নেবে। এ ধরনের চিন্তা ভাবনাকে সামনে রেখে নগরের বিভিন্ন দেওয়ালে বাংলার স্থলে আরবিতে যেখানে সেখানে প্রস্রাব করার নিষেধাজ্ঞা জারি করা হচ্ছে।

ধর্মমন্ত্রী অধ্যক্ষ মতিউর রহমান এ বিষয়ে একটি ভিডিও বার্তায় বলেছেন, 'এটা যদি কনটিনিউ করা হয়, তাহলে এটা প্রকৃতপক্ষেই একশ পারসেন্ট সাকসেসফুল হবে ইনশাআল্লাহ।' এটাকে একটি ইউনিক কনসেপ্ট বলেই উল্লেখ করা হচ্ছে।
সোজা কথা হলো, বাংলা ভাষাকে তুমি দাম দিলে কী না দিলে তাতে কারও কিছুই আসবে যাবে না। আরবিকে তোমার সম্মান করতেই হবে, তা যদি মূত্রপাতের বা শৌচাগারের আরবিও হয়। নেট, ভিডিও বার্তা, পত্রপত্রিকা বা টেলিভিশন সংবাদ থেকে আমরা যখন ঢাকঢোল পেটানো সংবাদটি জেনেই গেলাম যে, 'হুনা মামনু আততাবুল' হলো মূত্রপাতের আরবি, তাকে কেন ভক্তি শ্রদ্ধা করতে যাবে মানুষ। এর দুইটি মানে হতে পারে, প্রথমতঃ মূত্র বা মূত্রপাত অমূল্য সম্মানীয় বিষয় অথবা বাঙালি ধর্ম মন্ত্রণালয়ের চেয়েও অতি মূর্খ্য। মাননীয় আদালতে কর্তৃক সর্বস্তরে বাংলা চালুর নির্দেশনার বিষয়টি এখানে প্রযোজ্য নয় আমরা ধরেই নিলাম। কারণ যত্রতত্র মূত্রপাতের মতো সিলি বিষয়ে আদালতের নাক গলানোটা হয়ত সমীচিন হয় না। আমরা বাংলা ভাষার ওপর হিন্দী ভাষার আগ্রাসন বন্ধে গলা ফাটাই, কিন্তু ধর্মের জুজুকে প্রাধান্য দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের ভাষাটিকে সুস্বাগত জানাই। কারণ আমরা মানুষ নই, মুসলমান। সেকুলার বা লোকায়িত ধ্যানবাদীদের হাতেই পার্থিব মানবতাবাদের তবে পরিসমাপ্তি শুরু। এখন ঐশ্বরিক ভাষায় পারলৌকিক বন্দনার দিন। হুনা মামনু দিয়ে শুরু। একদিন হয়ত দীর্ঘশ্বাসে আরবিতেই বলব, তাকরীরাই এলাখিয়র মানে 'আমার সব শেষ'।


ধর্মপ্রেমের আবরণে মূত্র নির্গমন নিয়ন্ত্রণের মাজেজাটা আসলে কী? যুগে যুগে ধর্মাচারীরা মূত্রের মর্যাদা দেন বটে! জাত পাত বা শ্রেণি বৈষম্য বিরোধী বাউলদের Mysticism বা মরমিবাদ মতে, সরাবন তহুরারূপে 'পঞ্চরস' পান না করলে প্রকৃত সাধক হওয়া যায়না। পঞ্চরসের উপকরন হচ্ছে – মল, মূত্র, ঋতুরক্ত, রতিজনিত স্ত্রী-পুরুষের ক্ষরিত রস ও বীর্য। এহেন সাধন মূত্রের মর্যাদায় আরবির মোড়ক দিয়ে তাকে মহিমান্বিত করতে আমাদের ধর্ম মন্ত্রণালয় প্রাণিত হয়ে থাকতেও পারে।

