রাজনীতির নিরুদ্দেশ যাত্রা

ফারদিন ফেরদৌসফারদিন ফেরদৌস
Published : 10 July 2015, 06:13 PM
Updated : 10 July 2015, 06:13 PM

আমাদের প্রিয় কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর…
তাঁর সোনার তরী কাব্যের 'নিরুদ্দেশ যাত্রা' কবিতায় যথার্থ বলেছেন,

বেলা বহে যায়, পালে লাগে বায়–
সোনার তরণী কোথা চলে যায়,
পশ্চিমে হেরি নামিছে তপন
অস্তাচলে।
এখন বারেক শুধাই তোমায়,
স্নিগ্ধ মরণ আছে কি হোথায়,
আছে কি শান্তি, আছে কি সুপ্তি
তিমির-তলে?

এই ঘনঘোর বর্ষায় মেঘের আড়ালে সারাবেলাই সূর্যাস্তকালে কবিতাটি মনে পড়বার কারণ আমাদের এখনকার স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় থেকে অব্যাহতিপ্রাপ্ত দপ্তরবিহীন মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। দেশের প্রধানমন্ত্রীর এক নোটিশে তিনি এখন ক্ষমতাহীন। তাঁর পায়ের তলার রাজনীতি মাটির এমন ভরাডুবি আগে আর এমনকরে এসেছে কবে?

এ ঘটনাটি এমন সময়ে ঘটল, যখন চট্টগ্রামের সাতকানিয়া উপজেলার মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার মোহাম্মদ আইয়ুব খান ক্ষমতাবান হান্নান সচিবের গলা ধাক্কার অপমানে আত্মাহূতি দিয়েছেন। চেতনাধারীরা তাঁকে ছেড়ে গেলেও তাঁর কবর ছেড়ে যেতে পারেন না তাঁরই বৃদ্ধা মা। কিন্তু বহু ত্যাগে যে দেশটি তিনি এনে দিয়েছিলেন, সে দেশ তাঁকে গলা ধাক্কায় আত্মারাম খাচা ছাড়া করে দিয়ে নির্দয় পর করে দিয়েছে।
মুক্তিযোদ্ধার কাছ থেকে শুঁটকি বা টাকা খেয়ে পেট না ভরায় সাবেক রাজাকার মন্ত্রীর পিএস একালের মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ের সচিব গলাধাক্কায় সেই মুক্তিযোদ্ধাকে পৃথিবীছাড়া করতেই পারেন। তাতে যেমন সচিবের কিছু আসে যায় না। তেমনি কলমের এক খোচায় কঠিন মুক্তিযোদ্ধা দেশের প্রথম অস্থায় রাষ্ট্রপতির ছেলেরও পদবিলোপ ঘটতে পারে, সেই জায়গায় রাজাকারের গুণধর পুত্র আয়েশ করে বসতে পারেন তাতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবাজ রাজনীতিরও হয়ত কিছুই আসবে যাবে না।

মুক্তিযোদ্ধা আইয়ুব খান কিংবা সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের একই সময়ে প্রায় একই দশা কাকতালীয় হতে পারে। তবে একই ধরণের দুটি ঘটনার প্রতীকি ব্যঞ্জনা তাৎপর্যপূর্ণ বটে।

এক সময় সপরিবারে লন্ডনে বসবাসকারী সৈয়দ আশরাফ বঙ্গবন্ধু পরিবারের অনুরোধে ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশে এসে নির্বাচন করেন। এরপর থেকে তিনি বাংলাদেশের রাজনীতিতে সক্রিয় হন। ২০০২ সালে আওয়ামীলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও ২০০৯ সালে সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পান। এর আগে ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে তাকে দেওয়া হয় 'রাজনৈতিক মন্ত্রণালয়' হিসেবে পরিচিত স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব। তিনিই একমাত্র ব্যক্তি যিনি দুই টার্মের বেশি সময় সাধারণ সম্পাদকের পদ আকড়ে থাকতে চান না বলে হাই কমান্ডকে জানিয়ে রেখেছিলেন; যেখানে বছরের পর বছর পদ আকড়ে ধরে থাকাই আমাদের আসমুদ্র ভালোবাসা!

সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম বাঙালি জাতির বিশ্বস্ত সূর্যসন্তান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ সহচর মহান মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনাকারী জাতীয় চার নেতার একজন সেসময়ের বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের বংশধর। যিনি ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর দিনের সূচনালগ্নে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে বন্দি অবস্থায় মুক্তিযুদ্ধকালের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, মন্ত্রিসভার সদস্য ক্যাপ্টেন এম. মনসুর আলী এবং এএইচএম কামরুজ্জামানের সাথে বিপথগামী সেনাবাহিনীর হাতে নির্মম হত্যাকান্ডের শিকার হন।
কিশোরগঞ্জ তথা দেশের আওয়ামী রাজনীতিতে একটি ত্যাগী পরিবারের মানুষ হিসেবে আশরাফের বিরুদ্ধে এমন কোনো অভিযোগ কেউ দাড় করাতে পারেন নি, যাতে কলমের এক খোচায় যখন তখন তাঁকে অব্যাহতি দেয়া যায় বা ডিসমিস করা যায়। যেখানে এডভোকেট কামরুল ইসলাম বা মোফাজ্জল চৌধুরী মায়া মন্ত্রীর বিরুদ্ধে এন্তার অভিযোগ সত্ত্বেও তারা বহাল তবিয়তে থেকে মালপানির ধান্ধায় নিজেদের ব্যাপৃত রেখেও নেত্রীর সুনজরে আছেন। সেখানে নির্লোভ, সজ্জন বা সদালাপী তকমা পাওয়া আশরাফুল ইসলাম কিনা দপ্তরবিহীন হয়ে পড়েন।

