নারী বলে গর্ব! আর হবে না খর্ব!!

ফারদিন ফেরদৌসফারদিন ফেরদৌস
Published : 11 May 2015, 04:08 PM
Updated : 11 May 2015, 04:08 PM

পহেলা বৈশাখের নারী লাঞ্ছনাকারীদের গ্রেপ্তারের দাবিতে ছাত্র ইউনিয়নের প্রতিবাদ দমনে পুলিশি ভূমিকার সাফাই গাইতে গিয়ে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের ফেসবুক পেজে (মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ Detective Branch, DMP) ব্লেম গেমকে ঘৃণা করতে বলা হয়েছে। সেখানে পিতার বয়সী পুলিশ কর্তৃক নিপীড়িত নারায়নগঞ্জ ছাত্র ইউনিয়ন সদস্য ইসমত জাহানের দুইটি ছবি পোস্ট করে একটি স্ট্যাটাস দেয়া হয়েছে। প্রথম ছবিতে পুলিশের সাঁজোয়া যানে ইট পাটকেল ছুড়ছেন ইসমত আর দ্বিতীয় ছবিতে তাঁকে চুলের মুঠি ধরে শ্বাপদ-শকুন বা হায়েনার মতো তাড়া করছে পুলিশ। এর অর্থ হলো, টিট ফর ট্যাট বা ইটটি মারলে পাটকেলটি খেতে হবে। তবে পাটকেলটি যদি পুলিশের পক্ষ থেকে আসে তা আসবে বহুগুণে বাড় বাড়ন্ত হয়ে। পুলিশে ছুলে আঠার ঘায়ের কথা কে না জানে? প্রতিবাদকারীর ঐ ইটের বিপরীতে কয়েকজন পুলিশ তাকে সারমেয়রূপে বেশ কিছু সময় তাড়া করে চুলের মুঠি ধরে গাছের আড়াল থেকে টেনে হিচড়ে বের করে নিয়ে আসেন। সঙ্গে সঙ্গে আরও কয়েকজন ছুটে যান তাঁকে মারতে। একজন লাথি মারেন, একজন গলাধাক্কা দেন। অপরজন ওড়না ধরে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। এসময় ইসমত পড়ে গেলেও পুলিশের ক্রমাগত টানা হেঁচড়া চলতেই থাকে। এ এক আশ্চর্য গোলকধাঁধা, একজন নিরীহ নারীকে শায়েস্তা করতে হাফ ডজন সশস্ত্র পুলিশ লাগে! সকল নারী, কন্যা, বোন বা মাতা তোমাদের মরণ হয়না কেন, যাতে পুরুষেরা ইবলিশি প্রক্রিয়ায় স্বসঙ্গমে কেবলি পুং রাজত্ব কায়েম করতে পারে!

তো এ বিষয়টিতেই উল্লেখিত ফেসবুক পেজের এডমিন তরুণ পুলিশ অফিসারকে বললাম, মানবিকতার কোন কোডে নারীর ওপর মর্ষকামী পুরুষের হাত বা পা তোলার অধিকার স্বীকৃত। তিনি জানালেন, পুলিশ আমাদের ভাই এবং তাঁরা আমাদের পরিবার থেকেই গিয়েছে। পহেলা বৈশাখে টিএসসির নিপীড়করাও আমাদের ভাই। তার মানে তিনি বলতে চান, দোষটা আমাদের পরিবারের। ব্লেম গেমকে ঘৃণা করতে বলেছিলেন তরুণ পুলিশ অফিসারটি, এতে তাঁর ওপর আমার ঘৃণা জন্মেছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ঘৃণা আসলে আমাকেই কূড়ে খাচ্ছে। সত্যিইতো ঐ টিএসসিতে পুলিশের চোখে ধুলো দেয়া পলাতক নারী নিপীড়ক কিংবা রোববারের রাষ্ট্রীয় উর্দি পরা বুক ফুলানো পুলিশ নিপীড়ক সকলেই আমাদের ভাই। ওরা আমাদের পরিবারেরই মানুষ। আমরাই ওদের নিপীড়ক বানিয়েছি। নিপীড়ক নিপীড়ক ভাই। অথবা বলতে পারি আমরা সবাই নিপীড়ক আমাদের এই নিপীড়নের রাম রাজত্বে।