ভারতের পঞ্চম প্রধানমন্ত্রী মোরারজি দেশাই রোগ 'প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে' দীর্ঘদিন ধরে 'ইউরিন থেরাপি' নিতেন। সহজ কথায় বলা যায়, আক্ষরিক অর্থেই তিনি নিয়মিত নিজের প্রস্রাব খেতেন। ১৯৭৮ সালে মার্কিন টেলিভিশন সিবিএস নিউজের সাক্ষাৎকারভিত্তিক অনুষ্ঠান 'সিক্সটি মিনিটস'-য়ে মোরারজি এই কথা শুধু স্বীকারই করেননি, ইউরিন থেরাপির নানা 'উপকারী' দিকও তিনি তুলে ধরেছিলেন। সবাইকে এই 'মূত্র থেরাপি' নিতেও বলেছিলেন তিনি। মোরারজির পর এবার ভারতের কেন্দ্রীয় সড়ক পরিবহন মন্ত্রী নিতীন গড়কড়ির মুখেও শোনা গেছে 'মূত্র-বন্দনা'। তবে নিজে মূত্রসুধা পান না করে বাগানের গাছগাছালিতে পানি দেওয়ার পরিবর্তে মানুষের প্রস্রাব ব্যবহারের কথা বলেছেন তিনি। নিতীন গড়কড়ি বলেন,' প্রস্রাবে ইউরিয়া ও নাইট্রোজেনের উপস্থিতি আছে, যা উদ্ভিজ্যের জন্য পরম উপকারী। অবশ্য গড়কড়ির এই 'মূত্র তত্ত্ব' নিয়ে হাস্যরসের সৃষ্টি হয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। টুইটারে 'গড়কড়িলিকস' নামে একটি হ্যাশট্যাগও তৈরি হয়েছে এর মধ্যে। এতে একজন লিখেছেন, 'প্রধানমন্ত্রী আমাদের টয়লেটে প্রস্রাব করতে বলেন, গড়কড়ি বলেন বাগানে প্রস্রাব করতে। জাতি জানতে চায়, তাঁরা আসলে কোথায় প্রস্রাব করবে?

অন্যদিকে ফিনাইলের বদলে গরুর মূত্র দিয়ে পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখার পরামর্শ দিয়েছেন ভারতের এক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী। আর এক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী অ্যালোপাথিক ওষুধ ছেড়ে গোমূত্র ও গোবরের সমন্বয়ে তৈরি আয়ুর্বেদিক ওষুধকে সব রোগের প্রতিরোধক বলে দাবি করেছেন।

মানবমূত্র বা গোমূত্রের এহেন হিতকারী অনুষঙ্গ থাকার পরও কোথাও কেউ আছেন যে, মূত্রের অসম্মান করেন? প্রয়োজনে কেবল ধর্ম ভাষা আরবি নয়, পৃথিবীর তাবৎ ভাষা দিয়ে মূত্র বন্দনার গীত গাইতে থাকব।

আরবিতেই যদি বাঙালির এতো ভক্তি, তবে আমাদের সংবিধান থেকে বাংলা ভাষা সমূলে তুলে দিয়ে আরবিকরণ করা হোক। বাংলা ভাষায় লেখা বলে সংবিধানের কোনো কিছুর ধার আমরা ধারছি না। মানবাধিকার, গণতন্ত্র চর্চা বা আমাদের জন্য সাংবিধানিক সকল হিতোপদেশ লিডার শ্রেণির দ্বারা উপেক্ষিত হয়েই চলেছে। আরবিকরণের মাধ্যমে যদি ধর্মবোধের অনুভূতিটা সরকার বা বিরোধীপক্ষে সুড়সুড়ি দিয়ে উঠে তবে আমাদের মঙ্গল হলেও হতে পারে!
তবে আমার মায়ের ভাষার এমন অসম্মান বা দেয়াললিখনের নামে আরবিকরণের এমন ভূতুরে চেষ্টাকে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'অন্তর্যামী' কবিতার ভাষায় নিন্দা না জানিয়ে বায়ান্নের একুশে ফেব্রুয়ারিকেই লজ্জায় ফেলব এমন দুঃসাহস যেন কুলাঙ্গারেরও না হয়!

এ কী কৌতুক নিত্যনূতন
ওগো কৌতুকময়ী,
আমি যাহা কিছু চাহি বলিবারে
বলিতে দিতেছ কই।
অন্তরমাঝে বসি অহরহ
মুখ হতে তুমি ভাষা কেড়ে লহ,
মোর কথা লয়ে তুমি কথা কহ
মিশায়ে আপন সুরে।
কী বলিতে চাই সব ভুলে যাই,
তুমি যা বলাও আমি বলি তাই,
সংগীতস্রোতে কূল নাহি পাই,
কোথা ভেসে যাই দূরে।…

ফারদিন ফেরদৌসঃ লেখক ও সাংবাদিক
১১ মে ২০১৫
Facebook/fardeen.ferdous
Twitter/fardeenferdous