তাজউদ্দীন আহমদ ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মিত্রতা এবং শেষে কারো কান পড়ায় দুইজনার বিচ্ছেদের ঘটনা দেশের রাজনীতি সচেতন মানুষ কে না জানেন? বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনাকারী যেই তাজউদ্দীন জীবনে বঙ্গবন্ধুর এতোটুকু বিরোধিতার কথা কল্পনাও করেননি, সেই বঙ্গতাজ হয়ে পড়েছিলেন বঙ্গবন্ধুর চোখেরবালি। খন্দকার মোশতাকের মতো মীরজাফররা যেখানে রাজত্ব করবার চান্স পান সেখানে এমন ঘটনা ঘটে বটে। সেই খন্দকার মোশতাকের প্রেতাত্মারা হাইব্রিড রূপে বর্তমান আওয়ামীলীগের সারথী হয়েছেন হয়ত, যাদের কথায় আস্থা না রেখে পারছেন না হাই কমান্ড। যাদের পরশপাথরে বদলে গিয়ে নিরেট খাঁটি মুক্তিযোদ্ধার ছেলের মন্ত্রিত্ব কেড়ে নিয়ে সেখানে বসিয়ে দেয়া যায় স্বীকৃত রাজাকারের চোখ পিটপিটে পোলাকে। ডাবল দায়িত্ব পেয়ে তারা আবার যারপরনাই আহ্লাদিতও হতে পারেন, 'আরও বেশি জনসেবা করবার সুযোগ' পেলেন বলে!

বড়ই বিচিত্র এই দেশের রাজধর্ম। আরও বিচিত্র নেতা তোয়াজ রীতি।
দলের সতীর্থ যারা এতোদিন দিনরাত সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের সমালোচনায় মুখর থাকতেন, তিনি আলসে, কাজের প্রতি অমনোযোগী, দলে নিষ্ক্রিয়; সেই সমালোচকদের অনেকেই তাকে এখন বলছেন, তিনি বিতর্কিত না, বরং তিনি একজন নির্লোভ মানুষ। আওয়ামীলীগের জন্য বা দেশের কল্যাণকর রাজনীতির জন্য এমন স্বীকৃতিওয়ালা একজন রাজনীতিকের দরকার নাকি বিবিধ কেলেঙ্কারীর দাস কামরুল মায়াদের দরকার? অথবা পদায়নে যোগ্যতার মাপকাঠি কি নির্ধারণ হবে আত্মীয়তা দিয়ে? ভবিষ্যতে কোনোদিন মুক্তিযুদ্ধের ডাক আসলে কেউ রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধা না হয়ে পাকাপোক্ত বেয়াই হয়ত হতে চাইবেন! এতদবিষয়ে কার ভাবনা কে ভাববে?

তাজউদ্দীন বঙ্গবন্ধু বিচ্ছেদের ট্রাজিক অধ্যায় নিয়ে বাংলাদেশের ইতিহাসের বহু বাঁকবদল হয়েছে। এমনকি সেই রেশে ক্ষমতাসীনদের উদাসীনতা বা অবমূল্যায়নে তাজউদ্দীন পুত্র অতি সজ্জন সোহেল তাজ পর্যন্ত রাজনীতির প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে আমেরিকায় নীরব জীবনযাপন করছেন। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, সোহেল তাজের মতো আশরাফও যদি রাজনীতি বিমুখ হয়ে যান; তাতে আসলে কার লাভ? শীতের পরিযায়ী পাখির মতো দুধের মাছিরা যে হাইব্রিড হয়ে আওয়ামীলীগে ঢুকছে, তার পরিণাম কি হবে? শুভ! নাকি ভয়াবহ।

সৈয়দ নজরুল ইসলামের ছেলে আশরাফের ব্যক্তিত্ব যে, সোহেল তাজের চেয়ে নিম্নতর হবে না, এ ধারণা করেই দপ্তরবিহীন এই মন্ত্রীর রাজনৈতিক গন্তব্য অনুমান করা যায়। আগামী ১৫ জুলাই সৈয়দ আশরাফের স্ত্রী ও সন্তানের সঙ্গে ঈদ কাটাতে লন্ডন যাওয়ার কথা রয়েছে। তার এবারের লন্ডনযাত্রা অন্য ১০টি যাত্রার পরিবর্তে যদি রাজনৈতিক নিরুদ্দেশ যাত্রা হয়, তবে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে কি?

এই মধ্য বর্ষায় এতোটা অন্তর্গত শক্তিমান কে তিনি বা কি বিষয় যে, আওয়ামী রাজনীতির আকাশে কাল বোশেখীকে আহবান ক'রে আশরাফ-হাসিনা যুগলবন্দির অবসান ঘটায়? ভালো মানুষের রাজনীতির বাড়া ভাতে ছাই তুলে দেয়!

তবে নেতার জন্য জীবন দানের অভিপ্রায়ী সৈয়দ আশরাফীয় অনুভূতির এখন কী হবে?

আশরাফুল নামটির মধ্যেই রয়েছে 'ফুল' বলে দ্বান্দ্বিক একখানা দ্বিচারী অর্থবোধক শব্দ। এখন দেখার পালা সেই 'ফুল' দেশের রাজনীতির অচলায়তনে পুষ্প হয়ে ঝরে নাকি বোকামীর দণ্ডে বড় কাফফারা দেয়!

ফারদিন ফেরদৌসঃ লেখক ও সাংবাদিক
১০ জুলাই ২০১৫
https://www.facebook.com/fardeen.ferdous
https://twitter.com/fardeenferdous