নারী লাঞ্ছনাকারীদের গ্রেপ্তারের দাবিতে যাঁরা আন্দোলন করছেন, তাঁদের দমনে পুলিশ এমন মারমুখী কেন হলো- এর জবাবে পুলিশের রমনা বিভাগের উপকমিশনার আব্দুল বাতেন গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ দিয়েছেন, 'দাবি পেশ করার জন্য লাখ লাখ মানুষের দুর্ভোগ সৃষ্টি করে রাস্তা বন্ধ করে রেখেছিলেন তাঁরা। ওনাদের রিকোয়েস্ট করেছি। তখনতো রাস্তা পরিষ্কার করা আমাদের দায়িত্ব।' সেজন্য নারীর চুলের মুঠি ধরে টানা হেঁচড়া করে পুলিশের ধর্ষকামী অসুন্দর মুখোশটার স্বরূপ উন্মোচন করতে হবে?
কিন্তু পহেলা বৈশাখে ঢাবির টিএসসি এলাকায় প্রচন্ড ভিড়ের মধ্যে একদল যুবক দীর্ঘ সময় ধরে নারীদের লাঞ্চনা করেও নির্বিঘ্নে দিন গুজরান করছে, তাদের ধরা পুলিশের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না। এর একটাই কারণ কাকে যেমন কাকের মাংস খায় না, তেমনি পুলিশ নিজেই যখন নারী নিপীড়নের দন্ড সদা জাগ্রত রাখেন সেখানে তাঁরা নিপীড়ক ধরবে এ আশা বাতুলতা মাত্র।

বিশ্ববিদ্যালয়ে বরাবর দেখেছি ছাত্র ইউনিয়ন, প্রগতিশীল ছাত্রজোট বা সাম্রাজ্যবিরোধী ছাত্র ঐক্য জাতীয় ছাত্র সংগঠনগুলো রাষ্ট্র, সমাজ বা প্রতিষ্ঠানের যেকোনো সংকটে নিরীহ ধরণের প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করতে। ঐ আন্দোলনে জড়িতদের নিপাট প্রগতিশীল, মানবতাবাদী বা বিজ্ঞানমনষ্কই জেনে এসেছি। কখনো তাঁরা ক্ষমতার কাছে থাকা ছাত্রলীগ, ছাত্রদল বা শিবিরের মতো খুনোখুনি পাওয়ার পলিটিক্সের চর্চা করেন না। সেই তাঁদেরকেই যখন নিয়মতান্ত্রিক প্রতিবাদ আন্দোলনে গিয়ে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর হাতে নিপীড়নের স্বীকার হতে হয় তখন বলতে বাঁধা নেই নিয়ন্ত্রণ প্রকোষ্ঠের কোথাও এক ধরণের পচন ধরেছে। ক্যান্সারে রূপ পরিগ্রহ করার আগেই তা সমূলে বিনাশ করার সময়ও সমাগত। কিন্তু দায়িত্বটা কে নেবেন? এহেন নারী নিপীড়নেও যখন নারী দেশনায়ক বদন প্রশান্ত রাখেন, শান্তির দূতদের মুখে কথা ফুটে না বা সুশীলদের চামড়া গন্ডারকেও হার মানাতে থাকে তখন আমাদের পরিবার থেকে যাওয়া সেসব পুলিশ বা অদৃশ্য দলদাস ভাই বেরাদরদের বদমাশির প্রতিকার জানাব কার কাছে?
প্রশ্ন জাগে কার আশকারায় বা কী এমন বিবমিষায় পুরুষ এমন নিপীড়ক হয়ে উঠল? নারীবাদী ভার্জিনিয়া উলফের মতে, নারী সম্ভবত মহাজগতের সবচেয়ে আলোচিত প্রাণি। আর সেই প্রাণিকে পুরুষ নিপীড়করা ছুয়ে দেখবে না, তা না ভাবাটা ভুল বটে। নারীর কোনো স্বাধীনতা স্বীকার করেনি পুরুষ। পুরুষ এমন এক সভ্যতা গড়ে তুলেছে, যা নারীকে সম্পূর্ণ বন্দী না করতে পারলে ধ্বংস হয়ে যাবে বলে পুরুষের ভয় রয়েছে। এর নাম পিতৃতান্ত্রিক বা পুরুষতান্ত্রিক সভ্যতা। আর এই সভ্যতা পুরুষের জয়গানে ও নারীর নিন্দায় মুখরিত। আধুনিক বিংশ শতাব্দীতেও আমাদের পুরুষেরা প্রতিক্রিয়াশীল ফ্রয়েডের মনোবিজ্ঞান তত্ত্ব থেকে বের হতে পারেননি। ফ্রয়েড বলতেন, মানুষ বিশেষত পুরুষ জৈবিকভাবে নিয়ন্ত্রিত, যার মুক্তি নেই প্রবৃত্তির কারাগার থেকে।

ওপরে উল্লেখিত তরুণ পুলিশ অফিসার, তাঁর পুরুষ বস কিংবা অধঃস্তন পুরুষ সদস্যরা যে পুরুষতন্ত্রের গহ্বরেই নিপতিত হয়ে আছে তা বুঝি উল্লেখ না করলেও চলে। পুলিশকে বা নিপীড়ককে কেন মানুষ করা গেল না, তার উত্তর খুঁজতে হলে আমাদের সাংবিধানিক অধিকারের কথাটি মনে করতে পারি। আমাদের সংবিধানের ৩১(১) মোতাবেক প্রতিটি মনুষ্য প্রাণির 'চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে।'- তবে আমাদের পুরুষ পুলিশরা এই স্বাধীনতাটি হয়ত মহানিয়ন্ত্রকদের সমর্থন নিয়ে বেশিই উপভোগ করছেন।
আর তাই আমাদের নারীদের জন্য এক অন্ধকার সময় এসেছে এখন। নারীদের আবার জোর করে হেঁশেলে রান্নাবান্না বা কেবলমাত্র বাচ্চা লালন পালন কাজে ধাক্কিয়ে ঢুকানো হবে ঘর সংসারে। তাঁরা কেন রাস্তা ঘাটে নিপীড়কের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করবে? পুরুষ বা পুলিশের এই পিতৃতান্ত্রিক অমানবীয় বোধে টনিক হিসেবে কাজ করবে আমাদের দেশ নায়কের ছেড়ে দেয়া অধিকার চেতনা।
আপনাদেরতো কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের হৈমন্তী গল্পের নায়ক অপুর শ্বশুর বা হৈমন্তীর বাবা গৌরিশঙ্করের বিখ্যাত সংলাপ জানা থাকবারই কথা, যাহা দিলাম তাহা উজার করিয়াই দিলাম। অধিকার ছাড়িয়া দিয়া অধিকার রাখিতে যাইবার মত এমন বিড়ম্বনা আর নাই।

ছেড়ে দেয়া সেই বাঁধনহারা অধিকার বোধ থেকেই আমাদের নিপীড়ক পুলিশ নারীর গায়ে রোমশ হিংস্র পা তুলেই যাবেন। গলাধাক্কা দিয়ে ঘর সংসারেই ঢুকাতে থাকবেন। আর আমাদের দেশমাতার মূক, বধির ও নির্বিকার বিবেকখানা ফ্যাল ফ্যাল করে কেবলই আকাশপানে তাঁকিয়ে থাকবে।

ফারদিন ফেরদৌসঃ লেখক ও সাংবাদিক
১২ মে ২০১৫
Facebook/fardeen.ferdous
Twitter/fardeenferdous